উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/আশ্বমেধিকপর্ব

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

আশ্বমেধিকপর্ব

 রাজ্য লাভের পর যুধিষ্ঠিরের প্রথম কীর্তি হইল অশ্বমেধ যজ্ঞ। যুধিষ্ঠিরের শোক কিছুতেই একেবারে দূর না হওয়ায়, সকলে তাঁহাকে এই মহাযজ্ঞে উৎসাহ দিতে লাগিলেন। কিন্তু ইহা অতি বৃহৎ এবং কঠিন ব্যাপার; অল্প ধন লইয়া কিছুতেই ইহাতে হাত দেওয়া যাইতে পারে না। সুতরাং যুধিষ্ঠির এ যজ্ঞ করিতে নিতান্ত ইচ্ছুক হইয়াও, ইহা আরম্ভ করিতে ভয় পাইলেন৷

 ধনরত্ন যাহা কিছু ছিল, যুদ্ধে প্রায় তাহার সমস্তই ব্যয় হইয়া গিয়াছে। এখন অশ্বমেধ যজ্ঞের উপযুক্ত ধন কোথায় পাওয়া যাইবে? যুধিষ্ঠিরের এইরূপ চিন্তা দেখিয়া ব্যাস তাঁহাকে বলিলেন, “বৎস, তুমি চিন্তা করিও না; ধন সহজেই পাওয়া যাইবে। পূর্বে মহারাজ মরুত্ত হিমালয় পর্বতে যজ্ঞ করিয়া, ব্রাহ্মণদিগকে এত অধিক সুবর্ণ দিয়াছিলেন যে, তাঁহারা তাহা বহিতে না পারিয়া সেইখানেই ফেলিয়া আসেন। সেই সুবর্ণ এখনো তথায় রহিয়াছে, তাহা আনিলে অনায়াসে তোমার যজ্ঞ হইতে পারে।”

 এ কথায় যুধিষ্ঠির হর্ষভরে অমাত্যগণের সহিত সেই ধন আনয়নের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব প্রভৃতি সকলেই বলিলেন, “ব্যাসদেবের পরামর্শ অতি উত্তম।” সুতরাং অবিলম্বে মরুত্তের যজ্ঞের সোনা আনিবার জন্য হিমালয় যাত্রার আয়োজন হইল। সেখানে গিয়া উহা খুঁজিয়া বাহির করিতেও বিশেষ ক্লেশ হইল না।

 সেকালের লোকে এত ধন কোথায় পাইত? আর না জানি তাহারা কিরূপ মহাশয় লোক ছিল যে, এত ধন দান করিত! মরুত্ত রাজার যজ্ঞের সেই সোনা আনিতে, ষাটলক্ষ উট, এক কোটি বিশ লক্ষ ঘোড়া, দুই লক্ষ হাতি, এক লক্ষ রথ, এক লক্ষ গাড়ি লাগিয়াছিল। আর মানুষ আর গাধা যে কত লাগিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। এতগুলিতেও কি সে ধন সহজে আনিতে পারিয়াছিল? তাহারা সেই সোনার ভারে বাঁকা হইয়া, দিনে দুই ক্রোশের অধিক পথ চলিতে পারে নাই!

 এত ধন যে যজ্ঞে ব্যয় হইয়াছিল, তাহা যে কত বড় যজ্ঞ, বুঝিয়া লও। একটি প্রশস্ত ভূমি খাঁটি সোনায় মুড়িয়া, তাহার উপর যজ্ঞের গৃহাদি প্রস্তুত হইল। জমিটি যেমন, ঘর বাড়িও অবশ্য তাহার উপযুক্তই হইয়াছিল। এদিকে অর্জুন, ইহার অনেক পূর্বেই, গাণ্ডীব হাতে, একটি সুন্দর ঘোড়ার পশ্চাতে পৃথিবীর সকল স্থানে ঘুরিয়া আসিবে। ইহার মধ্যে কাহাকেও সে ঘোড়া আটকাইতে দেওয়া হইবে না। আর, অর্জুন যাহার রক্ষক, তাহাকে কেহ আটকাইয়া রাখিবার আশঙ্কাও নাই।

