আমার আত্মকথা/ছয়

উইকিসংকলন থেকে

ছয়

 আমার এই ঝড়ো অশান্ত জীবনে একটানা সুখের নীড় দুই তিনবার ছাড়া জোটে নি। নিজের মায়ের কাছ থেকে রাঙা মায়ের কাছে এসে গোমস্ লেনের এই আনন্দের হাট আমার অদৃষ্টে জুটেছিল মাত্র ২।৩ বছরের জন্যে। এ জীবনের যে কত কি বলবার আছে অথচ সে সব ঘটনা তুচ্ছ সাংসারিক দৈনিক জীবনের ঘটনা—অনাদরে পায়ের তলায় ফোটা ঘাসের ঘন নীল বা রক্তরাঙা ক্ষুদে বুনো ফুলটুকুর মত। আমাদের প্রাণের মাঝে যেন এক থিয়েটার সার্কাসের বাতিকওয়ালা অশান্ত জীব আছে, যে কেবলি চায় পিলে চমকানো ঘটনা, মেলো ড্রামা, ‘হা নাথ, হা প্রিয়ে, বিষ ভক্ষণ ও মৃত্যু’—এমনি সব নাটুকে ব্যাপার, তার চাই—ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে পনর হাত উঁচু অবধি লাফ খেয়ে শূন্যে পরমা সুন্দরী নীল পরীর গালে চুমু খেয়ে আবার সেই ঘোড়ার পিঠে এসে বস্‌তে হবে; তার চাই ভীমসেনী বীর, ঘটোৎকচ রাক্ষস, চারটে নায়ক নিয়ে একটা মেয়ের নাকানী চোবানী খাওয়া। পাঠকদের মধ্যে এই জাতীয় প্রকৃতি যাঁদের বেশি তাঁরা আমার সাইক্লোনিক জীবনের এই ক’টা পরিচ্ছেদ বাদ দিয়েই পড়বেন; মাঝে মাঝে শান্ত একটানা দিনের এই রকম ছুটিটা ছাটাটা পেয়েছিলুম বলেই পরে কর্ম্মের টানাপোড়েনে অতখানি ধকল সয়ে আজও টিঁকে আছি।

 এই গোমস লেনের বাড়ীতে আর যারা আসতো যেতো তাদের মধ্যে ছিল এক পুলিশের সাব-ইন্স্‌পেক্টরের পরিবার। এরকম strange bed fellows আমাদের জীবনে অহরহই জুটছে, নইলে কে ডি ঘোষের মত অতবড় সাহেবের পরিবারের বন্ধু হ’লো কিনা নীরদের মা! পুলিশ দারোগাটি ছিলেন মোটা সোটা, দীর্ঘাকার, বেশ একটু স্থূলবুদ্ধি জীব এবং বেহিসেবী পাঁড় মাতাল। তাঁর বৌটি ছিল ছোট্ট খাট্ট, সদাই দুঃখে ম্রিয়মান অথচ সদাই সুখের কাঙাল জীব। তাদের ছেলে হয়েছিল চার পাঁচটি, মেয়ে ছিল বলে আমার স্মরণ নেই। স্বামীর অত্যাচারে ও মাতলামোর দুঃখে মেয়েটি আত্মঘাতী হতে গেছিল দু’ তিনবার। এখনও আমার মনে পড়ে তার গলায় ভীষণ একটা কাটার চিহ্ন, একবার গলায় ক্ষুর চালিয়ে এমন কেটে ফেলেছিল যে প্রাণে প্রাণে বেঁচে উঠতে লেগেছিল ছয় মাস; আফিং খেয়ে মরতে সে প্রায়ই যেতো। আমার “মুক্তির দিশা” গল্পের বইএ ‘পাতাল পুরীর দুয়ার’ গল্পে দেখিয়েছি—অন্ধ এক যক্ষপুরী আছে আমাদের প্রাণ সত্তার তলায়। সেখান থেকে আসে দুঃখের হা হুতাশের কালো ঝড় আর আত্মঘাতের প্রেরণা। একবার যে সংযম ও মনের বাঁধ হারিয়ে এদের নিশিডাকে সাড়া দিয়েছে তাকে এরা ক্রমে পেয়ে বসে, তখন হয় হিষ্টিরিয়া বা নিউর‍্যাস্থেনীয়ার আধপাগল রোগীর সৃষ্টি। তাকে কে যেন ক্রমাগত ডেকে ডেকে বলতে থাকে, “আর কেন, তোমার তো সুখসাধ সব ফুরোলো; আর কেন, এইবার জুড়োও।” জগতে দুঃখ আমাদের পাশে পাশে ছায়ার মত চলছেই, দুঃখে ভেঙে পড়তে নেই; মনের জোর নিয়ে দুঃখের দিকে যে হেসে চাইতে শিখেছে তার দুঃখের বোঝা হালকা হয়, সুখের দিন আবার আসেই। কারণ, আসল দুঃখটার পরিমাণ খুব কম, আমাদের মন-প্রাণের দুশ্চিন্তা, নৈরাশ্য ও জ্বালা দিয়ে ওটাকে আমরা বাড়িয়ে তুলি অসম্ভব রকম বেশি।

