আমার আত্মকথা/নয়

উইকিসংকলন থেকে

নয়

 তখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী প্রণেতা শ্রীযুক্ত যোগীন্দ্রনাথ বসু দেওঘর হাই ইংলিশ স্কুলের হেড মাষ্টার। আমার বড় মামার নামও ছিল যোগীন্দ্র নাথ বসু এবং দু’জনে ছিলেন অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু। প্রসিদ্ধ “দেশের কথা” (আমাদের বোমার যুগে এই বইখানি বে-আইনী ঘোষণা করা হয়) প্রণেতা সখারাম গণেশ দেউস্কর এই স্কুলে নীচের ক্লাসে অধ্যাপনা করতেন। নীচের ক্লাসের শিক্ষক হ’লে হবে কি, তাঁর ও হেডমাষ্টার মশাইয়ের মত ছেলেদের জনপ্রিয় শিক্ষক এমন কেউ আর দেওঘরে তখন ছিল না। শিক্ষকদের মধ্যে আর যাঁদের কথা মনে আছে তার মধ্যে পণ্ডিত মশাই, পাণ্ডা শিক্ষক ঝা-মশাই আর তৃতীয় শিক্ষক বকুলাল বাবুর কথাই আমার মনে পড়ে।

 আমায় প্রথম যে দিন বড় মামা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন স্কুলে ভর্ত্তি করার জন্যে সে দিন আমার বুকের মাঝে ভয়ের কি গুরুগুরু—যেন বলিদানের জন্যে পাঁঠাকে পরম করুণাময়ী মা কালীর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্কুল কি তা’ সে পর্য্যন্ত কখনও চোখে দেখা হয় নি, ভয়াবহ রকম গম্ভীর উদ্যতবেত্র মাষ্টারের দল, চারিদিকে অচেনা মুখ এবং পড়ার অপ্রীতিকর পিঠ-মাজা-ভাঙ্গা চাপ এই সবগুলো নিয়ে একটা ভীতিপ্রদ ধারণা শুনে শুনে মনের অন্ধকারে ব্রহ্মদৈত্যের মত জমা হয়েছিল। প্রথমে অফিসে হেড মাষ্টার মশাইকে দেখলুম—বেঁটে ক্ষীণকায় গৌরকান্তি শান্ত গম্ভীর মানুষটি, হাসেনও বেশ আবার সে হাসিখুসীর মাঝে গাম্ভীর্য্য এবং ওজনও রাখতে জানেন। আমাকে দু’চারটি প্রশ্ন করে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্ত্তি করে নিলেন এবং সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন অজানা ছেলের মাঝে বসিয়ে দিয়ে এলেন। তখন বোধ হয় পণ্ডিত মশাইএর ক্লাস; পোড়া বৃষকাষ্ঠের মত কালো শীর্ণ পুরুষ, রক্তচক্ষু, গোঁফ ও ছাগল দাড়ি আছে, সদাই নিদ্রালু এবং রুক্ষভাষী। এই ছিলেন পণ্ডিত মশাই। তিনি পড়া জিজ্ঞেস করছেন উপক্রমণিকা ব্যাকরণের আর মুহুর্মূহু বিদ্রূপবাণ ও তিরস্কারের মধ্যে ছেলেরা বেঞ্চিতে আসন বদল করে উন্নতি অধোগতির নাগরদোলায় দুলছে। সেই যে পণ্ডিতমশাইকে বিষ চোখে দেখলুম আর কখনও সে স্মৃতির দাগ মন প্রাণ থেকে মোছে নি। নিজের রকমে তিনি স্নেহপ্রবণও যে না ছিলেন তা’ নয় কিন্তু তাঁর বেতহাতে বিদ্রূপ-পরায়ণ রুক্ষভাষী দিকটা নীচের ক্লাসের ছেলের কাছে তাঁকে ভয়ের সামগ্রী ও উঁচু ক্লাসের ছেলেদের কাছে ঠাট্টার বস্তু করে রেখেছিল। ছেলেদের মন প্রাণগুলি এত কোমল, এত স্পর্শালু, এত শীঘ্র দাগ নেয় যে, তাদের হৃদয়জয় এক দিক যেমন খুব সহজ, আর এক দিয়ে তেমনি শক্ত ব্যাপার।

