আমার আত্মকথা/আঠার

উইকিসংকলন থেকে

আঠার

 বরোদায় স্নিগ্ধ শান্ত রসাক্ত দিনগুলি আমার জীবনে এনেছিল নিরবচ্ছিন্ন আরাম, প্রচুর অবসর, নিরিবিলি নিরুদ্বিগ্ন একটানা সুখ, মৃগয়ার উত্তেজনা, কবিতা ও উপন্যাস লেখার অনাবিল আনন্দ আর আমার ছোট্ট বাগানটির মাঝে কৃষিকার্য্যে সখটুকু মেটাবার তৃপ্তি। এর বেশী তখনকার দিনে আর বেশী কিছু আমি চাই নি। ‘মিলনের পথে’ তখন আমি লিখছি,—অবশ্য পরে ছাপাবার আগে ওকে খোল নলচে সমেত বদলে একেবারে নতুন করে ঢেলে সেজেছি। তবু তার প্রধান চরিত্রগুলির কাঠামো তখনকারই সৃষ্টি, পরে শুধু তাদের ওপর রঙ ফলেছে বিস্তর, দোমেটো হবার সময় একটু আধটু করে তারা বদলেছেও অনেকখানি। তখন কি যে মাথামুণ্ডু কবিতা লিখতুম তা’ আর এখন একটাও বেঁচে বর্ত্তে নেই, একটা কাব্য লিখছিলুম বেশ বড় রকমের, কতকটা মাইকেলী ঢঙে, তবে অমিত্রাক্ষরে নয়।

 বরোদায় আমি বোধ হয় তিনবার গিয়েছিলুম। প্রথমবার যখন যাই তখন সেখানে দিদি ও সেজবৌদি ছিলেন না বলেই মনে হয়। তখন এবং আবার যখন দিদি বৌদি’ ও সেজ মামীকে নিয়ে দেওঘর থেকে পুজার ছুটীর পর বরোদায় (সেজদা’র সঙ্গে) আমি ফিরি তখনও আমাদের অবসর বিনোদন হতো প্লাঞ্চেট নিয়ে। প্লাঞ্চেট হচ্ছে দু’টো বোতামের মত পায়ার ওপর তে-কোণা কিম্বা পানের আকৃতির একটা কাঠ, তার এক দিকের ছিদ্রে একটা পেন্সিল লাগানো থাকে। কাঠটার ওপর দু’জনে হাত রাখলে ওটা ক্রমশঃ চলে এবং পেন্সিল দিয়ে লিখতে থাকে। যে শক্তি এসে হাতে ও প্লাঞ্চেটে ভর করে লেখে সে কখন বলে “আমি রামমোহন রায়,” কখন বলে “আমি নিত্যানন্দ সরকারের পিসী, দত্তদের শালখের বাড়ীর বেলগাছে আছি” ইত্যাদি। টেবিল বা প্লাঞ্চেটে হাত রাখলে হাত যে আপনি চলে তা’ কোন কোন ক্ষেত্রে সত্যি, কিন্তু সে শক্তি যে কি—আমাদেরই অবচেতনার খেলা বা কোন পারলৌকিক জীবাত্মা বা ভূতের কারসাজি তা বলা শক্ত। আমি এই সময় স্পিরিচুয়ালিষ্টদের বেদ মায়ার্সের প্রচণ্ড বই দু’খান। Human Personality পড়ে ফেলেছিলুম, সার কোনান ডয়েল ইত্যদির কথাও ঢের দেখেছি, কিন্তু কাউকে ঠিক ঠিক প্রমাণ করতে দেখি নি যে এই সব খেলা সত্যিই পারলৌকিক জীবের খেলা। প্লাঞ্চেটে কিছু একটা শক্তি এসে মৃক্ত কোন আত্মীয়ের নামে হুবহু পূর্ব্ব ঘটনা বলছে, এতে প্রমাণ হয় না যে ভূতে বা প্রেতাত্মায়

