ইংরেজ ডাকাত/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ
এই সময়ে একখানি ট্রেণ পশ্চিম হইতে আগমন করিল। আমরা তিনজনেই সেই ট্রেণে উঠিয়া, দিবা বারটার সময় মেমারি ষ্টেশনে পৌছিলাম। মেমারি ষ্টেশনে কয়েকখানি ঘোড়ার গাড়ি দেখিয়া, হাবিৎ সাহেব পূর্ব্ব প্রস্তাব আর ঠিক রাখিতে পারিলেন না; পদব্রজে যাওয়ার পরিবর্ত্তে গাড়ি করিয়া যাওয়াই তখন স্থির হইল। ষ্টেশন হইতে একজন পিয়নকে একখানি গাড়ি আনিতে পাঠাইয়া দিলেন। পিয়ন গাড়ি আনিতে গেল, সাহেবদ্বয় ওয়েটিং রুমে বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। আমি ভাবিলাম,—যখন এইস্থানে আসিলাম, তখন এই অবকাশে যতদূর পারি, এখানে একটু অনুসন্ধান করিয়া লই। এই ভাবিয়া আমি বুকিং অফিসের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাবুদিগকে জিজ্ঞাসা করায় কেহ কিছু বলিতে পারিলেন না। সেইস্থানে সিগ্নালার বাবু রজনীনাথ রায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি কহিলেন, “৬ই মার্চ তারিখে কলিকাতার প্রথম ট্রেণ দশটার কিছু পূর্ব্বে এইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হয়। সেই ট্রেণ হইতে যে সকল লোক এইস্থানে অবতরণ করে, তাহাদিগের টিকিট আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। উহাদিগের মধ্যে দুইজন সাহেব ছিলেন। তাহাদের টিকিট ছিল—শ্রীরামপুর হইতে আসানসোল পর্যন্ত। আমি টিকিট দেখিয়া সাহেবদ্বয়কে বলিয়াছিলাম, আপনারা ভুল করিয়াছেন, এ আসনসোল ষ্টেশন নহে, এ মেমারি। সাহেবদ্বয় আমার কথায় কর্ণপাত না করিয়া, বাজারের দিকে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু তাহার পর যে কোথায় গমন করিল, তাহা বলিতে পারি না। ইহাদের মধ্যে একজনের টুপি ছিল না।”
রজনীনাথের কথা শ্রীরামপুর ষ্টেশন মাষ্টারের কথার সহিত মিলিল দেখিয়া, আমি বাজারের দিকে গমন করিলাম।
বাজারের দোকানদারদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া ক্রমে জানিতে পারিলাম যে, সাহেবদ্বয় সেই স্থানের সরাবের দোকান অভিমুখে গমন করিয়াছিল। সরাবের দোকানে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, ৬ই তারিখে দুইজন সাহেব তাহাদের দোকানে গমন করিয়া অতি সামান্য পরিমাণে মদ্যপান করে, এবং তাহার মূল্যের দরুণ একথানি দশ টাকার নিতান্ত জীর্ণ ও মলিন নোট প্রদানপূর্ব্বক অবশিষ্ট টাকা লইয়া প্রস্থান করে। কিন্তু কোথায় যে গমন করে, তাহা তাহারা বলিতে পারিল না। সেই দোকান হইতে তখন পুনরায় বাজারে প্রত্যাগমন করিলাম। সেইস্থানে কতকগুলি মুটিয়া বসিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে একজন কহিল, “আজ তিনদিবস হইল, বেলা এগারটার সময় আমি দুইজন সাহেবকে সিউচরণ বাদীর গরুর গাড়িতে চক্দীঘির পথে গমন করিতে দেখিয়াছি।” অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, সিউচরণের বাসস্থান মেমারি হইতে প্রায় দুই মাইল ব্যবহিত। এই সকল সংবাদ সংগ্রহ করিতে প্রায় দিবা একটা বাজিয়া গেল, সেই সময় আমার অতিশয় ক্ষুধাবোধ হইতে লাগিল। স্নান আহ্নিক করিবার অবকাশ আর হইল না। মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়া সেই বাজারের একখানি মেঠাইয়ের দোকান হইতে কিছু আহারীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া ভক্ষণপূর্ব্বক ষ্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
আসিয়া দেখিলাম, একখানি ঘোড়ার গাড়ি আনা হইয়াছে ও সেই গাড়ির ভিতর দুইজন সাহেবই বসিয়া আমার অপেক্ষা করিতেছেন। আমার বিলম্ব হইয়াছে, আর “কালা বাঙ্গালীর” অপেক্ষায় যখন তাহারা অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন, তখন কাজেই ইংরাজের রাগ হইতে পারে। কিন্তু তাঁহারা রাগ করিয়া আমার কি করিবেন, আমি তাঁহাদিগের অধীনস্থ কর্মচারী নহি।