 আমাদেরই দেওঘর স্কুলের পঞ্চম মাষ্টার কীর্ত্তিচন্দ্র দত্ত ঝা-মশাই ছিলেন জাতিতে পাণ্ডা ব্রাহ্মণ, দেওঘরের পাণ্ডাদের মধ্যে বি এ পাশ মানুষ তখন ছিল প্রায় আকাশ কুসুমের যত দুর্ল্লভ পদার্থ। মোট। থলথলে কালো ভূঁড়েল মানুষটি মুহুর্মুহু পানতামাক সেবার ফলে কালো ময়লা দাঁত বার করে যখন হাসতেন আর স্থূল রসিকতা করতেন তখন সমস্ত ক্লাস হেসে কুটিপাটি হ’তো। তাঁর কয়েকটি বাঁধা রসিকতা ছিল যা শুনে শুনে আমাদের কর্ণ হয়ে গিয়েছিল অভ্যস্ত; সেই সব রসিকতা তাঁকে বলিয়ে প্রসন্ন করবার ও তাঁকে ভুলিয়ে পড়ার সময়টা ফাঁকি দিয়ে কাটিয়ে দেবার অছিলায় একজন উঠে হয়তো জিজ্ঞেস করলো, “সার, সার, “ইষ্টু পিট কি ধাতু কি প্রতায়?” এক গাল হেসে ঝা-মশাই প্রশ্নকারীকে কাছে ডেকে বললেন, “ইষ্টুপিট? সে হচ্ছে ইষ্ট পূর্ব্বক পিট ধাতু এক-দুই—তিনচার ঘা প্রত্যয়”, বলে গুম্ গুম্ করে পিঠে চারটে বিরাশী শিক্কা ওজনের কিল্ বসিয়ে দিলেন। একটা হাসির ঝড়ের মধ্যে সেদিনকার পড়ার চাপটা অমনি সহনীয় রকম লঘু হয়ে গেল, চাই কি রসালাপে হাস্য পরিহাসে ঘণ্টাকে ঘণ্টাই কাবার। বেঁটে সেঁটে আকারে এতটুকু চন্দ্রবাবু চতুর্থ মাষ্টার ছিলেন নিতান্ত মাটির মানুষ, তাঁর রাগের ভান আর বেতের আস্ফালনে সারা ক্লাস পুলকে মুখর হয়ে উঠতো; গণ্ডগোল থামাবার জন্যে স্বয়ং হেড মাষ্টার মশাইকে প্রায় ছুটে আসতে হতো। শিশু-শাসনে শিশুর চেয়েও অসহায় এই মানুষটিকে কেউ আমলেই আনতো না, অথচ তাঁরও দিন সুখে দুঃখে আর দশ জন কড়া নিয়মবাগীশ রুদ্র মাষ্টারের মতই কেটে যেত। সেকেণ্ড মাষ্টার ছিলেন সব চেয়ে কড়া মানুষ, যেমন গম্ভীর তেমনি নীরব; তাঁর ধীর হিসেব করা হাঁটায় এমন এক জলজীয়ন্ত গুরুমশাই ছিল যে, তাঁকে ভয় ও সমীহ না করে উপায় ছিল না। এই মাষ্টার ছুটিতে যাওয়ায় থার্ড টিচার হয়ে আসেন বকুলাল বিশ্বাস ও তাঁর বন্ধু আসেন সহকারী হেডমাষ্টারের পদে। এঁরা দু’জনেই ছিলেন ভক্ত বৈষ্ণব, সঙ্কীর্ত্তনে ও হরিনামে এঁদের চোখে ধারা বইতো। মাষ্টারে ও ছাত্রে গভীর প্রেম এই বকুবাবুকে দিয়ে আমি প্রথম বুঝি, আমাকে দেখবা মাত্র তিনি এমন ভালবেসে ফেলেছিলেন যে আমি তা’ দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যেতুম। এখন তিনি বোধ হয় মুন্সেফ, পথে ঘাটে আচম্বিতে ক্বচিৎ কদাচিৎ ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ বড় একটা এখন আর হয় না। তার ওপর আমি ডাকসাইটে বোমাড়ে আর তিনি ক্ষুদে হাকিম, কাজেই এ অবৈধ প্রণয় মনে প্রাণে চেপে রাখা ছাড়া তাঁর গতি কি আছে?

