আলোর ফুলকি/৫
৫
কুঁকড়ো নিজে যেমন, তেমনি কাউকে ভোরে উঠতে দেখলে ভারি খুশি। সোনালিয়াকে দেখে বললেন, “বাঃ তুমি তো খুব সকালে উঠেছ। বেশ, বেশ।” কিন্তু সোনালিয়া চিনেমুরগির চা-পার্টতে যাবার জন্যেই খালি আজ এত সকালে বিছেন ছেড়ে বেরিয়েছে শুনে কুঁকড়ো ভারি দমে গেলেন। কুঁকড়ে পষ্ট বললেন, তিনি ওই চিনে-মুরগিটাকে ছ'চক্ষে দেখতে পারেন না। কিন্তু সোনালিয়া ছাড়বার নয়, সে তবু কুঁকড়োকে চিনে-মুরগির মজলিসে যেতে পেড়াপিড়ি করে বললে, “দেখি তুমি আমার কথা রাখ কি না।”
কুঁকড়ে। তবু যেতে রাজি নয়, তখন সোনালিয়া অভিমান করে বললে, “তবে আমি এখনি বাড়ি চলে যাই।” কুঁকড়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললেন, “ন সোনালি, এখনি যেয়ে না।” সোনালি অমনি সুযোগ বুঝে বললে, “তবে যাবে বলে চিনি-দিদির বাড়িতে।” কুঁকড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আচ্ছা তাই, আমিও যাব।” কথাটা ব'লেই কুঁকড়ে মনে মনে নিজের উপর খুব চটলেন, মেয়ের যা আবদার করবে, তাই কি মানতে হবে।
সোনালি কুঁকড়োর ভাব বুঝে মনে মনে হাসতে লাগল। কুঁকড়োকে চিনি-দিদির বাড়িতে নিয়ে যেতে সে খুব ব্যস্ত ছিল না; সে কুঁকড়োর কাছ ঘেঁষে বললে, “তোমার সেই মন্তরের কথাটি বলো-না শুনিই-ই—।”
কুঁকড়ে একটু গম্ভীর হলেন, সোনালি বললে, “বলো-না, বলোবলো, বলো-না।”
কুঁকড়ে এবারে গদগদম্বরে “সোনালি আমার মনের কথাটি” বলে আবার চুপ করলেন। সোনালি বলে চলল, “বনের মধ্যে বসন্তকালের চাদনিতে সারারাত কাটিয়ে একলাটি আমি বনের ধারে এসে দাড়িয়েছি, সকালের আলো আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল, আর আমনি শুনলেম, তোমার ডাক দূর থেকে আসছে, যেন দূরে কার বাঁশি বাজছে।”— বনের রানী আলোর ফুলকি সোনালিয়া পাখি সকালের সোনার আলোতে একলাটি দাড়িয়ে কান পেতে তাঁর গান শুনছে একমনে, এ খবর পেয়ে কোন গুণীর না মনটা নরম হয়। কুঁকড়ো ঘাড় হেলিয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘বলি কি না বলি।’ সোনালিয়া মিঠে সুরে আরম্ভ করলে রূপকথা, “এক যে ছিল কুঁকড়ো আর যে ছিল বনের টিয়া।” কুঁকড়ো ভুল ধরলেন, “হল না তো হল না তো।” তার পর নিজেই রূপকথার খেই ধরলেন, কুঁকড়োর পিয়া ছিল সোনালিয়, বনবাসিনী বনের টিয়।” সোনালিয়া বলে উঠল, “কুঁকড়ো টিয়াকে কখনো বললে না রূপকথার নিতিটুকু”, বলতেই কুঁকড়ো সোনালিয়ার কাছে এসে বললেন, “জানে, সে কথাটা কী? যেটা বনের টিয়েকে কুঁকড়ে বলতে সময় পেলে না? কথাটা হচ্ছে, তোমার সোনার আঁচল বসন্তের বাতাস দিয়ে গেল সোনালিয়া বনের টিয়া।” সোনালি গম্ভীর হয়ে বললে, “কী বকছেন আপনি। রূপকথা শোনাতে হয় তো আপনার চার বউকে শোনান গিয়ে, খুশি হবে”, ব’লেই সোনালি অন্য দিকে চলে গেল।
কুঁকড়ো রেগে গজ গজ করে ঘুরে বেড়ান, অনেকক্ষণ পরে সোনালি আস্তে আস্তে কুঁকড়োর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে, “একটা গান গাও-না।” কুঁকড়ো ফোঁস করে উঠলেন, সোনালি বললে, “বাসরে,একে বুঝি বলে গান!” তখন মিষ্টি স্বরে কুঁকড়ো ডাকলেন, “সো-ও-ও-ন, যেন শু্যামা পাখি সিটি দিলে, সোনালি অমনি আবদার ধরলেন, কুঁকড়োর গুপ্ত মস্তরটি শোনবার জন্যে। কুঁকড়ো খানিক এদিক ওদিক করে বললেন, “সোনালি, তুমি বাইরে যেমন খাটি সোনার বুকের ভিতরটাও যদি তেমনি তোমার খাটি হয় তবে তোমায় আমার গোপন কথাটি শোনাতে পারি”, ব’লে সোনালির মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে যেন শুনতে লাগলেন, সোনালির বুকের মধ্যে থেকে ডাক আসছে কি না, বলে বলে।’ তার পর কুঁকড়ো আরম্ভ করলেন, “সোনালি পাখি, বুঝে দেখো আমি কী, সোনার শিঙার মতো বাক আমি বাজবার জন্তেই স্বষ্টি হয় নি কি জীবন্ত এক রোশন-চৌকি? জলের উপরে যেমন রাজহাস, তেমনি মুরের তরঙ্গে ভেসে বেড়াতেই আমার জন্ম, আমি চলেছি সুরের বোঝা শব্দের ভার বয়ে সোনার একটি মউরপঙখি, সকাল-বিকাল।”
সোনালিয়া বলে উঠল,“নেীকোর মতো ভেসে বেড়াতে তো তোমায় কোনোদিন দেখি নি, মাটি আঁচড়াতে প্রায়ই দেখি বটে।”