বলছে, আমাদের অবচেতনা বা ঊর্দ্ধচেতনায় এমন সব অলৌকিক শক্তি ও বৃত্তি আছে যার প্রকাশে অসম্ভব সম্ভব হতে পারে। টেলিপ্যাথি ও টেলিভিশন যখন আজ প্রায় সর্ব্ববাদী সম্মত ব্যাপার তখন ঐ ধরণের আরও কতনা বিচিত্র কাণ্ড থাকতে পারে এই অখণ্ড চৈতন্যময় জগতের গোপন স্তরে স্তরে।

 শ্রীঅরবিন্দের ‘Yoga and its Objects’ বইখানা তাঁর নিজের লেখা নয়, তিনি পেন্সিল ধরতেন আর এক অদৃশ্য শক্তি এসে লিখে যেত; রামমোহন রায়ের নামে এই ভাবে আগাগোড়া বইখানি পাওয়া গিয়েছিল; যখন এই ঘটনা ঘটে তখন অবশ্য আমি আন্দামানে। বরোদায় আমরা যত জন বসতুম তার মধ্যে সেজদা ও আমার হাতেই এইভাবে লেখা আসতো বেশী। একদিন স্বয়ং তিলক এসে নানা প্রশ্ন করে যান, তখন আমার হাতে পেন্সিল ছিল। তার আগের দিন একজন দূরদেশবাসী মারাঠার মৃতা আত্মীয়া এসে সেই মারাঠা ভদ্রলোককে বলে গেছিল তাঁদের পৈতৃক বাসভবন কোথায় কি ভাবে ভাঙা ও বাড়ানো কমানো হয়েছে; প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে সেগুলি হুবহু মিলে গেছিল।

 প্রতিদিন আমরা কি একটা যেন নেশা ও ঝোঁকের মাথায় দু’তিন ঘণ্টা ধরে এই কার্য্য করতুম এবং সেই দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে কত রামকৃষ্ণ, ফাদার দামিয়ন, কৃষ্ণদাস পাল, কত মৃতা ভূতযোনিপ্রাপ্তা পিসী মাসী, ঠাকুরদা, বন্ধু বান্ধব এসে দেড় টাকার প্ল্যাঞ্চেটের প্রসাদাৎ আমাদের সঙ্গে আলাপ আপ্যায়ন করে প্রাণ জুড়িয়ে যেতেন তার তো হিসাব হদিস্ ছিল না, তাঁদের কত কথাই সত্য ঘটনার সঙ্গে মিলতো না, কত আবোল তাবোল প্রলাপ কখনও আমরা অম্লান বদনে হজম করে যেতুম কিন্তু তাতে সে সব স্পিরিটদের খ্যাতি প্রতিপত্তি আমাদের কাছে যে বিশেষ কমতো তা’ নয়। শ’ দু’শ message পারলৌকিক বাণীর মধ্যে দশটা মিললেই ভূতযোনির ওপর বিশ্বাসের পারা অমনি চড়চড় করে পাঁচ ডিগ্রি উঠে যেত। আমাদের দেশে এবং যে কোন দেশে এত হাতুড়ে কবিরাজ ডাক্তার, এত বুজরুগ সন্ন্যাসী গণক, এত অগণ্য গুরুপুরুত যে করে খাচ্ছে তার কারণই মানুষের প্রাণের এই অন্ধ বিশ্বাস প্রবণতা। আগা এবং পাছতলার অংশটুকু ছিঁড়ে বাদ দেওয়া জীবনের এই মাঝের পাতাটুকুর অর্থ এবং রহস্য জানবার জন্যে আমাদের এমনই ব্যাকুলতা যে কোন একটা কিছু বিশ্বাস করবার জন্যে আমরা যেন ব্যাকুল হয়েই আছি। অন্ধ যেমন একটা কিছু লাঠি বা একজন কারুর হাতের ভর পেলেই তার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বেঁচে যায়, কালের পথে অন্ধ আমরা তেমনি কাউকে যা হোক কর্ণধার হিসেবে পেলেই বেঁচে যাই। সে শুধু কপা করে বললেই হ’লো যে সে সবজান্তা ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষ।