 স্কুলে ছাত্রদের মধ্যে খুব ভালবাসার জিনিস ছিলেন সখারাম বাবু। দীর্ঘছন্দ ঋজু দেহ, কেশ-বহুল বিস্তৃত বক্ষ, দ্রুত দৃঢ়সংকল্পের গতি, সুকৃষ্ণ গুম্ফ, ঘন ভ্রুযুগ, সুরসিক, সদাহাস্য পরায়ণ অথচ আদর্শবাদী এই মানুষটি ছিলেন ছেলেদের সব বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রাণ। আমাদের দরিদ্র ভাণ্ডার, কুষ্ঠাশ্রম সাহায্য সমিতি, সব কিছুর ইনিই ছিলেন নেতা। তখন ১৮৯৪ সাল, অত আগে আমরা এই সখারাম বাবুর প্রেরণায় দাড়োয়া নদীর শুষ্ক বালুচরে লাঠি খেলতুম; নন্দন পাহাড়কে দুর্গ করে একদল মোগল ও অন্য দল মাওলী সেনা সেজে যুদ্ধ করতুম। সখারাম বাবুর জীবনের সব চেয়ে বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল শিবাজীর জীবন-চরিত লিখে যাওয়া, মহারাজ বীর ছত্রপতির এত বড় শ্রদ্ধালু পূজারী আমি আর দেখি নি। এঁর প্রাণাগ্নির আঁচ পেয়ে আমরাও নেপোলিয়ন ও শিবাজীকে করেছিলুম জীবনের আদর্শ পুরুষ। কোথায় সাঁওতাল পরগণার এক নগণ্য স্কুলের ছাত্র আর কোথায় মহারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী, হাজার অসম্ভব হলেও এরকম রঙিন বেহিসাবী আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে বড় করে।

 তখনকার দেওঘর স্কুলে আমার চেয়ে ভাল ছেলে অনেক ছিল, পরীক্ষায় তারা ফার্স্ট সেকেণ্ড হ’তো, রাশি রাশি পুরস্কার পেতো, মাষ্টারদের আদর কুড়োতো; কিন্তু আজ তারা জীবনের কর্মক্ষেত্রে কোথায়? দু’ এক জন বড় চাকরী পেয়েছে, প্রফুল্ল মিত্র সায়েন্স কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশই তলিয়ে গেছে নগণ্য লোকেরই জনতায়। একটা উঁচু আদর্শ নিয়ে জীবন উৎসর্গ তাদের একজনও করে নি, এক আমি ছাড়া। প্রথমে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্ত্তি হই, সেখান থেকে ছ’মাসে প্রমোশন নিয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে উঠি, তারপর থেকেই দেওঘর স্কুলের ছাত্র জীবনে আমিই হই বড় বড় কাজে পালের গোদা। এই সময়ে যোগীন্দ্রবাবু প্রাণপাত করে দেওঘরে কুষ্ঠাশ্রম স্থাপন করছেন, তখনও তার রাজকুমারী কুষ্ঠাশ্রম নাম হয় নি। আমরা দরিদ্র ভাণ্ডার গড়ে বাড়ী বাড়ী হাঁড়ি রেখে চাল সংগ্রহ করে কুষ্ঠরোগী ও দুঃস্থ মানুষদের বিলোতুম। ডিবেটিং ক্লাব গড়ে ইতিহাস চর্চ্চা করতুম ও প্রবন্ধ লেখা আর বক্তৃতা দেওয়া শিখতুম, আমার কৈশোরের সে সব উদ্যমের আনন্দ ও নেশার ঘোর এখনও মনে পড়ে; আমার প্রাণ শক্তির বেগে আমি আমার কল্পনার রথের চাকায় বেঁধে টেনে নিয়ে চললুম প্রফুল্লুকে, দীনেশ্বরী প্রসাদকে, করালী-কিঙ্করকে, আশু বিশ্বাসকে, এমন কজনকে। তারা বোধ হয় আমায় ভালবাসতো বলেই সাড়া দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করতো কিন্তু “স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহ”—সুতরাং এ পরধর্ম্ম আশ্রয় করে পরবর্ত্তী জীবনে তাদের একজনও টিঁকে থাকতে পারে নি।