কুঁকড়ো বললেন, “মাটি আঁচড়াবার অর্থ আছে। তুমি কি মনে কর, আমি মাটি আঁচড়াই মাসকলাই সংগ্রহ করতে। সে করে মুরগিরা, আমি মাটি আঁচড়ে দেখি, কোন মাটি আমার উপযুক্ত দাড়াবার বেদী হতে পারে। আমি জানি, গান গাওয়া মিছে হবে যদি না ইট-পাটকেল ঘাস কুটো কাটা সব সরিয়ে এই পুরানো পৃথিবীর কালে মাটির পরশখানি নিতে ভুলি। পৃথিবীর বুকের খুব কাছে দাড়িয়ে মাটির সঙ্গে নিজেকে একেবারে মিলিয়ে তবে আমি গান করি। সোনালিয়া, প্রায় সবই তো শুনলে, আরো যদি জানতে চাও তে। বলি, আমাকে স্বর খুজে খুজে তো গান গাইতে হয় না, সুর আপনি ওঠে আমার মধ্যে, মাটি থেকে লতায় পাতায় রস যেমন ক’রে উঠে আসে, গানও তেমনি করে আমার মধ্যে ছুটে আসে আপনি, জন্মভূমির বুকের রস। পুব আকাশের তীরে সকালটি ফুটি-ফুটি করছে, ঠিক সেই সময় আমার মধ্যে উথলে উঠতে থাকে স্বর আর গান, বুক আমার কাপতে থাকে তারি ধাক্কায়, আর আমি বুঝি, আমি না হলে সরস মাটির এই সুন্দর পৃথিবীর বুকের কথা খুলে বলাই হবে না। সকালের সেই শুভ লগ্নটিতে মাটি আর আমি যেন এক হয়ে যাই, মাটির দিকে আমি আপনাকে নিয়ে যাই, আর পৃথিবী আমাকে সুন্দর শাখের মতো নিজের নিশ্বেসে পরিপূর্ণ করে বাজাতে থাকে, আমার মনে হয় তখন আমি যেন আর পাখি নই, আমি যেন একটি আশ্চর্য বাঁশি, যার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর কান্না আকাশের বুকে গিয়ে বাজছে।
“অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভোর রাতের হিম মাটি এই যে কাদন জানাচ্ছে, আকাশের কাছে তার অর্থ কী সোনালিয়া, সে আলো ভিক্ষে করছে, একটুখানি সোনার আলো-মাখা দিন তারি প্রার্থনা, ভোর বেলার সবাই কাদছে, দেখবে, আলো চেয়ে, গোলাপের কুঁড়ি সে অন্ধকারে কাদছে আর বলছে, আলো দিয়ে ফোটাও। ওই যে খেতের মাঝে একটা কাস্তে চাষারা ভুলে এসেছে, সে ভিজে মাটিতে পড়ে মরচে ধীরে মরবার ভয়ে চাচ্ছে আলো, একটু আলো এসে যেন রামধনুকের রঙে চারি দিকের ধানের শিষ রাঙিয়ে দেয়।
“নদী কেঁদে বলছে, আলো আমুক, আমার বুকের তলা পর্যন্ত গিয়ে আলো পড়ক। সব জিনিস চাচ্ছে যেন আলোয় তাদের রঙ ফিরে পায়, আপনার আপনার হারানো ছায়া ফিরে <
৬ পায়, তারা সারারাত বলছে, আলো কেন পাচ্ছি নে, আলো কী দোষে হারালেম।
“আর আমি কুঁকড়ো তাদের সে কান্না শুনে কেঁদে মরি, আমি শুনতে পাই ধান খেত সব কাদছে, শরতের আলোয় সোনার ফসলে ভরে ওঠবার জন্তে, রাঙা মাটির পথ সবর্কাদছে, যারা চলাচল করবে তাদের ছায়ার পরশ বুকের উপর বুলিয়ে নিতে আলোয়। শীতে গাছের উপরের ফল আর গাছের তলার গোল গোল মুড়িগুলি পর্যন্ত আলো তাপ চেয়ে কাদছে, শুনি। বনে বনে সূর্যের আলোক কে না চাচ্ছে বেঁচে উঠতে জেগে উঠতে, কে না আলোর জন্তে সারা রাত কাঁদছে। এই জগৎমৃদ্ধ সবার কান্না আলোর প্রার্থনা এক হয়ে যখন আমার কাছে আসে তখন আমি আর ছোটো পাখিটি থাকি নে, বুক আমার বেড়ে যায়, সেখানে প্রকাও আলোর বাজনা বাজছে শুনি, আমার দুই পাজর কাঁপিয়ে তার পর আমার গান ফোটে, “আ-লো-র ফুল”। আর তাই শুনে পুবের আকাশ গোলাপী কুঁড়িতে ভরে উঠতে থাকে, কাকসন্ধ্যার কী কী শব্দ দিয়ে রাত্রি আমার গানের স্বর চেপে দিতে চায়, কিন্তু আমি গেয়ে চলি, আকাশে কাগডিমে রঙ লাগে তবু আমি গেয়ে চলি আলোর ফুল, তার পর হঠাৎ চমকে দেখি আমার বুক সুরের রঙে রাঙা হয়ে গেছে আর আকাশে আলোর জবাফুলটি ফুটিয়ে তুলেছি আমি পাহাড়তলির কুঁকড়ে।”
সোনালি অবাক হয়ে বললে, “এই বুঝি তোমার মস্তর।”
“হাঁ, সোনালি, মন্তরটা আর কিছু নয়, আমি না থাকলে পুব আকাশে সব আলো ঘুমিয়ে থাকত এই বিশ্বাসটা আমি করতে পেরেছি এইটুকুই আমার ক্ষমতা, তা একে মন্তরই বলে বা তস্তরই বলে কিংবা অন্তরই বলো”, ব’লে কুঁকড়ো এমনি ঘাড় উচু ক’রে বুক ফুলিয়ে দাড়ালেন যে মনে হল যেন তিনি বলছেন— “ঘাড় হেঁট হয় এমন কাজ আমি করি নে, আমি নিজের গুণগান করে বেড়াই নে, আমি আলোর জয়-জয়কারই দিই, আমি জোরে গাই নিজের গলার রেশ নিজে শোনবার জন্তে নয়, আমি জোরে গাই আলোতে সব পরিষ্কার হয়ে ফুটবে বলে। কুঁকড়ে যতক্ষণ ব’লে চলেছিলেন ততক্ষণ সোনালি সব ভুলে তার কথাই শুনছিল, এখন কুঁকড়ে চুপ করতে তার চটকা ভেঙে গেল, কুঁকড়োর কথায় তার অবিশ্বাস হল; সে বলে উঠল, “একি পাগলের কথা। তুমি, তুমি ফুটিয়ে দাও আকাশে...” “সেই জিনিস যা চোখের পাতা মনের দুয়ারে এসে ঘুমের ঘোমটা খুলে দেয়। আকাশ যেদিন মেঘে ঢাকা, সেদিন জানব, আমি ভালো গাই নি।” -
“আচ্ছা, তুমি-যে দিনের বেলাও থেকে থেকে ডাক দাও, তার অর্থটা কী শুনি।” সোনালি শুধল। - -
কুঁকড়ো বললেন, “দিনের বেলায় এক-একবার গলা সেধে নিই মাত্র। আর কখনো-বা ওই লাঙলটাকে নয়তো কোদালটাকে ওই টেকি ও ওইখানে ওই কুড়ল এই কাস্তেকে বলি, ভয় নেই, আলোকে জাগিয়ে দিতে ভু-ল-ব-না ভু-ল-ব-না।”
সোনালি বললে, “ভালো, আলোকে যেন তুমি জাগালে, কিন্তু তোমাকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেয় কে, শুনি?”
