বিষয়বস্তুতে চলুন

অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: পনের

উইকিসংকলন থেকে


অধ্যায়: পনের

কিছু ভারতীয় আধ্যাত্মবাদীদের অলৌকিক ক্ষমতা

যোগ-সমাধিতে নাড়ি বন্ধ

আমরা শৈশব থেকেই শুনে আসছি, আমাদের দেশের মুনি-ঋষিরা যোগ সাধনার দ্বারা সমাধিতে যেতেন। নির্বিকল্প সমাধি তাঁদের অধিগত ছিল। নির্বিকল্প সমাধিতে নাড়ির গতি স্তব্ধ হয়ে যেত। অর্থাৎ, দেহ থাকতো, কিন্তু দেহে প্রাণ থাকতো না। এই অবস্থায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে বলে হিন্দু উপাসনা ধর্মগ্রন্থে বলা আছে। দেহের বাইরে বেরিয়ে আত্মা যে শুধু পরমাত্মাতেই মিলিত হতো, তেমনটি নয়। নিজের দেহের ভিতরে প্রবেশ করে দেখেছেন, ‘ষঠচক্র’ বা ছটি চক্রকে। এই ছটি চক্র রয়েছে গুহ্যে, লিঙ্গমূলে, নাভিতে, হৃদয়ে, কণ্ঠে ও দুই ভ্রূর মাঝখানে। মস্তিষ্কে আছে সহস্র পাপড়ির পদ্ম-কুঁড়ি। কুঁড়ির ওপর ফণা মেলে রয়েছে একটি সাপ; যার লেজ গেছে গুহ্য পর্যন্ত। এই পদ্মের বীজে আছেন ব্রহ্মস্বরূপ শিব। এ’সব-ই আমরা জেনেছি সেইসব মহান যোগীদের কাছ থেকে, যাঁরা যোগ বলে নিজেদের নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করতে পারতেন। তারপর মুক্ত আত্মা যেখানে খুশি যেতে পারতেন। ব্রহ্মলোক থেকে গ্রহ-নক্ষত্র সর্বত্র বিচরণ করতেন।

 আজকাল দু-পাতা বিজ্ঞান পড়ে কেউ কেউ মুনি-ঋষি-যোগীদের যোগ ক্ষমতাকেও অস্বীকার করতে চান।

 গত শতকের সাতের দশকে মহর্ষি মহেশ যোগী ভারতীয় যোগকে আবার বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করেন। পাশ্চাত্যের শিক্ষিত হাজার হাজার মানুষ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যোগ বলে নিজের নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মুনি-ঋষিদের যোগশক্তি আদে গল্প-কথা ছিল না।

 ওপরের এই কথাগুলো আমরা বলি ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ অনুষ্ঠানে। তারপর বলি:—

 “আপনাদের সামনে এবার হাজির করছি মহর্ষি মহেশ যোগীর শিষ্য যোগীরাজ...কে। তিনি আপনাদের সামনে একইভাবে নাড়ি বন্ধ করে দেখাবেন। আপনাদের কাছে অনুরোধ, একদম চুপ করে থাকুন, যাতে উনি মনঃসংযোগ করে যোগ সমাধিতে যেতে পারেন।

 “একটিও কথা নয়। আপনারা নিজের চোখে দেখুন এই মহান ঘটনা। আপনাদেরও শেখাবো, কী করে নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করবেন।

 “আপনাদের মধ্যে কোনও ডাক্তার থাকলে উঠে আসুন মঞ্চে। অথবা এমন কেউ উঠে আসুন, যিনি নাড়ি দেখতে পারেন। নাড়ি দেখা খুব সোজা। বুড়ো আঙুলের তলায় কব্জির উপর তর্জনি আর মধ্যমা আঙুল দুটি হালকা করে চেপে ধরুন। আঙুল দুটিতে নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে পারবেন। মিনিটে যতবার হার্ট ধক্‌-ধক্ করবে, ততবারই নাড়িও একই ছন্দে ধক্-ধক্ করবে। আগেকার দিনের ডাক্তার বা কবিরাজরা আগেই রোগীর নাড়ি টিপতেন। নাড়ির গতি মিনিটে তিরিশ বা তার নীচে হলে বলতেন—আমার আর কিছু করার নেই। ভগবানকে ডাকুন।

 “হ্যাঁ দেখুন। নাড়ি চলছে তো? মিনিটে ষাটের বেশি গতিতে চলছে তো? বাঃ, বহুত খুব। এবার নাড়ি থেকে আঙুল সরান। হ্যাঁ ঠিক আছে। পাশে-ই দাঁড়ান।

 “এ’বার আপনার সব্বাই যোগীরাজের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। একদম চুপ।

 “দেখুন আস্তে আস্তে যোগীরাজ চেয়ারে বসেই যোগ-সমাধিতে চলে যাচ্ছেন। যোগীরাজ চোখ বুজে, গভীর সমাধিতে চলে যাচ্ছেন।

 “চার মিনিট হয়ে গেছে। দেখি, এখন নাড়ির গতি কেমন? বন্ধ হয়ে গেছে। নাড়ির স্পন্দন পাচ্ছি না। আপনি এগিয়ে আসুন তো। আগে তো দেখেছিলেন পালস্ বিট্ নরমাল। এ’বার দেখুন তো?

