আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ।
এই সময়ে টমাসের তোপগুলি দক্ষিণে আসিয়া পৌঁছিল। তখন সন্তানের দল একেবারে ছিন্ন ভিন্ন হইল, কেহ বাঁচিবার আর কোন আশা রহিল না। সন্তানেরা যে যেখানে পাইল পলাইতে লাগিল। জীবানন্দ ধীরানন্দ তাহাদিগকে সংযত এবং একত্রিত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন কিন্তু কিছুতেই পারিলেন না। সেই সময় উচ্চৈঃশব্দ হইল “পুলে যাও, পুলে যাও! ওপারে যাও। নহিলে অজয়ে ডুবিয়া মরিবে, ধীরে ধীরে ইংরেজসেনার দিকে মুখ রাখিয়া পুলে যাও।”
জীবানন্দ চাহিয়া দেখিল সম্মুখে ভবানন্দ। ভবানন্দ বলিল “জীবানন্দ পুলে লইয়া যাও, রক্ষা নাই।” তখন ধীরে ধীরে পিছে হঠিতে হঠিতে সন্তানসেনা পুলের পারে চলিল। কিন্তু পুল পাইয়া বহুসংখ্যক সন্তান একেবারে পুলের ভিতর প্রবেশ করায় ইংরেজের তোপ সুযোগ পাইল। পুল একেবারে ঝাঁটাইতে লাগিল। সন্তানের দল বিনষ্ট হইতে লাগিল। ভবানন্দ জীবানন্দ ধীরানন্দ একত্র। একটা তোপের দৌরাত্ম্যে ভয়ানক সন্তানক্ষয় হইতেছিল। ভবানন্দ বলিল, “জীবানন্দ, ধীরানন্দ, এস তরবারি ঘুরাইয়া আমরা তিন জন এই তোপটা দখল করি।” তখন তিন জনে তরবারি ঘুরাইরা সেই তোপের নিকটবর্ত্তী তোলন্দাজ সেনা বধ করিল। তখন আর আর সন্তানগণ তাহাদের সাহায্যে আসিল। তোপটা ভবনন্দের দখল হইল। তোপ দখল করিয়া ভবানন্দ তাহার উপর উঠিয়া বসিল। করতালি দিয়া বলিল, “বল বন্দে মাতরং।” সকলে গায়িল “বন্দে মাতরং।” ভবানন্দ বলিল, “জীবানন্দ এই তোপে ঘুরাইয়া বেটাদের লুচির ময়দা তৈয়ার করি।” সন্তানেরা সকলে ধরিয়া তোপ ঘুরাইল। তখন তোপ উচ্চনাদে বৈষ্ণবের কর্ণে যেন হরি হরি শব্দে ডাকিতে লাগিল। বহুতর সিপাহী তাহাতে মরিতে লাগিল। ভবানন্দ সেই তোপ টানিয়া আনিয়া পুলের মুখে স্থাপন করিয়া বলিল “তোমরা দুই জনে সন্তানসেনা সারি দিয়া পুল পার করিয়া লইয়া যাও, আমি একা এই ব্যূহমুখ রক্ষা করিব―তোপ চালাইবার জন্য আমার কাছে জন কয় গোলন্দাজ দিয়া যাও।” কুড়িজন বাছা বাছা সন্তান ভবানন্দের কাছে রহিল।
তখন অসংখ্য সন্তান পুল পার হইয়া জীবানন্দ ও ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে সারি দিয়া পরপারে যাইতে লাগিল। একা ভবানন্দ কুড়িজন সন্তানের সাহায্যে সেই এক কামানে বহুতর সেনা নিহত করিতে লাগিল―কিন্তু যবনসেনা জলোচ্ছ্বাসোত্থিত তরঙ্গের ন্যায়! তরঙ্গের উপর তরঙ্গ, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ!―ভবানন্দকে সংবেষ্টিত, উৎপীড়িত, নিমগ্নের ন্যায় করিয়া তুলিল। ভবানন্দ অশ্রান্ত, অজেয়, নির্ভীক―কামানের শব্দে শব্দে কতই সেনা বিনষ্ট করিতে লাগিল। যবন বাত্যাপীড়িত তরঙ্গাভিঘাতের ন্যায় তাঁহার উপর আক্রমণ করিতে লাগিল, কিন্তু কুড়ি জন সন্তান, তোপ লইয়া পুলের মুখ বন্ধ করিয়া রহিল। তাহারা মরিয়াও মরে না―যবন পুলে ঢুকিতে পায়না। সে বীরেরা অজেয়, সে জীবন অবিনশ্বর। অবসর পাইয়া দলে দলে সন্তানসেনা অপরপারে গেল। আর কিছুকাল পুল রক্ষা করিতে পারিলেই সন্তানেরা সকলেই পুলের পারে যায়―এমন সময় কোথা হইতে নূতন তোপ ডাকিল― “গুড়ুম্ গুডুম্ বুম্ বুম্।” উভয়দল কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া চাহিয়া দেখিল,―কোথায় আবার কামান! দেখিল, বনের ভিতর হইতে কতকগুলি কামান দেশী গোলন্দাজ কর্ত্তৃক চালিত হইয়া নির্গত হইতেছে। নির্গত হইয়া সেই বিবাট কামানের শ্রেণী সপ্তদশ মুখে ধূম উদ্গীর্ণ করিয়া হে সাহেবের দলের উপর অগ্নিবৃষ্টি করিল। ঘোর শব্দে বন নদ গিরি সকলই প্রতিধ্বনিত হইল। সমস্ত দিনের রণে ক্লান্ত যবনসেনা প্রাণভয়ে সিহরিল। অগ্নিবৃষ্টিতে তৈলঙ্গী, মুসলমান, হিন্দুস্থানী পলায়ন করিতে লাগিল। কেবল দুই চারিজন গোরা খাড়া দাঁড়াইয়া মরিতে লাগিল।
