বিষয়বস্তুতে চলুন

আনন্দমঠ (১৯৩৮)/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ

 শান্তির অল্পবয়সে, অতি শৈশবে মাতৃবিয়োগ হইয়াছিল। যে সকল উপাদানে শান্তির চরিত্র গঠিত, ইহা তাহার মধ্যে একটি প্রধান। তাহার পিতা অধ্যাপক ব্রাহ্মণ ছিলেন। র্তাহার গৃহে অন্ত স্ত্রীলোক কেহ ছিল না।

 কাজেই শান্তির পিতা যখন টোলে ছাত্রদিগকে পড়াইতেন, শান্তি গিয় তাহার কাছে বসিয়া থাকিত। টোলে কতকগুলি ছাত্র বাস করিত; শাস্তি অন্য সময়ে। তাহাদিগের কাছে বসিয়া খেলা করিত, তাহাদিগের কোলে পিঠে চড়িত; তাহারাও শান্তিকে আদর করিত।

 এইরূপ শৈশবে নিয়ত পুরুষসাহচর্য্যের প্রথম ফল এই হইল যে, শান্তি মেয়ের মত কাপড় পরিতে শিখিল না, অথবা শিখিয়া পরিত্যাগ করিল। ছেলের মত কোচা করিয়া কাপড় পরিতে আরম্ভ করিল, কেহ কখন মেয়ে কাপড় পরাইয়া দিলে, তাহা খুলিয়। ফেলিত, আবার কোচা করিয়া পরিত। টোলের ছাত্রেরা খোপা বাধে না; অতএব শান্তিও কখন খোপা বাধিত ন!—কে বা তার খোপা বাধিয়া দেয়? টোলের ছাত্রের কাঠের চিরণী দিয়া তাহার চুল আঁচড়াইয়া দিত, চুলগুলা কুণ্ডলী করিয়া শাস্তির পিঠে, কাধে, বাহুতে ও গালের উপর জ্বলিত। ছাত্রেরা ফোটা করিত, চন্দন মাখিত; শান্তিও ফোট। করিত, চন্দন মাখিত। যজ্ঞোপবীত গলায় দিতে পাইত না বলিয়া শাস্তি বড় কাদিত। কিন্তু সন্ধ্যাহিকের সময়ে ছাত্রদিগের কাছে বসিয়া, তাহাদের অনুকরণ করিতে ছাড়িত না। ছাত্রের অধ্যাপকের অবর্তমানে, অশ্লীল সংস্কৃতের দুই চারিট বুক্‌নি দিয়া, দুই একটা আদিরসাভিত গল্প করিতেন, টিয়া পাখীর মত শান্তি সেগুলিও শিখিল—টিয়া পাখীর মত, তাহার অর্থ কি, তাহা কিছুই জানিত না।

 দ্বিতীয় ফল এই হইল যে, শান্তি একটু বড় হইলেই ছাত্রেরা যাহা পড়িত, শাস্তিও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে শিখিতে আরম্ভ করিল। ব্যাকরণের এক বর্ণ জানে না, কিন্তু ভট্টি, রঘু, কুমার, নৈষধাদির শ্লোক ব্যাখ্যা সহিত মুখস্থ করিতে লাগিল। দেখিয়া শুনিয়া, শান্তির পিতা “যদ্ভবিষ্যতি তদ্ভবিষ্যতি” বলিয়া, শান্তিকে মুগ্ধবোধ আরম্ভ করাইলেন। শান্তি বড় শীঘ্র শীস্ত্র শিখিতে লাগিল। অধ্যাপক বিস্ময়াপন্ন হইলেন। ব্যাকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুই একখানা সাহিত্যও পড়াইলেন। তার পর সব গোলমাল হইয়া গেল। পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হইল।

 তখন শান্তি নিরাশ্রয়। টোল উঠিয়া গেল; ছাত্রেরা চলিয়া গেল। কিন্তু শান্তিকে তাহারা ভালবাসিত-শান্তিকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিল না। এক জন তাহাকে দয়া করিয়া আপনার গৃহে লইয়া গেল। ইনিই পশ্চাৎ সন্তানসম্প্রদায়মধ্যে প্রবেশ করিয়া জীবানন্দ নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। আমরা তাঁহাকে জীবানন্দই বলিতে থাকিব।

