আমার খাতা/আমার মাতৃদেবী

উইকিসংকলন থেকে

আমার মাতৃদেবী।

 আমার পূজনীয়া জননী দেবী ঠাকুরবংশের দৌহিত্রীর কন্যা ছিলেন। তিনি শৈশবে পিতামাতাকে হারাইয়াছিলেন। আমার জননীকে ও আমার পূজনীয় মাতুল মহাশয়কে এক আত্মীয়া বিধবা রমণী লালনপালন করিয়াছিলেন, দুই ভাই ভগ্নির বাল্যজীবন তাঁহারই কাছে কাটিয়াছে আমার জননী দেবী সুন্দরী ছিলেন। তাঁহার সৌন্দর্য্যে এমন একটি কমনীয়তা ছিল যে তাঁহাকে দেখিলেই ভালবাসিতে ইচ্ছা হইত। মাতৃদেবীর যখন ৯ বৎসর বয়স তখন তাঁহার বিবাহ হয়, তিনি পিতার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। শুনিয়াছি, যখন আমার বিমাতা জীবিত ছিলেন তখন একদিন কোন কর্ম্ম উপলক্ষে তিনি আমার মাকে দেখিয়া পিতাকে বলেন—দেখ, কেমন একটি সুন্দরী মেয়ে এসেছে, ওকে বিয়ে করবে? তখন কে জানিত এই রহস্য-বাক্য একদিন সত্যে পরিণত হইবে? তাহার কিছুদিন পরেই আমার বিমাতা ইহলোক ত্যাগ করিলেন। এক বৎসর কি ততোধিক পরে আমার জননী দেবীর পিতার সহিত পরিণয় হইল। বিবাহের পরদিন যখন সকলে বধু লইতে আসিল ও বস্ত্রালঙ্কারে সজ্জিত করিল তখন সেই বাড়ীতেই আমার জননীর আর এক আত্মীয়া পূজায় উপবিষ্টা ছিলেন। আমার জননী তাঁহার কাছে পলাইয়া গিয়া বলিলেন—কর্ত্তা-মা উহাদের গহনা কাপড় লইয়া যাইতে বল; আমি উহাদের বাড়ী যাইব না। এই কথায় আমার জননীর লোভশূন্যতার পরিচয় পাওয়া যায়।

 এই ৯ বৎসরের বালিকাকে পতিগৃহে আসিয়া শাশুড়ীর অভাবে অনেক লাঞ্ছনা ও কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল। বড়লোকের বধু হইয়াও ভোগবিলাসের পরিবর্ত্তে দারিদ্র্যের কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছিল, তাঁহার বাল্যজীবন দুঃখেই কাটিয়া ছিল। মধ্যজীবনে সুখ ভোগ আরম্ভ হইতে না হইতেই দারিদ্র্য ঘনাইয়া আসিয়া সে সুখটুকু হরণ করিয়া লইল; তথাপি সেই চিরপ্রফুল্ল মুখখানিতে কখনও বিষাদের ছায়া পড়ে নাই। আমার জননীর কোন্ গুণের কথা রাখিয়া কোন্ গুণের কথা বলিব। পতিভক্তি যেন মূর্ত্তীমতী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সমস্ত গৃহকর্ম্মে অসাধারণ দক্ষ ছিলেন। রুগ্ন ও দুর্ব্বল শরীরে সমস্ত সংসারের কর্ত্তব্য একাকী স্বহস্তে সুন্দররূপে অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে সম্পন্ন করিতেন। রন্ধনকার্য্য এত ভাল জানিতেন যে রোগীর পথ্য ও তাঁহার হস্তে অতি সুস্বাদু হইত। তিনি কখন বৃথা আমোদে সময় নষ্ট করিতেন না। যেটুকু সময় পাইতেন রামায়ণ ও মহাভারত পাঠ করিতেন। অমিতব্যয়ীও ছিলেন না কৃপণও ছিলেন না। স্ত্রীলোকের যে সকল গুণ থাকা উচিত সেই সকল গুণে তিনি ভূষিতা ছিলেন। অতি অল্প বয়সেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করিয়াছিলেন। সংক্ষেপে তাঁহার জীবনের গুণাবলী লোকসমাজে প্রচার করিয়া জীবন সার্থক করিলাম।