আনন্দমঠ (১৯৩৮)/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

 মহেন্দ্র, সত্যানন্দের পাবন্দনা করিয়া বিদায় হইলে, তাঁহার সঙ্গে যে দ্বিতীয় শিষ্য সেই দিন দীক্ষিত হইয়াছিলেন, তিনি আসিয়া সত্যানন্দকে প্রণাম করিলেন। সত্যানন্দ আশীৰ্বাদ করিয়া কৃষ্ণাজিনের উপর বসিতে অনুমতি করিলেন। পরে অন্যান্য মিষ্ট কথার পর বলিলেন, “কেমন, কৃষ্ণে তোমার গাঢ় ভক্তি আছে কি না?”

 শিষ্য বলিল, “কি প্রকারে বলিব? আমি যাহাকে ভক্তি মনে করি, হয়ত সে ভণ্ডামি, নয়ত আত্ম-প্রতারণা।”

 সত্যানন্দ সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ল্লাল বিবেচনা করিয়াছ। যাহাতে ভক্তি দিন দিন প্রগাঢ় হয়, সে অনুষ্ঠান করিও। আমি আশীৰ্বাদ করিতেছি, তোমার যত্ন সফল হইবে। কেন না, তুমি বয়সে অতি নবীন। বৎস, তোমায় কি বলিয়া ডাকিব, তাহা এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করি নাই।”

 নূতন সন্তান বলিল, “আপনার যাহা অভিরুচি, আমি বৈষ্ণবের দাসানুদাস।”

 সত্য। তোমার নবীন বয়স দেখিয়া তোমায় নবীনানন্দ বলিতে ইচ্ছা করে— অতএব এই নাম তুমি গ্রহণ কর। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার পূর্বে কি নাম ছিল? যদি বলিতে কোন বাধা থাকে, তথাপি বলিও। আমার কাছে বলিলে কর্ণান্তরে প্রবেশ করিবে না। সন্তান-ধর্মের মর্ম এই যে, যাহা অবচ্য, তাহাও গুরুর নিকট বলিতে হয়। বলিলে কোন ক্ষতি হয় না।

 শিষ্য। আমার নাম শান্তিরাম দেবশর্মা।

 সত্য। তোমার নাম শান্তিমণি পাপিষ্ঠা।

 এই বলিয়া সত্যানন্দ, শিযযর কাল কুচকুচে দেড় হাত লম্বা দাড়ি বাম হাতে জড়াইয়া ধরিয়া এক টান দিলেন। জাল দাড়ি খসিয়া পড়িল।

 সত্যানন্দ বলিলেন, “ছি মা। আমার সঙ্গে প্রতারণা—আর যদি আমাকেই ঠকাবে ত এ বয়সে দেড় হাত দাড়ি কেন? আর, দাড়ি খাট করিলেও কণ্ঠের, স্বর—ও চোখের চাহনি কি লুকাতে পার? যদি এমন নির্বোধই হইতাম, তবে কি এত বড় কাজে হাত দিতাম?”

 শান্তি পোড়ারমুখী তখন দুই চোখ ঢাকা দিয়া কিছুক্ষণ অধোবদনে বসিল। পরক্ষণেই হাত নামাইয়া বুড়োর মুখের উপর বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “প্রভু, দোষই বা কি করিয়াছি। স্ত্রী-বাহুতে কি কখন বল থাকে না?”

 সত্য। গেস্পদে যেমন জুল।

 শান্তি। সন্তানদিগের বাহুবল আপনি কখন পরীক্ষা করিয়া থাকেন?

 সত্য। থাকি।

 এই বলিয়া সত্যানন্দ, এক ইস্পাতের ধনুক, আর লোহার কতকটা তার আনিয়া দিলেন, বলিলেন যে, “এই ইস্পাতের ধনুকে এই লোহার তারের গুণ দিতে হয়। গুণের পরিমাণ দুই হাত। গুণ দিতে দিতে ধনুক উঠিয়া পড়ে, যে গুণ দেয়, তাকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দেয়। যে গুণ দিতে পারে, সেই প্রকৃত বলবা।”

 শান্তি ধনুক ও তার উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিল, “সকল সন্তান কি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে?”

 সত্য। না, ইহা দ্বারা তাহাদিগের বল বুঝিয়াছি মাত্র।

 শান্তি। কেহ কি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নাই?

 সত্য। চারি জন মাত্র।

 শান্তি। জিজ্ঞাসা করিব কি, কে কে?

 সত্য। নিষেধ কিছু নাই। এক জন আমি।

 শান্তি। আর?

 সত্য। জীবানন্দ। ভবানন্দ। জ্ঞানানন্দ।

 শান্তি ধনুক লইল, তার লইল, অবহেলে তাহাতে গুণ দিয়া সত্যানন্দের চরণতলে ফেলিয়া দিল।

 সত্যানন্দ বিস্মিত, ভীত এবং স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “এ কি; তুমি দেবী, না মানবী?”

