আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/দোষস্বীকারের ফল

উইকিসংকলন থেকে

দোষস্বীকারের ফল

একদা, জর্ম্মনি দেশের কোনও রাজা ফ্রান্স্‌দেশে পর্য্যটন করিতে গিয়াছিলেন। এই দেশে টুলো নামক স্থানে, সৈন্যসংক্রান্ত অস্ত্রশালা ছিল। একদিন, তিনি, অস্ত্রশালা দেখিবার নিমিত্ত, ঐ স্থানে উপস্থিত হইলেন। অস্ত্রশালার তত্ত্বাবধায়ক, সবিশেষ যত্ন ও সম্মান সহকারে তাঁহাকে সমস্ত দেখাইলেন; তত্ত্বাবধায়কের বিনীত ও সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার দর্শনে, রাজা সাতিশয় প্রীতিপ্রাপ্ত হইলেন।

 অস্ত্রশালাদর্শন সমাপ্ত হইলে, তত্ত্বাবধায়ক, রাজার সম্মুখবর্তী হইয়া, বিনীত বচনে নিবেদন করিলেন, মহারাজ, অত্রত্য কারাগারে যে সকল অপরাধী রুদ্ধ আছে, তন্মধ্যে আপনি যাহাকে নির্দ্দিষ্ট করিবেন, আপনার সম্মানার্থে আমি তাহাকে কারাযুক্ত করিতে ইচ্ছা করি। এ বিষযে আপনকার যেরূপ অভিরুচি হয়।

 রাজা, তত্ত্বাবধায়কের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং লোক নির্দ্দিষ্ট করিবার নিমিত্ত তত্ত্বাবধাযকের সমভিব্যাহারে কারাগারে প্রবেশ করিলেন। তিনি একে একে প্রত্যেক কয়েদীর নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং কি কারণে তুমি কারাগারে রুদ্ধ হইয়াছ, এই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। প্রত্যেক কয়েদী বলিল, মহারাজ, আমার কোন অপবাধ নাই, বিনা অপরাধে আমি কারাগারে রুদ্ধ হইয়াছি। মহারাজ, অবিচার, অত্যাচার ও মিথ্যাভিযোগের জ্বালায় এ দেশে বাস করা ভার হইয়া উঠিযাছে। রাজা ও রাজপুরুষেরা বিচারবিমুখ হইয়া, সমস্ত কাজ করিয়া থাকেন, তাঁহাদের অত্যাচারে এ দেশে আর তিষ্ঠিতে পারা যায় না। কেহ কাহারও নামে মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিলে, রাজপুরুষেরা সে বিষয়ে কোনও অনুসন্ধান না কবিয়াই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড দেন, আর রাজপুরুষেরা কাহারও উপর কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হইলে, তাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করাইয়া দণ্ড দিয়া থাকেন।

 অবশেষে রাজা, এক কয়েদীর নিকটে উপস্থিত হইয়া, তাহাব কারারুদ্ধ হইবার কারণ জিজ্ঞাসিলে, সে বলিল, মহারাজ, আমি অতি দুষ্টস্বভাব ব্যক্তি, স্বভাবদোষে কত লোকের উপর কত অত্যাচার ও কত লোকের কত অনিষ্ট করিয়াছি, বলিতে পারি না। প্রকৃত কথা বলিতে গেলে, আমার মত দুবাত্মা আর নাই। পূর্ব্বে আমি আপন দোষ বুঝিতে পারিতাম না, এক্ষণে সবিশেষ অনুধাবন করিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছি, আমার যেরূপ গুরুতর অপরাধ, সে বিবেচনায় আমি লঘু দণ্ড পাইয়াছি। এই বলিতে বলিতে, তাহার নয়নযুগল হইতে প্রবল বেগে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল।

 তাহার কথা শুনিয়া ও তাহার ভাব দেখিয়া, রাজা অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, এবং স্থিব-দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, তত্ত্বাবধায়ককে বলিলেন, আমার বিবেচনায় এ ব্যক্তিরই কারামুক্ত হওয়া উচিত। অতএব; আমি এই ব্যক্তিকে নির্দদিষ্ট করিলাম। তদনুসারে সে ব্যক্তি, সেই দণ্ডে কারাগার হইতে মুক্ত হইয়া রাজাকে ধন্যবাদ দিয়া, প্রস্থান করিল।