 আমাদের সত্তা হচ্ছে মেঘস্পর্শী গিরিশৃঙ্গের মত—মাটির তলায় যার মূল ও ভিত্তি রয়েছে কতনা দূর অবধি স্তরে স্তরে লুকানো আর মেঘলোকের উপরে ঢাকা রয়েছে যার সূর্য্যালোকে উজ্জ্বল ভাস্বর চূড়ার পর চূড়া; মনের উপরে স্তরে স্তরে কতই না চেতনার ভূমি উঠে গেছে ধ্রুব থেকে ধ্রুবতর আলোর এবং জ্ঞানের জগতে—অর্দ্ধজ্ঞানে অর্দ্ধ অজ্ঞানে আলো আঁধারী এই বস্তুতন্ত্র মন যার ছায়া যাত্র। নীচের দিকেও তাই অবচেতনার মাঝে ঘুমের স্বপ্নের instinctএর কত না আবরণে মোড়া ঘুমন্ত জ্ঞানস্তর সব রয়েছে যার মাঝে হাতড়ালে ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমানের সব কিছু হারাণো ঘটনা এবং তার নিখিল রহস্য-পেটিকা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এই সব গুপ্ত জ্ঞানের কোন্ ভূমি থেকে বিদ্যুৎ চম্‌কালো—কোন্ অতিমানস বা অবমানস লোক থেকে বেতারা সংবাদ মনের যন্ত্রে এসে বেজে উঠলো তা বলা অনেকখানিই জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে, স্থূলবুদ্ধি অন্ধ মানুষই নিজের মনের বা প্রাণের আকাঙ্ক্ষার সুরে মুগ্ধ হয়ে তার নাম দেয় ভূত, মিরাকল ইত্যাদি।

 নিত্য এই ভূতলোকের অস্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা ছাড়া আমার আর এর কাজ ছিল—ভাঙা এস্রাজটিকে আমার কোন গতিকে চলনসই গোছের সুর বেঁধে নিয়ে মাঝে মাঝে বাজাতে বসা। ঢাকায় থাকতে মেজবৌদির বাজনা শেখাবার ওস্তাদ বিখ্যাত ভগবান সেতারীর কাছে আমার যৎসামান্য শেখা বিদ্যাটুকুই এই নিত্য ভাবে উদ্বেগ প্রাণের ছিল একটা মস্ত বড় safety valve। জোয়ার-ভাঁটায় সমুদ্রের কাছাকাছি নদীগুলির অবস্থার মত অনন্তের সঙ্গে যুক্ত আমাদের এই মন প্রাণ হৃদয়ে দিনে রাতে কত না সুখ দুঃখ আনন্দ নিরানন্দের জোয়ার এবং ভাটার ঢেউ ও বেগ জাগছে; সংসারে আমরা সেগুলি কাটাবার ভোগ সামগ্রী—স্ত্রী পুত্র আত্মীয় বন্ধু পাই বলেই ক্ষেপে যাইনে। কলা শিল্প সঙ্গীত এ সব হচ্ছে রূপ ও রস জগতের জোয়ারের তরঙ্গ, ঐ পথে তারা এই স্থূল জগতে নেমে আসে। গুটি দশ বার গৎ ছিল আমার সম্বল আর ছিল সস্তা স্বরলিপির বই; তাই নিয়ে আমার সঙ্গীতচর্চ্চা অদম্য উৎসাহে দিদি ও বৌদিকে মুগ্ধ করে অবাধে চলতো। আসলে বাজনাটা তবু তাল সুর কেটে কোন গতিকে বাজাতে পারলেও কণ্ঠসঙ্গীতে আমি ছিলুম একটি আস্ত “পদ্ম আঁখি আজ্ঞা দিলে আমি পদ্ম বনে যাব”, জাতীয় জীব। প্রাণভয়ে আজও আমি লোকালয়ে বিশেষতঃ রজকালয়ের কাছাকাছি কখনও গলা ছেড়ে গান গাই নি, এতটুকু বুদ্ধি ও আত্মজ্ঞান আমার আছে।