“পাছে ভুল হয়, সেই ভয়েই আমি জেগে উঠি।”
কুঁকড়োর জবাব শুনে সোনালির তকরার করবার কোক বাড়ল বৈ কমল না; সে বললে, “আচ্ছ, তুমি কি মনে কর, সত্যি তোমার গানে জগৎ জুড়ে আলোর বান ডাকে?”
কুঁকড়ো বললেন, “জগৎ জুড়ে কী হচ্ছে তার খবর আমি রাখি নে, আমি কেবল এই পাহাড়তলিটির আলোর জন্য গেয়ে থাকি, আর আমার এই বিশ্বাস যে এ-পাহাড়ে যেমন আমি ও-পাহাড়ে তেমনি সে, এমনি এক-এক পাহাড়তলিতে এক-এক কুঁকড়ো রোজ রোজ আলোকে জাগিয়ে দিচ্ছে।” সোনালির সঙ্গে কথা কইতে রাত ফুরিয়ে এল। কুঁকড়ে দেখলেন, সকালের জানান দেবার সময় হয়েছে, তিনি সোনালিকে বললেন, “সোনালি, আজ তোমার চোখের সামনে সূর্য ওঠাব, আমাকে পাগল ভেবো না, দেখে এবং বিশ্বাস করে। আজ যে গান আমার বুকের মধ্যে গুমরে উঠছে,তেমন গান আমি কোনোদিন গাইনি, গানের সময় আজ তুমি কাছে দাড়াবে, আমার মনে হচ্ছে, আজ সকালটি তাই এমন আলোময় হয়ে দেখা দেবে যে তেমন সকাল এই পাহাড়তলিতে কেউ কখনো দেখে নি সোনালিয়া।” বলে কুঁকড়ে ঢালুর উপরে গিয়ে দাড়ালেন। নীল আকাশের গায়ে যেন আঁকা সেই কুঁকড়োকে কী সুন্দরই দেখাতে লাগল। সোনালি মনে মনে বললে, ‘একে কি অবিশ্বাস করতে পারি।” এইবার কুঁকড়ো সোজা হয়ে দাড়ালেন, গায়ের রঙিন পালক ঝাড়া দিয়ে। সোনালি দেখলে, তার মাথার মোরগ-ফুলটা যেন আগুনের শিখার মতে রগরগ করছে। পুর্ব দিকে মুখ করে কুঁকড়ে ডাক দিলেন, “ফ জী-ই-ই-র ফ-জী-র”. সোনালি শুনলে কুঁকড়ো যেন পুব আকাশকে হুকুম দিলেন, “কাজ শুরু করো”, আর অমনি মাটির হুকুম কাজের সাড়া সকালের বাতাসে অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে গেল,“ভোর ভয়ি ভো-র ভ-য়ি” হাকতে হাকতে। তার পর সোনালি দেখলে কুঁকড়ে যেন সব কাদের সঙ্গে কথা কইছেন, “বাদল বসন্তের চেয়ে দুদণ্ড আগে তোমার আলো এনে দেব ভয় নেই।” সোনালি দেখলে তিনি একবার মাটির কাছে মুখ নামিয়ে একবারও-ঝোপ এ-ঝোপের দিকে মুখ ফিরিয়ে কখনো ঘাসগুলির পিঠে ডানা বুলিয়ে কত কী বলছেন, যেন সবাইকে তিনি অভয় দিচ্ছেন আর বলছেন, “দেব দেব, আলো দেব, রোদ দেব, হিম আঁধার ঘুচবে, ভয় কী ভয় কী।” অণুপরমাণু ধুলোবালি তারা— কুঁকড়োর কানে কানে কী বলে গেল, কুঁকড়ো ঘাড় নেড়ে বললেন, “দোলন চাই, আচ্ছা,দোলন দিচ্ছি, সোনার সে দোলন বাতাসে ঝুলবে, আর অণু পরমাণু মিলে লাগবে ঝুলোন দে দোল দোল, দে দোল দোল।” সোনালি দেখলে আকাশ আর মাটির মধ্যে ঝোলানো পাতলা নীল অন্ধকার একটু একটুঘলছে আর দেখতে দেখতে ভোরের শুকতারা যেন ক্রমে নিভে আসছে। সোনালি বললে, “দিনের আলো দেবার আগে সব তারাগুলোকে বড়ো যে নিভিয়ে দিচ্ছ, এককে নিভিয়ে অন্তকে আলো দেওয়া, এ কেমন?” কুঁকড়ে একটু হেসে বললেন, “একটি তারাও আমি নিভিয়ে ফেলি নি সোনালি, আলো জ্বালাই আমার ব্রত, দেখো এইবার পৃথিবী আলোময় হচ্ছে, রাত্রি দূ-উ-উ-র হল দেখতে দেখতে।” সোনালির চোখের সামনে নীলের উপর হলদে আলো লেগে সমস্ত আকাশ ধানি রঙে সবুজ হয়ে উঠল, মেঘগুলোতে কমলা রঙ আর দূরের পাহাড়ে মাঠে সব জিনিসে কুসুম ফুলের গোলাপী আভা পড়ল। কুঁকড়ে ডাক দিয়ে চললেন, “আলোর ফুল আলোর ফু-ল-কি-ই-ই গোলাপী হোক সোনালি, সোনালি সে রুপোলি, রুপোলি হোক সাদা আ-লো-আ-লো-র ফুল”, কিন্তু তখনে দূরে খেতগুলোতে শোন ফুলের রঙ মেলায় নি, সব জিনিসে চমক দিচ্ছে, কুঁকড়ো ডাকলেন, “আ-লো-ও ও”, অমনি কাছের খেতের উপরে চট করে এক পোছ সোনালি পড়ল, পাহাড়ে ঝাউগাছের মাথায় সোনা ঝকমক করে উঠল। কুঁকড়ে পুব ধারের আকাশকে বললেন, “খুলুক খুলুক।” অমনি আকাশ জুড়ে পুব দিকে আলোর ছড়া পড়তে থাকল। পাহাড়ের দিকে চেয়ে কুঁকড়ে ডাকলেন, “খুলুক খুলুক”, অমনি সব পাহাড়ে পাহাড়ে গোলাপী ফুলে ভর পদম্ গাছ ছবির মতো খুলে গেল সোনালির চোখের সামনে। “খুলুক খুলুক”, দূরে ঝাপসা পাহাড় কুয়াশার চাদর খুলে যেন কাছে এসে দাড়াল। দূরের কাছের সব জিনিস ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে, অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে, নতুন করে আলো-ছায় দিয়ে গড় এক টুকরো পৃথিবী। শুকনো ছড়ি থেকে ফলন্ত আমগাছ গড়বার সময় ছেলেরা যেমন সেটার দিকে ই ক'রে চেয়ে থাকে সোনালি তেমনি কুঁকড়োর এই-সব কাগুকারখানা অবাক হয়ে দেখছিল, আর ভাবছিল কুঁকড়োই বুঝি এ-সবের ছিষ্টিকত্তা, এমন সময় কানের কাছে শুনলে, “মোন, বলে ভালোবাস তো?”
