আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

আত্মচরিত

প্রথম পরিচ্ছেদ

জন্ম—পৈতৃক ভদ্রাসন—বংশ পরিচয়—বাল্যজীবন

 ১৮৬১ সালের ২রা আগষ্ট আমি জন্মগ্রহণ করি। এই বৎসরটি রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয়, কেননা ঐ বৎসরেই ব্রুক্‌স ‘থ্যালিয়ম’ আবিষ্কার করেন। আমার জন্মস্থান যশোর জেলার রাড়ুলি গ্রাম (বর্তমান খুলনা জেলায়)। এই গ্রামটি কপোতাক্ষী নদীতীরে অবস্থিত। কপোতাক্ষী ৪০ মাইল আঁকাবাঁকা ভাবে ঘুরিয়া কবিবর মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান সাগরদাঁড়ীতে পৌঁছিয়াছে। এই নদীরই আরও উজানে বিখ্যাত সাংবাদিক শিশিরকুমার ঘোষের জন্মস্থান পলুয়া মাগুরা গ্রাম—পরে যাহা ‘অমৃতবাজার’ নামে পরিচিত হইয়াছে। রাড়ুলির উত্তরদিকে সংলগ্ন কাটিপাড়া গ্রাম, এই গ্রামেরই অধিবাসী ও জমিদার ঘোষ বংশের কন্যা কবি মধুসূদন দত্তের মাতা।[১] এই দুই গ্রাম অনেক সময়ে একসঙ্গে রাড়ুলি-কাটিপাড়া নামে অভিহিত হয়।

 আমার পিতা এক শতাব্দীরও পূর্বে ১৮২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন মৌলবীর নিকট পারসী ভাষা শিখিয়াছিলেন। তখনকার দিনে ‘পারসী’ই আদালতের ভাষা ছিল। পিতা পারসী ভাষা বেশ ভাল জানিতেন, সঙ্গে সঙ্গে একটু আরবীও শিখিয়াছিলেন। তিনি অনেক সময় বলিতেন যে, যদিও তিনি সনাতন হিন্দুবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তবু কবি হাফিজের ‘দেওয়ানা’ তাঁহার মনের গতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে। তিনি গোপনে মৌলবী-দত্ত সুস্বাদু মরগীর মাংস পর্যন্ত খাইতেন। বলা বাহুল্য, যদি পরিবারের কেহ এই ব্যাপার জানিতে পারিতেন, তবে তাঁহারা পিতৃদেবের আচরণে স্তম্ভিত ও মর্মাহত হইতেন সন্দেহ নাই। বাড়ীতে লেখাপড়া শেষ করিয়া আমার পিতা ১৮৪৬ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কলেজে ইংরাজী বিদ্যা শিক্ষা করিতে যান। ঐ কলেজে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষার জন্য পড়িবার সময়, প্রসিদ্ধ শিক্ষক দেবচরিত্র রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের ছাত্র হইবার সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল। ঐ সময় কাপ্টেন ডি, এল, রিচার্ডসন কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আমার পিতা সাক্ষাৎভাবে তাঁহার ছাত্র না হইলেও, তাঁহার ভাব ও চরিত্রের প্রভাবে কিয়ৎ পরিমাণে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। বাংলায় শিক্ষা প্রচারের অগ্রদূত এই ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন কৃত “বৃটিশ কবিগণের জীবনী” (Lives of British Poets) শীর্ষক গ্রন্থখানি এখনও আমার নিকট আছে। এই গ্রন্থ বহুবার আমি পড়িয়াছি এবং এখানিকে আমি অমূল্য পৈতৃক সম্পদরূপে গণ্য করি।

 আমার পিতা যদি পরিবারিক কারণে হঠাৎ বাড়ী চলিয়া আসিতে বাধ্য না হইতেন, তাহা হইলে তিনি যথাসময়ে কলেজের শিক্ষা শেষ করিয়া সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দিতে পারিতেন।[২] আমার পিতা শিক্ষা অসম্পূর্ণ রাখিয়া কলেজ ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছিলেন; কেননা, আমার ঠাকুরদাদার তিনি একমাত্র পুত্র ছিলেন (আমার পিতৃব্যেরা সকলেই অকালে পরলোকগমন করেন)। ঠাকুরদাদা যশোর আদালতে সেরেস্তাদারের কাজ করিতেন (তখনকার দিনে এই সেরেস্তাদারের কাজে বেশ অর্থাগম হইত); সুতরাং বাড়ীতে পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশনা করিবার কেহ রহিল না। আর একটা কারণ বোধ হয় এই যে, মধসমূদন দত্ত এই সময়ে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাহার ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে এক আতঙ্কের সাড়া পড়িয়া যায়। ঠাকুরদাদার ভয় হইল যে, হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা যে সব বিজাতীয় ভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত হইত, সেই সব গ্রহণ করিয়া আমার পিতাও হয়ত পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিবেন।

 এইখানে আমি আমাদের বংশের ইতিহাস এবং পারিপার্শ্বিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিচয় দিব। ‘বোধখানার’ রায়চৌধুরী বংশ চিরদিনই ঐশ্বর্যশালী, উৎসাহী এবং কর্মকুশল বলিয়া পরিচিত। এই বংশের অনেকে নবাব সরকারে উচ্চ পদ লাভ করেন এবং যশোরের নূতন আবাদী অঞ্চলে অনেক ভূসম্পত্তি ও জায়গীর পান।[৩]

 ১৪শ, ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে মুসলমান পীরগণ প্রথম ধর্মপ্রচারকসুলভ উৎসাহ লইয়া এই যশোর অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের পতাকা বহন করিয়াছিলেন এবং তথায় লোক-বসতি গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। এই অঞ্চলের ইতস্ততঃ বহু গ্রামের নামই তাহার জ্বলন্ত সাক্ষ্য স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে, যথা— ইসলামকাটি, মামুদকাটি,[৪] হোসেনপুর, হাসানাবাদ (হোসেন-আবাদ) ইত্যাদি। ইসলামের এই অগ্রদূতগণের মধ্যে খাঞ্জা আলির নাম সর্বপ্রধান। ইনিই প্রায় ১৪৫০ খৃঃ—বাগেরহাটের নিকটে বিখ্যাত “ষাট গম্বুজ” নির্মাণ করেন। রাডুলির প্রায় দশ মাইল দক্ষিণে আর একটি মসজিদও এই মুসলমান-পীরের নির্মিত বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে।