 বিকেলের দিকে বরোদার পার্কে বেড়াতে যেতুম, রাজপুরাঙ্গনারা আঁটসাঁট বদ্ধ ঢাকা ব্রুহামে বা মটর কারে বস্তাবন্দী হয়ে ব্যাণ্ড শুনতে আসতেন। দু’ চার জন তন্বী গৌরাঙ্গী পার্শী মেয়ে হাত ধরাধরি করে ছেলেদের মধ্যে রূপ ও লাবণ্যের টানা ও পোড়েন দিয়ে দিয়ে পায়চারি করতেন, দর্শকদের মুগ্ধ প্রাণের তাঁতে মোহের সূক্ষ্ম চিনাংশুকখানি বুনতে বুনতে। রূপ-ক্ষুধাতুর চোখে এই সব দুর্ল্লভ মেনকা তিলোত্তমাদের চেয়ে চেয়ে দেখাই ছিল তখনকার দিনে একটা মস্ত দরকারী কাজ, যেদিন পার্কে যাওয়া বাদ পড়ে যেতো সে দিনটা বুকের মাঝে একটা খাঁ খাঁ করা শূন্যতা রেখে যেত। আসলে প্রথম যৌবনে যতদিন নারী-সঙ্গসুখ অদৃষ্টে ঘটেনি ততদিন দিল্লীকা লাড্ডুর পশ্চাতে ছোটার এই অবস্থাটি যে কি পর্য্যন্ত প্রাণান্তকর ছিল তা’ ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন; একে তো পর্দ্দা ও ঘোমটায় ঢেকে নারীকে করে রাখা হয়েছে দুর্ব্বার মোহের বস্তু, তার ওপর ঐ বয়সটিতেই প্রথম বসন্ত স্পর্শে রসাপ্লুত নব-মুঞ্জরিত প্রাণ আমাদের হয়ে ওঠে একান্তই লোভী ও ক্ষুধাতুর। তখন যে দু’চারটি মেয়ে দৈবাৎ চোখে পড়েন তাঁদের রূপ দূর থেকে গোগ্রাসে গেলা ছাড়া আমাদের দেশের যুবকদের উপায়ান্তর থাকে না, তাদের দেখেও যতখানি বিড়ম্বনা না-দেখেও ততখানি।

 যে সব দেশে নারী ও পুরুষের সম্বন্ধটা যৌনভয়ে এমন আড়ষ্ট নয়, ছেলেবেলা থেকে যে দেশের ছেলে মেয়ে সহজভাবে মেলামেশা করতে পায়, সে সব দেশে গা-সওয়া হয়ে নারী তার মোহিনীরূপ ত্যাগ করে কতকটা কেন অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়ায়, পুরুষের চোখে সেও হয় শেষে গুণে নিতান্তই সাধারণ মানুষ, রহস্যে ঘেরা আমাদের দুষ্প্রাপ্য চাঁদা মামা নয়। কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে ছেলে মানুষী ভাবে দু’চার বার প্রেমে পড়ে হৃদয় হারিয়ে ঘা খেয়ে খেয়ে সে সব দেশের পুরুষ যখন উঠে দাঁড়ায় তখন তার মোহের ঘোর অনেকটা কেটে গেছে, সে একটা সহজ ছন্দ ও balance পেয়ে সতর্ক হয়েছে, হৃদয়াবেগ ধারণ ও সংযত করবার কৌশল আয়ত্ত করেছে। আমার জীবন দিয়ে বাঙালীর ছেলের নারী-বঞ্চিত জীবনের হাহাকারটার ইতিহাস এবং সুফল ও কুফল বেশ পাঠ করার সুযোগ ঘটে। কারণ, নানা ঘটনা চক্রে পড়ে নারীর সঙ্গে চরম সম্বন্ধটি আমার সারা যৌবনটা পেরিয়ে ৪৬।৪৭ বৎসর বয়স অবধি ঘটে নি। অথচ আমার দেহে মনে প্রাণে তার প্রয়োজন, তার লিপ্সা ও ক্ষুধা, তার ডাক এত প্রবল ছিল যে, সে তীব্রতা আমাকে কবি করে ছেড়েছিল। রসায়ন শাস্ত্রে সোণা তৈরী করতে হ’লে, মকরধ্বজ তৈরী করতে হ’লে নানা ধাতু ও উপাদান মিশ্রিত রসকে যেমন বহুক্ষণ ধরে—কতই না দিবাযামিনী আগুনে পাক করতে হয় মানুষের হৃদয় মন প্রাণের রসবস্তুকেও তেমনি অনির্ব্বাণ রাবণের চিতার মত আগুনে ফেলে দীর্ঘকাল পাক না করলে তা থেকে কবিত্ব ও প্রতিভার অমন সোণালী বস্তুটি লাভ হয় না। এক এই কারণ ছাড়া আমাকে এতদিন ধরে নারী সংসর্গ থেকে উপবাসী রাখার আর কোন সার্থকতা আমি দেখি নে।