 অর্জুনের যাত্রাকালে যুধিষ্ঠির তাঁহাকে বলেন, “যাঁহারা কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাদের পুত্র পৌত্রদিগকে বধ করিও না।” অর্জুন যথাসাধ্য এই আজ্ঞা পালনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন; সেজন্য তাঁহাকে বিস্তর ক্লেশও পাইতে হইল। কুরুক্ষেত্রে কত রাজাই পাণ্ডবদিগের হতে মারা গিয়াছে, তাহাদের দেশে গেলেই, তাহাদের পুত্র পৌত্র আর দেশের লোকেরা ক্ষেপিয়া অর্জুনকে মারিতে আইসে। তিনি তাহাদিগকে অধিক বাণ মারেন না, পাছে বেচারারা মারা যায়। কিন্তু তাহাতে তাহারা মনে করে, বুঝি তিনি ভালোরূপ যুদ্ধই করিতে পারেন না; কাজেই তাহারা মহোৎসাহে তাহাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। সুতরাং তখন তিনি তাহাদের দু-চারজনকে মারিতে বাধ্য হন। তারপর তারা ভয়ে জড়সড় হইয়া তাঁহার নিকট হাতজোড় করিতে থাকে।  ত্রিগর্ত দেশে সুশর্মার পুত্র ধৃতবর্মার সহিত এইরূপ হইল। প্রাগ্‌জ্যোতিষে ভগদত্তের পুত্র বজ্রদত্তের সহিত এইরূপ হইল। সিন্ধুদেশে জয়দ্রথের আত্মীয়গণও এইরূপ আরম্ভ করিল। শেষে তাহাদের অত্যাচার অসহ্য হওয়ায় তিনি তাহাদের মাথা কাটিতে আরম্ভ করিলে আর তাহাদের দুর্দশার সীমা নাই।

 এমন সময় জয়দ্রথের স্ত্রী দুঃশলা, তাহার শিশু পৌত্রটিকে কোলে লইয়া, কাঁদিতে কাঁদিতে অর্জুনের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দুঃশলা ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা, সুতরাং অর্জুনের ভগিনী। তাহাকে দেখিবামাত্র অর্জুন গাণ্ডীব রাখিয়া দিয়া বলিলেন, “ভগিনী। তোমার কি কাজ করিব, বল।”

 ইহার উত্তরে দুঃশলা যাহা বলিলেন, তাহাতে অর্জুনের মনে বড়ই ক্লেশ হইল! জয়দ্রথের সঙ্গে দুঃশলার বিবাহ হইয়াছিল। জয়দ্রথের মৃত্যুর পর তাহার পুত্র সুরথ, পিতার শোকে নিতান্ত কাতর হইয়া পড়েন। ইহার উপরে যখন তিনি শুনিলেন যে অর্জুন যজ্ঞের ঘোড়া সমেত আসিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছেন, তখনি তাঁহার মৃত্যু হইল। এখন দুঃখিনী বিধবা দুঃশলা, পতি পুত্রের শোকে অস্থির হইয়া, পৌত্রটিকে অর্জুনের নিকট উপস্থিত করিয়াছেন, যদি তাহাকে দেখিয়া অর্জুনের দয়া হয়।

 ছেলেটি যখন মাথা হেঁট করিয়া কাতরভাবে অর্জুনকে প্রণাম করিল, তখন আর তিনি চক্ষের জল না রাখিতে পারিয়া বলিলেন, “ক্ষত্রিয়ের ধর্মকে ধিক্! এই ধর্ম পালন করিতে গিয়াই বন্ধু-বান্ধবদিগকে বধ করিয়াছি!”

 এই বলিয়া তিনি দুঃশলাকে সাদর মধুর বাক্যে সান্ত্বনা দিয়া তথা হইতে বিদায় হইলেন।

 মণিপুরের রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে অর্জুন বিবাহ করিয়াছিলেন। এখন সেই চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহণ মণিপুরের রাজা। ঘোড়া মণিপুরে উপস্থিত হইলে বভ্রুবাহণ তাঁহার পিতার আগমন সংবাদ প্রাপ্তিমাত্রেই পাত্রমিত্র সমেত, অতি বিনীতভাবে অর্জুনের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 কিন্তু অর্জুন ইহাতে কিছুমাত্র সন্তুষ্ট হইলেন না। তিনি বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “আমি আসিলাম যুদ্ধ করিতে, আর তুমি করজোড়ে আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলে! ইহা কখনোই ক্ষত্রিয়ের কাজ নহে, ইহা কাপুরুষের কাজ। তোমাকে ধিক্। তোমার জীবনে প্রয়োজন কি?”