 পুলিশ দারোগাটি শিয়ালদহের থানায় ছিলেন চাকরীতে বাহাল, মদের মাত্রার তারতম্য অনুযায়ী কখন হতেন সাবইন্সপেক্টর আর কখন হতেন হেড কনষ্টেবল। আমাদের দুই পরিবারে ছিল ঘন ঘন যাতায়াত! তাদের দু’একটি ছেলে এসে কখনও কখনও আমাদের গোমস্ লেনের বাড়ীতে থাকতো; তাদের বাড়ী থেকে আসতো বড়ই মুখরোচক লুচী, চচ্চড়ি, ছ্যাঁচড়া, আলুর দম, ক্ষীর ইত্যাদি; চপ, কাটলেট, কেক্, বিস্কুট খেয়ে খেয়ে আমার শ্রান্ত জীবে তা’ যে কি মধুর লাগতো তা’ ব’লে বুঝান অসম্ভব। সব আনন্দই আসলে ব্রহ্মানন্দেরই মত মুক্তাস্বাদনবৎ—অবাঙমনসগোচরম্, শুধু মাঝখান থেকে জীব বাবুজীউ মেরে দেন আনন্দটি। এই আত্মাপক্ষীটি কোন্ অচিন লোকের নন্দন কাননের শুকসারী তা জানি নে, কিন্তু রক্ত মাংসের এই চোদ্দপোয়া দেহকলটি বানিয়ে তা’তে কয়েকটি অতিমাত্রায় স্পর্শালু hypersensitive মাংস খণ্ড জুড়ে দিয়ে এবং চারধারে রূপ রস স্পর্শ গন্ধের লোভন আয়োজন সাজিয়ে কি আপ্রাণ চেষ্টাই চলছে সেই অচিন পাখীকে মাটির ধরায় আটকে রাখতে। কেন এত প্রলোভন, এত সাধাসাধি, এত আদর সোহাগ কে জানে? এত আয়োজন ফাঁসিয়ে দিয়ে সে কিন্তু একদিন পিঁজরে কেটে অচিন লোকে উড়ে যাবেই।

 এই পরিবারে একটি ছেলে রোজ রাত্রে ও দিনে চর্ব্ব্য চোষ্য আহার করে এক মিনিট পরে সব বমি করে আসতো; এই ছিল তার নিত্য কার্য্য অথচ শরীর ছিল তার আমাদের চেয়ে মোটা সোটা। ঐ কয়েক মিনিটে তার সজাগ দেহযন্ত্র প্রাণ ধারণের আবশ্যক মত উপাদান গোছালো গৃহিণীর মত সরিয়ে নিতো বোধ হয়। কোন ডাক্তারেই ধরতে পারে নি ছেলেটার কি এ রোগ এবং কি তার প্রতিকার।

 রোহিণী থেকে আমার আসবার বোধ হয় কয়েক মাস কি প্রায় এক বছর পরে একদিন ঘুম থেকে জেগে মা চোখের জলে ভেসে বললেন, যে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন, একটা গভীর অতল সমুদ্রে আমি তলিয়ে যাচ্ছি আর নিঃশ্বাস রোধ করে মা ডুবে চলেছেন দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে। আলো বাতাসহীন সেই নির্ম্মম অকূল জল—তল যার খুঁজে পাবার আশা দুরাশা, তার গ্রাসে ছেলে হারাবার আকুল আশঙ্কায় কি যে সে বুকে খিল-ধরা ডুব। জেগে উঠেও মা থর থর করে কাঁপছিলেন আর আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় সারা অঙ্গ আমার ছেয়ে দিচ্ছিলেন। সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এলো জ্বর এবং শীঘ্রই তা টাইফয়েডে দাঁড়ালো।