হাবিৎ সাহেবের মেজাজ স্বভাবতই একটু গরম। তিনি আমাকে দেখিয়াই ইংরাজীতে কহিলেন, (এই সময় সাহেব আবার ইংরাজীতেই কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু আমরা সে সকল কথা বাঙ্গালায় লিখিব), “তোমার নিমিত্ত বসিয়া বসিয়া এত বিলম্ব হইল, নির্দ্দিষ্ট কর্ম্মে গমন করিব কখন? বাঙ্গালী অকর্ম্মণ্য জাতি, কেবল গাল-গল্পেই মজবুত! দেখ দেখি, কত সময় মিথ্যা নষ্ট করিলে?”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমার মনে মনে একটু রাগ হইল। তাঁহাকে কহিলাম, “আমি আপনাদিগের সহিত এ কর্ম্মে নিযুক্ত হই নাই, আপনারা অক্লেশে গমন করিলেই পারিতেন; আমার নিমিত্ত অপেক্ষা করিয়া থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। এখন আপনার গমন করুন, আমি আপনার সহিত যাইব না।” এই বলিয়া আমি সেইস্থান হইতে ষ্টেশনের ভিতর গমন করিলাম।
ডালসুরি সাহেব নিতান্ত ভদ্রলোক। তিনি গাড়ি হইতে অবতরণপূর্ব্বক আমার নিকট আগমন করিয়া, আমাকে মিষ্টকথায় অনেক বুঝাইলেন, ও পরিশেষে আমাকে ধরিয়া গাড়ির নিকট লইয়া গেলেন। তখন হাবিৎ সাহেব কহিলেন, “আমি রাগ করিয়া তোমাকে কিছু বলি নাই। এখন যেকার্য্যে গমন করিতেছি, মিথ্যা সময় নষ্ট না করিয়া আইস, সেই কার্য্য সমাপন করি।”
হাবিৎ সাহেব বা ডালসুরি সাহেব তখন পর্যন্ত্য বুঝিতে পারেন নাই যে, আমি কেন তাহাদিগের সহিত গমন, করিতে অসম্মত। সেই সময় আমি কহিলাম, “সাহেব। আমি মিথ্যা সময় নষ্ট করি নাই, তোমরাই বসিয়া বসিয়া কেবল সময়ের বৃথা অপব্যয় করিয়াছ।” এই বলিয়া আমি যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার আনুপূর্ব্বিক উঁহাদিগকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তাঁহার কহিলেন, “আমরাই অনর্থক সময় নষ্ট করিতে গমন করিতে ছিলাম। এখন তুমি যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ, সেই সংবাদ মত তাহাদের অনুসরণ করিতে পারিলে, নিশ্চয়ই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। এখন চল, চক্দীঘি গমন করি; তাহা হইলে বোধ হয়, তাহাদিগকে পাইলে পাইতে পারিব।”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “সাহেব! এ ব্যস্ততার কার্য্য নহে। আমরা জানিতে পারিতেছি যে, তাহারা চক্দীঘির পথে গমন করিয়াছে; কিন্তু একথা কেমন করিয়া বলিতে পারি যে, তাহারা অন্যস্থানে না গিয়া চক্দীঘিতেই গিয়াছে? যদি আমার পরামর্শ শুন সাহেব, তবে এক কাজ কর;—প্রথমে সেই গাড়োয়ান সিউচরণের অনুসন্ধান কর, দেখ সে কি বলে।” আমার কথা শুনিয়া হাবিৎ সাহেব আমার সহিত সিউচরণের গ্রামে গমন করিতে চাহিলেন। হাবিতের কথা শুনিয়া আমার একটু রাগ হইল। ভাবিলাম, কোথাকার এক হাবাতে সাহেবের সহিত পড়িয়াছি; সে না বুঝে কথা, না বুঝে কার্য্য। তখন আমি তাহাকে কহিলাম, “সাহেব! তুমি অমন কর্ম্ম করিও না। এ নিতান্ত পল্লীগ্রাম, এই স্থানের অনেক লোক আজও পর্য্যন্ত সাহেব দেখিয়াছে কি না সন্দেহ; এরূপ অবস্থায় তুমি আমার সহিত গমন করিলে, কোন কার্য্যই হইবে না। তোমরা এইস্থানে অপেক্ষা কর, আমি গমন করিয়া সিউচরণের অনুসন্ধান করি। যদি তাহাকে পাই, তাহা হইলে তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিব।” ডালসুরি আমার কথা বুঝিল, এবং হাবিৎকে সে বুঝাইল। আমি সিউচরণের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত দুই মাইল পথ হাঁটিয়া, সেই গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। সিউচরণ তাহার বাড়ীতেই ছিল, সে আমার সহিত আসিতে প্রথমে অস্বীকার করিল; পরিশেষে তাহাকে অনেক প্রকার বুঝাইয়া, দিবা আড়াইটার সময় সাহেবদিগের নিকট উহাকে আনয়ন করিলাম। সিউচরণ যাহা বলিল, তাহা শুনিয়া আমরা সকলেই সাহেবের সেই ভাড়াটিয়া গাড়িতে চক্দীঘি-অভিমুখে যাত্রা করিলাম। বলা বাহুল্য, সিউচরণ আমাদের সঙ্গেই চলিল।