আনন্দমঠ (১৮৮৩)/প্রথম খণ্ড/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ।

 জীবানন্দ চলিয়া গেলে পর শান্তি নিমাইয়ের দাওয়ার উপর গিয়া বসিল। নিমাই মেয়ে কোলে করিয়া তাহার নিকট আসিয়া বসিল। শান্তির চোখে আর জল নাই; শান্তি চোখ মুছিয়াছে, মুখ প্রফুল্ল করিয়াছে, একটু একটু হাঁসিতেছে। কিছু গম্ভীর, কিছু চিন্তাযুক্ত, অন্যমনা। নিমাই বুঝিয়া বলিল,

 “তবু ত দেখা হলো।”

 শান্তি কিছুই উত্তর করিল না। চুপ করিয়া রহিল। নিমাই দেখিল শান্তি মনের কথা কিছু বলিবে না। শান্তি মনের কথা বলিতে ভালবাসে না তাহা নিমাই জানিত। সুতরাং নিমাই চেষ্টা করিয়া অন্য কথা পাড়িল—বলিল,

 “দেখ দেখি বউ কেমন মেয়েটী।”

 শান্তি বলিল,

 “মেয়ে কোথা পেলি—তোর মেয়ে হলো কবে লো?”

 নিমা। মরণ আর কি—তুমি যমের বাড়ী যাও—এ যে দাদার মেয়ে।

 নিমাই শান্তিকে জ্বালাইবার জন্য এ কথাটা বলে নাই। “দাদার মেয়ে” অর্থাৎ দাদার কাছে যে মেয়েটি পাইয়াছি। শান্তি তাহা বুঝিল না; মনে করিল, নিমাই বুঝি সূচ ফুটাইবার চেষ্টা করিতেছে। অতএব শান্তি উত্তর করিল,

 “আমি মেয়ের বাপের কথা জিজ্ঞাসা করি নাই—মার কথাই জিজ্ঞাসা করিয়াছি।”

 নিমাই উচিত শাস্তি পাইয়া অপ্রতিভ হইয়া বলিল।

 “কার মেয়ে কি জানি ভাই, দাদা কোথা থেকে কুড়িয়ে মুড়িয়ে এনেছে, তা জিজ্ঞাসা করবার ত অবসর হলো না! তা এখন মন্বন্তরের দিন, কত লোক ছেলেপিলে পথেঘাটে ফেলিয়া দিয়া যাইতেছে; আমাদের কাছেই কত মেয়ে ছেলে বেচিতে আনিয়াছিল—তা পরের মেয়ে ছেলে কে আবার নেয়?” (আবার সেই চক্ষে সেইরূপ জল আসিল—নিমি চক্ষের জল মুছিয়া আবার বলিতে লাগিল)

 “মেয়েটী দিব্য সুন্দর, নাদুসনুদুস চাঁদপানা দেখে দাদার কাছে চেয়ে নিয়েছি।”

 তার পর শান্তি অনেক্ষণ ধরিয়া নিমাইয়ের সঙ্গে নানাবিধ কথোপকথন করিল। পরে নিমাইয়ের স্বামী বাড়ী ফিরিয়া আসিল দেখিয়া শান্তি উঠিয়া আপনার কুটীরে গেল। কুটীরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া উননের ভিতর হইতে কতকগুলি ছাই বাহির করিয়া তুলিয়া রাখিল। অবশিষ্ট ছাইয়ের উপর, নিজের জন্য যে ভাত রান্না ছিল, তাহা ফেলিয়া দিল। তার পরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া অনেক্ষণ চিন্তা করিয়া আপনা আপনি বলিল, “এতদিন যাহা মনে করিয়াছিলাম, আজি তাহা করিব। যে আশায় এত দিন করি নাই, তাহা সফল হইয়াছে; সফল কি নিষ্ফল—নিষ্ফল! এ জীবনই নিষ্ফল! যাহা সংকল্প করিয়াছি, তাহা করিব। একবারেও যে প্রায়শ্চিত্ত, শতবারেও তাই।”