 সুন্দরবন অঞ্চলে আবাদ করিবার সময়, কতকগুলি লোক জঙ্গল পরিষ্কার করিতে করিতে কপোতাক্ষী নদীতীরে, চাঁদখালির প্রায় ছয় মাইল দক্ষিণে, একটি প্রাচীন মসজিদ মৃত্তিকার নিম্নে প্রোথিত দেখে; সেইজন্য তাহারা গ্রামের নাম রাখে “মসজিদকুঁড়”। এই মসজিদটি দেখিলেই বুঝা যায় যে, ইহা “ষাট গম্বুজে”এর নির্মাতারই কীর্তি।

 আমার কোন পূর্বপুরুষ জাহাঙ্গীর বাদশাহের আমলে বা তাহার কিছু পরে এই গ্রামে আসিয়া বাস করেন। নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামে তাঁহার জায়গীর ছিল। আমার প্রপিতামহ মাণিকলাল রায় নদীয়া ও যশোরের কালেক্টরের দেওয়ানের উচ্চপদ লাভ করিয়াছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম আমলে দেওয়ান, নাজির, সেরেস্তাদারগণই ব্রিটিশ কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজদের দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিলেন।

 বাংলার নবাবদের আমলে এবং ওয়ারেন হেষ্টিংস এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকাল পর্যন্ত রাজকার্যে উৎকোচ গ্রহণ প্রভৃতি নানা জঘন্য অনাচার যে ভাবে চলিয়াছিল, তাহার ফলেই বোধ হয় ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ প্রবর্তক লর্ড কর্ণওয়ালিস ভারতবাসীদিগকে সমস্ত সরকারী উচ্চ পদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন। এই পন্থা অবলম্বন করিবার স্বপক্ষে বাহ্যতঃ সঙ্গত কারণও যে তাঁহার ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। শোভাবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ (পরে রাজা নবকৃষ্ণ) রবার্ট ক্লাইভের মুন্সী ছিলেন এবং মাসিক ষাট টাকা মাত্র বেতন পাইতেন। কিন্তু তিনি নিজের মাতৃশ্রাদ্ধে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। তখনকার দিনের নয় লক্ষ টাকা এখনকার অর্ধকোটী টাকার সমান। ওয়ারেন হেষ্টিংসের দেওয়ান, পাইকপাড়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিং প্রভূত বিত্ত সঞ্চয় করেন এবং প্রাচীন জমিদারদের উৎখাত করিয়া বড় বড় জমিদারী দখল করেন। কান্ত মুদী নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া তাঁহার কাশিমবাজারের ক্ষুদ্র দোকানে ওয়ারেন হেষ্টিংসকে আশ্রয় দেন। ওয়ারেন হেষ্টিংস যখন বাঙ্গলার শাসক হন, তখন তাঁহার আশ্রয়দাতাকে ভুলেন নাই। হেষ্টিংস তাঁহার পুরাতন উপকারী বন্ধুকে খুঁজিয়া বাহির করেন এবং অনেক জমিদারী তাঁহাকে পুরস্কার দেন। এই সমস্ত জমিদারী ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অসম্ভব দাবী মিটাইতে না পারিয়া হতভাগ্য পুরাতন মালিকদের হস্তচ্যুত হইয়া গেল। এখানে গঙ্গাগোবিন্দ সিং এবং নসীপুরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দেবী সিংহের অত্যাচার-কাহিনী বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। বার্কের Impeachment of Warren Hastings গ্রন্থের পাঠকদের নিকট তাহা সুপরিচিত।

 কর্ণওয়ালিসের আমল অন্য অনেক বিষয়ে ভাল হইলেও, উচ্চপদ হইতে ভারতবাসীদিগকে বহিষ্কার তাহার একটি কলঙ্ক। পূর্বে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে, আমি কর্ণওয়ালিসের এই নীতির সাফাই গাহিতেছি।[৫] আমার উদ্দেশ্য মোটেই তাহা নয়। বস্তুতঃ রোগ অপেক্ষা ঔষধই মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইল। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান কর্মচারীরা এদেশের লোকের ভাষা, আচার ব্যবহার, সামাজিক প্রথা কিছুই জানিতেন না। সুতরাং তাঁহারা তাঁহাদের অধীন অসাধু ভারতীয় কর্মচারীদের হাতের পুতুল হইয়া দাঁড়াইলেন। আর ঐ সমস্ত ভারতীয় কর্মচারীরা যদি এরূপ লোভনীয় অবস্থার সুযোগ না লইতেন, তাহা হইলেই বরং অস্বাভাবিক হইত। অজন্মার জন্য কোন জমিদার খাজনা দিতে পারিল না, তাহার জমিদারী “সূর্যাস্ত আইনে” এক হাতুড়ীর ঘায়েই নীলাম হইয়া যাইবে এবং এক মুহূর্তেই সে কপর্দকশূন্য পথের ভিখারী হইবে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে সে কালেক্টরের নিকট দরখাস্ত করিল, তিনি তাহাকে ইচ্ছা করিলে রক্ষা করিতে পারেন। কিন্তু এই কালেক্টর আবার প্রায়ই দেওয়ান বা সেরেস্তাদারের পরামর্শেই চালিত হইতেন। সতরাং সেরেস্তাদার বা দেওয়ানকে যে পরিমাণ উৎকোচ দ্বারা প্রসন্ন করা হইত, সেই পরিমাণেই তিনি জমিদারদের পক্ষ সমর্থন করিতেন। ফৌজদারী মোকদ্দমাতেও পেস্কারের পরামর্শ বা ইঙ্গিতেই জজসাহেব অল্পবিস্তর প্রভাবান্বিত হইতেন। তখন জুরী প্রথা ছিল না, সুতরাং এই সব অধস্তন কর্মচারীদের হাতে কতদূর ক্ষমতা ছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। অসহায় জজেরা পেস্কারদের হাতের পতুল হইতেন, এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল নহে।

