আমার দেখা রাশিয়া/উনিশ
উনিশ
লেখক সংঙ্ঘ ও নাগরিকদের বিদায় ভোজ রাত্রি তিনটেয় শেষ হ’ল। শেষরাত্রেই আমরা তিবলিসি থেকে বিমানে যাত্রা করলাম। ২৪শে জুলাই বিকেল ৪টায় মস্কৌএ ফিরে এলাম। মুষলধারায় বৃষ্টি ও প্রখর বাতাস, তেমনি শীত। ন্যাশনাল হোটলের পরিচিত ঘরে প্রবেশ করে বাঁচলাম। চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে দেখি বৃষ্টিধারা স্নাত গাছগুলি দুলছে, পীচের রাস্তায় ভূঁইচাপা ফুল ফুটছে। ধূসর আকাশের নীচে ক্রেমলীন প্রাসাদদুর্গ আপন অটলোন্নত মহিমায় দাঁড়িয়ে ধারাস্নান করছে। পথ জনহীন। বর্ষার জলধারায় প্লাবিত কলকাতার কথা মনে পড়লো। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, ইলিশ গুঁড়ি বৃষ্টি হলেই মধ্য কলকাতায় কোমর জল। আপিস ফেরৎ বাবুর দল কলেজের ছাত্র ইতর ভদ্র সকলেই গোপাল-কাছা হয়ে জুতো জোড়া কাঁধে তুলে মন্থরপদে চলছে। অর্ধশতাব্দী দেখছি, কারো মুখে নালিশ নেই। যুবা বয়সে বিদ্যাধরী নদীর মরণ দশা নিয়ে খবরের কাগজে বিলাপ করেছি। কিন্তু কিছুই হয় নি, হ’ল না। ইঞ্জিনিয়রিং বিদ্যার পরাকাষ্ঠার দিনেও সহরের বর্ষার জল নিকাশের ব্যবস্থা হয় না। কেন হয় না? আমরা সহ্য করি বলেই হয় না। আমরা মুখ বুঁজে কর্পোরেশনের ট্যাক্স গুণি। দাবী দাওয়া নেই। মনে আছে মেয়র হয়ে ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বলেছিলেন, শ্যামবাজারের সঙ্গে চৌরঙ্গী পাড়ার কোন পার্থক্য রাখবো না। কিন্তু পার্থক্য রয়ে গেছে। কর্তাদের ভাবিয়ে না তুলতে পারলে তারা ভাববেন কেন? তাই চৌরঙ্গীর সাহেব পাড়ার রাস্তা খোয়া বের করা নয়, দুপাশে ফুলবাগান পাতাবাহার, উদ্যানগুলি সুরচিত ও সুরক্ষিত। আর আমাদের পাড়ার রাস্তা কতকগুলো ছোটবড় গর্তের যোগ ফল হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, মা বাপ মরা অনাথের মত। আমরা সহ্য করি কেন না আমাদের বুদ্ধি অলস, আত্মকর্তৃত্বের অধিকার যে মানুষের অধিকার পুঁথির এই তত্বটা আমাদের মগজে তর্কবুদ্ধি শানাবার চর্মই রয়ে গেল, আত্মরক্ষার বর্ম হল না। তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা পরবশতার পাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল। নানা দুঃখকে যারা দৈবের মার বলে নিরুপায় ভীরুতায় সয়ে যায়, তাদের মানসিক দাসত্বের গ্রন্থী না খুললে কোন দুঃখেরই প্রতিকার সচেষ্ট হয়ে উঠবে না।
ইয়োরোপের ইতিহাসে অনেক রক্তারক্তির মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। তার পরিপূর্ণ প্রবল মূর্তি রাশিয়ায় এসে প্রত্যক্ষ করেছি। আচার বিচার বিধি বিধানে আষ্টে পিষ্টে বাঁধা মানুষ ধর্মমোহে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে অশ্রদ্ধা করতো, দাস তৈরীর সেই পাকা কারখানাটা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে বলেই যুক্তিহীন ও যুক্তি-বিরুদ্ধ প্রথার বন্ধন থেকে এরা মুক্তি পেয়েছে। সেই মুক্তির আনন্দ ও বিস্তার এদের সমাজজীবনে দীপ্যমান। এরা বাইরের কোন অন্ধ বাধ্যতা দ্বারা পরিচালিত, বিদ্বেষে অন্ধ ছাড়া এমন কথা কেউ বলবে না।
এবারে মস্কৌএ এসে বিখ্যাত স্তালিন অটোমোবাইল ফ্যাক্টরী দেখলাম। বহুবিভাগে বিভক্ত বিশাল কারখানা। এর তিন প্রধান বিভাগ থেকে প্রতি সাড়ে তিন মিনিটে একখানা করে বাস্ মোটরগাড়ী ও লরী বেরিয়ে আসছে। বিভিন্ন বিভাগে তৈরী অংশগুলি কেমন করে স্তরে স্তরে জোড়া দেয়া হচ্ছে তা ঘুরে ঘুরে দেখতে অনেক সময় লাগলো। মেয়ে পুরুষ দুইরকম শ্রমিকই আছে, প্রজ্জ্বলিত চুল্লী বা হাপর ও হাতুড়ী পেটার কাজে মেয়েদের নিয়োগ করা হয় না। আমরা শ্রমিকদের খাটুনীর পরিমাণ ও সময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম। একজন রসিক শ্রমিক বললে, ছোট গোলামকে খাটাবার তরে এখানে বড় গোলাম চাবুক উঁচিয়ে নেই। ট্রেড্ ইউনিয়নের বাঁধা নিয়মে আমরা কাজ করি। কাজ চলেছে ঘড়ির কাঁটার মত।