 এই সময় আমি দু’জন অপূর্ব্ব মানুষের সঙ্গ ও স্পর্শ পাই। একজন বরিশালের অশ্বিনী বাবু আর একজন “রসলীলা” রচয়িতা ইন্দু বাবু। ঈশ্বর প্রেমে পাগলের মত হয়ে ইন্দু বাবু একবার পর্য্যটক হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় নিজের বীণাটি হাতে এই ঈশ্বরপ্রেমিক সাধক দেওঘরে আসেন। আমার দাদাবাবু রাজনারায়ণ বাবুর কাছে এমন অনেক মানুষই আস্‌তেন। এঁকে পেয়ে দাদাবাবুর আনন্দের অবধি ছিল না, পশ্চিম দিক্‌কার গোলাপ বাগানে ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাতে ইন্দুবাবুর “রসলীলা”গান হতো,

সে কোন্ জ্যোছনা দেশ সই রে?
যেথা  অগণন চকোর
মধুপানে বিভোর
নাহি জানে নিত্য সুখ বই রে?
যেথা পাষাণ ভেদিয়া ফুটে জীবনের ফুল রে
প্রাণময়ী ভাষা যথা নাহি তায় কুল রে
যে দেশের অভিধানে
দুখ মানে সুখ রে,
তুমি মানে আমি বই নই রে!

 এই ধরণের গানগুলি এখনও আমার স্মৃতির ফলকে একেবারে মুছে যায় নি। তার পর ইন্দু বাবুর সে রসের উজান শুকিয়ে গেল, তিনি সংসারে ঢুকলেন, ‘রসলীলা’ও আজ বাঙলা সাহিত্য থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। ‘রসলীলা’ আমার জীবনকে ঘোরাল রসাল করে দিয়ে গেছে, আমাদের পরিবারের ধর্ম্মপ্রাণতা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে হয়তো কিছু পেয়েছিলুম কিন্তু সে ঊর্ব্বর জমিতে পাট করেছে জলসেচ দিয়েছে যে কয়খানি বই “রসলীলা”ই তার প্রথম।

“ভোমরা রে
কি মধু পিইয়ে হলি ভোর?
তরল পরাণ তোর জমাট বাঁধিল রে!
গুন্ গুন্ গুন্ করে কত কেঁদেছিলি
কি মধু পড়িল মুখে চুপ হয়ে গেলিরে।”

 এই রকম ভাবের ও রসপূর্ণ কথা অকবিকে কবি করে ছাড়ে, আমি তো তখন তের বছর বয়স থেকে রাবীন্দ্রিক ঢঙে কবিতাই লিখছিলুম। প্রথমে কবি মানকুমারীর কবিতাই আমার কবিতা লেখার ছিল আদর্শ, তার পর এলেন তাঁর অপূর্ব্ব ঝঙ্কার ছন্দ ও মধু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ। বৈষ্ণব কবিতা তখনও আমি পড়ি নি, রবীন্দ্রের ‘ভানুসিংহের পদাবলী’তে তার একটু পূর্ব্বাস্বাদ পেয়েছি মাত্র।

 অশ্বিনী বাবু বোধ হয় দু’বার দেওঘরে আসেন! সন্ধ্যার সময় তাঁকে নিয়ে আমরা বেড়াতে যেতুম, তাঁর ভক্তিযোগের সম্বন্ধে আলোচনা চলতো। তিনিও আমাকে বড়ই ভালবেসে ফেলেছিলেন। দাদাবাবুর তিনি ছিলেন অভিন্নহৃদয় সুহৃদ, আবার আমাদেরও ছিলেন তাই। এত শীঘ্র ষাট বছরের বুড়ো থেকে ছেলে অবধি সব মানুষকে আপন অন্তরঙ্গ করে নেবার শক্তি অশ্বিনী বাবুর মত আমি আর ২।৪ জনেরই মাঝে দেখেছি। ইন্দু বাবুর গানই মাত্র আমরা শুনতুম, তিনি ছিলেন বড়দের ও বুড়োদের সঙ্গী; অশ্বিনী বাবু ছিলেন কিন্তু আবাল বৃদ্ধ যুবা সবার সমান দরদী।