সোনালি খানিক চুপ করে থেকে বললে, “অন্ধকার থেকে এমন সকাল যে উঠিয়ে আনলে, তার সঙ্গে মনের কথা চালাচালি করতে কে না ভালোবাসে।”
কুঁকড়ো বললেন, “সরে এসো সোনালি, বুক তুমি আনন্দে ভরে দিয়েছ, তোমাকে পেয়ে আজ কাজ মনে হচ্ছে কত সহজ” এই ব'লে কুঁকড়ে ডাকলেন, “আলোর ফুলকি সোনালি”, সোনালি অমনি কুঁকড়োর একেবারে খুব কাছে এসে বললে,”ভালোবাসি গো ভা-লো-বা-সি।” কুঁকড়ে বললেন, “সোনালিয়া, তোমার সোনালিয়া রূপটি সোনালি কাজলের মতো আমার চোখের কোলে লাগল, তোমার মধুর মতে মিষ্টি আর সোনালি কথা প্রাণের মধ্যেটা সোনায় সোনায় ভরে দিয়েছে। এত সোনা আজ পেয়েছি যে মনে হচ্ছে এখনি ওই সামনের উচু পাহাড়টা আমি আগাগোড়া সোনায় মুড়ে দিতে পারি।” সোনালিয়া আদর করে বললে, “দাও-না পাহাড়টা গিলটি করে, আমি তোমাকে রোজ রোজ ভালোবাসব।” কুঁকড়ে হাক দিলেন, “সোনা-র জল সো-না-লি-য়া”, অমনি পাহাড়ের চুড়োয় সোনা ঝকঝক করে উঠল, তার পর সোনা গ’লে ঢালু বেয়ে আস্তে আস্তে নীচের পাহাড়ের গোলাপীতে এসে মিশল, শেষে গোলাপী ছাপিয়ে একেবারে তলায় মাঠের উপর গড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে দূর আর কাছের রাস্তা-ঘাট মাঠ-ময়দান ঘর-ভুয়োর গ্রাম-নগর বন-উপবন সোনাময় হয়ে দেখা দিলে। কিন্তু দূরে পাহাড়ের গায়ে এখানে ওখানে নদীর ধারে গাছগুলোর শিয়রে এখনো একটু-আধটু কুয়াশ মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে, ওগুলো তো থাকলে চলবে না, কুঁকড়ো প্রথম আস্তে বললেন, “সাফাই”, সোনালি ভাবলে, কুঁকড়ো বুঝি হাঁপিয়ে পড়েছেন আর বুঝি পারেন না গান করতে, কিন্তু একি যে-সে কুঁকড়ো যে কাজ বাকি রেখে যেমন-তেমন সকাল করেই ছেড়ে দেবে, “আরো আলো চাই” বলে কুঁকড়ো আবার গা-ঝাড় দিয়ে এমন গল। চড়িয়ে ডাক দিলেন যে মনে হল বুঝি, তার বুকটা ফেটে গেল, “আলোর ফুল আলোর ফুল, ফু-উ-উ-উল-কি-ই-ই আলো-র-র-র-র”। দেখতে দেখতে আকাশের শেষ তারাটি সকালের আলোর মধ্যে একেবারে হারিয়ে গেল, তার পর দূরে দূরে গ্রামের কুটিরের উপর জলন্ত আখার সাদা ধুয়ো কুণ্ডলী পাকিয়ে সকালের আকাশের দিকে উঠে চলল আস্তে আস্তে। সোনালি তাকিয়ে দেখলে কুঁকড়ো কী মুন্দর। সে সকালের শিল্পী কুঁকড়োকে মাথা নিচু ক’রে নমস্কার করলে। আর কুঁকড়ো দেখলেন, আলোর ঝিকিমিকি আঁচলের আড়ালে সোনালিয়ার মুন্দর মুখ। কুঁকড়ো মোহিত হলেন। আজ তাঁর সকালের আরতি সার্থক হল, তিনি এক আলোতে তাঁর জন্মভূমিকে আর তাঁর ভালোবাসার পাখিটিকে সোনায়সোনায় সাজিয়ে দিলেন। কুঁকড়ো আনন্দে চারি দিকে চেয়ে দেখলেন, কিন্তু তখনো কেন মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটু অন্ধকার লুকিয়ে আছে। তিনি আবার ডাক দিতে যাবেন, এমনি সময় নীচের পাহাড় থেকে একটির পর একটি মোরগের ডাক শোনা যেতে লাগল; যে যেখানে সবাই সকালের আলো পেয়ে গান গাচ্ছে। আগে আলো হল, পরে এল সব মোরগের গান, কুঁকড়ো কিন্তু সবার আগে যখন আলো ব’লে ডাক দিয়েছেন, তখনে। রাত ছিল, তিনি যে সবার বড়ো তাই অন্ধকারের মাঝে দাড়িয়ে তিনি আলোর আশা সবাইকে শোনাতে পারেন। আলো জাগানো হল, এইবার সূর্যকে আন চাই, কুঁকড়ে আবার শুরু করলেন, “রাঙা ফুল আগুনের ফুলকি", অমনি দিকে দিকে সব মোরগ গেয়ে উঠল সেই স্বরে, “আলোর ফুলকি, আলোর ফুল।” সোনালি বললে,“দেখেছ ওদের আস্পর্ধা। তোমার সঙ্গে কিনা মুর ধরেছে, এতক্ষণ সবাই ছিলেন কোথা?”