 এক শতাব্দী পর্বে আমার প্রপিতামহ মাণিকলাল রায় কৃষ্ণনগরের কালেক্টরের এবং পরে যশোহরের কালেক্টরের দেওয়ান[৬] ছিলেন। এই পদে তিনি যে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমার বাল্যকালে তাঁহার সঞ্চিত ধনের অদ্ভুত গল্প শুনিতাম। তিনি মাঝে মাঝে মাটীর হাঁড়ি ভরিয়া কোম্পানীর ‘সিক্কা টাকা’ বাড়ীতে পাঠাইতেন। বিশ্বস্ত বাহকেরা বাঁশের দুইধারে ভার ঝুলাইয়া অর্থাৎ বাঁকে করিয়া এই সমস্ত টাকা লইয়া যাইত। সেকালে নদীয়া-যশোর গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোডে ডাকাতের অত্যন্ত উপদ্রব ছিল। সুতরাং ডাকাতদের সন্দেহ দূর করিবার জন্য মাটীর হাঁড়ির নীচে টাকা ভর্তি করিয়া উপরে বাতাসা দিয়া ঢাকিয়া দেওয়া হইত।

 আমার পিতামহ আনন্দলাল রায় যশোরের সেরেস্তাদার ছিলেন এবং প্রচুর ধন উপার্জন করিয়া পৈতৃক সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি যশোরেই অকস্মাৎ সন্ন্যাসরোগে মারা যান। আমার পিতা সংবাদ পাইয়া রাড়ুলি গ্রাম হইতে তাড়াতাড়ি যশোরে যান, কিন্তু তিনি পৌছিবার পূর্বেই পিতামহের মৃত্যু হয়, সুতরাং পিতাকে কোন কথাই বলিয়া যাইতে পারেন নাই।

 আমার প্রপিতামহ বিপুল ঐশ্বর্ষ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দে তিনি যে ভূসম্পত্তি ক্রয় করেন, তাহা তাঁহার ঐশ্বর্যের কিয়দংশ মাত্র। তাঁহার অবশিষ্ট ঐশ্বর্য কিরূপে হস্তচ্যুত হইল সে সম্বন্ধে নানা কাহিনী আছে। আমি যখন শিশু, তখন আমাদের পরিবারের বৃদ্ধা আত্মীয়াদের নিকট গল্প শুনিয়াছি যে, আমার প্রপিতামহ একদিন পাশা খেলিতেছিলেন, এমন সময় তিনি একখানি পত্র পাইলেন; তিনি ক্ষণকালের জন্য পাশা খেলা হইতে বিরত হইলেন, পত্রখানি আগাগোড়া পড়িলেন, তারপর একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। কিন্তু তাঁহার মখভাবের কোন পরিবর্তন হইল না, পূর্ববৎ পাশা খেলায় প্রবৃত্ত হইলেন। বোধ হয়, যে ব্যাঙ্কে তিনি টাকা গচ্ছিত রাখিয়াছিলেন, সেই ব্যাঙ্ক ফেল পড়িয়াছিল।[৭] কিন্তু প্রপিতামহ চতুর লোক ছিলেন। সুতরাং, তিনি নিশ্চয়ই তাঁহার সমস্ত ধন একস্থানে গচ্ছিত রাখেন নাই। সম্ভবতঃ তিনি প্রাচীন প্রথামত তাঁহার অর্থ মাটীর নীচে পুঁতিয়া রাখিয়াছিলেন, অথবা ঘরের মেজেতে বা দেয়ালে সংরক্ষিত করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ আমার বাল্যকালে ঘরের দেয়ালে এইরূপ একটি শূন্য গুহা আমি দেখিয়াছি।[৮] আমাদের বংশে প্রবাদ আছে যে, আমার পিতামহ প্রপিতামহের সঞ্চিত ধনের গুপ্ত সংবাদ জানিতেন। কিন্তু তাঁহার অকস্মাৎ মৃত্যু হওয়াতে পিতাকে কিছুই বলিয়া যাইতে পারেন নাই। একথা পূর্বে বলিয়াছি।

 আমাদের বাড়ীর অন্দর মহলের উপরতলার (যাহা এখনও আছে) দরজা লোহার পাত দিয়া মোড়া, তাহার উপর বোল্ট্ বসানো। ইহার উদ্দেশ্য, ডাকাতেরা সহজে যাহাতে ঐ দরজা না ভাঙ্গিতে পারে। এই উপরতলার কিয়দংশ এখনও “মালখানা” নামে অভিহিত হয়। আমার পিতা দেয়ালের স্থানে স্থানে গুপ্তধনের সন্ধানে খুঁড়িয়াছিলেন। কিন্তু কিছুই পান নাই, ঐ সমস্ত স্থান এখনও দেখা যায়, কেননা সেখানে নঁতন ইট সুরকী বসাইয়া মেরামত করা হইয়াছিল। বহু বৎসর পরে আমার পিতার যখন অর্থসঙ্কট উপস্থিত হয় এবং পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রয় হইতে থাকে, তখন আমার মাতা (যদিও সাধারণতঃ তিনি কুসংস্কারগ্রস্ত ছিলেন না) একজন গুণীকে ডাকিয়া পাঠান এবং তাঁহার নির্দেশ অনুসারে সিঁড়ির নীচে একটি স্থান খনন করান, কিন্তু এ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। আমি এই ব্যাপারে বেশ কৌতুক অনুভব করি। কেননা, আমার ঐ সব অতি-প্রাকৃত ব্যাপারে কখনই বিশ্বাস ছিল না।