ভবানন্দ রঙ্গ দেখিতেছিল। ভবানন্দ বলিল, “ভাই, নেড়ে ভাঙ্গিতেছে, চল একবার উহাদিগকে আক্রমণ করি।” তখন পিপীলিকাস্রোতোবৎ সন্তানের দল, নূতন উৎসাহে পুল পারে ফিরিয়া আসিয়া যবনদিগকে আক্রমণ করিতে ধাবমান হইল। অকস্মাৎ তাহারা যবনের উপর পড়িল। যবন যুদ্ধের আর অবকাশ পাইল না―যেমন ভাগীরথীতরঙ্গ সেই দম্ভকারী বৃহৎ পর্ব্বতাকার মত্তহস্তীকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সন্তানেরা তেমনি যবনদিগকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল। যবনেরা দেখিল পিছনে ভবানন্দের পদাতিক সেনা, সম্মুখে মহেন্দ্রের কামান। তখন হে সাহেবের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল। আর কিছু টিকিল না―বল, বীর্য্য, সাহস, কৌশল, শিক্ষা, দম্ভ সকলই ভাসিয়া গেল। ফৌজদারী, বাদসাহী, ইংরেজী, দেশী, বিলাতী, কালা, গোরা সৈন্য নিপতিত হইয়া ভূতলশায়ী হইল। বিধর্ম্মীর দল পলাইল। মার মার শব্দে জীবানন্দ, ভবানন্দ, ধীরানন্দ, বিধর্ম্মীসেনার পশ্চাতে ধাবমান হইল। তাহাদের তোপ সন্তানেরা কাড়িয়া লইল, বহুতর ইংরেজ ও সিপাহী নিহত হইল। সর্ব্বনাশ হইল দেখিয়া কাপ্তেন হে ও ওয়াটসন ভবানন্দের নিকট বলিয়া পাঠাইল “আমরা সকলে তোমাদিগের নিকট বন্দী হইতেছি আর প্রাণিহত্যা করিও না।” জীবানন্দ ভবানন্দের মুখপানে চাহিল। ভবানন্দ মনে মনে বলিল “তা হইবে না, আমায় যে আজ মরিতে হইবে।” তখন ভবানন্দ উচ্চৈঃস্বরে হস্তোত্তোলন করিয়া হরিবোল দিয়া বলিল “মার মার।”
আর এক প্রাণী বাঁচিল না―শেষ এক স্থানে ২০।৩০ জন গোরা সৈন্য একত্রিত হইয়া আত্মসমর্পণে কৃতনিশ্চয় হইয়া অতি ঘোরতর রণ করিতে লাগিল। জীবানন্দ বলিল “ভবানন্দ, আমাদের রণজয় হইয়াছে, আর কাজ নাই, এই কয়জন ব্যতীত আর কেহ জীবিত নাই। উহাদিগকে প্রাণদান দিয়া চল আমরা ফিরিয়া যাই।” ভবানন্দ বলিল “একজন জীবিত থাকিতে ভবানন্দ ফিরিরে না―জীবানন্দ তোমায় দিব্য দিয়া বলিতেছি, যে তুমি তফাতে দাঁড়াইয়া দেখ একা আমি এই কয় জন ইংরেজকে নিহত করি।
কাপ্তেন টমাস অশ্বপৃষ্ঠে নিবদ্ধ ছিলেন। ভবানন্দ আজ্ঞা দিলেন “উহাকে আমার সম্মুখে রাখ, আগে ঐ বেটা মরিবে তবে ত আমি মরিব।”
কাপ্তেন টমাস বাঙ্গালা বুঝিত, বুঝিয়া ইংরেজসেনাকে বলিল “ইংরেজ! আমি তো মরিয়াছি, প্রাচীন ইংলণ্ডের নাম তোমরা রক্ষা করিও, তোমাদিগকে খ্রীষ্টের দিব্য দিতেছি, আগে আমাকে মার তার পর এই বিদ্রোহী কাফ্রিকে মার।”
ভোঁ করিয়া একটী বুলেট ছুটিল, একজন আইরিসম্যান কাপ্তেন টমাসকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুড়িয়াছিল। ললাটে নিবিদ্ধ হইয়া কাপ্তেন টমাস প্রাণত্যাগ করিল। ভবানন্দ তখন ডাকিয়া বলিলেন “আমার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হইয়াছে, কে এমন পার্থ বৃকোদর নকুল সহদেব আছে যে এ সময়ে আমায় রক্ষা করিবে! দেখ বাণাহত ব্যাঘ্রের ন্যায় গোরা আমার উপর ঝুঁকিয়াছে। আমি মরিবার জন্য আসিয়াছি, আমার সঙ্গে মরিতে চাও এমন সন্তান কি কেহ আছে?”
