আমার আত্মকথা/এগার

উইকিসংকলন থেকে

এগার

 তারপর রোজ স্কুলের ছুটির পর এবং কখন কখন স্কুল থেকে পালিয়ে রাঙা মায়ের কাছে পাণ্ডার বাড়ীতে আমার হাজরে দেওয়া অবাধে চলতে লাগল। দশ পনর দিন সেখানে থেকে তারপর পাষাণে বুক বেঁধে মা আবার কলকেতায় ফিরে গেলেন। সেই সময়ে এবং পরে মায়ের মুখে শুনেছিলুম আমাদের ছিনিয়ে নেবার পর বাবার আমলের এই পুরাতন চাকর রামরাজ ছাড়া আর কেউ অসহায় নির্ব্বান্ধব মাকে আমার দেখে নি। যতদিন না মা বৈঠকখানা অঞ্চলে একটি বাড়ী কিনে ঘর বাঁধলেন এবং আমার বন্ধু সুরেন মায়ের ভার নিল ততদিন রামরাজ তাঁকে আগলে ছিল, ছেড়ে ততদিন কোথায়ও যায় নি।

 এরপর দ্বিতীয়বার যখন মা দেওঘরে এলেন তখন মায়ের অর্দ্ধ অঙ্গ পক্ষাঘাতে পড়ে গেছে, জ্বর বিকারে তিনি বেহুঁস ও অচেতন। সুরেন ঠিক কচি ছেলের মত কোলে সেই জ্বর বিকারের রোগীকে ট্রেন থেকে দেওঘরে নামিয়ে নিল, পোষ্ট অফিসের কাছাকাছি একটি বাড়ী ভাড়া করে মাকে রাখা হ’লো। সেবার দেওঘরে তাঁকে কয়েকমাস থাকতে হয়েছিল। জ্বর ত্যাগ হয়ে শরীরে বল এসে কবিরাজী চিকিৎসায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহ কতকটা সুস্থ হলে পর মা আবার কলকেতায় ফিরে গেলেন। তার অনেক পরে রামরাজকে দেখেছি কলকেতার শেরিফের তকমা ঝুলিয়ে সুকিয়া স্ট্রীটে শেরিফ সাহেবের বাড়ীর দরজায় বসে থাকতে। আমি তখন বেকার অবস্থায় ঘর সংসার আত্মীয় স্বজন ছেড়ে কলকেতার মেসে বাস করছি আর সংবাদপত্রে ওয়াণ্টেড কলম দেখে দেখে মরিয়া হয়ে আবেদন নিবেদন ঝাড়ছি। এহেন নিঃস্ব আমাকে দেখলেই সে উঠে দাঁড়িয়ে ধনীর দুলালের প্রাপ্য সসম্ভ্রম অভিবাদন জানাত।

 মা দ্বিতীয়বার দেওঘরে থাকতে একদিন কানা ঘুষায় তা’ শুনতে পেয়ে দিদিমা আমাকে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করে বসলেন। আমি স্বীকার করে বললুম, যে, হাঁ, রোগ হয়ে মা চেঞ্জের জন্যে এসেছেন দেওঘরে। তখন দিদিমা বললেন “আমরাও সেদিন দেখেছি, আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে খোলা ফিটনে বিবি সেজে যাচ্ছিল।” শুনে তো আমি পেটের হাসি চেপে রাখতে পারি নে। অনাথিনী মা আমার একবস্ত্রে বিধবার বেশে কত নিষ্ঠায় জীবনটা কাটিয়ে দিলেন আর তাঁকে কিনা এরা দেখলো খোলা ফিটনে বিবির বেশে! সমস্ত দিন ধরে গোটা পরিবারটা মিলে সে কি জটলা, কি ঘোঁট। অন্তঃপুরে বাঁধা একঘেয়ে জীবনে এমন মুরোচক চাটনী বড় একটা সচরাচর জোটে না; যদি বা ভাগ্যক্রমে জুটেই গেল তাকে কি ছাড়া যায়, জল্পনায় কল্পনায় ঘোরাল রসাল করে তাকে জিবে উল্টে পাল্টে চেটে উপভোগ তো করে নিতেই হবে। বৈদ্যনাথে দিদিমার বাড়ীর এই কুপমণ্ডূক পরিবারটির এই রকম পরচর্চ্চার খোরাক আমি জীবনে অনেকবার জুটিয়েছি, পুরো বিপ্লবী হয়ে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে তো “বেরেটার কীর্ত্তি”ই ছিল এদের সান্ধ্য বৈঠকের ঘোট পাকাবার বিষয়। সে সব বৈঠকে তিল হ’তো তাল, স্বয়ং বড়মামা ভিতরে বারাণ্ডায় লম্বা লম্বা পা ফেলে অবিশ্রান্ত পায়চারি করতেন এবং ফোড়ং কেটে কেটে জল্পনারত মেয়েদের কাছে ‘বেরেটার’ কারসাজি রঙিয়ে ফলিয়ে উজ্জ্বল করে তুলতেন। ‘আমি দিব্যচক্ষে দেখছি ওকে একদিন ধরে আম গাছে লটকে দেবে’—বলে এমন কালো tragic রঙে বড়মামা আমার ভাবী দুরদৃষ্ট ও দুর্গতির ছবি আঁকতেন যে সবাই ভীত কণ্টকিত শরীরে মহা পুলকে তাতে সায় না দিয়ে পারতো না। বড়মামার মনটা ছিল ইংরাজ-বিদ্বেষী প্যাট্রিয়ট আর প্রাণটা ছিল তখনকার সাবধানী বাক্যবাগীশ ভীরু বাঙ্গালী। তার ওপর আড্ডা দেবার লোভ তাঁর ছিল প্রচণ্ড, ইংরেজের বিপুল শক্তি আর আমাদের ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দ্দারী ভেবে তিনি হয়ে পড়তেন যেন একেবারে স্নেহকাতর ভীত পিসীমাটি।