আমার পিতা

 প্রায় ২৫ বৎসর বয়সে আমার পিতা পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশুনা করার ভার গ্রহণ করেন। তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি পারসী ভাষা জানিতেন, সংস্কৃত ও আরবীও কিছু জানিতেন। ইংরাজী সাহিত্যেও তাঁহার বেশ দখল ছিল এবং আমার বাল্যকালে তাঁহার মুখ হইতেই আমি প্রথম ‘ইয়ং’এর ‘Night Thoughts’ এবং বেকনের ‘Novum Organum প্রভৃতি গ্রন্থের নাম শুনি। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থসংগ্রহ,’ ‘হিন্দু পত্রিকা,’ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ এবং তাহার পূর্ববর্তী ‘অমৃত-প্রবাহিনী’ ও ‘সোমপ্রকাশের’ তিনি নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। কেরী কৃত হোলী বাইবেলের অনুবাদ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’ ও ‘রাজাবলী,’ লসনের ‘পশ্বাবলী’ (জীবজন্তুর কথা) এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এন্‌সাইক্লোপিডিয়া বেঙ্গলেনসিস’[৯] তাঁহার লাইব্রেরীতে ছিল। সমসাময়িক যুগের তুলনায় আমার প্রপিতামহও বেশ শিক্ষিত লোক ছিলেন মনে হয়। ইহার একটি প্রমাণ, তিনি ‘সমাচার দর্পণের’ নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’ প্রথম বাঙ্গলা সংবাদপত্র, ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর হইতে মিশনারীগণ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। আমার বাল্যকালে আমাদের লাইব্রেরীতে এই সংবাদপত্রের ফাইল আমি দেখিয়াছি। বিলাতে ঔপন্যাসিক ফিল্ডিং এর সময়ে গ্রামের ভদ্রলোকেরা যে ভাবে জীবন যাপন করিতেন, আমার পিতাও কতকটা সেইভাবে জীবন আরম্ভ করেন। স্কোয়ার অলওয়ার্দির সঙ্গে তাঁহার চরিত্রের সাদৃশ্য ছিল। তাঁহার অবস্থা সচ্ছল ছিল, সুতরাং নিজের রুচি অনুসারে চলিতে পারিতেন। কলিকাতার সঙ্গেই তাঁহার বেশী যোগ ছিল এবং তিনি ঐ সহরের শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের সঙ্গে মিশিতেন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, কৃষ্ণদাস পাল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি তৎকালীন প্রধান প্রধান লোকদের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় ছিল। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৮৬০ খৃষ্টাব্দের পূর্বে) আমার পিতা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সদস্য হইয়াছিলেন। তিনি সঙ্গীত ভাল বাসিতেন। এবং ওস্তাদের মত বেহালা বাজাইতে পারিতেন। সন্ধ্যাকালে তাঁহার বৈঠকখানায় সঙ্গীতের ‘জল্‌সা’ বসিত এবং পরবর্তী জীবনে স্বভাবতই তিনি সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও সঙ্গীতাচার্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। শেষোক্ত দুই জন বাঙ্গলা দেশে হিন্দু সঙ্গীতের পুনরভ্যুদয়ের জন্য অনেক কাজ করিয়াছেন। আমার পিতা পৈতৃক সম্পত্তি পরিচালনার ভার গ্রহণ করিয়া প্রথমেই ভদ্রাসন বাটীর সদর মহল ভাঙ্গিয়া নূতন করিয়া নির্মাণ করেন। স্থাপত্যশিল্পেও তাঁহার বেশ সৌন্দর্যবোধ ছিল। দিগম্বর মিত্র (পরে রাজা ও সি, এস, আই, উপাধিপ্রাপ্ত) আমাদের গ্রামের নিকটে সোলাদানা জমিদারী ক্রয় করেন। তিনি আমাদের বাড়ীতে দুই এক দিনের জন্য পিতার আতিথ্য গ্রহণ করেন। সুন্দরবনের সীমানার নিকটবর্তী একটি গ্রামে এমন বাড়ী ও সুসজ্জিত বৈঠকখানা দেখিয়া তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হইয়াছিলেন। কেননা, আমাদের বাড়ী ও বৈঠকখানা কলিকাতার যে কোন ধনীর বাড়ী ও বৈঠকখানার সঙ্গে তুলনীয় ছিল।

 আমি পূর্বেই বলিয়াছি, আমার পিতা ১৮৫০ খৃঃ অঃ অর্থাৎ আমার জন্মের এগার বৎসর পূর্বে নিজের জমিদারীতে স্থায়িভাবে বাস করিতে আরম্ভ করেন। তিনি “নব্য বাঙ্গলার” ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। সুতরাং, নিজের জেলায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি একজন অগ্রণী ব্যক্তি ছিলেন। রাডুলিতে তিনিই বলিতে গেলে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ইহারই পার্শ্বে একটি মধ্য ইংরাজী বিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়। ৭৫ বৎসর পূর্বে এ সব বিদ্যালয় বাংলার অধিকাংশ স্থানেই বিরল ছিল এবং গ্রামের গৌরবস্বরূপ বলিয়া গণ্য হইত। বর্তমানে এক খুলনা জেলাতেই ৪৫টা উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় আছে, তা ছাড়া দুটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ এবং বালিকাদের জন্য উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ও আছে।

 এই প্রসঙ্গে ইংরাজী ভাষায় লিখিত ‘আত্মচরিত’ প্রচারের ৩ বছর পরে প্রকাশিত বাংলা ১৩৪০ সালের ৫ই ফাল্গুনের ‘দেশ’ পত্রিকায় সু-সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র বাগল প্রদত্ত বিবরণ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি। উহা হইতে আমার পিতার বিদ্যোৎসাহিতার পরিচয় মিলিবে:—

 “ঊনবিংশ শতাব্দীর আরম্ভে কলিকাতায় প্রথম ইংরাজী শিক্ষার প্রবর্তন হয়। কিছু সময়ের মধ্যে এই শিক্ষা বাঙ্গলাদেশের সুদূর পল্লীতেও ছড়াইয়া পড়ে। সেকালে বিদ্যোৎসাহী লোকের বড় একটা অভাব ছিল না। তাঁহাদের চেষ্টায় গ্রামে পল্লীতে ইংরাজী বাঙ্গলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। আর একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় বালিকা বিদ্যালয়ও তখন নানাস্থানে স্থাপিত হইয়াছিল। আচার্য প্রফল্লচন্দ্র রায়ের পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় নিজ রাড়ুলিগ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া সেখানকার বালক বালিকাদের শিক্ষার সুবিধা করিয়া দেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘সাধুরঞ্জন’ হইতে এখানে যে সব অংশ উদ্ধৃত হইল তাহাতে সে যুগে বাঙ্গলাদেশে শিক্ষাপ্রচারের উদ্যোগ আয়োজন সম্বন্ধে যথেষ্ট আভাষ পাওয়া যাইবে।”