 তখন জীবানন্দের পিতা মাতা বর্তমান। তাঁহাদিগের নিকট জীবানন্দ কন্যাটির সবিশেষ পরিচয় দিলেন। পিতা মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন এ পরের মেয়ের দায় ভার নেয় কে?” জীবানন্দ বলিলেন, “আমি আনিয়াছি—আমিই দায় ভার গ্রহণ করিব।” পিতা মাতা বলিলেন, “ভালই।” জীবানন্দ অনূঢ়—শাস্তির বিবাহবয়স উপস্থিত। অতএব জীবানন্দ তাহাকে বিবাহ করিলেন।

 বিবাহের পর সকলেই অনুতাপ করিতে লাগিলেন। সকলেই বুঝিলেন, “কাজটা ভাল হয় নাই।” শাস্তি কিছুতেই মেয়ের মত কাপড় পরিল না; কিছুতেই চুল বাঁধিল। সে বাটীর ভিতর থাকিত না; পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়া খেলা করিত। জীবানন্দের বাড়ীর নিকটেই জঙ্গল, শান্তি জঙ্গলের ভিতর এক প্রবেশ করিয়া কোথায় ময়ুর, কোথায় হরিণ, কোথায় দুর্লভ ফুল ফল, এই সকল খুঁজিয়া বেড়াইত। শ্বশুর শ্বাশুড়ী প্রথমে নিষেধ, পরে ভৎসনা, পরে প্রহার করিয়া শেষে ঘরে শিকল দিয়া শান্তিকে কয়েদ রাখিতে আরম্ভ করিল। পীড়াপীড়িতে শান্তি বড় জ্বালাতন হইল। এক দিন দ্বার খোলা পাইয়া শান্তি কাহাকে না বলিয়া গৃহত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল।

 জঙ্গলের ভিতর বাছিয়া বাছিয়া ফুল তুলিয়া কাপড় ছোবাইয়া শান্তি বাচ্চা সন্ন্যাসী সাজিল। তখন বাঙ্গালা জুড়িয়া দলে দলে সন্ন্যাসী ফিরিত। শান্তি ভিক্ষা করিয়া খাইয়া। জগন্নাথক্ষেত্রের রাস্তায় গিয়া দাড়াইল। অল্পকালেই সেই পথে এক দল সন্ন্যাসী দেখা দিল। শান্তি তাহাদের সঙ্গে মিশিল।

 তখন সন্ন্যাসীরা এখনকার সন্ন্যাসীদের মত ছিল না। তাহারা দলবদ্ধ, সুশিক্ষিত, বলিষ্ঠ, যুদ্ধবিশারদ, এবং অন্যান্য গুণে গুণবান্ ছিল। তাহারা সচরাচর এক প্রকার রাজবিদ্রোহী রাজার রাজস্ব লুটিয়া খাইত। বলিষ্ঠ বালক পাইলেই তাহারা অপহরণ করিত। তাহাদিগকে সুশিক্ষিত করিয়া আপনাদিগের সম্প্রদায়ভুক্ত করিত। এজন্য তাহাদিগকে ছেলেধরা বলিত।

 শান্তি বালকসন্ন্যাসিবেশে ইহাদের এক সম্প্রদায়মধ্যে মিশিল। তাহারা প্রথমে তাহার কোমলাঙ্গ দেখিয়া তাহাকে গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক ছিল না, কিন্তু শান্তির বুদ্ধির প্রাখর্য, চতুরতা, এবং কর্মদক্ষতা দেখিয়া আদর করিয়া দলে লইল। শান্তি তাহাদিগের দলে থাকিয়া ব্যায়াম করিত, অস্ত্রশিক্ষা করিত, এবং পরিশ্রমসহিষ্ণু হইয়া উঠিল। তাহাদের সঙ্গে থাকিয়া অনেক দেশ বিদেশ পর্যটন করিল; অনেক লড়াই দেখিল, এবং অনেক কাজ শিখিল।