আগে ধীরানন্দ অগ্রসর হইল, পিছে জীবানন্দ―সঙ্গে সঙ্গে আর ১০।১৫।২০।৫০ জন সন্তান আসিল। ভবানন্দ ধীরানন্দকে দেখিয়া বলিল “তুমিও যে আমাদের সঙ্গে মরিতে আসিলে?”
ধীর। কেন, মরা কি কাহারও ইজারা মহল নাকি? এই বলিতে বলিতে ধীরানন্দ একজন গোরাকে আহত করিলেন।
ভব। তা নয়। কিন্তু মরিলে ত স্ত্রীপুত্রের মুখাবলোকন করিয়া দিনপাত করিতে পারিবে না!
ধীর। কালিকার কথা বলিতেছ? এখনও বুঝ নাই? (ধীরানন্দ আহত গোরাকে বধ করিলেন।)
ভব। না―(এই সময়ে এক জন গোরার আঘাতে ভবানন্দের দক্ষিণ বাহু ছিন্ন হইল।)
ধীর। আমার সাধ্য কি যে তোমার ন্যায় পবিত্রাত্মাকে সে সকল কথা বলি। আমি সত্যানন্দের প্রেরিত চর হইয়া গিয়াছিলাম।
ভব। সে কি? মহারাজের আমার প্রতি অবিশ্বাস? (ভবানন্দ তখন একহাতে যুদ্ধ করিতেছিলেন) ধীরানন্দ তাঁহাকে রক্ষা করিতে করিতে বলিলেন, “কল্যাণীর সঙ্গে তোমার যে সকল কথা হইয়াছিল তাহা তিনি স্বকর্ণে শুনিয়াছিলেন।”
ভব। কি প্রকারে?
ধীর। তিনি তখন স্বয়ং সেখানে ছিলেন। সাবধান থাকিও! (ভবানন্দ এক জন গোরা কর্ত্তৃক আহত হইয়া তাহাকে প্রত্যাহত করিলেন। তিনি কল্যাণীকে গীতা পড়াইতেছিলেন এমত সময়ে তুমি আসিলে। সাবধান! (ভবানন্দের বাম বাহুও ছিন্ন হইল।)
ভব। আমার মৃত্যুসম্বাদ তাঁহাকে দিও! বলিও আমি অবিশ্বাসী নহি।
ধীরানন্দ বাষ্পপূর্ণলোচনে, যুদ্ধ করিতে করিতে বলিলেন “তাহা তিনি জানেন। কালি রাত্রির আশীর্ব্বাদবাক্য মনে কর। আর আমাকে বলিয়া দিয়াছেন, “ভবানন্দের কাছে থাকিও। আজ সে মরিবে। মৃত্যুকালে তাহাকে বলিও আমি আশীর্ব্বাদ করিতেছি, পরলোকে তাহার বৈকুণ্ঠপ্রাপ্তি হইবে।”
ভবানন্দ বলিলেন “সন্তানের জয় হউক, ভাই! আমার মৃত্যুকালে একবার “বন্দে মাতরং” শুনাও দেখি।”
তখন ধীরানন্দের আজ্ঞাক্রমে যুদ্ধোন্মত্ত সকল সন্তান মহাতেজে “বন্দে মাতরং” গায়িল। তাহাতে তাহাদিগের বাহুতে দ্বিগুণ বলসঞ্চার হইয়া উঠিল। সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত্তে অবশিষ্ট গোরাগণ নিহত হইল। রণক্ষেত্রে আর শত্রু রহিল না।
এই মুহূর্ত্তে ভবানন্দ মুখে “বন্দে মাতরং” গায়িতে গায়িতে, মনে বিষ্ণুপদ ধ্যান করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন।
হায়! রমণী রূপলাবণ্য! ইহ সংসারে তোমাকেই ধিক্!