রাড়ুলি অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার

সংবাদ প্রভাকর ১০ ফেব্রুয়ারী ১৮৫৮। ২৯ মাঘ, ১২৬৪]

আমরা নিম্নস্থ পত্রখানি অতি সমাদরপূর্বক প্রকটন করিলাম।

 “কিয়দ্দিবস অতীত হইল জিলা যশোহরের অন্তর্গত রাড়ুলিগ্রাম নিবাসি শ্রীযুক্ত বাবু হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় এবং অন্যান্য কতিপয় মহোদয়গণের প্রযত্নে প্রোক্ত রাডুলি পল্লীতে গবর্ণমেণ্ট সাহায্যকৃত একটী স্বদেশীয় ভাষার বিদ্যালয় সংস্থাপিত হয়, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়াবধি বালকবালিকারা যথাবিধিক্রমে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া আসিতেছে এবং সুশিক্ষার প্রভাবে তাহারা স্ব স্ব পঠিত বিষয়ে একপ্রকার ব্যুৎপন্নও হইয়াছে বটে, ফলতঃ অতি অল্পকালের মধ্যে এই রাডুলি বিদ্যালয়স্থ ছাত্রেরা যেরূপ কৃতকার্য হইয়াছে, অন্যত্রে প্রায় সেরূপ শুনিতে পাওয়া যায় না। বিগত পৌষ মাসে জিলা যশোহরের শ্রীযুক্ত কালেক্টার সাহেব তথা খুলনিয়ার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীযুক্ত বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র মহাশয় এবং অন্যান্য কতিপয় সদ্বিদ্যাশালী মহাত্মাগণ অত্র বিদ্যালয়ে শুভাগমন পুরঃসর বালক বালিকাকুলের পরীক্ষা গ্রহণে যথোচিত সন্তোষ প্রাপ্ত হইয়াছেন। এস্থলে বিদ্যালয়ের সমুন্নতির বিস্তারিত বিবরণ করিতে হইলে এই বলা উচিত যে বিদ্যালয়ের পণ্ডিত শ্রীযুক্ত মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের সুনিয়মে শিক্ষাপ্রদান ও প্রস্তাবিত বাবু হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয়ের অবিচলিত অধ্যবসায় এবং গাঢ়তর উৎসাহই তাহার প্রধান কারণ।”

সংবাদ সাধুরঞ্জন, ২৪শে মে, ১৮৫৮। ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৬৫।

নিম্নস্থ বিদ্যালয় সম্বন্ধীয় বিষয়টি অতি সমাদর পূর্বক প্রকটন করা গেল।

 “গভর্ণমেণ্টের আনুকূল্য প্রাপ্ত, যশোহরস্থ রাডুলির স্কুলের বালকাবলীর ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষা বিগত বর্ষের সেপ্টেম্বর মাসে ডেপটি ইনস্পেক্টর শ্রীযুত বাবু দয়ালচাঁদ রায় মহাশয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে চারিজন বালক ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্ত হইয়াছে। প্রথম শ্রেণীর ছাত্র হরিশ্চন্দ্র বসু, নবীনচন্দ্র ঘোষ কলিকাতাস্থ মেডিকেল কলেজে ও শীতলচন্দ্র বসু, পরেশনাথ রায়, যশোহরস্থ ইংরাজী স্কুলে আগামী ১লা মার্চ হইতে প্রবিষ্ট ও অব্যাঘাতে চারি বর্ষ পর্যন্ত ছাত্রবৃত্তি সম্ভোগে বিদ্যানুশীলন করিবেন। এই ছাত্রগণের অবলম্বিত অধ্যবসায় সমধিক ফলোপধায়ক দর্শনে অন্যান্য ছাত্রগণের আশালতার উদ্দীপকতা বিদ্যাভ্যাসে একাগ্রতা জন্মিয়াছে। অল্পবয়স্ক শিশুগণের অন্তঃকরণে পরিশ্রমের পুরস্কার ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্তের অভিসন্ধি সংস্পর্শে বিদ্যাশিক্ষার একান্ত অনুরাগ সঞ্চার, সতরাং না হওয়ার বিষয় কি? এত অল্পকালের মধ্যে বিদ্যার্থিগণের এতদনুরূপ ফললাভ হইবেক ইহা মনোরথের অগোচর। বিদ্যালয় সংস্থাপনাবধি দিন গণনা করিলে ইহার বয়ঃক্রম দুই বৎসর অতীত হয় নাই, তাহার তুলনা এরূপ হওয়া কেবল উপদেষ্টাগণের সদুপদেশ শিক্ষাপ্রণালীর সুকৌশলেরি মাহাত্ম্যই স্বীকার করিতে হইবে। সংস্কৃত কালেজের সুশিক্ষিত সুবিজ্ঞ শ্রীযুক্ত বাবু মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ শিক্ষাবিধান করিতেছেন। গবর্নমেণ্ট প্রদত্ত সম্পাদকীয় ভার শ্রীযুক্ত বাবু হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি পরম বিদ্যোৎসাহী, বিশেষতঃ স্বদেশ ভাষায় অসাধারণ জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তিনি প্রত্যহ অন্ততঃ দুই ঘটিকা পর্যন্ত প্রগাঢ় উৎসাহ সহকারে উপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন। সদুপদেশ অমূল্য অসমুদ্র-সম্ভূত রত্ন-স্বরূপ, যে প্রকার দিনকরের কর নিস্তেজ বস্তুতে প্রতিফলিত হইয়া সেই বস্তু নয়ন-প্রফুল্লকর শোভায় শোভিত হয়, তদ্রূপ সুমধুর উপদেশাবলী বালকগণের অন্তঃকরণে নীত হইয়া তাহাদিগের জ্ঞানাভাব উজ্জ্বল্য সম্পাদন করে। স্কুলের অবস্থা ক্রমে যেরূপ সমুন্নতি হইতেছে তাহাতে তত্রত্য বালকবালিকারা ভাষা শিক্ষা বিদ্যাভ্যাস প্রভৃতি উত্তরোত্তর পরিবর্ধিত হইবেক। আমরা বোধ করি অব্যাঘাতে তিন চারি বৎসর যথাবিধানে শিক্ষাকার্য সুসম্পন্ন হইলে বিদ্যালয়ের অনেকাংশে শ্রীবৃদ্ধি হইবেক। বিগত ১০ই ফিব্রুআরি তারিখে ডেপটি ইন্‌স্পেক্টার প্রশংসিত বাবু বিদ্যালয়ে আগমন ও নিয়মিতরূপে পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিগমন করিতে করিতে ১২ই ফিব্রুআরী তারিখে প্রধান ইনস্পেক্টার শ্রীযুক্ত মেং উডরো সাহেব মহোদয় বিদ্যালয়ে উপনীত হইয়া শিক্ষা সমাজের প্রচারিত পদ্ধতিক্রমে বালক বালিকার প্রত্যেককে এক এক করিয়া পরীক্ষা লইয়া অতীব সন্তোষ জ্ঞাপন করিয়াছেন। তদনন্তর সম্পাদক বাবুর যত্নাতিশয় বশতঃ সাহেব এই পল্লীর অনতিদূরবর্তি— কাটিপাড়াস্থ গ্রাম্য স্কুল সন্দর্শন করিতে গিয়াছিলেন, তথায় চতুর্দিকে মনোহর পুষ্পোদ্যান পরিশোভিত সুখসেব্য বায়ু সেবিত সুবিস্তৃত সুসজ্জিত রমণীয় বিদ্যামন্দির দর্শন ও যথা কথঞ্চিৎ ছাত্রগণের একজামিন করিলেন। অতঃপর স্কুল সংস্থাপনকারি শ্রীযুক্ত বাবু বংশীধর ঘোষ মহাশয়ের প্রযত্ন ক্রমে এই স্কুলটি গবর্ণমেণ্টের তত্ত্বাবধারণে আনার প্রস্তাব হইয়াছে। বাবু বার্ষিক তিন শত টাকা চাঁদা দিতে সম্মত হইয়াছেন। এ প্রদেশের মধ্যে এস্থান সর্বপ্রধান, সকলে মনে করিলে যত্ন করিলে মাসিক এত চাঁদা সংগ্রহ হয় যে তদ্দ্বারা বিদ্যালয় স্কুল অথবা কালেজ সংস্থাপন ও অনায়াসে ব্যয় নিষ্পন্ন হইতে পারে, কিন্তু মনের অনৈক্যতা, ধনের উন্মত্ততা, স্ব স্ব স্বতন্ত্রতা প্রভৃতি কারণে বিঘ্ন বিঘটন করে, এইক্ষণে গবর্ণমেণ্টের যত্নবারি বিতরিত হইলে স্কুলটি চিরস্থায়ী হইতে পারে।”