 অকল্যাণ, অপযশ, বিপদ আপদের একটা দুর্দ্দমনীয় টান আছে; কাজেই পরের ভাগ্যে সে রকম একটা কিছু ঘটলে পাড়াপড়শীর পক্ষে তা’ হয় একটা চাপা আনন্দের ঘটনা। পরম আত্মীয়ের জীবনে ঘটলেও তা সুখদুঃখ মিশ্রিত একটা উৎকট টানের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। ‘আমার ছেলেটি যায় যায়’— একথা ভাবতে এবং তা’ ক্রমাগত ভেবে ভেবে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে মা বাপের একটা তীব্র অস্বাভাবিক সুখ হয়; এমনি করে দুঃখকেও মানুষ অহরহ ভোগ করছে; এই জন্যে ট্রাজেডিই মানুষের জীবনের সব চেয়ে রসঘন বস্তু, ট্রাজেডি না হলে নাটক জমে না, ট্রাজেডি বিনা ফিল্মকে দিয়ে শ্রোতাকে thrill দেওয়া শক্ত হয়, কারণ হাসি ও কান্না একই স্নায়বিক উত্তেজনার দু’টো এবং কান্নাটাই তার মধ্যে সব চেয়ে স্নায়ু-সুখকর ও উত্তেজক ব্যাপার। ‘পাতালপুরের দুয়ার’ গল্পে এই দুঃখের অকল্যাণের ডাক যে কত সম্মোহন তা’ কতকটা দেখিয়েছি।

 দরবারী কাহার ছিল দেওঘরে পুরন্দাহায় পাল্কীবেহারাদের চাঁই, সে ও তার ভাই বনোয়ারী ও আস্রফিয়া আমাদের বাড়ী মাঝে মাঝে চাকরী করতো। মাকে একবার নন্দন পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবার সময় এই দরবারীদের পাল্কী ভাড়া করা হয়, তাদেরই মুখে দিদিমারা মায়ের দেওঘর আসার খবরটা পান। আমার নিজের গর্ভধারিণী মা থাকতেন রোহিণীতে একা, তারিণী বাবুদের বাড়ীতে, তা’ আগেই বলেছি। মাসান্তে এক আধবার রবিয়া বা আস্রফিকে সঙ্গে নিয়ে আমি মাকে দেখে আসতুম। একবার পাল্কী করে গিয়ে ফিরবার পথে রাত হয়ে যায়, একে অন্ধকার রাত, তায় উঠলো প্রচণ্ড ঝড় ও মুসলধারে বৃষ্টি। দরবারীরা পাল্কী নিয়ে দাড়োয়া নদীর ধারে এসে দেখলো নদীতে বিপুল বাণ এসেছে, একূল ওকূল ভরা দুর্ব্বার তরঙ্গক্ষুব্ধ ঘোলা জল, তাতে নামে কার সাধ্য। তখন মাঠে ধান ক্ষেতের আলে আলে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে কোন গতিকে বিদ্যুতের আলোয় পথ দেখে দুই ক্রোশ দূরে ব্রিজের ওপর আসা গেল। পাল্কী সমেত অতি সন্তর্পণে ব্রিজ পার হয়ে বাড়ী পৌছান গেল, তখন রাত বারটা। আর একবার এমনি দুর্য্যোগে পড়েছিলুম বাবার সঙ্গে খুলনায়। বাগেরহাটে কোথায় এক গ্রাম্য স্কুলে বাবা গেছিলেন পারিতোষিক বিতরণে সভাপতি হয়ে, আমি গেছিলুম সঙ্গে। ফিরতি পথে থালে থালে ভরা মেঠাই-মণ্ডায় আমাদের নৌকো বোঝাই করে আধপথে আসতে না আসতে ঝড় উঠলো। নৌকা ডুবু ডুবু দেখে এক আঘাটায় নৌকো বেঁধে আমাকে পাল মুড়ি দিয়ে ডাঙ্গায় বসিয়ে রাখা হ’লো, ঝড় থামলে আমরা ভিজে তোয়ালে পরে বাড়ী এলুম। সেই থেকে কেমন এক রকম হয়ে গেছে; সত্তার স্নায়ুমণ্ডলে কোথায় একটা ভয়ের ছাপ পড়ে আছে, ভিজে পূবে বা উত্তরে হাওয়া অন্ধকার রাত্রে মাঠের পথে বইলেই কেমন একটা অসহায় ভাব মনে জাগে, বুক গুর গুর করতে থাকে।