 আমার স্বভাবে নারীকে দুর্ব্বার টানের বস্তু করবার কত যে উপাদান ও কারণ আমার জীবনে বর্ত্তমান তা’ একবার ভেবে দেখুন। প্রথম জন্মাধিকার সূত্রে প্রবল কামশক্তি আমি পেয়েছিলুম। দ্বিতীয়, আমার কবিত্ব শক্তি যা মানুষের চোখে সুন্দরকে নানাভাবে দেখায় তার রহস্যময় আবরণটি পরদায় পরদায় তুলে, তার অবগুণ্ঠন সরিয়ে সরিয়ে। রূপ, সুষমা ও আনন্দের কুবের ভাণ্ডার এই জগতে থরে বিথরে কত যে অপর্য্যাপ্ত সাজানো রয়েছে তা’ সহজ সংসারী মানুষ সাদা চোখে সব দেখতে পায় না, সে সব নিঃশেষে দেখতে পায়— কেবল সেই সুন্দরের ঋষি যার চোখে জ্ঞানের ও কবি-প্রতিভার অঞ্জন বিধাতার তুলির টানে জন্মাবধি মাখানো রয়েছে।

 তৃতীয়তঃ, আমি হচ্ছি স্বভাবতঃ রাজসিক পুরুষ, রজঃশক্তির বিপুল উৎস বুকে ও নাভিমূলে নিয়ে আমার জন্ম ও জীবনধারণ, যার বেগ বোমা থেকে আরম্ভ করে এতগুলি অসাধ্য সাধনের দিকে সারাটা জীবন আমাকে ক্রমাগতঃ ঠেলে নিয়ে গিয়েছে। আগেই বলেছি বাল্যকালে আমারই খেলার সাথী মাসতুতো ভাই হুপো বা অবিনাশ যে অসংযমের ফলে albumeneria হয়ে মারা গেল আমি ঠিক ততখানি অসংযমের মুখেও এই ক্ষীণ দেহ যষ্টিখানি অটুট রেখে বেরিয়ে এলুম। তার পরেও সারা বয়সটা জুড়ে নারীর আশায় আশায় কম শক্তিক্ষয় হয় নি, তবু কিন্তু এ শরীর ভাঙলো না। এক একবার মত্ততায় ক্লান্তিতে বহু দিন-রজনী কাটিয়ে যখন উঠেছি তখন বোধ হয়েছে এইবার বুঝি দেহ যায় কিন্তু দু’চার দিনে এমন বল ও স্বাস্থ্য কোন্ অদৃশ্য প্রাণ সমুদ্রের মোহানা থেকে কুল কুল বেগে বয়ে এসে শ্রান্ত দেহ মনকে সজীব করে তুলেছে যে, আমি নিজেই আশ্চর্য্য হয়ে গেছি। এ থেকেই বোঝা যায় আমার রাজসিক ধাতুতে গড়া দেহ-প্রাণের স্বাভাবিক তেজ ও শক্তির পরিমাণ অপরিমেয়।