 “রাডুলি অঞ্চল হইতে এক বন্ধু আমাকে জানাইয়াছেন,—হরিশ্চন্দ্র রায়চৌধুরী কিরূপ বিদ্যোৎসাহী ও স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন একটি ঘটনা হইতে তাহা বেশ বুঝা যায়। হরিশ্চন্দ্র ১৮৫৮ সন হইতে মাঝে মাঝে কলিকাতায় আসিয়া বাস করিতেন। তখন তিনি তাঁহার সহধর্মিণী ভুবনমোহিনীকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং ভূবনমোহিনীকে বাঙ্গালা পাঠ শিক্ষা করিতে সহায়তা করিতেন।

 হরিশ্চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি পরবর্তি কালে শুধু বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত হইরাছে। বিদ্যালয়টি এখন একটি দ্বিতল গৃহে অবস্থিত। হরিশ্চন্দ্রের সুযোগ্য পুত্র বিশ্ববিশ্রুত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাডুলি অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারের জন্য বহুসহস্র টাকা দান করিয়াছেন। এই টাকার উপস্বত্বের কতক অংশ বালিকাদের শিক্ষার জন্য ব্যয়িত হইয়া থাকে। বিদ্যালয়টি এখন আচার্য রায় মহাশয়ের মাতা ভূবনমোহিনীর নামে।”

 এই স্থলে গত ষাট বৎসরে বাঙ্গালা দেশে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়াছে, তাহার কিছু পরিচয় দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এই ষাট বৎসরের স্মৃতি আমার মনে জ্বলন্ত আছে।

 আমার পিতার বার্ষিক ছয় হাজার টাকা আয়ের ভূ-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তাহার পূর্বে দুই পুরুষে আমাদের পরিবার যে সম্পত্তি ভোগ করিয়াছেন, এই আয় তাহার তুলনায় সামান্য, কেননা আমার প্রপিতামহ ও পিতামহ উভয়েই বড় চাকুরী করিতেন। আমার পিতা যে অতিরিক্ত সম্পত্তি লাভ করেন, তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, তাঁহার বিবাহের সময় আমার পিতামহ আমার মাতাকে প্রায় দশ হাজার টাকার অলঙ্কার যৌতুক দিয়াছিলেন। আমার পিতার যে সব রূপার বাসন ছিল, তাহার মূল্যও কয়েক হাজার টাকা। আমার মনে পড়ে, আমার বাল্যকালে কয়েকজন বিশিষ্ট অতিথিকে একই সময় রূপার থালা, বাটি ইত্যাদিতে খাদ্য পরিবেষণ করা হইয়াছিল। আমার মাতা মোগল বাদশাহের আমলের সোণার মোহর সগর্বে আমাকে দেখাইতেন। আমার মাতার সম্মতিক্রমে তাঁহার অলঙ্কারের কিয়দংশ বিক্রয় করিয়া অন্য লাভবান কারবারে লাগানো হয়। বস্তুতঃ, তাঁহার নামে একটি জমিদারীও ক্রয় করা হয়। আমার পিতা অর্থনীতির মূল সূত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি বলিতেন যে, অলঙ্কারে টাকা আবদ্ধ রাখা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়; কেননা, তাহাতে কোন লাভ হয় না; তাঁহার হাতে যথেষ্ট নগদ অর্থ ও ছিল, সতরাং তিনি লগ্নী কারবার করেন এবং কয়েক বৎসর পর্যন্ত তাহাতে বেশ লাভ হইয়াছিল। ঐ সময়ে অল্প আয়ের লোকদের পক্ষে টাকা খাটাইবার কোন নিরাপদ উপায় ছিল না এবং চোর ডাকাতদের হাত হইতে চিরজীবনের সঞ্চিত অর্থ কিরূপে রক্ষা করা যায়, তাহা লোকের পক্ষে একটা বিষম উদ্বেগের বিষয় ছিল। এই কারণেই লোকে সঞ্চিত অর্থ ও অলঙ্কার মাটীর নীচে পুঁতিয়া রাখিত।