 যখন আমার জ্ঞান হ’লো তখন দেখলুম বাবার খুলনার খড়ো বাড়ীতে একটা ঘরে বিছানার সঙ্গে মিশে হাড় পাঁজরের একটা ক্ষীণ বোঝা হয়ে আমি পড়ে আছি। মা রয়েছেন মাথা কোলে নিয়ে মুখের ওপর ঝুঁকে, তাঁর সে দীপ্ত রূপ অনাহারে অনিদ্রার গেছে কালি হয়ে। ক্রমে ক্রমে শুনলুম একুশ দিন নাকি আমি অচেতন ছিলুম। যে দিন নাড়ী ছেড়ে যায় ডাক্তাররা দুঃখে উন্মাদের মত বাবাকে ঘরে চাবী দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলেন। মা এই একুশ দিন আমার শয্যাপ্রান্ত ছেড়ে ওঠেননি বললেই চলে। মৃত্যুর অন্ধপুরী ছাড়িয়ে সেই আমার প্রথম ফিরে আসা, জীবনে রোগে মৃত্যুদণ্ডে এরকম আরও দু’ তিনবার হয়েছে। ফিটের ঘোরে আমি কেবল দেখতুম আমার শরীরটা দশ বিশ মণ ভারী, এক এক খানা হাত পা যেন লোহার বিম, তোলা শক্ত। আলনার কাপড়গুলো কেবলি মানুষ হয়ে ঝুপ ঝাপ করে এসে মাটিতে আমার চারদিকে পড়ছে। রোগ সেরে ভাত খাবার জন্যে সে কি ব্যাকুল কাকুতি মিনতি। ডাতের শোকে মনে হতো সবাই আমার পরম শত্রু। ডাক্তাররা বলেছিল এ কাল রোগ থেকে ছেলেটি উঠবে একটা অঙ্গহানি নিয়ে, সেই থেকে আমার চোখের দৃষ্টি গিয়ে short sight এর ব্যাধি জীবনসঙ্গী হ’লো।

 এই সময়ে জীবনের এই দু’বছরে দেখেছি মায়ের সে কি আপ্রাণ চেষ্টা বাবাকে মদ ছাড়াতে, সুপথে আনতে। কলকেতা থেকে না বলে কয়ে হঠাৎ খুলনার বাড়ীতে এসে পড়তেন বাবার নৈতিক অনাচার ধরবার জন্যে। এই দৃপ্তা গরিয়সী মেয়েটির পদ্ম চোখের ভ্রূকুটি আর অশ্রুকে বাবা যে কি মর্ম্মান্তিক ভয়টা করতেন তা ছিল একটা দেখবার জিনিস। খুলনায় মা থাকলে বাবার হুইস্কির বোতল থাকতো মায়ের কাছে, অনেক কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষাস্বরূপ দিনে এক আধ পেগ পেতেন। অর্থ, সম্পত্তি ও জীবিকার উপায়গুলি করায়ত্ত করে পুরুষ সমাজ নারীকে করে রেখেছে তার গলগ্রহ, অন্ন-বস্ত্রের জন্য তাদের একান্তই মুখাপেক্ষী; ভারতের মত দেশে নারী আবার শাস্ত্রে অনধিকারী, শিক্ষা-দীক্ষায় বঞ্চিত, পুরুষের অন্তঃপুরবন্দিনী অসূর্য্যম্পশ্যা ভোগপুত্তলী। তবু এত করে এত আট-ঘাট বেঁধেও পুরুষ তার স্বাভাবিক অর্দ্ধাঙ্গিনীকে সব ক্ষেত্রে পায়ের দাসখৎ লেখা দাসী করে উঠতে পারে নি। যেটুকু সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্র আমরা তাদের দিয়েছি সেই অন্তঃপুরটুকুর মধ্যেই ওরা হয়ে রয়েছে নিজের শক্তি ও মহিমায় সম্রাজ্ঞী। বড় বড় কর্ত্তারা হাঁক-ডাক করে গৃহিণীর এই রাজ্যে অনধিকার চর্চ্চা করতে গিয়ে ল্যাজটি গুটিয়ে থোঁতা মুখ ভোঁতা করে ভাল মানুষের মত বাইরের ঘরে ফিরে এসে বসেন। মানুষের মাঝে—নারীর মাঝে কি একটা অপরাজেয় বস্তু আছে যাকে কিছুতেই এঁটে ওঠা যায় না। কত বড় বড় দাম্ভিকের দম্ভ চূর্ণ হয়ে গেছে ঐ স্ফটিকস্তম্ভে লেগে, মানুষকে বন্দী করবার ব্যর্থ প্রয়াসেরও শেষ নেই আর অবলীলায় অষ্টপাশ তার ছিঁড়ে ফেলে মানুষের মুক্ত হওয়ার ইতিহাসেরও অন্ত নেই।