কুঁকড়ো বললেন, “তাহোক, স্বর বেম্বর সব এক হয়ে ডাক দিলে যাচাই তাপেতে বেশি দেরি হয় না, সূর্য দেখা দিলেন ব'লে।” কিন্তু তখনো কুঁকড়ে দেখলেন একটি কুটির ছায়ায় মিশিয়ে রয়েছে, তিনি হাক দিলেন অমনি কুটিরের চালে সোনার আলো লাগল। দূরে একটা সরষে খেত তখনো নীল দেখাচ্ছে, কুঁকড়ো ডাক দিলেন, আলো পড়ে খেতটা সবুজ হল, খেতে যাবার রাস্তাটি পরিষ্কার সাদা দেখা গেল, নদীটা কেমন ধুয়াটে দেখাচ্ছিল। কুঁকড়ো ডাকলেন, অমনি নদীর জলে পরিষ্কার নীল রঙ গিয়ে মিলল। হঠাৎ সোনালিয়া বলে উঠলে, “ওই যে সূর্য উঠেছেন।” কুঁকড়ো আস্তে আস্তে বললেন, “দেখেছি, কিন্তু বনের ওপার থেকে এপারে টেনে আনতে হবে আমাকে ওই সূর্যের রথ, এসে তুমিও”, বলেই কুঁকড়ো নানা ভঙ্গিতে যেন সূর্যের রথ টেনে ক্রমে পিছিয়ে চললেন, “তফাত হো তফাত হো” বলতে বলতে। সোনালিয়া বলতে লাগল, “আসছেন আসছেন”, কুঁকড়ো। হাপাতে হাপাতে বললেন, “ওপার থেকে এল রথ।” ঠিক সেই সময়ে শালবনের ওপার থেকে সূর্য উদয় হলেন সিন্দুর বরন। কুঁকড়ে মাটিতে বুক ঠেকিয়ে সূর্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বললেন, “আঃ, আজকের সূর্য কত বড়ো দেখেছ!” সোনালির ইচ্ছে, কুঁকড়ে সূর্যের জয় দিয়ে একবার গান করেন। কিন্তু গলার সব মুর খালি করে তিনি আজ সকালটি এনেছেন আর তাঁর সাধ্য নাইগাইতে। যেমন এই কথা সোনালিকে কুঁকড়ো বলেছেন, অমনি দূরে দূরে সব মোরগ ডেকে উঠল “উরু-উরু-রু-রু-রু”। কুঁকড়ো শুকনোমুখে বললেন, “আমি নেই-বাজয় দিলেম, শুনছ দিকে দিকে ওরাসব তুরী বাজিয়ের্তার উদয় ঘোষণা করছে।” সোনালি শুধলে, “সূর্য উঠলে পর তুমি কি কোনোদিনই তার জয়-জয়কার দাও না? তোমার নবতখানায় সোনার রৌশনচোঁকি সূর্যের জয় দিয়ে কি কোনোদিন বাজাও নি।”
“একটি দিনও নয়” বলে কুঁকড়ো চুপ করলেন। সোনালি একটু ঠেস দিয়ে বললে, “সূর্য তো তা হলে ভাবতে পারেন অন্য সব মোরগের তাকে উঠিয়ে আনে।” কুঁকড়ো বললেন, “তাতেই-বা কী এল গেল।” সোনালি আরো কী বলতে যাচ্ছে, কুঁকড়ো তাকে কাছে ডেকে বললেন, “আমি তোমায় ধন্যবাদ দিচ্ছি, তুমি আমার কাছে আজ না দাড়ালে সকালের ছবিটা কখনোই এমন উৎরতো না।” সোনালি কুঁকড়োর কাছে এসে বললে, “তুমি যে সকালটা করতে সূর্যের রথ বনের ওধার থেকে টেনে আনতে এত কষ্ট করলে তাতে তোমার লাভটা কী হল।” কুঁকড়ে বললেন, “পাহাড়ের নীচে থেকে ঘুমের পরে জেগে ওঠার যে সাড়াগুলি আমার কাছে এসে পেচচ্ছে, এইটেই আমার পরম লাভ” সোনালি সত্যিই শুনলে, নীচে থেকে দূর থেকে কাছ থেকে কী-সব শব্দ আসছে। সে পাহাড় থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে চারি দিক চাইতে লাগল। কুঁকড়ো চুপটি করে চোখ বুজে বসে বললেন, “কী শুনছ সোনালিয়া, বলো।”
সোনালিয়া বলে চলল, “আকাশের গায়ে কে যেন কাসর পিটছে।”
কুঁকড়ো বললেন, “দেবতার আরতি বাজছে।”
সোনালি বললে, “এবার যেন শুনছি মানুষদের আরতির বাজনা টং টং”
কুঁকড়ো বললেন, “কামারের হাতুড়ি পড়ছে।”
সোনালি, “এবার শুনছি গোরু সব হামা দিয়ে ডাকছে আর মানুষে গান ছেড়েছে।”
কুঁকড়ো, “হাল গোরু নিয়ে চাষা চলেছে।”
সোনালি এবার বললে, “কাদের বাসা থেকে বাচ্ছাগুলো সব রাস্তার মাঝে চলকে পড়ে কিচমিচ করে ছুটছে।”
কুঁকড়ো বলে উঠলেন, “পাঠশালার পোড়োর চলল”, ব’লে কুঁকড়ে সোজা হয়ে বসলেন। সোনালি আবার বললে, “পিপড়ের মতো করা সাদা হাত-পা-ওয়ালা কাদের সব ধরে ধরে আছাড় দিচ্ছে, খুব দূরে একটা জলের ধারে পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।”