এই কারখানার হাউস অফ কালচার বা সংস্কৃতি-ভবন একটা বৃহৎ ব্যাপার। বিরাট প্রাসাদ, বড় বড় হলে খেলাধূলা ছবি আঁকা বই বাঁধাই নানাবিধ হাতের কাজ শেখার ব্যবস্থা। শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা এখানে শিক্ষা ও আমোদ-প্রমোদ দুই-ই পাচ্ছে। একটা বড় হলে ঢুকে দেখি ছেলেমেয়েরা নানারকম খেলনা নিয়ে মেতে আছে, এ দৃশ্য কত সুন্দর ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ছোটদের ও বড়দের দুটো সিনেমা হল ও থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ, তারপর লাইব্রেরী। শ্রমিকরা টেকনোলজী অর্থাৎ যন্ত্রবিজ্ঞান শিক্ষা করে উন্নত হতে পারে তারও দরাজ ব্যবস্থা। এদেশে এসে যতগুলো কারখানা দেখেছি, সর্বত্রই এ সব আছে। আর আছে শিশুপালনাগার কিণ্ডারগার্টেন প্রসূতিভবন চিকিৎসালয়। কৃষক শ্রমিকের রাষ্ট্রে এ হবে না তো আর কোথায় হবে? এখন দেখে আর অবাক হইনে!
নিখিল রাশিয়ার ট্রেড্ ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় আপিস। কলকাতার লাল দীঘির দপ্তরখানার প্রায় তিনগুন। সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকদের গঠন কাজের ধারা নিয়ন্ত্রিত করবার স্নায়ুকেন্দ্র। আমরা একটা বড় হলঘরে সমবেত হলাম। চার পাঁচ জন বয়স্ক শ্রমিকনেতা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আলোচনা প্রসঙ্গে জানা গেল ছয়ষট্টি প্রকার বিভিন্ন কারখানা শিল্প দপ্তরখানা শিক্ষালয়ের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত। শ্রমিক শিক্ষক ও কেরানীর মোট সংখ্যা তিনকোটি ৯০ লক্ষ। এর মধ্যে তিন কোটি ট্রেড্ ইউনিয়নের সদস্য। শাখা ও আঞ্চলিক শ্রমিক সঙ্ঘগুলির বছরে দুইবার নির্বাচন হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি যন্ত্রের উন্নতি, শারিরীক শ্রম লাঘব, শ্রমিকদের মর্যাদা, শিক্ষা স্বাস্থ্য সাংস্কৃতিক উন্নতি প্রভৃতি বিবেচনা করে সংস্কারের প্রস্তাব করেন, সর্বজনের সমর্থনে তা অনুমোদিত হলে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান তা গ্রহণ করেন এবং গভর্নমেণ্টও সেইভাবে আইন সংশোধন করেন।
সদস্যরা উপার্জনের শতকরা একভাগ মাসিক চাঁদা দেয়। এ ছাড়া কারখানা ও গভর্নমেণ্টও নির্দিষ্ট হারে অর্থ দেন। এই অর্থে এরা বর্তমানে ৯ হাজার ৫ শ’ সংস্কৃতি ভবন ক্লাব ও শিক্ষালয়, ৯০ হাজার ছোট বড় রেড ক্লাব এবং ৮ হাজার ৫শত লাইব্রেরী ও পাঠাগার (বই ৫ কোটি) পরিচালনা করেন। শ্রমিকরা বার্ধক্যে বা রোগে অকর্মণ্য হয়ে পড়লে স্যোশাল ইনসিওরেন্স ভাণ্ডার থেকে তাদের ভরণপোষণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
ট্রেড্ ইউনিয়ন বা শ্রমিকদের কর্তব্য ও অধিকার অতি নির্দিষ্টভাবে বিধিবদ্ধ।
১। যারা কলকারখানা দপ্তরখানা কিম্বা উচ্চতম বিদ্যালয়ে অথবা কারিগরী ও বিশেষ বৃত্তির শিক্ষা লাভ করছে সেই সব সোবিয়েত রাষ্ট্রের নাগরিক মাত্রই ট্রেড্ ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে;
২। ট্রেড্ ইউনিয়নের সদস্যদের এই সব অধিকার আছে;
(ক) ইউনিয়নের সাধারণ সভায় যোগদান;
(খ) ইউনিয়নের সংস্থা সম্মেলন এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়া;
