বিষয়বস্তুতে চলুন

ইংরেজ ডাকাত/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 যে হরিণ-বাড়ীর জেলে ওয়ার্ণার ছিল, হিলিও সেই জেলে ছিলেন। হিলি প্রথমে সৈনিক পদ গ্রহণ করিয়া ইংলণ্ড হইতে এ প্রদেশে আগমন করেন। তিনি দলের মধ্যে একজন অতিশয় বলশালী সৈনিক পুরুষ। যতদিন তিনি এদেশে সৈনিক বিভাগে কর্ম্ম করেন, তাহার মধ্যে দুই তিনটী সম্মুখ সংগ্রামে নিযুক্ত হন—যুদ্ধ কয়েকটীতেই ইংরাজের জয়লাভ হয়। যে সকল যুদ্ধে এবং যে যে কর্ম্মচারীর অধীনে তিনি নিযুক্ত হন, তাহার পরিচয় এখানে অনাবশ্যক। হিলি একজন প্রকৃত যোদ্ধা; তাঁহার শরীরে এখনও অনেক ‘গুলির’ চিহ্ণ বিদ্যমান আছে। কয়েক বৎসর তিনি সৈনিক-বিভাগে কর্ম্ম করিলে, পরিশেষে তাঁহার রেজিমেণ্ট (Her Majesty's Own Scottish Border’s Regiment.) যখন মিরাটে ছিল, সেই সময়ে তিনি বিনা-অনুমতিতে নিরুদ্দেশ হন, এবং কোন সুযোগে ইংলণ্ড যাত্রা করেন। সেস্থানে গমন করিয়া, কি জানি, কি কারণে তিনি সৎপথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক অসৎপথ অবলম্বন করেন; একজন প্রসিদ্ধ ডাকাতের সহিত সম্মিলিত হইয়া ডাকাইতি-ব্যবসায় আরম্ভ করেন। ক্রমে তিনি একটী প্রধান ডাকাইত দলের সর্ব্ব প্রধান নেতা হয়েন। ইংলণ্ডে তিনি যে কত শত ভয়ানক ভয়ানক ডাকাতিতে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার সম্পূর্ণ ইতিহাস এদেশে প্রাপ্ত না হওয়া গেলেও, যাহা কিছু জানিতে পারা গিয়াছে, তাহার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ এইস্থানে লিপিবদ্ধ করিতে হইলে, পুস্তকের কলেবর নিতান্ত দীর্ঘ হইয়া পড়িবে বলিয়া তাহা পরিত্যক্ত হইল। এক কথায়, ইংলণ্ডে তিনি অনেক ভয়ানক চুরি ও ডাকাইতি করিয়া, সেইস্থানের সুযোগ্য পুলিস ও ডিটেক্‌টিভের চক্ষে ধূলি প্রদান করেন। পুলিস তাঁহার জ্বালায় নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া, অন্য কর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক কেবল তাঁহারই উপর দৃষ্টি রাখেন; ভাল ভাল খ্যাতনামা বিলাতি ডিটেক‍্টিভগণ তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিতে থাকেন। এইরূপ নানাকারণে বাধ্য হইয়া ইংলণ্ড পরিত্যাগ পূর্ব্বক হিলি পুনরায় এদেশে পদার্পণ করেন! প্রথমে বোম্বাইতে আগমন করেন, ও সেইস্থান হইতে কলিকাতায় আসিয়া, কোন হোটেলের একটী ত্রিতল গৃহে অবস্থান করিতে থাকেন।