  ক্রমশঃ তাহার যৌবনলক্ষণ দেখা দিল। অনেক সন্ন্যাসী জানিল যে, এ ছদ্মবেশিনী স্ত্রীলোক। কিন্তু সন্ন্যাসীরা সচরাচর জিতেন্দ্রিয়; কেহ কোন কথা কহিল না।

 সন্ন্যাসীদিগের মধ্যে অনেকে পণ্ডিত ছিল। শান্তি সংস্কৃতে কিছু ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছে দেখিয়া, এক জন পণ্ডিত সন্ন্যাসী তাকে পড়াইতে লাগিলেন। সচরাচর সন্ন্যাসীরা জিতেন্দ্রিয় বলিয়াছি, কিন্তু সকলে নহে। এই পণ্ডিতও নহেন। অথবা তিনি শান্তির অভিনব যৌবনবিকাশজনিত লবণ্যে মুগ্ধ হইয়া ইন্দ্রিয় কর্তৃক পুনর্বার নিপীড়িত হইতে লাগিলেন। শিষ্যাকে আদিরসাশিত কাব্যসকল পড়াইতে আরম্ভ করিলেন, আদিরসাশ্রিত কবিতাগুলির অশ্রাব্য ব্যাখ্যা শুনাইতে লাগিলেন। তাহাতে শান্তির কিছু অপকার না হইয়া কিছু উপকার হইল। লজ্জা কাহাকে বলে, শান্তি তাহা শিখে নাই; এখন খ্রীস্বভাবসুলভ লজ্জা আসিয়া আপনি উপস্থিত হইল। পৌরুষ চরিত্রের উপর নির্মল স্ত্রীচরিত্রের অপূর্ব্ব প্রভা আসিয়া পড়িয়া, শান্তির গুণগ্রাম উদ্ভাসিত করিতে লাগিল। শান্তি পড়া ছাড়িয়া দিল।

 ব্যাধ যেমন হরিণীর প্রতি ধাবমান হয়, শান্তির অধ্যাপক শান্তিকে দেখিলেই তাহার প্রতি সেইরূপ ধাবমান হইতে লাগিলেন। কিন্তু শান্তি ব্যায়ামাদির দ্বারা পুরুষেরও দুর্লভ বলসঞ্চয় করিয়াছিল, অধ্যাপক নিকটে আসিলেই তাহাকে কীল ঘুষার দ্বারা পূজিত করিতকীল ঘুষগুলি সহজ নহে। এক দিন সন্ন্যাসী ঠাকুর শান্তিকে নির্জনে পাইয়া বড় জোর করিয়া শান্তির হাতখানা ধরিলেন, শান্তি ছাড়াইতে পারিল না। কিন্তু সন্ন্যাসীর দুর্ভাগ্যক্রমে হাতখানা শান্তির বাঁ হাত; দাহিন হাতে শান্তি তাহার কপালে এমন জোরে ঘুষা মারিল যে, সন্ন্যাসী মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল। শান্তি সন্ন্যাসিসম্প্রদায় পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল।

  শান্তি ভয়শূন্যা। একাই স্বদেশের সন্ধানে যাত্রা করিল। সাহসের ও বাহুবলের প্রভাবে নির্বিঘ্নে চলিল। ভিক্ষা করিয়া অথবা বন্য ফলের দ্বারা উদর পোষণ করিতে করিতে, এবং অনেক মারামারিতে জয়ী হইয়া, শ্বশুরালয়ে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, শ্বশুর স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। কিন্তু শ্বাশুড়ী তাহাকে গৃহে স্থান দিলেন না, জাতি যাইবে। শান্তি বাহির হইয়া গেল।

  জীবানন্দ বাড়ী ছিলেন। তিনি শান্তির অনুবর্তী হইলেন। পথে শান্তিকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কেন আমার গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিলে? এত দিন কোথায় ছিলে?” শান্তি সকল সত্য বলিল। জীবানন্দ সত্য মিথ্যা চিনিতে পারিতেন। জীবানন্দ শান্তির কথায় বিশ্বাস করিলেন।