 “কী বলছেন? নেই? কর্ডলেসটা আপনার কাছে ধরছি। পাবলিককে বলুন যা দেখলেন।

 “বাঃ সুন্দর। আবার আপনাকে একটু কষ্ট দেবো। আবার একটু সরে আসুন। যোগীরাজের পাশে চুপটি করে দাঁড়ান। হ্যাঁ, একদম ঠিকঠাক।

 “যোগীরাজ, আবার আপনি সমাধি ভেঙে স্বাভাবিক হয়ে আমাদের মধ্যে চলে আসুন। প্লিজ, একটুও গোলমাল নয়। আপনার একটু অসহযোগিতার জন্য যোগীরাজ নির্বিকল্প সমাধি থেকে ফিরতে না পারার মানে জানেন? মৃত্যু। হ্যাঁ, মৃত্যু।

 “হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, নাড়ি ধীরে-ধীরে চলতে শুরু করেছে। এবার আর একবার কষ্ট করে পরীক্ষা করুন। দেখুন। কি, নাড়ির স্পন্দন অনুভব করতে পারছেন? উনি পারছেন। ওঁর কাছ থেকেই আপনারা বরং শুনুন।”


 হ্যাঁ, মোটামুটি এভাবেই বলি আমাদের সমিতির অনুষ্ঠানে পালস্ বিট্ বন্ধ করে দেখাবার সময়।

 কীভাবে বন্ধ করি? দুটি মাঝারি আলু অথবা দুটি রুমাল শক্ত করে পুঁটলি করে দু’বগলের তলায় রাখুন। এবার হাত দুটো বুকের পাশে চেপে রাখুন। এই চাপে বগলের তলার অ্যাক্সিলারি ধমনীতে চাপ পড়বে। বাহুতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। কব্জির রেডিয়াল ধমনীতে রক্ত চলাচল স্বভাবতই বন্ধ হবে। অর্থাৎ নাড়ির স্পন্দন বন্ধ হবে।


 এই হলো যোগ সমাধিতে নাড়ি বন্ধ করার মোদ্দা কৌশল।

 স্বাস্থ্যবান কোনও মানুষ বগলের পেশি ফুলিয়ে হাত দুটি চেপে অ্যাক্সিলারি ধমনীর রক্ত চলাচল বন্ধ করতে পারেন।

 দুটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়ের জন্য নাড়ি বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। দু’হাতের রক্ত চলাচল দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ রাখলে তা হাতের বিপদ ঘটাবে।


বালক ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পর ‘নির্বিকল্প সমাধি’র বুজরুকি ফাঁস করতে সুখচর আশ্রমে
যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা নাড়ি বন্ধ করে দেখাচ্ছেন ০৫.০৬.১৯৯৩

 যুক্তিবাদী আন্দোলনের শুরুতে নাড়ির গতি স্তব্ধ করে দেখাতাম আমি। আজ দেখান আমাদের সমিতির কয়েক’শ সদস্য-সদস্যা। দেখান আরও অনেক বিজ্ঞান আন্দোলনকর্মী। শুরু থেকে লক্ষ্য করেছি, আমি যখন নাড়ি বন্ধ করতাম, তখন সাধারণ মানুষরা তেমন অবাক হতেন না। অবাক হতেন বড় বড় চিকিৎসকরা। কারণ সাধারণ মানুষরা ভাবেন যোগ যাঁরা জানেন, তারা নাড়ি বন্ধ করতে-ই পারেন। এর মধ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। নতুন কিছুও নয়।

 চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের কাছে যখন দেখিয়েছি, তখন তাঁদের বিস্ময়ের ঘোর লেগে যেত। কারণ, নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করে একজন মানুষের স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা মানুষের শারীরবৃত্তিতে অসম্ভব ব্যাপার। যখন কৌশলে নাড়ির স্পন্দন বন্ধ করেছি তখন তা দেখে ভয়ংকর রকম অবাক হয়েছেন ডাঃ আবিরলাল মুখার্জি, ডাঃ প্রসেনজিৎ কোনার, ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল প্রমুখ বহু বিশিষ্ট চিকিৎসক।

 সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটা ধাক্কা দিতে-ই একসময় থেকে নাড়ি বন্ধ করার আগে মুনি-ঋষিদের যোগে নাড়ি বন্ধের গল্প বলা শুরু করি। দেখলাম, মানুষ হতবাক হয়ে দেখেছে নাড়ি বন্ধের ঘটনা।

