আকাশ-প্রদীপ/যাত্রা

উইকিসংকলন থেকে

যাত্রা


ইস্টিমারের ক্যাবিনটাতে কবে নিলেম ঠাঁই,
স্পষ্ট মনে নাই।
উপরতলার সারে
কামরা আমার একটা ধারে।

পাশাপাশি তারি ...' আরো ক্যাবিন সারি সারি নম্বরে চিহ্নিত, একই রকম খোপ সেগুলোর দেয়ালে ভিন্নিত । সরকারী যা আইন কানুন তাহার যাথাযথ্য অটুট, তবু যাত্রীজনের পৃথক বিশেষত্ব রুদ্ধ হুয়ার ক্যাবিনগুলোয় ঢাকা, এক চলনের মধ্যে চালায় ভিন্ন ভিন্ন চাকা ভিন্ন ভিন্ন চাল । 啤 অদৃশ্য তার হাল, অজানা তার লক্ষ্য হাজার পথেই, সেথায় কারো আসনে ভাগ হয় না কোনোমতেই । প্রত্যেকেরই রিজার্ভ করা কোটর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ; দরজাটা খোলা হোলেই সম্মুখে সমুদ্র, 輸 মুক্ত চোখের পরে, সমান সবার তরে, তবুও সে একান্ত অজানা, তরঙ্গ-তর্জনীতোলা অলঙ্ঘ্য তার মান ।

মাঝে মাঝে ঘণ্টা পড়ে। ডিনার টেবিলে খাবার গন্ধ, মদের গন্ধ, অঙ্গরাগের সুগন্ধ যায় মিলে,

তারি সঙ্গে নানা রঙের সাজে
ইলেক্‌ট্রিকের আলো-জ্বালা কক্ষমাঝে
একটু জানা অনেকখানি না-জানাতেই মেশা
চক্ষু কানের স্বাদের ঘ্রাণের সম্মিলিত নেশা
কিছুক্ষণের তরে
মোহাবেশে ঘনিয়ে সবায় ধরে।
চেনা শোনা হাসি আলাপ মদের ফেনার মতো
বুদ্বুদিয়া ওঠে আবার গভীরে হয় গত।
বাইরে রাত্রি তারায় তারাময়,
ফেনিল সুনীল তেপান্তরে মরণঘেরা ভয়।


হঠাৎ কেন খেয়াল গেল মিছে
জাহাজখানা ঘুরে আসি উপর থেকে নিচে।
খানিক যেতেই পথ হারালুম, গলির আঁকে বাঁকে
কোথায় ওরা কোন্ অফিসার থাকে।
কোথাও দেখি সেলুনঘরে ঢুকে
ক্ষুর বোলাচ্ছে নাপিত সে কার ফেনায় মগ্ন মুখে।
হোথায় রান্নাঘর,
রাঁধুনেরা সার বেঁধেছে পৃথুল কলেবর।
গা ঘেঁষে কে গেল চলে ড্রেসিং গাউন পরা,
স্নানের ঘরে জায়গা পাবার ত্বরা।

নিচের তলার ডেকের পরে কেউ বা করে খেলা,
ডেকচেয়ারে কারো শরীর মেলা,
বুকের উপর বইটা রেখে কেউ বা নিদ্রা যায়,
পায়চারি কেউ করে ত্বরিত পায়।
স্টুয়ার্ড হোথায় জুগিয়ে বেড়ায় বরফী সর্বৎ।
আমি তাকে শুধাই আমার ক্যাবিন ঘরের পথ
নেহাৎ থতোমতো।
সে শুধাল, নম্বর তার কত।
আমি বললেম যেই,
নম্বরটা মনে আমার নেই—
একটু হেসে নিরুত্তরে গেল আপন কাজে,
ঘেমে উঠি উদ্বেগে আর লাজে।
আবার ঘুরে বেড়াই আগে পাছে,
চেয়ে দেখি কোন্ ক্যাবিনের নম্বর কী আছে।
যেটাই দেখি মনেতে হয় এইটে হোতে পারে,
সাহস হয় না ধাক্কা দিতে দ্বারে।
ভাবছি কেবল কী যে করি, হোলো আমার এ কী,
এমন সময় হঠাৎ চমকে দেখি
নিছক স্বপ্ন এ যে,
এক যাত্রার যাত্রী যারা কোথায় গেল কে যে॥
গভীর রাত্রি; বাতাস লেগে কাঁপে ঘরের সাসি,
রেলের গাড়ি অনেক দূরে বাজিয়ে গেল বাঁশি॥

২৬|২|৩৯