বিষয়বস্তুতে চলুন

আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না/কিছু কথা

উইকিসংকলন থেকে


ঈশ্বর বিশ্বাস: কিছু কথা

বইটির নাম ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’। এখানে ‘আমি’ শুধুমাত্র লেখক নন। ‘আমি’ সেই আমজনতা, যাঁরা নিরীশ্বরবাদী, ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। ‘আমি’ সেই নিরীশ্বরবাদীদের প্রতীক, কোনও ব্যক্তিমাত্র নন।

মানুষ কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে? ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা তা নিয়ে নানা ধরনের যুক্তি হাজির করেন। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের মধ্যে ফুটপাতের ভিখারি থেকে সুপণ্ডিত বুদ্ধিজীবী, প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর গুরু থেকে 'নোবেল' বিজয়ী বিজ্ঞানী, সবই উপস্থিত। তাই বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তিও নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। আটপৌরে যুক্তি থেকে বিজ্ঞান-তত্ত্বের কূট-কচালি। এর কোনও একটি যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে ‘নিরীশ্বরবাদী’ বলে নিজেকে ঘোষণা করাটা যুক্তির দিক থেকে মোটেই সুবিবেচনার কথা নয়। পাশ না কাটিয়ে পাশ করতে হলে খুব জরুরী কাজটা হল—ঈশ্বর বিশ্বাসীদের পক্ষের ছোট-বড় সমস্ত যুক্তিকে সংগ্রহ করা। তারপর থাকে প্রতিটি যুক্তিকে খণ্ডনের প্রশ্ন।

ঈশ্বরে বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি সংগ্রহে আন্তরিক ছিলাম, এ'বিষয়ে আমার সহযোদ্ধারা অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। প্রতিটি যুক্তিই খণ্ডিত হয়েছে, বলাই বাহুল্য। নতুবা একজন যুক্তিবাদী হবার সুবাদে, ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতে বাধ্য হতাম। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এই গ্রন্থে ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষে হাজির করা যুক্তির বাইরে বাস্তবিকই আর কোনও যুক্তি আপনার জানা থাকলে আমাকে জানান। আন্তরিক কৃতজ্ঞ থাকব। পরবর্তী সংকলনে সে যুক্তি হাজির করব এবং খণ্ডন করব, এই প্রত্যয় রাখি। খণ্ডনে ব্যর্থ হলে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি তাদের সমস্ত শাখা সংগঠন, শাখা গণসংগঠন ও সহযোগী সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে। এটা আমার কোনও বাক্তিগত হঠকারি সিদ্ধান্ত নয়। আমাদের কার্যকরী সমিতির গৃহীত সিদ্ধান্ত। আর কেউ যদি ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেখান, সেটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ মেনে নিয়ে ঝাঁপ বন্ধের প্রতিজ্ঞায় অটল রইলাম। ঈশ্বরে বিশ্বাসের মৃত্যুর জন্য এই চ্যালেঞ্জ ভয়ংকর হলেও অতি প্রয়োজনীয় ছিল।

ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষে কোনও একটি যুক্তি খণ্ডনে ব্যর্থ হলে যুক্তিবাদী হবার সুবাদে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতাম-এ'জাতীয় কথা শুনে কেউ যদি বিষম খান, তো তাঁর উদ্দেশে বলি—কী মুশকিল, আমরা তো ভাববাদী বা অলীক কল্পনাবাদীদের মত শাস্ত্রবাক্য বা গুরুবাকাকে অভ্রান্ত বলে ধরে নিয়ে স্থবির বা অনড় নই। যুক্তিবাদীরা নমনীয়। যে দিকে যুক্তি, সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। যুক্তিবাদীরা বর্তমানের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আজ যা বলেন, আগামীকালের বাড়তি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আজকের বক্তব্য বাতিল করার প্রয়োজন হলে আন্তরিকতার সঙ্গেই তা করেন। তবে যা করেন তা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই, ‘ভবিষ্যতে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে যেতেও তো পারে’—এমনটা ভেবে করেন না।

যুক্তিবাদীরা অনমনীয়। অনমনীয় তাদের আদর্শের প্রতি। তাদের মূল্যবোধের প্রতি। একই সঙ্গে যুক্তি ও যুক্তিহীনতায় অবস্থান করে যুক্তিবাদী হওয়া যায়। মানুষের বিশ্বাসে আঘাত না দেওয়ার পক্ষে হাজারো অজুহাত হাজির করেও নয়। এ অজুহাতের আর এক নাম ‘সুবিধাবাদ’।

কয়েকমাস আগে গণেশের দুধ খাওয়ার মত একটা তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার লৌকিক ব্যাখ্যা হাজির করতে দেশের প্রায় প্রত্যেকটি প্রচার-মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর এক মাস পরে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘিরে গড়ে ওঠা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার-মাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার জন্য তাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।

