উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/খুঁত ধরা ছেলে

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

খুঁত ধরা ছেলে

 বিলাতে চারটি ভাই একদিন এক জায়গায় বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিল। তাহাদের আলাপের বিষয়, কে কি করিবে। সকলেরই মনে ইচ্ছা, একটা কিছু হওয়া চাই। সকলের ‘একটা কিছু’ ত আর একরকম হয় না। তাই চার ভাই চারকম কথা বলিল।

 একজন বলিল—‘আমি ইঁটের কারবার করিব। তাহাতে টাকা হইবে, আর ইঁট দিয়া আমার একখানা বাড়ি করিব।’

 আর-একজন বলিল—‘দূর হ, তোর নেহাত ছোট নজর। আমি তোর চাইতে বেশি একটা কিছু হ’ব— আমি ইঞ্জিনিয়ার হব॥ কত লোক আমার কাছে ঘরবাড়ির নক্সা করিয়া নিতে আসিবে,কত লোকের বাড়ি ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্ কি, আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্।’

 তৃতীয় ভ্রাতা—‘বিল্‌ডার, কণ্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’

 শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলিল—‘তোরা যাহাই করিস্ ভাই, এমন কিছু করিতে পারিবি না যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল, দেখ্ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি?’

 চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তা ছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কণ্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপালিটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি কবিতে গিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনকরূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল।

 একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার; স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দারোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলেন না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না; তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম। দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যাণ্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময়ে কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজায় ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন—

 ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি?

—দরজাগুলি ত মন্দ নয়, কিন্তু স্বর্গের দ্বার বন্ধ থাকিবে কেন? দরজাগুলি আরো বড় হওয়া উচিত।’

 ‘তুই কেরে, পৃথিবীর লোক, ক্যাচ্ ক্যাচ্ করিয়া কথা কহিতেছিস্?’

 ‘অত মোটা সুরে বলিতেছেন কেন?—আমি স্বর্গে যাইতে চাই।’

 ‘বটে? তুই করিয়াছিস কে?’

 ‘আমি খুঁত-ধরা কাজ করিয়াছি। আমার তিন ভাই যে কাজ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দোষ আমার নোট বহিতে লিখিয়া আনিয়াছি। যে ইঁট পোড়াইয়াছিল, সে আর দুই মণ কয়লা কম খরচ করিলে সুরকিওয়ালা সহজেই খোয়া করিতে পারিত। যার নামে স্ট্রীট হইয়াছে, সে এত রোগা যে অত বড় স্ট্রীট তাহার দরকার নাই। যে নূতন ধরণের বাড়ী বানিয়েছিল সে বাড়ী চাপা পড়িয়া মরিয়াছে—’

 ‘আরে থাম্ থাম্, ও-সব কি কাজ? তুই নিজের হাতে কি করিয়াছিস্?

 ‘এই-সব নোট লিখিয়াছি।’

 ‘দূর হ ব্যাটা, তুই কি আর কোন কাজই করিস্ নাই? কেবল দোষ ধরা কাজই করিয়াছিস্?’

 ‘আর স্মৃতি পুস্তিকায় তাহা লিখিয়াছি।’

 ‘যা, যা! তোর এখানে আসিবার হুকুম নাই।’

 ‘আউ পচারিব কাঙ্কু, জগনাথঙ্কু,—’ বলিয়া দারোয়ান দেবতা গান ধরিলেন। আমাদের সমালোচক দেখিলেন যে এত পথ খরচ, রেলভাড়া, গাড়িভাড়া করিয়া আসিয়াও কোন ফল পাইলেন না। বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন যে, কাগজে লেখা উচিত ‘স্বর্গে ভালো অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত নাই।’ গাড়ি পাইতে অনেক দেরি, সুতরাং ইত্যবসরে দরজার দোষগুলি টুকিয়া রাখিতে লাগিলেন। দরজার কথা শেষ হইলে, সাহেব দ্বারী-ঠাকুরের গানের এক মজার বর্ণনা লিখিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন যে, যে বুড়িকে তাহার ভাই ঘর করিয়া দিয়াছিল, সে আসিতেছে। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘ও বুড়ি! তুই কেমন করিয়া আসিলি?’