কুঁকড়ো বললেন, “কাপড় কাচা হচ্ছে। আর দেখছি”—সোনালিয়া বললে, “এ কী, কালে কালে ফড়িংগুলো সব ইস্পাতের মতো চকচকে ডানা ঘষছে।” কুঁকড়ো দাড়িয়ে উঠে বললেন, “ওহে, কাস্তেতে যখন শান পড়ছে তখন ধান কাটার দিন এল ব’লে।” তার পর পাহাড়তলির থেকে এদিক থেকে ওদিক থেকে চারি দিক থেকে কত কিসের সাড়া আসতে লাগল। ঘণ্টার ঢং ঢং, হাতুড়ির ঠং ঠং, কুড়লের খটখট, জলের ছপ ছপ, সেকরার টুকটাক, কামারের এক ঘা, হাসি বাঁশি-বাজনা সব শুনতে লাগলেন কুঁকড়ো। কাজ-কর্ম চলেছে, কেউ কি আর ঘুমিয়ে নেই বসে নেই সত্যিই দিন এসেছে, কুঁকড়ো যেন স্বপন দেখার মতো চারিদিকে চেয়ে বললেন, “সোনালি,দিন কি সত্যিই আনলেম,এই-সব কারখানা একি আমার ছিষ্টি। দিন আমি যে আনলুম মনে করেছি আমি যে ভাবছি আকাশে আলো আমিই দিচ্ছি একি সত্যি, না এ-সব পাহাড়তলি পাগলা কুঁকড়োর খ্যাপামি আর খেয়াল? সোনালি, একটি কথা বলব, কিন্তু বলে সে কথা প্রকাশ করবে না, আমার শক্র হাসাবে না? সোনালি, তুমি আমাকে যাই ভাব-না কেন, আমি জানি এই স্বর্গে মর্তে আলো দেবার ভার নেবার উপযুক্ত পাত্র আমি নই, এত পাখি থাকতে অতি তুচ্ছ সামান্ত পাখি আমার উপর অন্ধকারকে দূর করবার ভার পড়ল? কত ছোটো, কত ছোটো আমি, আর এই জগৎজোড়া সকালের আলো সে কী আশ্চর্যরকম বড়ো, কী অপার তার বিস্তার। প্রতিদিন সকালে আলো বিলিয়ে যখন দাড়াই তখন মনে হয়, একেবারে ফকির হয়ে গেছি। আমি যে আবার কোনোদিন এতটুকুও আলো দিতে পারব তার আশাটুকুও থাকে না। সোনালি শুনলে যেন কুঁকড়োর কথা চোখের জলে ভিজে ভিজে, সে তাঁর খুব কাছে গিয়ে বললে, “মরি মরি।” কুঁকড়ো সোনালির মুখ চেয়ে বললেন, “আঃ সোনাল, যে আশা-নিরাশার মধ্যে আমার বুক নিয়ত তুলছে তার যে কী জ্বালা কেমন করে বলি। গান গাইতে হবে, আলোও জ্বালাতে হবে, কিন্তু কাল যখন আবার এইখানে দাড়িয়ে দশ আঙুলে আশার রাগিণী খুজে খুজে কেবলই মাটির বুকের তারে তারে টান দিতে থাকব, তখন হারানো সুর কি আবার ফিরে পাব, না দেখব, গান নেই গলা নেই আলো নেই তুমি নেই আমি নেই কিছু নেই? হারাই কি পাই, এরি বেদন মোচড় দিচ্ছে বুকের শিরে শিরে সোনালি। এই যে দো-টানায় মন আমার তুলছে এর যন্ত্রণা কে বুঝবে। রাজহাস যখন রসাতলের দিকে গলাটি ডুবিয়ে দেয়, সে নিশ্চয় জানে, পদ্মের নাল তার জন্তে ঠিক করা রয়েছে জলের নীচে, বাজপাখি যখন মেঘের উপর থেকে আপনাকে ছুড়ে ফেলে মাটির দিকে তখন সেও জানে ঠিক গিয়ে সে যেটা চায় সেই শিকারের উপরেই পড়বে, আর সোনালি তুমিও জান বনের মধ্যে উই পোকা আর পিপড়ের বাসার সন্ধান পেতে তোমায় এতটুকুও ভাবতে হয় না, কিন্তু আমার এ কী বিষম ডাক দেওয়া কাজ। কাল যে কী হবে সেই দুঃস্বপ্নই বয়ে বেড়াচ্ছি, আজকের ডাক আজকের সাড়া কাল আবার দেবে কি না প্রাণ, গান গাব কি না ফিরে আর-একবার, তাই ভাবছি সোনালিয়া।”
সোনালি কুঁকড়োকে আপনার ডানার মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললে, “নিশ্চয়ই কাল তুমি গান ফিরে পাবে গল। ফিরে পাবে, আলোর সুর মাটির ভালোবাসা আবার সাড়া দেবে তোমার বুকের মধ্যে।” ৭ কুঁকড়াে সােনালিকে বললেন, “কী আশার আলােই জ্বালালে সােনালি, বলো, বলো, আরাে বলো-।”
সােনালি চুপি চুপি বললে, “আহা মরি, কী সুন্দর তুমি।” “ও কথা থাক্ সােনালি।” “কী চমৎকারই গাইলে তুমি।” কুঁকড়াে বললেন, “গান ভালাে মন্দ যেমনি গাই আমি যে আনতে পেরেছি...।” সােনালি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “ঠিক, ঠিক, আমি তােমায় যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।” “না সােনালি, আমার কথার উত্তর দাও, বলাে, সত্যি কি।” সােনালি আস্তে বললে, “কী?” কুঁকড়াে বললেন, “বলল, সত্যি কি আমি”, সােনালি এবার তাড়াতাড়ি উত্তর দিলে, “পাহাড়তলির কুঁকড়াে তুমি সত্যি আলাে দিয়ে সূর্যকে ওঠালে আজ, এ আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”
“ভ্যালারে ওস্তাদ” বলেই তাল-চড়াইটা হঠাৎ উপস্থিত। কুঁকড়াে চমকে উঠে দেখলেন চড়াইটা তার মুখের দিকে চেয়ে ভুরু তুলে শিস দিচ্ছে আর নমস্কার করছে। কুঁকড়াে ভাবছেন এ হরবােলাটা সব শুনেছে নাকি। ইতিমধ্যে সােনালিয়া আস্তে আস্তে অন্য দিকে চলেছে দেখে তিনি ডাকলেন, “আমাদের একলা ফেলে কোথায় যাও সােনালি।” চড়াই যতই হাসুক কুঁকড়াের আজ কিছুই গায়ে লাগবে না, সােনালিকে কাছে পেয়ে তার আনন্দ ধরছে না।
চড়াই বললে, “বাহবা তারিফ। যা দেখলেম শুনলেম।”