 দ্বিতীয়বার রোগ সেরে মা চলে গেলেন। স্নিগ্ধ ঝির ঝিরে ঊষায়, মহুয়ার গন্ধে, মহিষ চড়া মেঠো রাখালের বাঁশীতে, মাঠ ছাওয়া পলাশের রক্তিমায় আরো দু’তিন বছর আমার কেটে গেল। ইতিমধ্যে বিলেত থেকে দাদা দেশে এলেন, তার পরে এলেন সেজদা, সব শেষে এলেন মেজদা’। যতদূর মনে আছে দেশে এসে মেজদাই আগে দেওঘরে আসেন, দাদা আসেন সব শেষে। সেজদা শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে দাদাবাবু রাজনারায়ণ বসুর খুব মনের মিল হয়েছিল, মেজদা কিন্তু বাঙলা ভাষাকে monkeys jabber বলাতে দাদাবাবুর সঙ্গে তাঁর ভাব গোড়াতেই চিড় খেয়ে গেল। মেজদা ও সেজদা দুজনেরই সঙ্গে আমি প্রথম দেখায় লুকোচুরি খেলেছি, কত ফষ্টি-নষ্টী করেছি, সমানে সমানে ইয়ার্কি দিয়েছি। মেজদা ঢাকার ব্রাহ্ম কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়েকে বিয়ে করায় অসবর্ণ বিয়ের বিরোধী দাদাবাবু আর তাঁর মুখ দেখেন নি। পুজোর ছুটিতে সেজদাই বছর বছর আসতেন আর আমাকে দেশপ্রীতি ও দেশসেবার সম্বন্ধে বোঝাতেন।

 এত ঘটনার মধ্যেও অন্তঃসলিলা ফন্তু ধারার মত আমার প্রথম প্রেম সেই আত্মীয়া প্রণয়িণীকে ঘিরে অবাধে অবিচ্ছেদে তখনও বইছিল। তারাও পূজোর সময়ে দেওঘরে আসতো আর আমিও দূর থেকে তাকে দু’চোখ ভরে দেখতুম; তার উপেক্ষা ও অবহেলার আঘাতে বসে বসে দু’চোখে ধারা ফেলতুম ও কবিতা লিখে সে দুঃখ লাঘব করতুম। আমার মাস্‌তুত ভাই যাকে সে ভালবেসেছিল—এই সময়ে তার হলো ‘এল্‌বুমেনেরিয়া’ ব্যাধি; প্রায় ৬।৭ মাস ভুগে একদিন মুখে রক্ত তুলে সে আমার চোখের সামনে মারা গেল। এই আমার প্রথম মৃত্যু দর্শন; শেষ অবস্থায় তার গায়ে মাথায় ওডিকোলন দেওয়া হয়েছিল বলে অনেক দিন অবধি ওডিকোলনের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারতুম না। তাকে যখন দাড়োয়া নদীতে দাহ করা হলো তখন আমি সঙ্গে গিয়ে জ্বলন্ত চিতায় সেই দেহ পুড়ে ছাই হতে দেখেছিলুম। সে ভয়াবহ দৃশ্যও আমি অনেক দিন ভুলি নি।

 তার মৃত্যুর সময়ে আমার প্রণয়িনী কলকেতায়। তার কয়েক মাস পরে সে যখন দেওঘরে এলো তখন আমি আমার এত দিনের ব্যর্থ প্রেমের কিছু প্রতিদান পেলুম। তখনকার প্রতিদান যানে এক আধবার লুকিয়ে হাত ধরা, একটু হাসি, চোখে নিবিড় করে দৃষ্টি বিনিময় আর পাশাপাশি বেড়ান বা গা-ঘেঁসে বসে গল্প-গাছা করা। প্রেমপত্রের বিনিময়ও অবশ্য চলতো কিন্তু সে ভীত চকিত প্রেমের কৈশোর খেলা এর বেশি আর এগোতো না। তাকে কাছে নিয়ে প্রথম চুম্বন যখন আমাদের ঘটলো তার আগেই আমার জীবনে আর একজন মেয়ে প্রেমাস্পদ রূপে এসেছে—এসে করুণ ট্র্যাজেডির মাঝে সে প্রেম প্রতিমারও বিসর্জ্জন হয়ে গেছে। সে গল্প পরে বলছি।