বিষয়বস্তুতে চলুন

আলালের ঘরের দুলাল (১৮৭০)/১৬

উইকিসংকলন থেকে

১৬ ঠকচাচার বাটীতে ঠকচাচীর নিকট পরিচয় দান ও

তাহাদিগের কথোপকথন, তন্মধ্যে বাবুরাম বাবুর

ডাক ও তাঁহার সহিত বিষয় রক্ষার পরামর্শ।


 ঠকচাচার বাড়িটি শহরের প্রান্তভাগে ছিল— দুই পার্শ্বে পানা পুষ্করিণী, সম্মুখে একটি পিরের আস্তানা। বাটীর ভিতরে ধানের গোলা, উঠানে হাঁস, মুর্গি দিবারাত্রি চরিয়া বেড়াইত। প্রাতঃকাল না হইতে২ নানা প্রকার বদমায়েশ লোক ঐ স্থানে পিল২ করিয়া আসিত। কর্ম্ম লইবার জন্য ঠকচাচা বহুরূপী হইতেন—কখন নরম—কখন গরম—কখন হাসিতেন—কখন মুখ ভারি করিতেন—কখন ধর্ম্ম দেখাইতেন—কখন বল জানাইতেন। কর্ম্মকাজ শেষ হইলে গোসল ও খানা খাইয়া বিবির নিকট বসিয়া বিদ্‌রির গুড়গুড়িতে ভড়র২ তামাক্ টানিতেন। সেই সময়ে তাঁহাদের স্ত্রী-পুরুষের সকল দুঃখ-সুখের কথা হইত। ঠকচাচী পাড়ার মেয়ে মহলে বড় মান্যা ছিলেন—তাহাদিগের সংস্কার ছিল যে তিনি তন্ত্রমন্ত্র, গুণকরণ, বশীকরণ, মারণ, উচ্চাটন, তুক তাক, জাদু, ভেল্কি ও নানা প্রকার দৈব বিদ্যা ভাল জানেন, এই কারণ নানারকম স্ত্রীলোক আসিয়া সর্ব্বদাই ফুস ফাস করিত। যেমন দেবা তেমনী দেবী—ঠকচাচা ও ঠকচাচী দুজনেই রাজযোটক—স্বামী বুদ্ধির জোরে রোজগার করে, স্ত্রী বিদ্যার বলে উপার্জ্জন করে। যে স্ত্রীলোক স্বয়ং উপার্জ্জন করে তাহার একটু২ গুমর হয়, তাঁহার নিকট স্বামীর নির্জ্জলা মান পাওয়া ভার, এই জন্যে ঠকচাচাকে মধ্যে২ দুই একবার মুখঝাম্‌টা খাইতে হইত। ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন— তুমি হর রোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও —তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ি বল যে হাতে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড় চায় যে জরি জর পিনে দশজন ভাল২ রেণ্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মতো ফের—চুপচাপ মেরে হাবলিতে বসেই রহ। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আমি যে কোশেশ করি তা কি বল্‌ব, মোর কেত্‌না ফিকির—কেত্‌না ফন্দি—কেত্‌না প্যাঁচ—কেত্‌না শেম্ভ তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দন্তে এল২ হয় আবার পেলিয়ে যায়। আলবত সিকার জল্‌দি এসবে এই কথাবার্ত্তা হইতেছে ইতিমধ্যে একজনা বাঁদি আসিয়া বলিল বাবুরাম বাবুর বাটী হইতে একজন লোক ডাকিতে আসিয়াছে। ঠকচাচা অমনি স্ত্রীর পানে চেয়ে বলিল—দেখ্‌চ মোকে বাবু হরঘড়ী ডাকে—মোর বাত না হলে কোন কাম করে না। মুইও ওক্তবুঝে হাত মার্‌বো।

 বাবুরামবাবু বৈঠকখানা বসিয়া আছেন। নিকটে বাহির সিমলের বাঞ্ছারাম বাবু, বালীর বেণী বাবু ও বৌবাজারের বেচারাম বাবু বসিয়া গল্প করিতেছেন। ঠকচাচা গিয়া পালের গোদা হইয়া বসিলেন।

 বাবুরাম। ঠকচাচা! তুমি এলে ভাল হল—লেটাতো কোন রকমে মিট্‌চে না —মকদ্দমা করে২ কেবল পালকে জোলকে জড়িয়ে পড়ছি—এক্ষণে বিষয়-আশয় রক্ষা করবার উপায় কি?

 ঠকচাচা। মরদের কামই দরবার করা —মকদ্দমা জিত হলে আফদ দফা হবে। তুমি একটুতে ডর কর কেন?

 বেচারাম। আ মরি! কী মন্ত্রণাই দিতেছ? তোমা হতেই বাবুরামের সর্ব্বনাশ হবে তার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই—কেমন বেণী ভায়া কি বল?

 বেণী। আমার মতে খানেক দুখানা বিষয় বিক্রয় করিয়া দেনা পরিশোধ করা ও ব্যয় অধিক না হয় এমন বন্দোবস্ত করা আবশ্যক আর মকদ্দমা বুঝে পরিস্কার করা কর্ত্তব্য কিন্তু আমাদিগের কেবল বাঁশবোনে রোদন করা—ঠকচাচা যা বল্‌বেন সেই কথাই কথা।

 ঠকচাচা। মুই বুক ঠুকে বল্‌ছি যেত্‌না মামলা মোর মারফত হচ্‌ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে —আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব—মরদ হইলে লড়াই চাই—তাতে ডর কি?

 বেচারাম। ঠকচাচা! তুমি বরাবর বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ। নৌকা ডুবির সময়ে তোমার কুদরৎ দেখা গিয়াছে। বিবাহের সময় তোমার জন্যেই আমাদিগের এত কর্ম্ম‌ভোগ, বরদা বাবুর উপর মিথ্যা নালিশ করিয়াও বড় বাহাদুরি করিয়াছ আর বাবুরামের যে২ কর্ম্মে‌ হাত দিয়াছ সেই২ কর্ম্ম বিলক্ষণই প্রতুল হইয়াছে। তোমার খুরে দণ্ডবৎ তোমার সংক্রান্ত সকল কথা স্মরণ করিলে রাগ উপস্থিত হয়—তোমাকে আর কি বলিব? দূঁর!! বেণীভায়া উঠ এখানে আর বসিতে ইচ্ছা করে না।