 শান্তি করজোড়ে বলিল, “আমি সামান্যা মানবী, কিন্তু আমি ব্রহ্মচারিণী।”

 সত্য। তাই বা কিসে? তুমি কি বালবিধবা? না, বালবিধবারও এত বল হয়; কেন না, তাহারা একাহারী।

 শান্তি। আমি সধবা।

 সত্য। তোমার স্বামী নিরুদ্দিষ্ট?

 শান্তি। উদ্দিষ্ট। তাঁহার উদ্দেশেই আসিয়াছি। সহসা মেঘভাঙ্গা রৌদ্রের ন্যায় স্মৃতি সত্যানন্দের চিত্তকে প্রভাসিত করিল। তিনি বলিলেন, “মনে পড়িয়াছে, জীবানন্দের স্ত্রীর নাম শান্তি। তুমি কি জীবানন্দের ব্রাহ্মণী?”

 এবার জটাভারে নবীনানন্দ মুখ ঢাকিল। যেন কতকগুলা হাতীর শুড়, রাজীবরাজির উপর পড়িল। সত্যানন্দ বলিতে লাগিলেন, “কেন এ পাপাচার করিতে আসিলে?”

 শান্তি সহসা জটাভার পৃষ্ঠে বিক্ষিপ্ত করিয়া উন্নত মুখে বলিল,

 “পাপাচরণ কি প্রভু? পত্নী স্বামীর অনুসরণ করে, সে কি পাপাচরণ? সন্তান- ধর্মশাস্ত্র যদি একে পাপাচরণ বলে, তবে সন্তানধর্ম অধর্ম। আমি তাহার সহধর্মিণী, তিনি ধর্মাচরণে প্রবৃত্ত, আমি তাহার সঙ্গে ধর্মাচরণ কষিতে আসিয়াছি।”

 শান্তির তেজস্বিনী বাণী শুনিয়া, উন্নত গ্রীবা, স্ফীত বক্ষ, কম্পিত ধর এবং উজ্জ্বল অথচ অদ্ভুত চক্ষু দেখিয়া সত্যানন্দ প্রীত হইলেন। বলিলেন,

 “তুমি সাধ্বী। কিন্তু দেখ মা – পত্নী কেবল গৃহধর্ম্মেই সহধর্মিণী-বীরধর্ম্মে রমণী কি?”

 শান্তি। কোন্ মহাবীর অপত্নীক হইয়া বীর হইয়াছেন? রাম সীতা নহিলে কি বীর হইতেন? অর্জুনের কতগুলি বিবাহ গণনা করুন দেখি। ভীমের যত বল, ততগুলি পত্নী। কত বলিব? আপনাকে বলিতেই বা কেন হইবে?

 সত্য। কথা সত্য, কিন্তু রণক্ষেত্রে কোন্ বীর জায়া লইয়া আইসে?

 শান্তি। অর্জুন যখন যাদবী সেনার সহিত অন্তরীক্ষ হইতে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কে তাঁহার রথ চালাইয়াছিল? দ্রৌপদী সঙ্গে না থাকিলে, পাণ্ডব কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুঝিত?

 সত্য। তা হউক, সামান্য মনুষ্যদিগের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত এবং কার্য্যে বিরত করে। এই জন্য সন্তানের ব্রতই এই যে, রমণী জাতির সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবে না। জীবানন্দ আমার দক্ষিণ হস্ত। তুমি আমার ডান হাত ভাঙ্গিয়া দিতে আসিয়াছ।

 শান্তি। আমি আপনার দক্ষিণ হস্তে বল বাড়াইতে আসিয়াছি। আমি ব্রহ্মচারিণী, প্রভুর কাছে ব্রহ্মচারিণীই থাকিব। আমি কেবল ধর্ম্মাচরণের জন্য আসিয়াছি; স্বামিসন্দর্শনের জন্য নয়। বিরহ যন্ত্রণায় আমি কাতরা নই। স্বামী যে ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন, আমি তাহার ভাগিনী কেন হইব না? তাই আসিয়াছি।

 সত্য। ভাল, তোমায় দিন কত পরীক্ষা করিয়া দেখি।

 শান্তি বলিলেন, “আনন্দমঠে আমি থাকিতে পাইব কি?”

 সত্য। আজ আর কোথা যাইবে?

 শান্তি। তার পর?

 সত্য। “মা ভবানীর মত তোমারও ললাটে আগুন আছে, সন্তানসম্প্রদায় কেন দাহ করিবে?” এই বলিয়া, পরে আশীর্ব্বাদ করিয়া সত্যানন্দ শান্তিকে বিদায় করিলেন।

 শান্তি মনে মনে বলিল, “র বেটা বুড়ো! আমার কপালে আগুন! আমি পোড়াকপালি, না তোর মা পোড়াকপালি?”

 বস্তুত সত্যানন্দের সে অভিপ্রায় নহে—চক্ষের বিদ্যুতের কথাই তিনি বলিয়াছিলেন, কিন্তু তা কি বুড়ো বয়সে ছেলে মানুষকে বলা যায়?