 আমরা একদিকে অলৌকিকত্বের বিরুদ্ধে প্রচার করেছি, আর একদিকে মুনি-ঋষিদের যোগ বিষয়ে ‘মিথ’ ভেঙেছি।

জলের তলায় বারো ঘণ্টা

 ১৯৮৩ সালের ২৪জুন ‘সত্যযুগ’ পত্রিকা এবং ২৫ জুন ‘যুগান্তর’ পত্রিকা একটা দারুণ চাঞ্চল্যকর খবর ছাপল—জলের তলায় বারো ঘণ্টা। খবরের বিবরণে জানা গেল কৃষ্ণনগর ষষ্ঠীতলার ২১ বছরের তরুণ প্রদীপ রায় কোনও যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়া জলের তলায় একনাগাড়ে বারো ঘণ্টা থাকতে পারে। অবশ্যই একটা বিশ্ব রেকর্ড, কারণ জলের তলায় থাকার আগেকার বিশ্ব রেকর্ড ক্যালিফোর্নিয়ার রবার্ট ফস্টারের। তিনি কোনও কিছু যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়া ১৩ মিনিট ১৫ সেকেণ্ডের মতো জলের তলায় ছিলেন।

 প্রদীপ রায় জানিয়েছিলেন— বছর সাতেক আগে আগরতলায় দাদার কাছে থাকার সময় জলে ঝাঁপাতে গিয়ে বুকে আঘাত পান। তারপর থেকেই তাঁর এই অলৌকিক ক্ষমতা এসে গেছে। মাছের মতোই জলের তলায় থাকতে আর অসুবিধে হয় না।

 প্রদীপ রায় পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দেখালেন নিজের অলৌকিক ক্ষমতার সপক্ষে একগাদা সার্টিফিকেট, এগুলো নাকি দিয়েছেন পশ্চিম দিনাজপুরের জেলাশাসক, কাটোয়ার মহকুমা শাসক এবং আরও অনেক হোমরা-চোমরা।

 সমস্ত ঘটনা শুনে এবং নথিপত্র দেখে সুভাষ চক্রবর্তী ঠিক করলেন প্রদীপ রায়ের অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা নেবেন। পরীক্ষার দিন ঠিক হলো ১৬ জুলাই। ১৬ জুলাই সরকারি পরীক্ষকদের চোখকে যাতে প্রদীপবাবু ফাঁকি না দিতে পারেন, তার জন্যে এই পরীক্ষা ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করার জন্য বেসরকারিভাবে নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি প্রস্তুত হই। আমাকে সহযোগিতার করার জন্যে আমার দুই বন্ধুকেও তৈরি রাখি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রদীপ রায় ১৬ জুলাই-এর পরীক্ষায় হাজির হননি। পরিবর্তে ১৫ জুলাই প্রদীপবাবুর পক্ষ থেকে জানানো হয় ১৬ জুলাই প্রদীপ রায়ের জন্মদিন, অতএব সেই দিনের পরীক্ষায় হাজির হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

 জানিনা পরবর্তীকালে ‘সত্যযুগ ও যুগান্তর’-এ প্রকাশিত খবরটি নিজের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে কত জায়গায় হাজির করেছিলেন প্রদীপ রায়।

জলপরী (পুং) রূপরাজ

১৯৮৯-এর ফেব্রুয়ারি। শীত-শীত সন্ধ্যা। কয়েকজন তরুণ বন্ধুর সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় কথায় ব্যস্ত হলাম। কলিংবেল বাজল। সমিতির এক সদস্য উঠে গেলেন। এসে জানালেন, “আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছেন। খবু নাকি জরুরী প্রয়োজন।” বললাম, “দেখছই তো প্রচণ্ড ব্যস্ত আছি। রবিবার সকাল ১০ টায় আসতে বলো।” সদস্যটি কথা বলে আবার ফিরে এলেন, ‘বলছেন, এর আগেও একদিন এসেছিলেন। আপনার দেখা পাননি। খুবই প্রয়োজন। দু-চার মিনিটের বেশি সময় নেবেন না জানালেন।” নিয়ে আসতে বললাম।

 আগন্তুক ঘরে ঢুকলে তাঁর দিকে একঝলক তাকালাম। মাঝারি উচ্চতার স্বাস্থ্যবান যুবক। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। মুখে স্বল্প দাড়ি-গোঁফ। পরনে চকোলেট রঙের ট্রাউজার, হালকা রঙের হাফ হাতার বুশ সার্ট ও চটি। শিশুর সারল্যে আমাকে জানালেন, আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চান। তবে একটি শর্ত আছে। আমাকে ৫০ হাজার টাকার পরিমাণটা বাড়াতে হবে।

 বিস্মিত হলাম। বাড়াতে হবে মানে? ইচ্ছে করলেই টাকার পুঁজি বাড়ানো যায় কি? অথবা আমাকে কি দস্তুরমতো আমির ঠাউরেছেন?