 এত অল্প বয়সে কবি হবার আর এক কারণ এই বয়সে আমার প্রথম প্রেমে পড়া। আমার সে প্রেমের পাত্রীকে যখন প্রথম দেখি তখন সে দশ বছরেরটি। বড় বড় ভাষা চোখ, গৌর বর্ণ, নাতি দীর্ঘ কিশোর তনু। এই ভালবাসা গভীর হয়ে আমার হৃদয় ও প্রাণসত্তা জুড়ে তের বছর অবধি ছিল। ব্রাহ্ম সমাজে বাল্য বিবাহ নেই, উপার্জ্জনক্ষম না হয়ে অন্ততঃ ছেলেরা সে সমাজে বিয়ের কথা ভাবেই না। আর অত ছোট বয়সের ভালবাসায় অতদূরের হিসেব কি থাকে? তার ওপর সে ছিল আমার নিকট আত্মীয়া, আমিও ছিলুম কবি, দেহ সম্বন্ধটার ওপর ছিল নবোঢ়ার ভয় সঙ্কোচ ও ঘৃণা। মাটির বুকের পদ্মটির জন্য আকাশচারী চাঁদের অতৃপ্ত আকুল পিয়াসা; পনরটি দিন ধরে কলায় কলায় পূর্ণ হয়ে উঠতে উঠতে সারা হৃদয় মণ্ডলের কিরণ ঢেলে দয়িতকে ছোঁওয়া, ঘিরে থাকা, ব্যাকুল করা, তাকে আলোর বন্যায় ডুবিয়ে রাখা আর তার পর তাকে না পাওয়ার শোকে আবার নীরবে কলায় কলায় ক্ষয়ে যাওয়া। এই রকম ছিল আমার কামগন্ধহীন সেই কৈশোর যৌবনের কবিত্বগাঢ় স্বপ্নালু প্রেম।

 মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির কি যে হিসেব,—মনের কৃত্রিম খোপ কাটা কাটা ভাল মন্দের উচিৎ অনুচিতের সে উদ্ভট মনগড়া রাজ্য,—সে হচ্ছে একটা আধ-আলো আধ আঁধারের ঘরকন্না। নিজেদের ছোট ছোট ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থবুদ্ধি ও হিসাব কিতাব থেকে মানুষ সেখানে গণ্ডী কেটে নিয়েছে,— ‘ঐইটে আমার—ঐটাকে ছুঁয়োনা’ “ঐটে তোমার—ঐখানেই সারা জন্ম ঘুর ঘুর করে মর”। আমাদের মন হচ্ছে হিসাবী লোক, লাভ লোকসান খতিয়ে সে চলে, নিয়মকে—ব্যবস্থা পত্রকে কঠিন দুর্লঙ্ঘ্য করে সে বাঁধে, পান থেকে চূণ খসলে সে ভাবে চৌষট্টি নরক তার নীচে হাঁ করে রয়েছে তাকে গেলবার জন্য। অথচ বিবাহের বা মিলনের প্রধান জিনিষটা হচ্ছে হৃদয় বিনিময়—ভালবাসা, প্রেমকে বাদ দিয়ে বিবাহ হয়ে পড়ে প্রহসন, ব্যভিচার। দেহের ক্ষুধা মেটাবার ব্যবস্থার নামই যদি হয় বিবাহ তা’হলে রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণের মত প্রেমকে বাদ দিয়ে বিবাহ একটা পাশব ব্যবস্থা ছাড়া আর কি? পরিবারে আমি দেখিছি অতি নিকট আত্মীয়ে আত্মীয়ে প্রণয়, যারা সারাটা জীবন হয়তো এক পরিবারের বাঁধনে পরস্পরকে কত না সুখে দুঃখে ধরে একত্র থাকে, তাদের একজন আর এক জনকে টানবে এ তো খুবই স্বাভাবিক। তবু কিন্তু বিজ্ঞানের হুকুম, সমাজের ব্যবস্থা এই যে—রক্তের সম্বন্ধ যেখানে গাঢ় ও নিকট সেখানে মিলন অবৈধ। কাজেই কত না পরিবারে কত না প্রেম অন্তঃসলিল হয়ে মরেছে, অন্ধকারে ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে পাঁক তুলছে, গোপন ভ্রূণহত্যা, নারীঘাত ও প্রবঞ্চনার সৃষ্টি করছে। মানুষের মনগড়া নীতির সামাজিক জগতে তাই পাপের অপরাধের ও মনস্তাপের আর অন্ত নেই।