 এই ভাবিয়া শান্তি ভাতগুলি উননে ফেলিয়া দিল। বন হইতে গাছের ফল পাড়িয়া আনিল। অন্নের পরিবর্ত্তে তাহাই ভোজন করিল। তার পর তাহার যে ঢাকাই শাড়ীর উপর নিমাইমণির চোট তাহা বাহির করিয়া তাহার পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিল। বস্ত্রের যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, গেরিমাটীতে তাহা বেশ করিয়া রঙ করিল। বস্ত্র রঙ করিতে, শুকাইতে সন্ধ্যা হইল। সন্ধ্যা হইলে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, অতিচমৎকার ব্যাপারে শান্তি ব্যাপৃত হইল। মাথার রুক্ষ আগুল‍্ফলম্বিত কেশদামের কিয়দংশ কাঁচি দিয়া কাটিয়া পৃথক করিয়া রাখিল। অবশিষ্ট যাহা মাথায় রহিল, তাহা বিনাইয়া জটা তৈয়ারি করিল। রুক্ষ কেশ অপূর্ব্ব বিন্যাসবিশিষ্ট জটাভারে পরিণত হইল। তার পর সেই গৈরিক বসন খানি অর্দ্ধেক ছিঁড়িয়া ধড়া করিয়া চারু অঙ্গে শান্তি পরিধান করিল। অবশিষ্ট অর্দ্ধেকে হৃদয় আচ্ছাদিত করিল। ঘরে একখানি ক্ষুদ্র দর্পণ ছিল, বহুকালের পর শান্তি সেখানি বাহির করিল; বাহির করিয়া দর্পণে আপনার বেশ আপনি দেখিল। দেখিয়া বলিল, “হায়! কি করিয়া কি করি!” তখন দর্পণ ফেলিয়া দিয়া, যে চুলগুলি কাটা পড়িয়াছিল তাহা লইয়া শ্মশ্রু গুম্ফ রচিত করিল। চাঁদমুখ খানি নবীন দাড়ি গোঁপে শোভা পাইতে লাগিল। তার পর ঘরের ভিতর হইতে এক বৃহৎ হরিণচর্ম্ম বাহির করিয় কণ্ঠের উপর গ্রন্থি দিয়া, কণ্ঠ হইতে জানু পর্য্যন্ত শরীর আবৃত করিল। যদি কোন কবি সেরূপ দেখিত তাহা হইলে এই নবীন “কৃষ্ণত্বচং গ্রন্থিমতীং দধানাকে” দেখিয়া একেবারে মন্মথের বিনাশ দূরে থাকুক পুনরুজ্জীবনের আশঙ্কা করিত। এইরূপে সজ্জিত হইয়া সেই নূতন সন্ন্যাসী গৃহমধ্যে ধীরে ধীরে চারিদিক নিরীক্ষণ করিল। নিরীক্ষণ করিয়া কেহ কোথায় নাই নিশ্চিত বুঝিয়া অতি গোপনে সংরক্ষিত একটি পেটিকা খুলিল। খুলিয়া মোট বাহির করিল। মোট খুলিয়া তাহার ভিতর যাহা ছিল তাহা মাটির ওপরে সাজাইল। কতকগুলি তুলটের পুথি। ভাবিল “এগুলি কি করি, সঙ্গে লইয়া গিয়া কি হইবে? এত বা বহিব কি প্রকারে? রাখিয়া গিয়াই বা কি হইবে? রাখারই বা আর প্রয়োজন কি—দেখিয়াছি জ্ঞানেতে আর সুখ নাই, ও ভস্মরাশিমাত্র—ও ভস্ম ভস্মই হোক।”—এই বলিয়া শান্তি সেই গ্রন্থগুলি একে একে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করিলেন। কাব্য, সাহিত্য, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, আর কি কি তাহা এখন বলিতে পারি না, পুড়িয়া ভস্মাবশিষ্ট হইল। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইলে শান্তি সেই সন্ন্যাসীবেশে দ্বারোদ্ঘাটন পূর্ব্বক অন্ধকারে একাকিনী গভীর বনমধ্যে প্রবেশ করিলেন। গ্রামবাসীগণ সেই নিশীথে কাননমধ্যে অপূর্ব্ব গীতধ্বনি শ্রবণ করিল।

গীত।[১]

“দড় বড়ি ঘোড়া চড়ি কোথা তুমি যাওরে।”
“সমরে চলিনু আমি হামে না ফিরাও রে।
হরি হরি হরি হরি বলি রণরঙ্গে,
ঝাঁপ দিব প্রাণ আজি সমর তরঙ্গে,

তুমি কার কে তোমার, কেন এসো সঙ্গে,
রমণীতে নাহি সাধ, রণজয় গাওরে।”



“পায়ে ধরি প্রাণনাথ আমা ছেড়ে যেওনা।”
“ওই শুন বাজে ঘন রণজয় বাজনা।
নাচিছে তুরঙ্গ মোর রণ করে কামনা,
উড়িল আমার মন, ঘরে আর রব না,
রমণীতে নাহি সাধ রণজয় গাওরে।”


  1. রাগিণী বাগীশ্বরী—তাল আড়া।