(গ) ইউনিয়নের কাজের উন্নতির জন্য প্রস্তাবাদি উত্থাপন করা;
(ঘ) ট্রেড্ ইউনিয়নের সভা সমিতি কংগ্রেস এবং সংবাদপত্রে স্থানীয় অথবা উচ্চতর ইউনিয়নগুলির তাদের কর্মকর্তাদের সমালোচনা করা, প্রশ্ন করা বিবৃতি দেওয়া অথবা অভিযোগ উপস্থিত করা;
(ঙ) যে পরিচালকবর্গ সম্মিলিত চুক্তি ভঙ্গের অথবা প্রচলিত শ্রমিক আইন, সোশ্যাল ইনসিওরেন্স সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণের বিধিবদ্ধ নিয়ম লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী, সেখানে ট্রেড্ ইউনিয়নের নিকট সুবিচার প্রার্থনা করা;
(চ) কারো কাজকর্ম ও আচরণ সম্বন্ধে যখন ইউনিয়ন কোন মন্তব্য প্রকাশ করে তখন সেখানে ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিতি দাবী করা;
৩। প্রত্যেক ইউনিয়ন সদস্যের কর্তব্য;
(ক) পৌর ও শ্রমিক শৃঙ্খলা সর্বপ্রযত্নে মেনে চলা;
(খ) সোবিয়েত পদ্ধতির অটল ভিত্তি জনসাধারণ ও সমাজতান্ত্রিক সম্পত্তি, দেশের ঐশ্বর্য ও শক্তির উৎস শ্রমজীবীদের সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির প্রাণশক্তির উৎস নিরাপদ রাখা ও রক্ষা করা;
(গ) যোগ্যতার সমুন্নতি এবং স্ববৃত্তি পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করা;
(ঘ) স্ব স্ব শ্রমিকসঙ্ঘের নিয়মতন্ত্র মেনে চলা এবং নিয়মিতভাবে চাঁদা দেওয়া;
8। প্রত্যেক সদস্যই নিম্নলিখিত সুবিধেগুলি পাবার অধিকারী;
(ক) যারা সদস্য নয়, তাদের থেকেও বেশী পরিমাণে রাষ্ট্রের সোশ্যাল ইনসিওরেন্স ভাণ্ডার থেকে সদস্যরা অর্থ সাহায্য পাবে। এই সাহায্য পাওয়া অবশ্য রাষ্ট্রের নিয়মকানুনের অধীন;
(খ) বিশ্রামাগার, সেনাটোরিয়াম স্বাস্থ্যনিবাস প্রভৃতিতে যাওয়ার ছাড়পত্র বিতরণে এবং ছেলেমেয়েদের শিশুপালনাগার কিণ্ডারগার্টেন এবং তরুণ পাইওনিয়র্স শিবিরে পাঠাবার অগ্রাধিকার;
(গ) ট্রেড্ ইউনিয়ন ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজন মত সাহায্য;
(ঘ) শ্রমিকসঙ্ঘ থেকে বিনামূল্যে আইনের পরামর্শ;
(ঙ) প্রত্যেক সদস্যের পরিবারবর্গ নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী সঙ্ঘের সাংস্কৃতিক ও খেলাধূলার প্রতিষ্ঠানে যোগদান;
(চ) স্ব স্ব শ্রমিকসঙ্ঘের পারস্পরিক সহায়ক সমিতির সদস্য হবার।
বলা বাহুল্য শ্রমিকদের কর্তব্য ও অধিকারের এই ধারাগুলি আমি ওদের মুদ্রিত নিয়মতন্ত্র থেকে বলছি। এর মধ্যে দুর্লভ বা দুরূহ কিছু নেই। কিন্তু এই নিয়মের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজের আত্মীয়তা নিবিড় হয়ে উঠেছে এইটে চোখে দেখে এলাম। পশ্চিমী সভ্যতার ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বুলি তোতাপাথীর মত আমরাও কপচাই কিন্তু তলিয়ে দেখিনে, ঐ বুলির আড়ালে দানবীয় লোভ মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ককে কি গভীর অনৈক্যে কলুষিত করে দিয়েছে। আমাদের দেশে যা দেখি তা কেবল ধনী নির্ধনের ভেদ নয়, জাতিভেদ ধর্মভেদ তো আছেই, তার উপর শিক্ষা বিদেশী ভাষায় হওয়ায় শিক্ষিত ভদ্রলোক এবং “ছোটলোকের” মধ্যে সামাজিক আত্মীয়তা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বেচ্ছাচারের এই চেহারা কত কুৎসিত। ছলে বলে কৌশলে আমি বড় হব, আমি ভোগ করবো, মানুষকে দূরে ঠেকিয়ে রেখে অপমান ও বঞ্চনা করা সমাজ জীবনে কত বিচিত্র আকারে প্রকাশিত। সোবিয়েত রাশিয়ার মানুষ এই স্তর অতিক্রম করার কঠিন পণ করেছে। ওদের শ্রমিকসঙ্ঘের গঠন ও পরিচালনা প্রণালী পরস্পরের প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা।