উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/পাকা ফলার
পাকা ফলার
পাড়াগাঁয়ে এক ফলারে বামুন ছিল। তাহাকে যাহারা নিমন্ত্রণ করিত, তাহারা সকলেই খুব গরিব; দৈ-চিঁড়ের বেশি কিছু খাইতে দিবার ক্ষমতা তাহাদের ছিল না।
ব্রাহ্মণ শুনিয়াছিল দৈ-চিঁড়ের ফলারের চাইতে পাকা ফলারটা ঢের ভাল। সুতরাং এরপর যে ফলারের নিমন্ত্রণ করিতে আসিল, তাহাকে সে বলিল, ‘পাকা ফলার খাওয়াতে হবে।’ সে বেচারা গরিব লোক, পাকা ফলার সে কোথা হইতে দিবে? তাই সে বিনয় করিয়া বলিল, ‘মশাই, পাকা ফলার দেওয়া কি যার তার কাজ? রাজা রাজড়া হলে তবে পাকা ফলার দিতে পারে।’ এ কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণ বলিল, ‘তবে, রাজা যেখানে থাকে, সেইখানে গিয়ে আমি পাকা ফলার খাব।’
ব্রাহ্মণ পাকা ফলার খাইবার জন্য রাজার বাড়ি চলিয়াছে। পথে যাহাকে দেখে, তাকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যাঁগা, রাজার বাড়িটা কোন্খানটায়?’ একজন তাহাকে রাজার বাড়ি দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ যে পাকা বাড়ি দেখছ, ঐটে রাজার বাড়ি।’
ব্রাহ্মণ ‘পাকা ফলার’ যেমন খাইয়াছে, ‘পাকা বাড়ি’ও তেমনি দেখিয়াছে। সুতরাং পাকা বাড়ির কথা শুনিয়া সে ভারি আশ্চর্য হইয়া রাজার বাড়ির দিকে তাকাইল। সে দেশের সব লোকেই কুঁড়েঘর;খালি রাজার একটি সুন্দর পাকা বাড়ি ছিল। রাজার বাড়ি দেখিয়া ব্রাহ্মণের মুখে লাল পড়িতে লাগিল। সে গদগদ স্বরে বলিল, ‘পাকা বাড়ি! আহা! পাকা বাড়িই বটে! হবে না কেন? সে যে রাজা, তাই সে অমন বাড়িতে থাকে। ওটা তয়ের করতে না জানি কত ক্ষীর, ছানা আর চিনি লেগেছিল!’
এ মনে করিয়া ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি গিয়া রাজার বাড়ির একটা কোণ কামড়াইয়া ধরিল; আবার তখনই ‘উঃ-হুঃ-হুঃ’ করিয়া কামড় ছাড়িয়া দিল।
তারপর সে ভাবিতে লাগিল, ‘তাই ত, এই পাকা ফলারের এত নাম!’ আর খানিক ভাবিয়া সে বলিল, ‘ওঃ হো! বুঝেছি। নারকেলের মতন আর কি! ওটা ওর খোলা; আসল জিনিসটা ভিতরে আছে!’ এই বলিয়া সে আগের চাইতে দ্বিগুণ উৎসাহে কামড়াইতে আরম্ভ করিল। তাহার দুইটা দাঁত ভাঙিয়া গিল, তাহাতে গ্রাহ্য নাই। কামড়াইতে কামড়াইতে সে সেই কোণের অনেকখানি ভাঙিয়া ফেলিয়াছে, আর মনে করিতেছে যে, ‘আর বেশি দেরি নেই এরপরই পাকা ফলার আসবে!’ এমন সময় কোথা হইতে মস্ত পাগড়িওয়ালা এক দরোয়ান আসিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ‘আরে ঠাকুর, ক্যা করতে হো? মহারাজকে ইমারত খা ডল্তে হো? চলো তুম হমারে সাথ।’ এই বলিয়া দরোয়ান তাহাকে রাজার নিকট লইয়া চলিল।
দরোয়ানের কাছে সকল কথা শুনিয়া রাজা বলিলেন, ‘কি ঠাকুর, ওখানে কি করছিলে?’ ব্রাহ্মণ উত্তর করিল, ‘মহারাজ! আমি পাকা ফলার খাচ্ছিলুম। খোলাটা না ভাঙতে ভাঙতেই এই বেটা দবোয়ান আমাকে ধরে এনেছে!’
এই কথা শুনিয়া রাজামহাশয় হো-হো করিয়া হাসিতে লাগিলেন, আর বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, ঠাকুরের পেটে অনেক বুদ্ধি। যাহা হউক, তাহার সাদাসিধে কথাগুলি রাজার বেশ ভাল লাগল। সুতরাং তিনি হুকুম দিলেন যে, এই ব্রাহ্মণকে পেট ভরিয়া পাকা ফলার খাইবার মত ময়দা, ঘি আর মিঠাই দাও।
ব্রাহ্মণ মনের সুখে রাজাকে আশীর্বাদ করিতে করিতে ময়দা, ঘি আর মিঠাই লইয়া ঘরে ফিরিল। আসিবার সময় বলিয়া আসিল যে, পাকা ফলার খাইয়া আবার রাজামহাশয়কে আশীর্বাদ করিতে আসিবে।
পরদিন সকালে রাজামহাশয়, মুখ হাত ধুইয়া সভায় আসিয়াই সেই ব্রাহ্মণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি ঠাকুর, কাল পাকা ফলার খেলে কেমন?’ ব্রাহ্মণ বলিল, ‘মহারাজ, অতি চমৎকার খেয়েছি! পাকা ফলার কি আর মন্দ হতে পারে? গুঁড়োগুলো আগে গলায় বড্ড আটকাচ্ছিল। জল দিয়ে গুলে নিতে শেষে তরল হল; কিন্তু অর্ধেক খেতে না খেতেই বমি হয়ে গেল!’
ময়দা আর ঘি দিয়া যে লুচি তৈয়ার করিতে হয়, ব্রাহ্মণ বেচারা তাহা জানিত না। কাজেই সে ঐ কাঁচা ময়দাগুলিকেই ঘি আর মিঠাই দিয়া মাখিয়া খাইতে বিশেষ চেষ্টা করিয়াছে। সহজে তরল হয় না দেখিয়া, আবার তাহার সঙ্গে জল মিশাইয়াছে। খাইতে তাহার খুব ভালই লাগিয়াছিল; তবে, পেটে রহিল না, এই যা দুঃখ।
রাজা দেখিলেন, লুচি নিজে তয়ের করিয়া খাইতে হইলে আর ব্রাহ্মণের ভাগ্যে পাকা ফলার ঘটিতেছে না। সুতরাং তিনি তাঁহার রসুয়ে বামুনদের একজনকে ডাকাইয়া বলিলেন, ‘এখান থেকে ময়দা ঘি নিয়ে, তোমার বাড়িতে লুচি তয়ের ক’রে, এই ঠাকুরকে পেট ভ’রে পাকা ফলার খাইয়ে দাও।’
রসুয়ে বামুন ফলারে বামুনকে তাহার বাড়ি দেখাইয়া বলিল, আমি খাবার তয়ের ক’রে রাখব, বিকালে আপনি এসে খাবেন। আমি বাড়ি থাকব না, আমার ছেলে আপনাকে খেতে দেবে এখন। ব্রাহ্মণ রাজি হইয়া বাড়ি গিয়া বিকাল বেলার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।
রসুয়ে বামুনের সেই ছেলেটা ভাল লোক ছিল না; একটা চোরের সঙ্গে তাহার বন্ধুতা ছিল। রসুয়ে বামুন ফলারে বামুনের জন্য লুচি, সন্দেশ ইত্যাদি তয়ের করিয়া তাহার ছেলেকে বলিল, ‘সেই লোকটি এলে তাকে বেশ ক’রে খাওয়াস!’ তাহার ছেলে বলিল, ‘তার জন্যে কিছু চিন্তা করো না, আমি তাকে খুব যত্ন ক’রে খাওয়াব এখন।’ রসুয়ে বামুন রাজবাড়িতে রান্না করিতে চলিয়া গেল; আর তাহার ছেলে ফলারে বামুনের খাবারের আয়োজনে মন দিল। দু সেরের বেশি লুচি আর তাহার মত তরকারি মিঠাই ইত্যাদি প্রস্তুত হইয়াছিল। খানচারেক লুচি আর খানিকটা তরকারি ফলারে বামুনের জন্য রাখিয়া, আর সমস্ত সেই হতভাগা তাহার সেই বন্ধু আর নিজের জন্য রাখিয়া দিল। ফলারে বামুন আসিলে পর সে সেই চারখানা লুচি তাহাকে খাইতে দিল। সে বেচারা জন্মেও লুচি খায় নাই, তাহাতে আবার এমন চমৎকার লুচি—রাজার বামুন ঠাকুর যাহা তয়ের করিয়াছে! এমন জিনিস দু-চারখানি মাত্র খাইয়া তাহার পেট ত ভরিলই না, বরং তাহার ক্ষুধা বাড়িয়া গেল। সে খালি দুঃখ করিতে লাগিল, ‘আহা! আর যদি খানকতক দিত।’
রসুয়ে বামুনের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ফলারে বামুন রাস্তা দিয়া চলিল। তাহার মনের দুঃখ রাখিবার আর জায়গা দেখিতেছে না। চলে, আর খালি বলে, ‘আহা! আর যদি খানকতক দিত!’
এমন সময় হইয়াছে কি, রাজার প্রধান ভাণ্ডারী সেই রাস্তা দিয়া চলিয়াছে সে নিজের হাতে সেদিন সকাল বেলায় ঐ ফলারে বামুনের জন্য পুরো দু সের ময়দা আর তাহার মতন অন্য সব জিনিস মাপিয়া দিয়াছে। ফলারে বামুনের মুখে ঐ কথা শুনিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ঠাকুরমশাই! কি যদি আর খানকতক দিত?’ ফলারে বামুন বলিল, ‘বাবা আমি পাকা ফলারের কথা বলছি। রাজামশাই চিরজীবী হউন, আমাকে এমন জিনিস খাইয়েছেন! খালি যদি আর খানকতক হত!’
ভাণ্ডারী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনাকে কখানা দিয়েছিল?’ ফলারে বামুন বলিল, ‘চারখানি পাকা ফলার আমাকে দিয়েছিল।’ ভাণ্ডারী সবই বুঝিতে পারিয়া বলিল, ‘সে কি ঠাকুরমশাই! দু সের ময়দা দিয়েছি, তাতে কি মোটে চারখানা লুচি হয়!’ ব্রাহ্মণ বলিল, ‘হ্যাঁ বাপু, চারখানাই ছিল। আর তাতে খুব চমৎকার লেগেছিল।’ ভাণ্ডারী বলিল, ‘দু সের ময়দায় তার চেয়ে ঢের বেশি লুচি হয়। আমার বোধ হচ্ছে, ঐ রসুয়ে বামুনের ছেলেটা বাকি লুচিগুলো মাচায় তুলে রেখেছে। আপনি আবার যান। এবারে গিয়ে একেবারে মাচায় উঠবেন;দেখবেন আপনার লুচি সেখানে আছে।’ ব্রাহ্মণ বলিল, ‘তাই নাকি? বাপু তুমি বেঁচে থাকো। হতভাগা, বেল্লিক, বাঁদর, শয়তান পাজি’— বলিতে বলিতে ব্রাহ্মণ সেই রসুয়ে বামুনের বাড়ির পানে ছুটিল। গালিগুলি অবশ্য ভাণ্ডারীকে দেয় নাই।—রসুয়ে বামুনের ছেলেকে দিয়াছিল।
রসুয়ে বামুনের ছেলে ফলারে বামুনকে চারিখানি লুচি খাওয়াইয়া বিদায় করিয়াই, তাহার সেই চোর বন্ধুর কাছে গিয়াছিল। সেখানে গিয়া সে চোরকে বলিল, বন্ধু, ঢের লুচি তয়ের ক’রে মাচার উপর রেখে এসেছি। তুমি শিগগির যাও; আমিও এই বাজার থেকে একটা জিনিস নিয়ে এখনি আসছি।’
চোর রসুয়ে বামুনের মাচার উপর উঠিয়া সবে লুচির ঢাকনা খুলিতে যাইবে, এমন সময় ফলারে বামুন আসিয়া উপস্থিত। এবারে কথাবার্তা নাই, একেবারে মাচায় গিয়া উঠিল। চোর মুশকিলে পড়িল। লুকাইবারও স্থান নাই, পালাইবারও পথ নাই। এখন সে যায় কোথায়? শেষটা আর কি করে, মাচার কোণে একটা কাঠের থাম জড়াইয়া কোনরকমে বেমালুম হইয়া থাকিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। একে সন্ধ্যাকাল, তাহাতে আবার ফলারে বামুন নিতান্তই সাদাসিধে লোক, লুচি খাইবার জন্য তাহার মনটা যারপর নাই ব্যস্ত রহিয়াছে। সুতরাং চোরকে সে দেখিতে পাইল না। ফলারে বামুন সামনে লুচি, সন্দেশ, তরকারি মিঠাই সাজানো দেখিয়াই খাইতে বসিয়া গেল। পেটে যত ধরিল, তত সে খাইল;আর একটি হজমি গুলির স্থানও নাই।
এমন সময়ে ভারি একটা মজা হইল। রসুয়ে বামুনের ছেলেও বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে আর ঠিক সেই সময় রসুয়ে বামুনও আসিয়াছে। অন্যদিন সে প্রায় দুপুর রাত্রের পূর্বে ফিরে না, কিন্তু সেদিন সে ভুলিয়া একটা ঝাঁজরা ফেলিয়া গিয়াছিল, সেটার ভারি দরকার। ছেলে আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাবা, তুমি এখনি ফিরে এলে যে?’ রসুয়ে বামুন বলিল, ‘ঝাঁজরা ফেলে গিয়েছিলুম, তাই নিতে এসেছি।’
এতক্ষণে ফলারে বামুনের পেট এত বোঝাই হইয়াছে যে, আর-একটু হইলেই তাহার দম আটকায়। পিপাসায় গলা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু সেখানে জল নাই। সে ‘জল জল’ বলিয়া চেঁচাইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু ভাল করিয়া কথা ফুটিল না।
রসুয়ে বামুন তাহার ছেলেকে বলিল, ‘ওটা কি রে?’ ছেলে দেখিল ভারি মুশকিল। সে ফলারে বামুনের কথা ত আর জানিত না, কাজেই সে মনে করিয়াছে যে ওটা তাহার বন্ধু, গলায় সন্দেশ আটকাইয়া বিশ্রী স্বরে জল চাহিতেছে। বন্ধুর খবরটা বাপকে দিলে সে আর বন্ধুর হাড় আস্ত রাখিবে না, আর কিছু না বলিলেও হয়ত এখনই মাচায় উঠিয়া দেখিবে। এমন সময় হঠাৎ তাহার বুদ্ধি জোগাইল— সে বলিল, ‘বাবা, ওটা, নিশ্চয় ভূত। না হইলে মাচার থেকে অমন বিশ্রী আওয়াজ দেবে কেন।’
ভূতের কথায় শুনিয়া রসুয়ে বামুন কাঁপিতে লাগিল। আরো মুশকিলের কথা এই যে, ভূতটা জল চাহিতেছে। তাহার কাছে জল লইয়া যাইতে কিছুতেই ভরসা হইতেছে না, অথচ জল না পাইলে সে নিশ্চয় ভয়ানক চটিয়া যাইবে। তারপর সে কি করে তাহার ঠিক কি? ছেলের ভারি ইচ্ছা, সে ভূতকে জল দিয়া আসে। কিন্তু রসুয়ে বামুন বলিল, ‘তা হবে না, যদি তোর ঘাড় ভেঙে দেয়।’ এই সময়ে তাহার মনে হইল যে, মাচার উপর কয়েকটা নারকেল ছাড়ানো আছে, সুতরাং সে ভূতকে বলিল, ‘মাচায় নারকেল আছে, থামে আছড়ে ভেঙে খাও।’
ফলারে বামুনের হাতের কাছেই নারকেলগুলি ছিল; সে তাহার একটা হাতে লইয়া থামে আছড়াইয়া ভাঙিতে গেল। সে থাম জড়াইয়া চোর দাঁড়াইয়া ছিল; ব্রাহ্মণ পিপাসার চোটে থাম মনে করিয়া সেই চোরের মাথাতেই নারকেল আছড়াইয়া বসিয়াছে—একেবারে মাথা ফাটাইয়া ফেলিবার জোগাড় আর কি!
এরপর একটা মস্ত গোলমাল হইল। নারকেলের বাড়ি খাইয়া চোর ভয়ানক চেঁচাইয়া উঠিল;আর তাহাতে ভয়ানক চমকাইয়া গিয়া ব্রাহ্মণও হাঁউমাঁউ করিতে লাগিল। গোলমাল শুনিয়া পাড়ার সমস্ত লোক সেখানে আসিয়া জড়ো হইল। আসল কথাটা জানিতে এরপর আর বেশি দেরি হইল না। চোর ধরা পড়িল আর রসুয়ে বামুন তাহার ছেলেকে সেই ঝাঁজরা দিয়া এমনি ঠেঙান ঠেঙাইল যে কি বলিব।