 বললাম, “দেখুন ভাই, অনেক কষ্টে ৫০ হাজার টাকা জমিয়েছি। আপনি চাইলেই বাড়াই কী করে বলুন?

 আমার উত্তরটা যে তরুণটির কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি তা তরুণটির পরবর্তী কথায় বুঝতে অসুবিধে হলো না।

 বললাম, “দেখুন, আপনার নামটাই জানা হল না। আপনার কি ক্ষমতা দেখাবেন, তাও বললেন না। শুধু টাকার পরিমাণ বাড়াতে অনুরোধ করছেন। জানেনতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হলে আপনাকেও জমা রাখতে হবে পাঁচ হাজার টাকা?”

 ছড়িয়ে হাসলেন। “অবশ্যই জানি। আপনি রাজি হলে আগামী রবিবার ৫ ফেব্রুয়ারিই আমার তরফের মানতের টাকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনার তরফে টাকাটা বাড়াতে হবে। আমি যা দেখাব, তা সাঁইবাবার বিভূতি বা সোনার টাকা করার মতো বুজরুকি নয়, ডাইনি ঈপ্সিতার মত মিথ্যে প্রচারের ঢাক পেটানো নয় বা পারমিতা, শকুন্তলাদেবী, অসিত চক্রবর্তী, নরেন্দ্র মাহাতোর মতো জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করার আহাম্মকি নয়। আমি জানি এঁরা প্রত্যেকেই আপনার কাছে পরাজিত বা পলাতক। এঁরা প্রত্যেকেই প্রচারের ফানুস, তাই প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রমাণ রাখতে পারেননি, ফেঁসে গেছেন। প্রচারের আড়ালে বিজ্ঞানের বাইরেও অলৌকিক বলে যে কিছু আছে, সেটা আপনার মত একজন যুক্তিবাদীকে অন্তত একবারের জন্য দেখানো প্রয়োজন বলে মনে করি। অনুভব করেছি, এখন আপনাকে থামানো প্রয়োজন, আপনাকে বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।”

 তরুণটির কাব্যময় কথাগুলো আমাকে শুধুমাত্র ক্লান্তই করছিল। বললাম, “দু-চার মিনিট কিন্তু আমরা অনেকক্ষণ আগেই পার হয়ে এসেছি। আপনার অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে আপনি ঠিক কি দেখাবেন যদি দয়া করে সে কথায় আসেন তো বাধিত হই।”

 “আমি বিনা অক্সিজেনে থাকতে পারি।”

 “এ আর নতুন কী? আজকাল অলৌকিক বিরোধী বিভিন্ন প্রদর্শনীতে বহু ছেলে-মেয়েই কবরের তলায় দু-চার ঘণ্টা কাটিয়ে বহাল তবিয়তে বেরিয়ে আসছেন। কবরের ভেতরের অক্সিজেনে যতক্ষণ থাকা সম্ভব ততক্ষণ অথবা বাইরে থেকে গোপনে অক্সিজেনের সরবরাহ চালু রেখে বহুক্ষণ থাকা সম্ভব। কিন্তু সে সবই কৌশলের ব্যাপার। আপনিও কি ওই ধরনের কিছু করে থাকেন? তাই যদি হয়, তবে আর জমানতের টাকা খোয়াবেন কেন? আমারও সময় নষ্ট করাবেন কেন?”

 তরুণটি এবার উত্তেজিত হলেন। ‘আপনি পুরো ব্যাপারটাকেই হালকাভাবে নিতে চাইছেন। আমি কোনও বুজরুক বা প্রতারক নই। বিনা অক্সিজেন চব্বিশ ঘণ্টা আপনার সামনে থেকে দেখাব।’

 জিজ্ঞেস করলাম, “আগে কখনও দেখিয়েছেন?”

 “অবশ্যই এবং জেলাশাসক, এম, এল, এ. অধ্যাপক থেকে শুরু করে বহু বিদগ্ধ মানুষই আমার এই অলৌকিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছেন।”

 “তাঁদের সামনে আপনি পরীক্ষা দিলেন কেমন করে?” আমি তখন রীতিমতো বিস্মিত।

 “জলের তলায় ডুবে থাকলে তো একজন মানুষের পক্ষে কৌশল ছাড়া দশ-বারো ঘণ্টা থাকা সম্ভব হয়, আমি সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছি।”