কুঁকড়াে বললেন, “চটকরাজ, তুমি যে মাটি ফুড়ে উপস্থিত হলে দেখছি।”
চড়াই কুঁকড়ােকে সেই পুরানাে ময়লা খালি ফুলের টবটা দেখিয়ে বললে, “আমি ওইটের ভিতরে বসে একটা কান-কুটুরে পােকা কুট কুট করে খাচ্ছি এমন সময় আঃ, কী যে দেখলেম, কী যে শুনলেম তা কী বলি।”
কুঁকড়াে বললেন, “তার পর।” চড়াই অমনি বলে উঠলে, “তার পর যদি বলি ওই মাটির টবটা দিব্যি শুনতে পায় তবে কি তুমি অবাক হবে নাকি।”
কুঁকড়াে বললেন, “গামলা থেকে লুকিয়ে শােনা বিদ্যেও তােমার আছে দেখছি।” চড়াই জবাব দিলে, “শুধু শােনা নয় লুকিয়ে দেখার-লুকি-বিদ্যেও আমি জানি, আমি এমনি অবাক হয়েছিলেম যে কখন যে গামলার তলার ফুটোটা দিয়ে উকি মেরে সব দেখেছি তা আমার মনে নেই। আহা, কী দেখলেম রে, কী দেখলেম রে, কী সুন্দর কী সুন্দর।”
কুঁকড়ো তাকে এক ধমক দিয়ে বললে, “বটে, লুকিয়ে দেখা! তফাত যাও।” কুঁকড়ো যত ব’লেন, “তফাত তফাত”, চড়াই ততই লেজ নাচিয়ে বেড়ায় আর ঘাড় নেড়ে কুঁকড়োর নকল ক’রে কিচ কিচ ক’রে, “বিদ্যে ফাস লুকি-বিদ্যে হল ফাস ফুস-মস্তর হল ফাস ক্যাবাৎ কাব্যাৎ। কুঁকড়ো তার রকম দেখে হেসে ফেললেন। সোনালিয়া বললে, “চড়াই যখন সত্যিই তোমায় ভক্তি ক’রে তখন ওর সাত খুন মাপ।”
চড়াই বললে, “ভক্তি করব না? এমন আলেয়া বাজিগর বুজরুগ কেউ কি দেখেছে, কী সকালের রঙটাই ফলালে কী গানটাই গাইলে গা যেন তুবড়িবাজি ভুস।”
সোনালি বললে, “এখন তোমরা দুই বন্ধুতে আলাপ-সালাপ ক’রে, আমি চললুম।”
কুঁকড়ো বললে, “কো-ক্-কো-ক্ কোথায়?”
সোনালি বললে, “ওই যে সেই—।”
চড়াই অমনি ব’লে উঠল, “তাই তো, কুঁকড়োর গানের গুণে চিনে-মুরগির ছোটো হাজিরিও জমতে চলল, সাধে বলি কুঁকড়োর গান গাওয়া, চিনে-মুরগির চা খাওয়া,একসঙ্গে আসা যাওয়া।”
কুঁকড়ো সোনালিকে চুপি চুপি শুধলেন, সে একা যাবে, না তিনিও সঙ্গে যাবেন?
সোনালি বললে, না ওরকম মজলিসে তার যাওয়াটা ভালো দেখায় না। কুঁকড়ো সোনালিকে বললেন, “তবে তুমি যাচ্ছ যে।”
সোনালি বললে, “আমি যাচ্ছি আজ তোমার আলোর ঝকমকানিটা কেমন তাই সেই-সব হিংসুক পাখিকে দেখিয়ে আসব”, ব’লে সোনালি একবার গা ঝাড়া দিলে তার সোনার পালকগুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে পড়তে লাগল। সোনালি কুঁকড়োকে সেইখানে তার জন্যে থাকতে ব’লে চিনে-মুরগির মজলিসে চলল। চড়াই অমনি তাড়াতাড়ি ব’লে উঠল,“হা, কুঁকড়োর আজ সেখানে না গেলেই ভালো।”
কুঁকড়ো শোধালেন, “কেন।”
“সে তোমার শুনে কাজ নেই” ব’লে চড়াই মিটমিট ক’রে চাইতে লাগল সোনালির দিকে। সোনালি হেসে বললে, “না, চড়াইকেও যে তুমি পাগলা করলে” বলে সোনালী পাখি সোনালী ডান মেলে উড়ে গেল। কুঁকড়ো চড়াইয়ের দিকে চেয়ে ভাবছেন, জিন্ম একে দেখতে পারে না, কিন্তু চড়াইট নেহাত মন্দ নয়, একটু বক্তার বটে, কিন্তু বদমাশ তো নয়।
চড়াই এবার লেজ নেড়ে বললে, “বলিহারি তোমার বুদ্ধিকে, সব মুরগিগুলোকে বিশ্বাস করিয়েছে যে তুমিই সূর্যোদয় করে থাক, মেয়েদের চোখে ধুলো দিতে তোমার মতো দুটি নেই, এতদিনে বুঝলেম মুরগিরাকেন তোমার অত প্রশংসা করে। হয় কলম্বস যে ডিমটি নিয়ে রাজাকে ডিমের বাজি দেখিয়েছিলেন সেই ডিমটি থেকে তুমি বেরিয়েছ, নয়তো সিন্ধবাদ যে আজগুবি সামোরগের ডিমের গল্প লিখে গেছে, তারি তুমি বাচ্ছ, এ না হলে তুমি আলোর আবিষ্কর্তা হতে না আর মুরগিদের এমন আজগুবি কথা শুনিয়েও ভোলাতে পারতে না। অণু পরমাণুদের জন্তে আলোর দোলন, খড়ের চালে সোনার পোচ, এ-সব খেয়াল কি যে-সে মাথা থেকে বার হয়, না আপনাকে অতি দীন অতি হীন ব’লে চালিয়ে যেমনি দিন এল বলে অমনি আলোর ফুল ব'লে চেচিয়ে উঠে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে যাওয়া যার-তার কর্ম।”
রাগে কুঁকড়োর দম বন্ধ হবার জোগাড় হচ্ছিল, তিনি অতি কষ্টে বললেন, “থামো, চুপ।”
চড়াই তু-পাপিছিয়ে গিয়ে বললে, “আচ্ছ, সত্যি কি তুমি জান না যে দিন-রাত যে আসে সেটা একটা প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া আর কিছু নয়?”