 সুতরাং যখন আমার পিতা নিজে একটি লোন আফিসের কারবার খুলিলেন, তখন গ্রামবাসীরা নিজেদের সঞ্চিত অর্থ উহাতে স্থায়ী সুদে সাগ্রহে জমা দিতে লাগিল। আমার পিতার সততার খ্যাতি ছিল। এইজন্যও লোকে বিনা দ্বিধায় তাঁহার লোন আফিসে টাকা রাখিতে লাগিল। এইরূপে আমার পিতার হাতে নগদ টাকা আসিয়া পড়িল। বহু বৎসর পরে এই ব্যবসায়ের জন্য আমার পিতা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিলেন। আমার পিতার মোট বার্ষিক আয় প্রায় দশ হাজার টাকা ছিল। এখনকার দিনে এই আয় সামান্য বোধ হইতে পারে, কিন্তু সেকালে ঐ আয়েই তিনি রাজার হালে বাস করিতেন। ইহার আরও কয়েকটি কারণ ছিল।

 আমাদের পৈতৃক ভদ্রাসনকে কেন্দ্র করিয়া যদি চার মাইল ব্যাস লইয়া একটি বৃত্ত অঙ্কিত করা যায়, তবে আমাদের অধিকাংশ ভূসম্পত্তি উহারই মধ্যে পড়ে। ইহা হইতেই সহজে বুঝা যাইবে, আমার পিতা অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরাজ স্কোয়ারদের মত বেশ সচ্ছলতা ও জাঁকজমকের সঙ্গে বাস করিতে পারিতেন; কারণ এই যে, তিনি তাঁহার নিজের প্রজাদের মধ্যেই রাজত্ব করিতেন। আমাদের সদর দরজায় মোটা বাঁশের যষ্টিধারী ছয়জন পাইক বরকন্দাজ থাকিত। আমার পিতা তাঁহার কাছারী বাড়ীতে সকাল ৮টা হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বসিতেন, ঐ কাছারী যেন গম্‌গম করিত। তাঁহার এক পার্শ্বে মুন্সী অন্য পার্শ্বে খাজাঞ্জী বসিত এবং নায়েব গোমস্তারা প্রজা ও খাতকদের নিকট হইতে খাজনা লইত বা লগ্নী কারবারের টাকা আদায় করিত।

 কাছারীতে রীতিমত মামলা মোকদ্দমার বিচারও হইত। এই বিচারপ্রণালী একটু রুক্ষ হইলেও, উভয় পক্ষের নিকট মোটামুটি সন্তোষজনক হইত। কেননা, বাদী বিবাদীদের সাক্ষ্য বলিতে গেলে প্রকাশ্যেই গ্রহণ করা হইত। বিবাদের বিষয় সকলেরই প্রায় জানা থাকিত এবং যদি কেহ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়া বিচারকের চোখে ধূলা দিতে চেষ্টা করিত, তবে তাহা প্রায়ই ব্যর্থ হইত। আর এখনকার আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রভৃতি দেওয়ার যে প্রলোভন আছে, তখনকার দিনে তাহা ছিল না। অবশ্য, এই বিচারপ্রণালী দোষমুক্ত ছিল না। কেননা, তখনকার দিনে গ্রামবাসী জমিদারের সংখ্যা বেশী ছিল না এবং এই গ্রামবাসী জমিদারের নিকটেও অনেক সময় ঘুষখোর ও অসাধু নায়েবদের মারফৎই যাইতে হইত। বলা বাহুল্য বাদী বা বিবাদীকে অধিকাংশক্ষেত্রেই নিজের সুবিধার জন্য এই নায়েবদিগকে ঘুষ দিয়া সন্তুষ্ট করিতে হইত। তবে ঐ বিচারপ্রণালীর একটা দিক প্রশংসনীয় ছিল। রুক্ষ এবং সেকেলে “খারাপ" প্রথায় সুবিচার (বা অবিচার) করা হইত, কিন্তু তাহাতে অযথা বিলম্ব হইত না। আর ব্যাপারটা তখন তখনই শেষ হইয়া যাইত, তাহা লইয়া বেশী দূর টানা হেচড়া করিতে হইত না; অন্য একটি অধ্যায়ে আমি এ বিষয় বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছি।