 ‘তাই ত বাপু, আমি ত কিছু জানি না। আমি দুঃখিনী বুড়ি, এমন ত কিছু করি নাই, যাহাতে এখানে আসিতে পারি।’

 ‘তুই কি কোন কাজ করিস্ নাই? আমি ত সমালোচনা করিয়াছি।’

 ‘আমার আর ত কিছুই মনে হয় না। তবে একদিন আমার বাড়ির কাছে পুকুরে জমা বরফের উপরে পাড়ার সকলে খেলা করিতে গিয়াছিল। যাইবার সময় আমাকে সকলেই দেখিয়া মিষ্টি কথা কহিয়া গেল। আমি ভয়ানক কাতর ছিলাম। কিছুকাল পরে দেখি, আকাশে একরকম মেঘ দেখা দিয়াছে। এরূপ মেঘ আমার জন্মে আমি আর একবার দেখিছিয়ালাম। তখন দুই মিনিটে মধ্যে সমুদয় বরফ ফাটিয়া গিয়াছিল। আমার মনে বড় ভয় হইল। এখনই এতগুলি লোক ডুবিয়া মরিবে ভাবিয়া আমার চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। আমি কি করি? রোগে মরি, উঠিবার শক্তি নাই, ডাকিলেও কেউ আমার কথা শুনিবে না। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাহিরে আসিয়া আপনার ঘরে আগুন লাগাইয়া দিলাম। সকল লোক বুড়ি পুড়িয়া মরিল মনে করিয়া দৌড়িয়া আসিল। আমি তারপর কি হইল বিশেষ জানি না। কেবলমাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কার কিছু হয় নি ত?’

একজন লোক বলিল, ‘না, আমরাও আসিয়াছি আর বরফও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’ তারপর আর কিছু জানি না। কে যেন আমাকে এখানে আনিয়াছে।’

 বুড়ির কথা শুনিয়া দরোয়ান-দেবতা স্বর্গে খবর দিলেন। আর দলে দলে দেবতারা আসিয়া ‘এসো এসো’ বলিয়া আদর করিয়া বুড়িকে স্বর্গের ভিতরে লইয়া চলিলেন। কিন্তু বুড়ি সমালোচকের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল-‘ওর ভাই আমাকে বাড়ি করিয়া দিয়াছিল, আমার থাকিবার জায়গা ছিল না। ও মুখ কাল করিয়া ফিরিয়া যাইবে, আর আমি কোন প্রাণে তোমাদের সঙ্গে যাইব? আমার মনে বড় লাগে। আমাকে তোমরা স্বর্গে নিও না। এ বেচারা তাহা হইলে বড় কষ্ট পাইবে।’

 তখন দেবতারা সমালোচককে-‘অলস! অপদার্থ! যা! বুড়ির জন্য তোকে স্বর্গে নিয়া যাওয়া হইল। তুই জীবনটা কেবল সমালোচনা করিয়াই কাটাইলি, ভাল কাজ কিছুই করিলি না। তোর মতন লোক আর এর পূর্বে স্বর্গে যায় নাই।

 দেবতারা তারপর বুড়ির সঙ্গে সমালোচককেও টানিয়া স্বর্গে নিয়া চলিলেন। সমালোচক হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। একবার মাত্র বলিল,‘টানিয়া লওয়া বুঝি তোমাদের অভ্যাস নাই? ভাল করিয়া টানা হইতেছে না। এমনি বুঝি টানে।’

 ঢেঁকি যেখানে থাক্‌, তার ধান ভানা কাজ ঘোচে না। আমাদের সমালোচক ভায়া স্বর্গে গিয়াও খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, আর কিইবা করে, একটা কাজ ত চাই? কতকগুলি ছেলে আছে, তাহারা কেবলই খুঁত ধরে; পরের দোষ দেখিয়া তাহার নিন্দা করার চেয়ে নিজের শোধরাইয়া পরের গুণ দেখা ভাল।