  অপ্সরোগণের ভ্রূবিলাসযুক্ত কটাক্ষের জ্যোতি লইয়া অতি যত্নে নির্মিত যে সম্মোহন শর, পুষ্পধম্বা তাহা পরিশীত দম্পতির প্রতি অপব্যয় করেন না। ইংরেজ পূর্ণিমার রাত্রে রাজপথে গ্যাস জ্বালে, বাঙ্গালী তেলা মাথায় তেল ঢালিয়া দেয়; মনুষ্যের কথা দূরে থাক, চন্দ্রদেব, সূর্যদেবের পরেও কখন কখন আকাশে উদিত থাকেন, ইন্দ্র সাগরে বৃষ্টি করেন; যে সিন্দুকে টাকা ছাপাছাপি, কুবের সেই সিন্দুকেই টাকা লইয়া যান; যম যার প্রায় সবগুলিকেই গ্রহণ করিয়াছেন, তারই বাকিটিকে লইয়া যান। কেবল রতিপতির এমন নির্বুদ্ধির কাজ দেখা যায় না। যেখানে গাঁটছড়া বাঁধা হইল—সেখানে আর তিনি পরিশ্রম করেন না, প্রজাপতির উপর সকল ভার দিয়া, যাহার হৃদয়শশাণিত পান করিতে পারিবেন, তাহার সন্ধানে যান। কিন্তু আজ বোধ হয় পুষ্পধম্বার কোন কাজ ছিল না—হঠাৎ দুইটা ফুলবণ অপব্যয় করিলেন। একটা আসিয়া জীবানন্দের হৃদয় ভেদ করিল—আর একটা আসিয়া শান্তির বুকে পড়িয়া, প্রথম শান্তিকে জানাইল যে, সে বুক মেয়েমানুষের বুক—বড় নরম জিনিস। নবমেঘনিম্মুক্ত প্রথম জলকণানিষিক্ত পুষ্পকলিকার যায়, শান্তি সহসা ফুটিয়া উঠিয়া, উৎফুল্লনয়নে জীবানন্দের মুখপানে চাহিল।

 জীবানন্দ বলিল, “আমি তোমাকে পরিত্যাগ করিব না। আমি যতক্ষণ না ফিরিয়া আসি, ততক্ষণ তুমি দাড়াইয়া থাক।”

 শান্তি বলিল, “তুমি ফিরিয়া আসিবে ত?” জীবানন্দ কিছু উত্তর না করিয়া, কোন দিক্‌ না চাহিয়া, সেই পথিপার্শ্বস্থ নারিকেলকুঞ্জের ছায়ায় শান্তির অধরে অধর দিয়া সুধপান করিলাম মনে করিয়া, প্রস্থান করিলেন।

 মাকে বুঝাইয়া, জীবানন্দ মার কাছে বিদায় লইয়া আসিলেন। ভৈরবীপুরে সম্প্রতি র্তাহার ভগিনী নিমাইয়ের বিবাহ হইয়াছিল। ভগিনীপতির সঙ্গে জীবানন্দের একটু সম্প্রীতি জন্মিয়াছিল। জীবানন্দ শাস্তিকে লইয়া সেইখানে গেলেন। ভগিনীপতি একটু ভূমি দিল। জীবানন্দ তাহার উপর এক কুটার নির্ম্মাণ করিলেন। তিনি শাস্তিকে লইয়া সেইখানে মুখে বাস করিতে লাগিলেন। স্বামিসহবাসে শাস্তির চরিত্রের পৌরুষ দিন দিন বিলীন বা প্রচ্ছন্ন হইয়া আসিল। রমণীয় রমণীচরিত্রের নিত্য নবোন্মেষ হইতে লাগিল। মুখস্বপ্নের মত র্তাহীদের জীবন নিববাহিত হইত; কিন্তু সহসা সে মুখস্বপ্ন ভঙ্গ হইল। জীবানন্দ সত্যানন্দের হাতে পড়িয়া, সন্তানধর্ম্ম গ্রহণপূর্বক, শান্তিকে পরিত্যাগ করিয়া গেলেন। পরিত্যাগের পর তাহাদের প্রথম সাক্ষাৎ নিমাইয়ের কৌশলে ঘটিল। তাহাই আমি পুর্ব্বপরিচ্ছেদে বর্ণিত করিয়াছি।