 তরুণের কথায় একটা কাজ হলো। বললাম, “বেশ, আমি আপনার অনুরোধ মত আমার দেয় টাকার পরিমাণ সাধ্যমতো বাড়াবার চেষ্টা করব। আপনি আপনার আইনজ্ঞ ও জমানতের টাকা নিয়ে আগামী রবিবার আসুন। আবার একটা কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমি আমাদের সমিতি আইনজ্ঞের উপদেশ মতো আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নেব, অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা দিতে গিয়ে আপনি মারা পড়লে দায়ী নই। আমি আপনার সেইসব বিদগ্ধ দর্শক নই। একটু মোটা মাথার মানুষ। প্যাঁচ-ঘোঁচ তেমন বুঝি না, কাউকে কোনও প্যাঁচ কষতেও দিই না। তেমন কিছু প্যাঁচোয়া পরিকল্পনা থাকলে আপনি বেঘোরে মারা পড়বেন, এটা মনে রেখেই আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবো।”

 “সে লিখে দেব। আর হ্যাঁ, আমার নাম জানতে চাইছেন না? রূপরাজ। রূপরাজ ঘোষ। ঠিক আছে আর আপনাকে বিরক্ত করব না। রবিবারই দেখা হবে।”

 এই মুহূর্তে আমার মাথায় যে চিন্তাটা ঢুকল তা হলো, রূপরাজের অক্সিজেন গ্রহণের কৌশলটা কী হতে পারে? অক্সিজেন ছাড়া যোগের সাহায্যে বেঁচে থাকা গল্প-গাছাতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়। অতএব?

 রূপরাজকে অনুরোধ করলাম, “কিছু মনে না করলে আমাদের সামনে অক্সিজেন ছাড়া দশ মিনিট থেকে দেখাবেন?”

 রূপরাজ জিজ্ঞেস করলেন, “পরীক্ষা করবেন কেমন করে?”

 “কেন, স্রেফ আপনার নাক-মুখ টিপে রেখে।”

 রূপরাজ সোফায় বসলেন। আমি ওর নাক-মুখ আমার হাতের তালু ও আঙুলের সাহায্যে চাপা দিলাম। দেওয়ালের ব্যাটারিচালিত ঘড়ির লাল সেকেণ্ডের কাঁটা ঘুরতে শুরু করল এক-দুই-দশ-কুড়ি...তিরিশ...পঞ্চাশ..ষাট...। না, আমার উৎকণ্ঠাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন রূপরাজ। দমবন্ধ ইঁদুরের মতো বারকয়েক হাঁস-ফাঁস করে এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে দিলেন।

 “সে কি রূপরাজবাবু; চব্বিশ ঘণ্টার কথা বলে মাত্র এক মিনিটেই মাত হয়ে গেলেন? এই ক্ষমতা নিয়ে আপনি আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এসেছিলেন।”

 রূপরাজ মুহূর্তের জন্য কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন। সেটা কাটিয়ে উঠে বললেন, “ঠিক আছে আমি পারিনি হেরে গেছি, আপনার চ্যালেঞ্জ আর গ্রহণ করতে আসছি না, হলো তো?”

 “হলো আর কোথায়? এই কথাগুলোই যে আপনাকে লিখে দিতে হবে ভাই। নতুবা আবার কোথায় গিয়ে যে আপনি প্রতারণা করবেন তার ঠিক কি?”

 “ক্ষমা তো চেয়ে নিয়েছি। পরাজয় মেনে নিয়েছি। আবার কি, আপনার অনেক দামি সময়ের কিছুটা নষ্ট করলাম বলে দুঃখিত।” উঠে দাঁড়ালেন রূপরাজ। “দরজাটা খুলে দিন।”

 “না লিখে দিলে তো আপনাকে ছাড়ছি না।”

 ঘরের মধ্যে খাঁচাবন্দী বাঘের মতো পায়চারি করতে করতে রূপরাজ বললেন, ‘বেশ তো, ধরে রেখে দিন যতক্ষণ খুশি যতদিন খুশি।”

 “আপনি আমার সহজ সরল শর্তে রাজি না হলে কিন্তু আখেরে আপনাকেই পস্তাতে হবে। আপনার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে প্রতারণার অভিযোগ আনতে বাধ্য হব।”

 “অভিযোগ শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারবেন তো?” রূপরাজ-এর কথায় ব্যঙ্গের সুর।

 অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, “তা পারব বই কি। আপনাদের মতো বিখ্যাতদের সঙ্গে সাক্ষাতের বিশেষ মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়েছে। এই যে আপনি এলেন, কথা বললেন, এ-সবই ক্যামেরা ও টেপে বন্দি করে রেখেছি।”

 “তাই না কি? বাঃ বাঃ, আপনার তো সব মর্ডান অটোমেটিক ব্যবস্থা দেখছি।” আমার কথাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে রূপরাজ টেনশন মুক্ত হতে চাইলেন।