  1. মধুসূদনের মাতা জাহ্নবী দাসী কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা।
  2. তখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় নাই।
  3. যে সব পাঠক এ সম্বন্ধে আরও বেশী জানিতে চাহেন, তাঁহারা সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ পড়িতে পারেন।
  4. কাটি (কাষ্ঠখণ্ড) — সুন্দরবনে জঙ্গল কাটিয়া যে সব স্থানে বসতি হইয়াছে, সেখানকার অনেক গ্রামের নামের শেষেই এই শব্দ আছে।
     ওয়েস্টল্যাণ্ডের ‘Report on the District of Jessore’ ২০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। হাণ্টার যথার্থই বলিয়াছেন,—বাঙ্গালী জমিদার এই কথা বলিয়া গর্ব করিতে ভালবাসেন যে, তাঁহার পূর্বপুরষে উত্তর অঞ্চল হইতে আসিয়া জঙ্গল কাটিয়া গ্রামে বসতি করেন। যে পুকুর কাটাইয়া, জমি চাষ করিয়া বসতি করে সেই এখনও গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা বলিয়া গণ্য।
  5. এ বিষয়ে মার্শম্যান ও সার হেনরী ষ্টাচীর উক্তি উল্লেখযোগ্য:
    “লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমল হইতে আমাদের শাসনে এক দূরপনেয় কলঙ্কের মসী লিপ্ত হইয়া আছে; আমাদের সাম্রাজ্যের যত শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, দেশের মধ্যে যাহারা প্রভাব প্রতিপত্তিশালী তাহাদের আশা ভরসায় ততই ছাই পড়িতেছে; আমাদের শাসন ব্যবস্থায় তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনও স্থান নাই। আপন দেশে তাহারা দুর্গতির হীনতম স্তরে অবস্থান করিতেছে।”
     “একটা সমগ্র জাতির এরূপ অপাংক্তেয় অবস্থার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর দেখা যায় না। যে গল জাতি সীজারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিল তাহাদেরই বংশধরগণ রোমের রাষ্ট্রসভায় সদস্যপদ লাভ করিয়াছিল। যে রাজপুত বীরগণ বাবরের মোগলশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অঙ্কুরেই বিনষ্টপ্রায় করিয়াছিল তাহাদেরই পুত্রপৌত্রাদি আকবরের আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন এবং প্রভুর হিতে বঙ্গোপসাগর ও অক্‌সাস নদীর তীরে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিল। এমন কি, মুসলমান সুবাদারগণের ষড়যন্ত্রে যখন আকবর বিপন্ন, তখন এই রাজপুতগণই অবিচলিত নিষ্ঠা ও রাজভক্তি সহকারে তাঁহার সিংহাসন নিরাপদ রাখিয়াছিল, কিন্তু ভারতের যে অংশেই আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেখানেই দেশবাসীদের পক্ষে উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতা, যশ, অর্থ, সম্মান বা যে কোন প্রকার উন্নতির পথ চিররুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। ইহারই পাশাপাশি দেশীয় নৃপতিগণের সভায় ছিল যোগ্যতা ও গুণের প্রচুর সমাদর—সতরাং তুলনায় এই বৈষম্য বড়ই বিসদৃশ লাগিত।”—মার্শম্যানের ভারতেতিহাস।
     “কিন্তু ইউরোপীয়ান কর্মচারীদিগকে আমরা প্রলোভনের বহু ঊর্দ্ধে রাখিয়াছি। যে সকল দেশীয় কর্মচারীর পূর্বপুরুষগণ, উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত পদে থাকিয়া দশজনের উপর কর্তৃত্ব করিতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁহাদিগকে আমরা বিশ ত্রিশ টাকা বেতনে সামান্য কেরাণীর কাজে নিযুক্ত করিয়াছি। ইহার পর আমরা বলিয়া বেড়াই যে, ভারতীয়েরা অসাধু ও ঘুসখোর এবং একমাত্র ইউরোপীয় কর্মচারিগণই তাহাদের প্রভু হইবার যোগ্য।”—সার হেনরী স্ট্যাচী।
  6. ‘দেওয়ান’ শব্দ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইত। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, নিমক চৌকীর দেওয়ান ছিলেন। মিঃ ডিগ্‌বী রাজা রামমোহন রায়ের “কেন উপনিষৎ ও বেদান্তসারের” ইংরাজী অনুবাদের ভূমিকায় লিখিয়াছেন, “তিনি (রামমোহন) পরে যে জেলায় রাজস্ব সংগ্রহের দেওয়ান বা প্রধান দেশীর কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সেই জেলায় আমি পাঁচ বৎসর (১৮০-১৪) ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সিভিল সার্ভিসে কালেক্‌টর ছিলাম।”— মিস্ কোলেট কৃত রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী ও পত্রাবলী, ১৯০০, ১০-১১ পূঃ।
     “সেকালে সেট্‌ল্‌মেণ্টের কাজে বিশ্বস্ত দেশীর সেরেস্তাদারদিগকেই সাধারণতঃ কালেক্‌টরেরা প্রধান এজেণ্ট নিযুক্ত করিতেন এবং কালেক্‌টরেরা এই সব সেরেস্তাদারদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত ধারা বহুল পরিমাণে চালিত হইতেন।” শিবনাথ শাস্ত্রী প্রণীত ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস, ১২ পৃঃ।
     ‘মডার্ণ রিভিউ’, ১৯৯০, মে, ৫৭২ পৃঃ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
  7. এই ব্যাঙ্কের নাম পামার এণ্ড কোং, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। ১৮২৯ সালে ঐ ব্যাঙ্ক ফেল পড়াতে বহু ইউরোপীয় ও ভারতীয় সর্বস্বান্ত হন।
  8. সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ইংলণ্ডেও টাকাকড়ি গচ্ছিত রাখা কষ্টকর ছিল, সুতরাং লোকে সাধারণতঃ অর্ধ মাটির নীচে বা ঘরের মেজেতে লুকাইয়া রাখিত। কথিত আছে যে, কবি পোপের পিতা তাঁহার প্রায় একশত বিশহাজার পাউণ্ড নিজের বাড়ীতে এই ভাবে লুকাইয়া রাখেন।...তৃতীয় উইলিয়মের শাসনের প্রথম ভাগে ইংলণ্ডের অধিকাংশ লোকই স্বর্ণ ও রৌপ্য গোপনীয় সিন্দুকে প্রভৃতিতে লুকাইয়া রাখিত।—মেকলে, ইংলণ্ডের ইতিহাস।
     বাঙ্গলা, বিহার এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশের যে সব অংশে পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রবেশ করে নাই, সেখানকার লোকেরা এখনও অর্থ ঐ ভাবে লুক্কায়িত রাখে।
     সুসভ্য ফ্রান্সে কৃষকেরা এখনও উলের মোজাতে করিয়া ঘরের মেঝেতে অথবা মাটীর নীচে অর্থ সঞ্চিত করে (‘ডেলী হেরাল্ড’ হইতে কলিকাতার সংবাদ পত্রে উদ্ধৃত বিবরণ—ফেব্রুয়ারী, ২৯শে, ১৯৩২)।
     যদিও বর্তমানে অনেক গ্রামে ডাকঘরের সেভিংস ব্যাঙ্ক এবং কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটীর ব্যাঙ্কের সুবিধা আছে, তথাপি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী অর্থ সঞ্চয়ের প্রথা এখনও বিদ্যমান।
     ডাঃ এইচ, সিংহের ‘Early European Banking in India', পৃঃ ২৪০ দ্রষ্টব্য।
  9. দ্বিভাষায় লিখিত পাঠ্যগ্রন্থ (১৮৪৩) লর্ড হার্ডিঞ্জের নামে উৎসর্গীকৃত।