আমার খাতা/জ্ঞান ও প্রেমের মিলন

উইকিসংকলন থেকে

জ্ঞান ও প্রেমের মিলন।

 জ্ঞান ও প্রেম উভয়ই আমাদের মনুষ্যজীবনে সাধনার বস্তু। প্রেম প্রথম স্তর। প্রেম মানুষকে জ্ঞানেতে পৌঁছাইয়া দেয়। প্রেম প্লাবন আনে, সেই প্লাবনে হৃদয়ের সঙ্কীর্ণতা ও পাপ মলিনতা ধুইয়া হৃদয়কে পবিত্র করে ও জ্ঞানসাগরে মিশিয়া যায়। তখন আর প্রেমের পৃথক্‌ অস্তিত্ব থাকে না। এই জ্ঞানে ও প্রেমে যোগ সাধন করিতে হইলে আমাদের প্রথম অবলম্বনীয় প্রেম। প্রেমই আমাদিগকে ব্রহ্মানন্দ উপভোগ করায়। পশুতে মনুষ্যোচিত চিত্তবৃত্তি অল্প বিস্তর দেখা যায়, তবে পশুতে ও মানুষে পার্থক্য কোথায়? পশুরা লক্ষ্যশূন্য যন্ত্রচালিত ভাবে বিশ্ব নিয়মের অধীন জন্ম মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয়। আর আত্মজ্ঞান লাভ করাই মনুষ্য-জীবনের লক্ষ্য এবং সফলতা। মনুষ্য হইয়া যদি আত্মজ্ঞান লাভ করা না যায় তবে মনুষ্যতে আর পশুতে পার্থক্য থাকে না। প্রেমের মত এমন হিতকর বন্ধু আর আমাদের কে আছে? পাপ মলিনতাকে ধুইয়া, পথের লোককে বুকে তুলিয়া লইতে, সংঙ্কীর্ণতাকে প্রসারিত করিতে, গর্ব্বিত মস্তককে সকলের কাছে নত করিতে, কেবল বিশুদ্ধ প্রেমই পারে। শক্তির ন্যায় প্রেম অপূর্ণ থাকিতে পারে না কেবলই পূর্ণতার দিকে চলিয়াছে। তড়িৎ যদি একটা মেঘে বেশি থাকে ও অপরে কম থাকে দুইটা মিশিয়া এক হইতে চায়—তখন বিজলী চমকিতে দেখিতে পাই। প্রেমেও সেইরূপ দুটা হৃদয়কে এক করিয়া দেয় ও সেই মিলন দেখিয়া লোকে চমকিত হয়। যেখানে প্রেমের বন্যা আসে তাহার আশে পাশে সকলকেই ভাসাইয়া লইয়া চলিয়া যায়। চৈতন্যকে প্রেমের অবতার বলা হয় কারণ চৈতন্যই প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন। তিনি যেখানে যেখানে গিয়াছিলেন সেই সেই স্থানের সকলকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিলেন। পাপী পুণ্যবান সকলেই তাঁহার বক্ষে স্থান পেয়েছিল। তাঁহার গতি ছিল জ্ঞান সাগরে, তিনি তাহাতেই মিশিয়াছিলেন।

 প্রেমেতে আত্মহারা করে, এই আত্মহারা ভাবই যোগের চরম উৎকর্ষতা। প্রেমের বেগ কেহই রোধিতে পারে না। মত্তমাতঙ্গসদৃশ আমাদের ইন্দ্রিয় বৃত্তির সাধ্য কি প্রেমের গতিকে রোধ করিতে পারে? অন্যান্য সদ‍্বৃত্তির অনুশীলনে অল্পে অল্পে চিত্তশুদ্ধি হইয়া থাকে কিন্তু প্রেমে অতি শীঘ্রই পাপ মলিনতাকে ধুইয়া পুঁছিয়া লইয়া যায়। তাই প্রেমের পথ সরল। প্রেমকে বিশুদ্ধ করাই প্রেমের সাধনা প্রেমেতে যাহাতে স্বার্থপরতার খাদ না মেশে তাহাই করা উচিত; আর যদি মিশিয়া থাকে তবে তাহাকে নিবৃত্তির আগুণে গলাইয়া খাঁটি করিতে হয়। প্রেমের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিলে নিঃসন্দেহ আত্মজ্ঞানলাভ করিবে ও আত্মার অন্তরতম জ্ঞানস্বরূপ ঈশ্বরের বিমলানন্দে মগ্ন হইবে।