 হাত বাড়ালাম। একটা সুইচ টিপতে যে কণ্ঠস্বর ঘরে ভেসে বেড়াতে লাগল সেটা রূপরাজের। সামান্য শব্দের কি শক্তি তা টের পেলাম। রূপরাজের চেহারা পালটে গেল। সোফায় ধপাস করে বসে পড়ে পায়ের তলার কার্পেট পা ঘষতে ঘষতে পাগলের মতো মুঠো করে করে নিজের চুল টানতে লাগলেন। সেই সঙ্গে গোঙানো কান্না, “আমি ক্ষমা চাইছি। সত্যিই ভুল হয়ে গেছে।” তারপর হঠাৎ উঠে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আমার পায়ের পাতা দুটি সবল দুটি হাতে ধরে নিজের মাথাটা বার-বার ঠুকতে লাগলেন। “আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি। বুঝলে কখনও আসতাম না। আপনি দয়া করে আমার সম্বন্ধে কোনও পত্রিকায় কিছু লিখবেন না। লিখলে বরবাদ হয়ে যাবে। আমার এতদিনের সম্মান শেষ হয়ে যাবে। মুখ দেখাতে পারব না। কথা দিচ্ছি, আর কোনওদিন কোথাও বিনা অক্সিজেনে থাকার ঘটনা ঘটিয়ে দেখাব না।”

 বললাম, “এই মুখের কথাগুলোই আপনাকে লিখে নিতে হবে। আপনাকে ক্ষমা করার কোনও প্রশ্নই আসে না। এর আগে বহুজনকে ঠকিয়েছেন, আমাকে ঠকাতেই এসেছিলেন। আপনার কৌশল আমি ধরতে না পারলে, আপনার কাছে আমি হেরে গেলে আপনি কি আমাকে কোনও দয়া দেখাতেন? কোনও প্রতারকই তা দেখায় না। আপনি আমাকে শুধু আর্থিক ও মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত করতেন না, আমাদের দেশে সদ্য গড়ে উঠতে শুরু করা কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনকেও এক ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে দিতেন।”

 অনেক টাল-বাহানার পর রূপরাজ লিখে দিলেন একটি অঙ্গীকার পত্র। তাতে এও লিখলেন, “প্রবীরবাবুর কাছে আমি এক মিনিটের বেশি বিনা অক্সিজেনে থাকতে পারিনি। টাকার পরিবর্তে প্রবীরবাবুর পায়ে হাত দিয়ে মার্জনা চেয়েছি। প্রবীরবাবুকে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন এই ধরনের প্রতারণা করব না।”

 সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলেন বহরমপুর কলেজের অধ্যাপক ও মুর্শিদাবাদ বিজ্ঞান পরিষদের সম্পাদক ডঃ মিহিরকুমার দত্ত ও সিঁথি অঞ্চলের জনৈক বিজ্ঞান কর্মী বিশ্বজিৎ ঘোষ।

 রূপরাজকে বললাম, “চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এসে হেরে গেলেন। তবু আপনার পাঁচ হাজার টাকা বেঁচে গেল। পরিবর্তে বিদায় নেবার আগে আমাদের একটু আনন্দ দিয়ে যান। তিনবার কান ধরে ওঠ-বস করুন।”

 বিখ্যাত ব্যক্তির কান ধরে ওঠ-বস করার মত একটা রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে সীমা (স্ত্রী) ও পিনাকী গুটি গুটি পায়ে বসবার ঘরে হাজির হলো।

 হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত তিনবার কান ধরে ওঠ-বস করার পরেই রূপরাজ ওরফে বিশ্বরূপ ওরফে প্রদীপ ঈপ্সিতা, শকুন্তলাদেবী, সাঁইবার, পারমিতা, পাগলাবাবাদের দলেই নাম লিখিয়ে বিদায় নিলেন। ‘প্রবীর' বিজয় হলো না।

শরীর থেকে বিদ্যুৎ

 ১৯৮৫ সালের ২৫ মে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি ‘অলৌকিক’ খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত পুরো খবরটাই আপনাদের আগ্রহ মেটাবার জন্য তুলে দিচ্ছি।

  অলৌকিক  
   
 নয়াদিল্লি ২৪মে—জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তাঁর শরীর থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছুরণ করতে পারেন। “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ বিষয়ে গবেষণারত এই ছাত্রের নাম সত্যপ্রকাশ। তার শরীরে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে তিনি ৬০ থেকে ২০০ ওয়াটের ইলেকট্রিক বালব জ্বালাতে পারেন। অবশ্যই অতি মৃদু আলো। এমনকি মাথা দিয়েও ওই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারেন তিনি। ২৮ বছরের সত্যপ্রকাশ তাঁর এই বিস্ময়কর ক্ষমতাটি লোকের সামনে দেখানোর আগে মিনিট দুই ঘরবন্দী থাকেন। প্রাণায়াম ধরনের ব্যায়াম করেন এবং ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তখনই তার ওই ‘শক্তি সঞ্চয়’ ঘটে। সত্যপ্রকাশ বলেছেন, বাতাস আর্দ্র না হলে এবং ঝোড়ো বাতাস না থাকলেই এই ক্ষমতা দেখাতে তাঁর সুবিধা হয়। ৪৮ ঘণ্টা অনশন করে থাকতে পারলে আরও ভালো। বছর দুয়েক আগে সত্যপ্রকাশ হঠাৎ একদিন এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি তখন হস্টেলে প্রাণায়াম ব্যায়াম করছিলেন। হঠাৎ বোধ করেন যে, তাঁর শরীর থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছুরণ হচ্ছে।

