আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/গান্ধীজীর প্রতি নেতাজীর আবেদন
৪ঠা জুলাই ১৯৪৪:
আরাকান ও মণিপুরের যুদ্ধ সফল হয় নাই। তাহার প্রধান কারণ প্রবল বর্ষা।
গত যুদ্ধে কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক অদ্ভুত বীরত্ব দেখাইয়াছেন। আজ নেতাজী তাহাদের পদক পুরস্কার দানে সম্মানিত করিলেন। কর্ণেল এল্-এস্ মিশ্র পাইলেন সর্দার-ই-জঙ্গ্ পদক এবং লেফটন্যাণ্ট পিয়ারী সিংহ পাইলেন বীর-ই-হিন্দ পদক।
নেতাজী বলিলেন—‘আজ লেফটন্যাণ্ট পিয়ারী সিংহকে পদকদানে সম্বর্দ্ধিত করিয়া আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করিতেছি। শুধু আমিই নয় আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টও ইহাতে গৌরবান্বিত হইয়াছেন’।
আজ রেডিওতে মহাত্মা গান্ধীর প্রতি সুভাষচন্দ্রের আবেদন শুনিলাম:
“মহাত্মাজী, ব্রিটিশ কারাগারে শ্রীমতী কস্তুরবাই-এর মৃত্যুর পর আপনার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে আমাদের দেশবাসীর উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। বহির্ভারতের মধ্যে মতের পার্থক্য অনেকখানি ঘরোয়া মতদ্বৈতের ন্যায়। ১৯২৯ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে লাহোর কংগ্রেসে যখন আপনি স্বাধীনতা বিপ্লব সুরু করিয়াছিলেন, তাহার পর হইতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সকল সভ্যই তাহাদের সকলের মনে কেবল এক আশাই পোষণ করেন। বহির্ভারতেব ভারতীয়গণের নিকট আপনিই আমাদের দেশের বর্ত্তমান জাগরণের জন্মদাতা।····
বহির্ভারতের দেশপ্রেমিক ভারতীয়গণ এবং ভারতের স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী বৈদেশিক বন্ধুগণ আপনাকে উচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে। ১৯৪২ সালে আগষ্ট মাসে দুর্জয় সাহসের সঙ্গে আপনি যখন ভারত ত্যাগ করার আন্দোলন করিলেন তখন উহা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। চক্রশক্তি সম্বন্ধে আমার কেবল একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তর দিবার আছে। তাহাদের দ্বারা আমার প্রবঞ্চিত হওয়া কি সম্ভব হইতে পারে? ইহা আমার বিশ্বাস, সকলেই একথা স্বীকার করিবেন—সর্ব্বাপেক্ষা ধূর্ত্ত এবং চতুর রাজনীতিবিদ ব্রিটিশদের মধ্যেই দেখিতে পাওয়া যায়। যখন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদগণ আমাকে খোঁচাইয়া বা আমার উপর জোরজুলুম করিয়াও আমাকে বশীভূত করিতে পারে নাই তখন আর কোন বাজনীতিবিদই উহা করিতে সমর্থ হইবে না এবং যে ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টের নিকট আমাকে বহুবার কারাজীবন বরণ করিতে হইয়াছে, কত অত্যাচার ও উৎপীড়ন সহ্য করিতে হইয়াছে, উহা যখন আমাকে নৈতিক পথভ্রষ্ট করিতে পারে নাই তখন অন্য কোন শক্তিই আর উহা করিতে পারিবে না। আমার দেশের মর্য্যাদা, আত্মসম্মান অথবা স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় এইরূপ কোন কার্য্যই আমি কখনও করি নাই।
মহাত্মাজী, ভারতীয়গণ কেবল প্রতিশ্রুতিকে কতখানি সন্দেহের চক্ষে দেখেন উহা অন্য ব্যক্তি অপেক্ষা আপনি অনেক ভাল জানেন। জাপানের ঘোরণা যদি কেবল প্রতিশ্রুতিই হইত, তাহা হইলে আমি কখনও জাপানীদের কথায় বিশ্বাস করিতাম না।
মহাত্মাজী, আমরা এখানে যে সাময়িক গভর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি, এইবার উহার সম্বন্ধে কিছু বলিব। সাময়িক গভর্ণমেণ্টের লক্ষ্য এক—ভারতের স্বাধীনতা। আমাদের প্রচেষ্টা, আমাদের দুঃখকষ্ট এবং আমাদের উৎসর্গের জন্য আমরা একটা মাত্র পুরস্কার চাই; উহা হইতেছে আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা। আমাদের মধ্যে এমন অনেক আছেন যাহারা ভারতের স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক কর্ম্মক্ষেত্র হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে চান। ভারতে অবস্থিত আমাদের স্বদেশবাসী যদি কোন উপায়ে তাহাদের নিজের চেষ্টায় নিজেদের মুক্ত করিতে পারে অথবা যদি কখন ব্রিটিশ সরকার আপনার “ভারত ত্যাগ কর” প্রস্তাব গ্রহণ করেন তাহা হইলে আমাদের অপেক্ষা অন্য কোন ব্যক্তিই অধিক সুখী হইবে না। যাহা হউক, উপরোক্ত কোনটিই সাফল্যলাভ করিবে না এবং সংগ্রাম অনিবার্য্য ইহা ধরিয়া লইয়া আমরা কার্য্যে অগ্রসর হইতেছি।
হে আমাদের জাতির পিতা! ভারতের স্বাধীনতার এই পবিত্র সংগ্রামের সময় আমরা আপনার আশীর্ব্বাদ ও শুভ কামনা প্রার্থনা করি।’