 গোমস্ লেনের বাড়ীতে সংসারের কাজকর্ম্মের পালা সাঙ্গ করে অবসর বিনোদন হতো তাসের আড্ডা জমিয়ে, হারমনিয়ম বাজিয়ে আর নভেল পড়ে। মায়ের কাছে কেউ একজন বসে রমেশচন্দ্রের বা বঙ্কিমচন্দ্রের নভেলগুলি পড়তো আর মায়ের সঙ্গে আমরা শুনতুম। এইখানে আমার সত্তার গোপন পুরীর কল্পনা সুন্দরীর প্রথম জাগরণ, গল্পের মোহিনী শক্তির স্পর্শে গুপ্ত কবি ও চিত্রকরের প্রথম বিস্ময়মুগ্ধ চোখ মেলা। বাবা ছিলেন ষ্টার থিয়েটারের একজন পেট্রন; খুলনায় বাৎসরিক প্রদর্শনী ও উৎসব হ’তো, তা’তে ষ্টার থিয়েটারকে বাবা নিয়ে যেতেন টাকা খরচ করে। আমাদের একটি বক্স ষ্টারে বাঁধা ছিল। সেইখানে মায়ের কোল ঘেসে বসে আমার প্রথম নাটকাভিনয় দর্শন। তখন ভাল বুঝতুম না, সেই নৃত্যগীতমুখর আলোকমালা শোভিত রহস্য-পুরীর পটপরিবর্ত্তন মুগ্ধ স্পন্দিত হৃদয়ে বসে বসে দেখতুম আর ভাবতুম, “ওরা না পারে কি?” পরের সুখ দুঃখের টান যে এমন চিত্তবিমোহন হতে পারে তা’ প্রথম অনুভব করে সেই দশ বৎসর বয়সে আমার চোখে ধারা বইতো। হাসি অশ্রুর সুখস্রোতে নিশি ভোর হয়ে যেত। তখনও কলা রাজ্যের দু’টি বড় জিনিস—ছবি ও গানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি, কিন্তু ষ্টারের রঙ্গমঞ্চের মায়াপুরীতে নৃত্য ও গীতের আমি যে প্রথম আস্বাদন পেলুম আমার এই কৈশোরের দিনে, তা খুব উচ্চাঙ্গের নৃত্য-গীত না হলেও আমার বালক-চিত্তকে তা’ আলোড়িত মথিত করে তুলেছিল। কোথায় যেন একটি পরিপূর্ণ ছন্দের রূপের ঝঙ্কারের রাজ্য আছে যার শিব তাণ্ডবে এ জগত ভেঙে যায়, যার রাসলীলায় এ জগত রসে মুঞ্জরিত পুষ্পিত হয়ে ওঠে, যার স্বপ্নালু সুছন্দ গতিতে নব নব সৃষ্টিকমল অনন্ত কোন্ দিগন্ত জুড়ে ফুটে ওঠে; এ নৃত্য-গীত তারই আভাষ যেন আমাকে দিয়ে চিরজীবনের মত কবি করে দিয়ে গেল। নৃত্যগীত বা অভিনয়ে আর্ট ও সুকুমার কলাজ্ঞান না থাকলে তা’ কতখানি বীভৎস ও vulgar হতে পারে তা’ আমাদের দেশের রসজ্ঞানহীন চাষাড়ে-বুদ্ধি শ্রোতার দলে খুব কম লোকেই বোঝে। কলাজগতে ভারতের আপামর সাধারণ এমন কি ছাত্র-সমাজও এখনও প্রায় গোমূর্খ অবস্থায় আছে, নইলে এত দিনে বাঙলা নাট্যমঞ্চের বহু রূপান্তর ঘটে যেত। তবু কিন্তু পথের পাশে নৃত্যশীলা বেদের মেয়ের কণ্ঠে ও অঙ্গলীলায় সেই পরম রসই অমার্জ্জিত crude অবস্থায় উথলে উঠছে যা’র কথায় উপনিষদ বলে গেছেন—

আনন্দাদেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেন যাতানি জীবন্তি
আনন্দম প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি
তদ্ ব্রহ্ম।