পি. টি. আই

 পি. টি. আই-এর দেওয়া এবং আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরটা ওপর ভিত্তি করে আমি সত্যপ্রকাশকে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় চিঠি দিই ২৭.৫.১৯৮৫ তে। তাতে লিখেছিলাম—“পত্রিকায় আপনার অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা আপনার শরীরে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারেন এবং সেই তৈরির বিদ্যুৎ দিয়ে মৃদু আলো জ্বালাতেও সক্ষম। আমি একজন যুক্তিবাদী এবং আপনার অলৌকিক ক্ষমতার দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী। আশা করি আমার এই সত্যানুসন্ধানে আপনি সহযোগিতা করবেন। আপনার সুবিধামতো একটা তারিখ দিলে আমি সেই তারিখে দিল্লি গিয়ে একটি নিরপেক্ষ স্থানে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে পারি। অনুগ্রহ করে তারিখটা এমনভাবে ফেলবেন যাতে আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি একমাসের মতো হাতে সময় পাই।

 আমাদের পশ্চিমবাংলার শহর, শহরতলী ও গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন পুজো উপলক্ষে বসা মেলাতে বিদ্যুৎ-কন্যার প্রদর্শনীয় হয়। একটি মেয়ের শরীরে বাল্ব ছুঁইয়ে আলো জ্বালানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রদর্শনীর ব্যবস্থাপক বেশি পয়সা রোজগারের জন্য বিদ্যুৎ-কন্যাকে অলৌকিক ক্ষমতাধারী বলে প্রচার করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই এঁরা বিজ্ঞান এবং বিদ্যুৎ-এর ধর্মকে কৌশল হিসেবে কাজে লাগিয়ে আলো জ্বালান। এই ধরনের বিদ্যুৎ তৈরিকে জাদু হিসেবে কৈশোরে দেখিয়েছি। তাই আপনাদের দাবির খবরটা পড়ে খবরের সত্যতা সম্বন্ধে আপনার কাছ থেকে জানতে একান্তভাবে আগ্রহী। আমার সন্দেহ হচ্ছে, আপনার গৃহীত একটা সাধারণ বৈদ্যুতিক কৌশলকে বোঝার ভুলে প্রচার মাধ্যমগুলো এইভাবে প্রচার করেছে। এই বিষয়ে প্রেস ট্রাস্ট অফ ইণ্ডিয়াকে আপনি একটি চিঠি দিয়ে ভুল ভাঙিয়ে দিলে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন একটি দেশের বহু লোকের মধ্যে গড়ে ওঠা আপনার সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণার অবসান হবে।

 আপনি যদি সত্যিই এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন, তবে সেইক্ষেত্রে আপনার দাবিকে আরো জোরাল করার জন্য আমাকে পরীক্ষা করতে দেওয়ার সুযোগ দিন।”


 চিঠির উত্তর আজ পর্যন্ত পাইনি।

 পত্রিকায় ‘অলৌকিক’ খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের সমিতি বহু শত অনুষ্ঠানে শরীর থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে দেখিয়েছে। নাটকীয়তা সৃষ্টি করিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ তৈরি করেছি কোনও দর্শকের শরীর থেকে। আমরাও কিন্তু বালব জ্বেলে থাকি সত্যপ্রকাশের মতোই গোপন ব্যাটারি সাহায্যে।

ভূ-সমাধি

 ১৯৭৩ সালে ভারতের একটি চিকিৎসা-বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পত্রিকায় ডাঃ কোঠারি, ডাঃ গুপ্ত প্রমুখ তিনজন ডাক্তারের একটি পরীক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটিতে বলা হয়, একজন যোগীকে মাটির নীচে ছোট একটি আধারে ৮০ দিন রেখে দেওয়া হয়েছিল। যোগী সমাধিস্থ অবস্থায় ৮০ দিন শ্বাস না নিয়েও বেঁচে ছিলেন। সমাধিস্থ যোগীর হৃৎপিণ্ড কেমন কাজ করে দেখার জন্য ডাক্তাররা যোগীর হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে E.C.G যোগাযোগ ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় দিনেই দেখা যায় E.C.G কাজ করবে না অথচ হৃৎপিণ্ড কাজ করে যাবে। চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে অতীন্দ্রিয় বলা যায় কী?