 এই সময়ে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্ট্রীটের নিকটবর্ত্তী স্থান সকলে ভয়ানক চুরি আরম্ভ হইল। প্রত্যহ প্রাতঃকালে সংবাদ আসিতে লাগিল, আজ তিনজন ইংরাজের গৃহ হইতে চেন ও ঘড়ী প্রভৃতি চুরি হইয়া গিয়াছে; কল্য আর পাঁচস্থানের পাঁচজন ইংরাজের চেন, ঘড়ী ও আংটী প্রভৃতি মূল্যবান্ দ্রব্যাদি পাওয়া যাইতেছে না; ইত্যাদি সংবাদের উপর সংবাদ আসিতে আরম্ভ করিল। অনুসন্ধান চলিতে লাগিল; প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ ইংরাজ ও দেশীয় কর্ম্মচারীগণের মধ্যে প্রায় সকলেই এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন। আমাকেও তাঁহাদিগের সহিত যোগ দিতে হইল। যিনি যেরূপভাবে অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা করিলেন, তিনি সেইরূপেই আপনার বুদ্ধির চালনা করিতে লাগিলেন; কিন্তু কাহারও দ্বারা যে কোনরূপ সুফল ফলিবে, তাহা বোধ হইল না। যিনি দর্প করিয়া এই অনুসন্ধানে যোগ দিলেন, ভগবান্ তাঁহার দর্প চূর্ণ করিলেন। যাহার মনে মনে অভিমান ছিল যে, তাহার মত সুনিপুণ অনুসন্ধানকারী আর কেহই নাই; এই চুরিতে তাহার সেই অভিমান দূরে পলায়ন করিল। স্থূল কথায়, কাহারই দ্বারা এই সকল চুরির অনুসন্ধানের ফল ফলিল না, অপহৃত দ্রব্যগুলির কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না। সাহেবদিগের খানসামা-বাবুর্চিদিগকে বিশেষরূপে জিজ্ঞাসা করায় কেহ কহিল, ‘রাত্রিতে আমাদের কুঠিতে একজন মুসলমান-বেশী লোককে দেখিয়াছিলাম।’ কেহ বলিল, ‘আমি চোরকে পলাইতে দেখিয়াছি, সে ইহুদি।’ কেহ বলিল, ‘চোর আমার হস্ত ছাড়াইয়া পলাইয়া গিয়াছে—সে ফিরিঙ্গি।’ এইরূপ নানাকথা শুনা যাইতে লাগিল; সুতরাং চোর কে, বা কোন্ জাতীয় লোক, তাহা কিছুই স্থির হইল না। এইরূপে চারি পাঁচদিবসের মধ্যে উক্ত স্থানটী একরূপ অরাজক হইয়া উঠিল। পুলিসের যিনি মস্তক, তাঁহারও মস্তক ঘূরিয়া গেল—হস্তপদের ত কথাই নাই! কি প্রকার বন্দোবস্ত করিলে, এই চুরি বন্ধ হয়, এবং চোর ধরা পড়ে, তাহার নানাপ্রকার যুক্তি ও পরামর্শ হইতে লাগিল। পরিশেষে সাব্যস্ত হইল যে, যে স্থানে চুরি হইতেছে, সেইস্থানে রীতিমত পুলিশ পাহারার বন্দোবস্ত করা হইবে।

 পরামর্শ-অনুযায়ী সেইস্থানে পাহারা পড়িল। পাহারার নিমিত্ত সেইস্থানে এত পরিমাণে পুলিসের আমদানী হইল যে, দশহস্ত অন্তর একজন করিয়া পাহারায় নিযুক্ত হইল। ইহা ব্যতীত প্রত্যেক বাড়ীর দরজায় পুলিস রহিল। পাহারাওয়ালা ব্যতীত উর্দ্ধতন-কর্ম্মচারীমাত্রই অর্থাৎ ইন‍্স্পেক্টার পর্য্যন্ত পাহারায় নিযুক্ত হইলেন। ইহার উপর তাঁহাদের উর্দ্ধতন-কর্মচারীগণও ঘুরিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য যে, আমরাও সে পাহারা হইতে পরিত্রাণ পাইলাম না।

 তথাপি চুরি বন্ধ হইল না। এইরূপে ক্রমে সাতদিবস গত হইয়া গেল, তথাপি চুরি বন্ধ হইল না। এই ভয়ানক সতর্ক অভেদ্য পাহারার ভিতরও সকলের চক্ষে ধূলি দিয়া চোরে চুরি করিতে লাগিল।