এর আগেও এ'দেশে কুসংস্কারের ঢেউ উঠেছে। আমজনতা উদ্বেল হয়েছে। প্রচার-মাধ্যমগুলো এবারের মত ইতিবাচক ভূমিকা নেয়নি। এর আগেও পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছে। প্রচার-মাধ্যমগুলো এ'বারের মত গ্রহণ নিয়ে কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হাজির হয়নি। এ'বার হয়েছে। কারণ, এখন জনগণ শুধু কুসংস্কারের কাঁথা জড়িয়ে উষ্ণতার স্বাদ নেয় না। জনতার একটা বড়-সড় মাপের অংশ কুসংস্কার বিরোধিতার মধ্যে প্রগতির উত্তাপকে অনুভব করে। জীবনের উত্তাপকে অনুভব করে। জনমানসের এমন উত্তরণ একদিনে ঘটেনি। এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠার ব্যাপার। আমজনতার একটা অংশ যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে একটু একটু করে পরিচিত হতে হতে কুসংস্কার বিরোধী হয়ে উঠেছেন। এই হয়ে ওঠার ব্যাপারে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির লাগাতার প্রক্রিয়া ও অবদানকে স্বীকার না করে কোনও উপায় নেই। জনতার চাহিদা আছে। বিক্রি হবে। তাই প্রচার-মাধ্যমগুলো তাদের মালিকের শ্রেণীস্বার্থকে সংরক্ষিত রেখে নানা সাজে বিক্রি করছে প্রগতিশীলতা। কারণ প্রতিটি প্রচার-মাধ্যমই শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবসা। আর পাঁচটা ব্যবসার মতই।

প্রচার-মাধ্যমগুলোর নীতি নির্ধারণ করেন মালিক। মালিক প্রগতিশীলতা ও কুসংস্কার বিরোধিতাকে ততদূর পর্যন্তই এগিয়ে নিয়ে যাবে, যতদূর নিয়ে গেলে এই অসাম্যের সমাজ কাঠামোর গায়ে আঁচটি লাগবে না। তাই গণেশের দুধ খাওয়া বা গ্রহণের ব্যাপার নিয়ে 'কাস্টমার'দের উত্তেজনার আগুন পোহানর ঢালাও ব্যবস্থা রাখলেও নিয়তিবাদ—অধ্যাত্মবাদ—ঈশ্বরবাদ বিষয়ে জনচেনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। কারণ বঞ্চিত মানুষদের চিন্তাকে বিভ্রান্ত করতে এই তিন ‘বাদ’-এর জবাব নেই। পরিবর্তে আসবে নানা অজুহাত, কূট-কচালি—জনগণের বিশ্বাসকে আঘাত দেওয়া কতটা অযৌক্তিকতা—বোঝাবার নানা চেষ্টা। তার চেয়ে থাক না কিছু বিশ্বাস, আপন মনে, সঙ্গোপনে!

যুক্তিবাদী আন্দোলনের তরীতে জোয়ারের টান। পালে সুচেতনার দখিনা হাওয়া। তরতর চলমান আমজনতার প্রগতিশীল অংশ। সমাজ-কাঠামোর স্তম্ভগুলোয় নোনা ঢেউয়ের লাগাতার আঘাত। স্তম্ভের ফাটল রেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সারাইয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। ময়দানে এখন বেশ কিছু 'যুক্তিবাদী' সংগঠন, 'যুক্তিবাদী' শব্দটা তো কারও একচেটিয়া নয়! 'ভাল্লাগে তাই ওমনি এমনি ব্যবহার করি'—বললে কারও প্রত্যুত্তর দেওয়ার কিছু থাকে না। আমাদেরও নেই। এদের কাউকে ‘স্পনসর' করছে রাষ্ট্রশক্তি, কাউকে বা বিদেশের ধনকুবেররা। সাম্যের সমাজ গড়ার লড়াই চালাবার অধিকার কারও একচেটিয়া নয়! রাষ্ট্রশক্তি ও তাদের চালিকা শক্তি ধনকুবেররা যদি রাজ্য-পাট-ছেড়ে আমজনতায় সামিল হতে চায়—কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। আমাদেরও নেই। 'ভাল্লাগে তাই’ ও ‘স্পনসর পাওয়া' যুক্তিবাদীদের অনেকের উপরই প্রচার-মাধ্যমের 'স্পট-লাইট'। কাকে আলোকিত করবে, তা নির্বাচন করার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রচার-মাধ্যমগুলোর আছে। কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। আমাদেরও নেই।

কিন্তু প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারও অধিকার আছে ‘সাদা'কে 'সাদা' ও 'কালো’কে 'কালো' বলার। আপনার অধিকার আছে অজুহাতের ঘেরাটোপে ঈশ্বর ও আত্মার বিশ্বাসকে সুরক্ষিত রেখে যারা যুক্তি ও বিজ্ঞানের পক্ষে জয়গান করে, তাদের ‘অ-যুক্তিবাদী’, ‘সুবিধাবাদী’, ‘দ্বিচারী’ বিশেষণে বিশেষিত করার। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস করি, আপনারাই শেষ কথা বলার অধিকারি। আপনারাই ঠিক করে দিতে পারেন-‘যুক্তিবাদ’-এর আর এক নাম ‘সুবিধাবাদ’ হবে, না ‘যুক্তিবাদ’ যুক্তিবাদেই থাকবে।


সংগ্রামী অভিনন্দন, আমার প্রেরণার উৎস প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, মেঘলা সময়ে।


প্রবীর ঘোষ
৭২/৮ দেবীনিবাস রোড
কলকাতা ৭০০ ০৭৪

দশ ডিসেম্বর
উনিশ শো পঁচানব্বই