ব্রাহ্ম সমাজের কোলে আমার জন্ম, বঙ্গদেশ ও বঙ্গসমাজ ব্রাহ্ম সমাজের কাছে অনেক কিছু পেয়েছে। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে আমার নালিশেরও অন্ত নেই—বিশেষ করে নীতিজ্ঞানের অতিমাত্রায় আড়ষ্ট পিউরিটানী সাধারণ সমাজের বিরুদ্ধে। ঠেকায় এরা সবই করে অথচ হিন্দুদের জীবনের কত কিছুর বিরুদ্ধে নিরাকার নাক এদের কুঁচকেই আছে। থিয়েটার তার মধ্যে একটি, যেহেতু ওখানে নটীর নৃত্য হয়; অথচ নটীর নৃত্য না দেখেও ব্রাহ্ম-যুবকদের ভেতর কুরুচি ও কামবৃত্তির খেলা এক চুল কম তো দেখি নে। বাহিরটা ধোপদস্ত রেখে জেণ্টলম্যান সেজে থাকার এই যে মানবী প্রবৃত্তি এর মত হাস্যকর জিনিস আর কি আছে? হিন্দু ঘরের অনেক মেয়েকে ঝগড়া ঝাটির মাঝে তারস্বরে চোখ মুখ ঘুরিয়ে বক্তৃতা করতে শুনি যে, সে কত বড় সতী, তার অনিষ্ট করতে গিয়ে হারাণ দত্ত পড়লো আর মরলো। এই লোক-দেখানো মরালিটি সেই ধরণের নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে সতীর বড়াই করার মতই ব্যাপার। নটীর নাচকে ভদ্রলোকের বাড়ীর অঙ্গনে এনে এখন রবীন্দ্রনাথ অনেক তথাকথিত সুরুচিবাগীশ ব্রাহ্মের মুখ বন্ধ করেছেন, এখন ভদ্রঘরের মেয়ে ও কুলবধূও নটীর কাজে আসরে নামছেন— তাঁদের নমস্যা পূর্ব্ববর্ত্তিনীরা ছিলেন রাজকন্যা শ্রেষ্ঠী-কন্যার দল, এই তাঁদের সব চেয়ে বড় নজির। আগেই বলেছি নারীর অঙ্গের সুললিত ছন্দোবদ্ধ গতি কতখানি কুরুচি জাগায় জানিনে, কিন্তু যে রসজগৎ সে মানুষের কাছে খুলে দেয় তা’র দাম দেয় কে? আর ঐ ভগবদ্দত্ত কুরুচিপূর্ণ বৃত্তিটা—ওটা তো সবারই কেশাকর্ষণ করে নানাবিধ কুকার্য্য দিবারাত্র করিয়ে নিচ্ছেই, ওটার হাত থেকে নিরাকার ভজেও যখন উদ্ধার নেই তখন নৃত্যগীত চিত্র প্রভৃতি কলারসের সুখে ও আনন্দে আমরা বঞ্চিত থাকি কেন?

 ষ্টারে তখন কিসের পালা দেখেছি তা আমার স্মরণ নেই, তবে তাজ্জব ব্যাপার, বিবাহ বিভ্রাট আদি নক্সাগুলির কথা বেশ মনে আছে। ব্রাহ্ম-সমাজ তখন ছিল থিয়েটারী ব্যঙ্গের প্রধান লক্ষ্য। সার্কাসেও যেতুম মাঝে মাঝে, সাহেব মেম সেজে পশুশালা, ইডেন গার্ডেন, বোটানিকেল গার্ডেনও দেখা হতো। কলকেতা বিস্বাদ একঘেয়ে লাগতে আরম্ভ করলে সপরিবারে খুলনা যাত্রার হিড়িক পড়তো। একবার বজরায় করে আমরা একমাসের মত বেরিয়ে পড়েছিলুম কালনার দিকে, কতদূর গিয়েছিলুম এখন আর মনে নেই। তবে গঙ্গার সে রজত ধবল কলনাদিনী স্রোতকণ্টকিত রূপ ভোলবার নয়। নদীতটের সেই গ্রাম্য ছবি—কুলবধূর পিতলের কলসী কাঁখে জ্বলভরা, হাতের খাড়ু বাউটি নেড়ে বাসন মাজা, বজরা দেখে আড় ঘোমটার ফাঁকে কাজল-কালো চোখে বিস্ময় নিয়ে থমকে চেয়ে থাকা, নৌকার সাদা পাল তুলে হাঁসের মত ভেসে চলা, বকের সারি, কাশের সাদা তুফান, শিকড় জাগা গাছের মূল ঘিরে নদীর তরঙ্গলীলা, কিই বা তার মাঝে ভুলতে পেরেছি! আমার গল্পে উপন্যাসে কবিতায় তারা ক্রমাগতই রূপ নিতে এসে ব্যর্থ হয়ে গেছে, কারণ আমার সে প্রতিভা কোথায় যে তাদের নিখুঁৎ করে ফুটিরে সরস জীবন্ত করে তুলতে পারি?