 এই একই পরীক্ষাকে বিজ্ঞানগ্রাহ্য করতে হলে যোগীকে আগা-গোড়া প্রতিটি তল কাচের তৈরি একটি ঘরে রাখতে হবে, যেখানে সকলে প্রতি মুহূর্তে যোগীকে দেখতে পাবে। কাচের ঘরে একটি মাত্র ছিদ্র থাকবে, যেটা দিয়ে ঘরকে বায়ুশূন্য করা হবে। এই অবস্থায় E.C.G গ্রহণের ব্যবস্থা রাখলে যোগীর কোনও কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।

কোনও অতীন্দ্রিয় পরীক্ষা গ্রহণের সময় প্রতিযোগিকে সম্ভাব্য
সমস্ত কৌশল গ্রহণের সুযোগ থেকে দূরে রাখতে হবে।
যেখানে সুযোগ গ্রহণের অবকাশ রয়েছে সেখানে
পরীক্ষাটিকে কখনই যুক্তিগ্রাহ্য ও
বিজ্ঞানগ্রাহ্য বলা যাবে না।

 আমার কথায় আপনারা অনেকেই আপত্তি তুলতে পারেন। জানি, আপনাদের অনেকেই বলবেন—আপনি নিজের চোখে কোনও সন্ন্যাসী বা যোগীকে মাটির নীচে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে শীর্ষাসনে থাকতে দেখেছেন। অনেক এও দেখেছেন, বড় গর্ত খুঁড়ে গর্তের ভেতর পদ্মাসনে বসে থাকেন যোগী বা সন্ন্যাসী। তারপর তার সারা শরীরটাকেই মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় তাঁরা বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেন। হ্যাঁ, আপনারা যা দেখেছেন আমিও তা দেখেছি। ঘটনাটা দেখলে যেমন যোগের অলৌকিক ফল বলে মনে হয়, বাস্তব ক্ষেত্রে কিন্তু আদৌ তা নয়। ভূ-সমাধির আগে সন্ন্যাসী বা যোগী মহারাজ তাঁর মাথাটা একটা পাতলা কাপড়ে ঢেকে নেন, যাতে চোখে মুখে বা নাকে মাটি ঢুকে না যায়। ভূ-সমাধির গর্তটা বেশ কিছুটা বড় করা হয় এবং ওপর থেকে আলগা মাটি ঢেলে শরীর বা মাথাটার ভূ-সমাধি ঘটানো হয়। আলগা মাটির ফাঁক দিয়ে অনায়াসেই বায়ু চলাচল করে এবং নাক পাতলা কাপড়ের ছাঁকনি ভেদ করে এই বায়ুর সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে যায়। দীর্ঘ অধ্যবসায় ও অনুশীলনের ফলে শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজন কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এই অনুশীলনকেই সাধু-সন্ন্যাসী যোগীরা যোগের অলৌকিক শক্তি বলে প্রচার লেগে পড়েন।

 কলকাতার রাজভবনের কাছে একটি যোগীকে দেখেছিলাম যে ভূ-সমাধির গর্তে বায়ু আসার জন্য একটি নলের ব্যবস্থা রেখেছিল। নলটা মাটির তলা দিয়ে গিয়েছিল দূরে বসে থাকা তারই কয়েকজন সঙ্গীর ঝোলায়। ভূ-সমাধির মাটি ভালো করে পিটিয়ে বন্ধ করা ছিল বলেই আমি বায়ু-নলের উপস্থিতি অনুমান করতে পারি। যোগীবাবার সহকারী যেখানে বসেছিল সেখানটা পরীক্ষা করতেই কৌশল বেরিয়ে পড়ে। উপস্থিত দর্শকদের প্রচণ্ড গালাগাল শুনতে শুনতে দু’জনেই দ্রুত তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে যায়।

 জাদু জগতের বিস্ময় জাদুকর হ্যারি হুডিনিকে (harry Houndini) একবার কফিনে পুরে ৬ ফুট মাটির নীচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ৬০ মিনিট পরে কফিনটি ওপরে তোলা হয় এবং দেখা যায় হুডিনি জীবিত।

 ১৯২৮ সালে এক ফরাসি সাংবাদিককে কফিনে পুরে জলের তলায় নামিয়ে দেওয়া হয়। ৮৫ মিনিট পরে কফিনটি তুলে দেখা যায় সাংবাদিকটি সম্পূর্ণ সুস্থ।
বিদেশী প্রচার মাধ্যমের সামনে ভূ-সমাধি করে দেখাচ্ছেন যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য
এই দুটি ক্ষেত্রেই কোনও অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দাবি তোলা হয়নি।

 ১৯৮৬-র জানুয়ারিতে এই বইটির প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির বিভিন্ন শাখা ও সহযোগী সংস্থার উদ্যোগে হাজারের ওপর ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে ভূ-সমাধি করে দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞানকর্মীরা মাটির নীচে থেকেছে ৩ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নেহাতই খেলার মেজাজে, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দাবিকে নস্যাৎ করে।