 মানুষ ভুলে যায় যে, মানুষ শুধু মন নয়, শুধু প্রাণ নয়; প্রাণ, মন, হৃদয় ও দেহ এই চারটেকে নিয়ে সে একটা গোটা সত্তা। তার হৃদয়ের প্রেম দেহ প্রাণ মন সব নিয়েই জাগবে, মনের খোঁটায় বাঁধা হয়ে হৃদয়ের গণ্ডীতেই আটকে থাকবে না, দেহের ক্ষুধার রাজ্যেও সে পঙ্কজিনী ফুটে উঠবে দেহের মিলন-রসে শতটি প্রস্ফুট দলে। সেইটেই স্বাভাবিক, প্রকৃতির নিয়মই যে তাই। কুলের বংশের গোত্রের বাহির থেকে তাজা নতুন রক্ত না এলে জাতি নাকি সুস্থ সবল হয়ে ওঠে না; বেশ কথা, কিন্তু এ যেমন একটা নিয়ম, তেমনি হৃদয়ের প্রাণের ও দেহের রাজ্যের আরও হাজারটা নিয়ম যে রয়েছে যার বশে একজন আর একজনকে না টেনে না ভালবেসে পারে না; সে টান ব্যর্থ করলে স্নায়ুমণ্ডল আঘাত পায়, ছিঁড়ে যায়, মানুষ পাগল হয়ে আত্মঘাতী হয়, হিষ্টিরিয়ার রুগী হয়ে সারা জন্ম থাকে। অতি জটিল সুকুমার যন্ত্র হচ্ছে মানব সত্তা—তার মন প্রাণ হৃদয় দেহময় এই চতুর্ম্মুখ চেতনা। একটা মাত্র নিয়মকে কঠিন rigid করে জীবনের আরও অসংখ্য ধারাকে অবহেলা ও দমন করতে গিয়ে ট্র্যাজেডিই বাড়ে,—জীবন ও সমাজ দেহ বিষিয়ে ওঠে। রক্তের সম্বন্ধ যেখানে নিকট সেখানে বিবাহকে অবৈধ করে যেমন একদিক দিয়ে রেখেছি আবার অন্যদিক দিয়ে কৌলিন্যের লোভে ক্রমশঃ দু’ চারটি পরিবারে বিবাহ করে সেই নিয়মেই ব্যভিচার আমরা নিত্য নিয়ত করছি। কে জানে বাঙ্গালী জাত হয়তো তাইতেই এত নিস্তেজ দুর্ব্বল ও ক্ষীণপ্রাণ হয়ে পড়েছে কি না? কূপমণ্ডুক এ জাতির বিবাহপ্রথা এত সঙ্কীর্ণ, ছত্রিশ জাতের আর শত শত উপজাতের গণ্ডীতে গণ্ডীতে এমন করে বাঁধা বলে নতুন তাজা রক্ত এ জাতির পচা ঘুণধরা দেহে বহুদিন আসে নি। অথচ পূর্ণ জীবনের উজ্জ্বল দিনে হিন্দুর এ ব্যবস্থা ছিল না, অনুলোম ও বিলোম বিবাহে নিকৃষ্ট উৎকৃষ্ট সব জাতের মানুষ এসে হিন্দু-সমাজ-সাগর-সঙ্গমে মিলতো।