 খুব বড় করে জ্বালা আগুনের কুণ্ড যেমন কলাগাছটাও নিজের তেজে ভস্ম করে শত অম্লান শিখায় জ্বলতে থাকে তেজস্বী প্রাণবান পুরুষরাও হয় ঠিক সেই রকম। যে রূপমুগ্ধ ভোগলোলুপ দুর্ব্বার প্রাণশক্তি নারী ও সুরার মাঝে কবি চিত্তরঞ্জনকে ভোগবিলাসী করে রেখেছিল সেই শক্তিই মুহূর্ত্তের আবেগে ঊর্দ্ধমুখী হয়ে তাঁকে করে তুললো সর্ব্বত্যাগী দেশবন্ধু। যেখানে সব চেয়ে উঁচু আকাশস্পর্শী গিরিচূড়া নিজ মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে তারই পাশে থাকে পাতাল-ছোঁয়া অতলগর্ভ খাদ। তাই শাস্ত্রে বলে ‘তেজিয়াংশ্চ ন দোষায়’। তাই মানব জীবনের ইতিহাসের পাতায় এত বড় বড় কবি, দেশকর্ম্মী, বীর ও চিত্রকরদের পাই এতখানি উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতিমূর্ত্তি রূপে। তাঁরা উদ্বেল তরঙ্গমুখর প্রাণসিন্ধু বুকে ধরে তার রেগ সব সময় সামলাতে পারবেন না সেটা কি খুব বেশী আশ্চর্য্য ব্যাপার? ক্ষুদ্রপ্রাণ ক্ষুদ্রশক্তি মানুষের পক্ষে শাস্ত্রভয়ে লোকভয়ে বিধি-নিষেধের ভয়ে গোপাল সুবোধ বালক সেজে চলা সহজ, কারণ—তাদের পিছনে খুব বড় শক্তির তাড়া নেই, ভাল বা মন্দের ক্ষুধা তাদের একটুখানি।

 যাই হোক, এই প্ল্যাঞ্চেটী ব্যাপারে ক্রমশঃ আমাদের জীবনের নদীপথে তরীখানি বাঁক নিয়ে আবার অন্য পথে চলবার আয়োজন করে নিলো। রামমোহন কি বিবেকানন্দ বা অমনি কে এসে ক্রমাগত বক্তৃতা দিয়ে আমাদের উত্তেজিত করতে লাগল দেশে নব আনন্দমঠে সন্তান-সেনা গড়বার জন্যে। তখন মহারাষ্ট্রের গুপ্তসমিতির নেতা ঠাকুর সাহেব জাপানে, গুজরাটের গুপ্তচক্রের দেশপতি (প্রেসিডেণ্ট) বরোদায়ই আছেন। তাঁর কাছে আদেশ পেয়ে বরোদা সেনা-বিভাগের কাজ ছেড়ে দিয়ে যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকেতায় চলে গেছেন এবং সেখানে গুপ্ত-সমিতি গড়ে তুলেছেন। আমার ডাক পড়লো বাঙলা দেশের তরুণদের ও ছাত্র-সমাজের মনের ভূমিতে স্বাধীনতার বীজ বপন করবার জন্যে; যতীনদা’ কয়েকজন মাতব্বর ধরে টাকারই নাকি ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, তরুণদের হৃদয় জয় করতে পারেন নি। আমাকে বাঙলা দেশে গিয়ে সেইটি করতে হবে। পোষা হাতি দিয়ে যেমন করে হাতি ধরে গন্‌গনে আগুনে গড়া আমার তরুণ প্রাণের ছোঁয়াচ লাগিয়ে তেমনি তরুণ ধরবার ব্যবস্থার জন্যে গুপ্তমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে আমাকে দেশে পাঠান হল।