কুঁকড়ো বললে, “তুমি জানতে পার আমি জানি নে। আর যাই নিয়ে ঠাট্টা কর, করে, এ কথা নিয়ে আর কোনোদিন তামাশা কোরো না যদি আমার উপর তোমার একটুও মায়া থাকে।”
চড়াই মুখে বললে, খুব মায়া খুব শ্রদ্ধা সে কুঁকড়োকে করে কিন্তু তবু খোচা দিয়ে ঠেস দিয়ে কথা সে বলতে ছাড়ছে না, তর্কও করতে চায়।
কুঁকড়ো রেগে বললেন, “কিন্তু যখন আমি ডাক দিতেই সূর্য উঠল আলো হল, সে আলো পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে গেল, আকাশে নানা রঙ ধরলে তখনো কি একবার তোমার মনে হয় না যে এ-সব কাণ্ড করলে কে।” চড়াই বললে,“গামলায় গর্তটা এমন ছোটো যে সেখান থেকে আমি কেবল একটুখানি মাটি আর তোমার ওইহলুদবরন চরণ-কুখানি দেখেছিলেম,আকাশটাকোথায়, তা খবরেও আসে নি।”
কুঁকড়োবললেন, “তোমার জন্য আমার ছঃখু হয়, আলোর মর্ম বুঝলে না, তুমি যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকে। অত্যন্ত চালাক পাখি।”
চড়াই জবাব দিলে, “বেশ কথা, অতি বিখ্যাত কুঁকড়ে।”
কুঁকড়ো বললেন,“বেশ কথা, যে থাকবার থাক, আমি যেমন চলেছি সূর্যের দিকে মুখ রেখে তেমনিই চলি দিনরাত এই পাখি-জন্ম সার্থক ক’রে নিয়ে। চড়াই জান, বেঁচে সুখ কেন তা জান?”
চড়াই ভয় পেয়ে বললে, “তত্ত্বকথা এসে পড়ল শুনেই মনে হয় পিপড়ের পালক ওঠে মরিবার তরে”, ব’লে চড়াই নিজের পালক খুটতে লাগল। কিন্তু কুঁকড়ে বলে চললেন, “কিছুর জন্যে যদি চেষ্টা না করব তবে বেঁচেই থাকা বৃথা, বড়ো হবার চেষ্টাই হচ্ছে জীবনের মূল কথা, তুই চড়াই সবার সব চেষ্টাকে উড়িয়ে দিতে চাস, সেইজন্যে তোকে আমি ঘৃণা করি, এই যে এতটুকু গোলাপী পোকাটি এক মস্ত ওই গাছের গুড়িটাকে রুপোর জাল দিয়ে গিল্টি করতে চাচ্ছে, ওকে আমি বাস্তবিকইভান্ধা করি।” “আর আমি ওকে টুপ করে গালে ভরি” বলেই চড়াই পোকাটিকে ভক্ষণ করলেন। “তোর কি দয়া-মায়া নেই রে। যাঃ, তোর মুখ দেখব না” বলে কুঁকড়ো চললেন। চড়াই বললে, “দয়া-মায়া নেই কিন্তু ঘটে আমার বুদ্ধি আছে, যা হোক আমি আর তোমার কিছুতে নেই তোমার শত্রুরা যা-ইচ্ছে করুক বাপু, আমার সে কথায় কাজ কী, তুমি জান আর তারা জানে।”
কুঁকড়ো শোধালেন, “শক্র কারা শুনি?”
“কেন, পেচার।” চড়াইট বলে উঠল।
“শেষ এও ভাগ্যে ছিল, পেচা হলেন শত্রু আমার, হাঃ হাঃ হাঃ” ব’লে কুঁকড়ো হেসে উঠলেন।
চড়াই বললে, “আলোর কাছে তারা এগোতে পারে না বটে, সেইজন্যে তারা এক বাজখাই গুগু জোগাড় করেছে, যে পাখি রোজই দিন গুনছে তাকে জবাই করতে।” “কাকে তারা জোগাড় করেছে” কুঁকড়ো শোধালেন।
চড়াই বললে, “তোমারই জাতভাই হায়দ্রাবাদি মোরগ, আঃ, সে যে কুস্তিগীর ভীম বললেই চলে, সে তোমার আসা-পথ চেয়ে সেখানে আছে।” কুঁকড়ো শোধালেন, “কোথায়।” “ওই চিনে-মুরগির ওখানে” চড়াই বললে। কুঁকড়ো শোধালেন, “তুমি তাকে দেখতে যাচ্ছ নাকি।” “না বাবা, যে তার পায়ে লোহার কাটা বাধা কী জানি যদি লেগে যায় তবে” ব’লে চড়াইট আড়চোখে কুঁকড়ো কী করেন দেখতে লাগল। কুঁকড়ো চট করে কুলতলার দিকে ঘুরে দাড়ালেন। চড়াই যেন কত ভয় পেয়ে বললে, “যাচ্ছ কোথায়।” “কুলের কাটা যেখানে অনেক সেই কুলতলাতে যাচ্ছি” বলে কুঁকড়ো ঘাড় উচু ক’রে পায়ে পায়ে চললেন। চড়াই যেন কুঁকড়োকে কিছুতেই যেতে দেবে না এমনি ভঙ্গি করে বললে, “নাতোমার যাওয়া সেখানে মোটেই উচিত হবে না, আমি বলছি যেয়ে না।” “যাওয়া চাই” ব’লে কুঁকড়ো গম্ভীর মুখে পুরোনো ফুলের খালি টবট দেখে বললেন, “এই ছোটো গামলাটির মধ্যে তুমি সেঁধোলে কেমন ক’রে” “কেন এমনি ক’রে” বলেই চড়াই লাফিয়ে সেটার মধ্যে গিয়ে বললে, “কেন এই এমনি করে সেধিয়ে এই ফুটো দিয়ে আমি দেখলুম”, “কী দেখলে?” “কেন মাটি”, “আর, এইবার আকাশ দেখে নাও।” বলেই কুঁকড়ো ডানার এক ঝাপটে টবটা উলটে চড়াইকে চাপা দিয়ে সোজা চলে গেলেন। চড়াইট গামলার মধ্যে থেকে বেরোবার জন্মে ঝটাপটি করতে থাকল “গেছি গেছি” ব’লে।