 এ কথায় বভ্রুবাহণ নিতান্ত ব্যথিতচিত্তে মাথা হেঁট করিয়া রহিলেন। এমন সময় সেই যে উলুপী নাম্নী নাগকন্যার সহিত অর্জুনের বিবাহ হইয়াছিল, তিনি আসিয়া বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “বাছা, আমি তোমার বিমাতা উলুপী। তোমার পিতা যখন যুদ্ধের বেশে আসিয়াছেন, তখন ইঁহার সহিত যুদ্ধ করাই তোমার উচিত। তাহাতে ইনি সন্তুষ্ট হইবেন।” তখন বভ্রুবাহণ, বিপুল যুদ্ধের আয়োজন করিয়া, সৈন্যগণকে আদেশ দিবামাত্রই তাহারা যুদ্ধ আরম্ভ করিলে, ক্ষণেকের ভিতরেই বভ্রুবাহণের বাণে তাঁহাকে অজ্ঞান হইতে হইল।

 জ্ঞান হইলে অর্জুন বভ্রুবাহণকে বলিলেন, “বাঃ! এই তো চাই! আমি বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম! আচ্ছা, এখন আমি মারি, স্থির হইয়া সামলাও তো!”

 তারপর অর্জুন অসংখ্য নারাচ ছুঁড়িয়া মারিলে, বভ্রুবাহণ তাহার সমস্তই কাটিলেন! কিন্তু তাহার পরে ভয়ানক বাণগুলি ফিরাইতে না পারায়, তাহার রথের ধ্বজ আর ঘোড়া কাটা গেল। তখন তিনি রথ হইতে নামিয়া এমনি ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, তাহা দেখিয়া অর্জুনের আর আনন্দের সীমা রহিল না। এমন সময় বভ্রুবাহণ কি যে একটা বাণ মারিলেন, তাহাতে নিমেষ মধ্যে অর্জুনকে একেবারে মৃতপ্রায় করিয়া ফেলিল। বভ্রুবাহণও তাহা দেখিয়া দুঃখে অজ্ঞান হইয়া গেলেন।

 এই বিষম বিপদের সময়, চিত্রাঙ্গদা কাঁপিতে কাঁপিতে সেখানে আসিয়া উলুপীকে দেখিয়াই বলিলেন, “উলুপি! তোমার দোষেই এই বিপদ উপস্থিত হইল।” বভ্রুবাহণও সেই সময়ে জ্ঞানলাভ করিয়া, উলুপীকে তিরস্কারপূর্বক বলিলেন, “পিতাকে মারিয়াছি, সুতরাং আমিও এখনি প্রাণত্যাগ করিব। তাহা হইলে হয়তো তুমি সন্তুষ্ট হইবে।”

 উলুপী যথাসাধ্য ইহাদিগকে সান্ত্বনা দিয়ে তখনি নাগলোক হইতে সঞ্জীবনী মণি আনাইলেন। সে মণির কি আশ্চর্য গুণ! উহা অর্জুনের বুকে স্থাপনমাত্রই তিনি চক্ষু মার্জনাপূর্বক উঠিয়া বসিলেন, যেন তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিল।

 তারপর অবশ্য খুব সুখের অবস্থাই হইল। আর তখন এ কথাও জানা গেল যে উলুপী অতি মহৎ অভিপ্রায়েই এই ব্যাপার ঘটাইয়াছিলেন। শিখণ্ডীর সহায়তায় ভীষ্মকে বধ করায়, অর্জুনের যথেষ্ট অপরাধ হইয়াছিল। সেই অপরাধে বসুগণ এবং গঙ্গাদেবী তাঁহাকে শাপ দিতে প্রস্তুত হন। উলুপী সে সময়ে তথায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এবং তাঁহার পিতা সেই দেবতাদিগকে অর্জুনের প্রতি প্রসন্ন হওয়ার জন্য বিস্তর মিনতি করায়, তাঁহারা বলেন, “বভ্রুবাহণ অর্জুনকে বধ করিলে, তবে তাঁহার শাপ কাটিবে।” এইজন্যই উলুপী বভ্রুবাহণকে অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে উৎসাহ দেন। তিনি জানিতেন যে, অর্জুনকে বাঁচাইবার ঔষধ তাঁহার ঘরে আছে! এ সকল কথা জানিতে পারিয়া সকলেই যে উলুপীর উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

 তখন বভ্রুবাহণ, চিত্রাঙ্গদা আর উলুপীকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণপূর্বক, অর্জুন পুনরায় তথা হইতে যাত্রা করিলেন।

 মগধে জরাসন্ধের নাতি মেঘসন্ধিও অন্যান্য অনেক মূর্খের ন্যায়, মনে করিয়াছিলেন যে, অর্জুন অপেক্ষা তিনি নিজে অধিক যোদ্ধা। অর্জুন, যুধিষ্ঠিরের কথা মনে করিয়া যতই তাঁহাকে বাঁচাইয়া বাণ মারিতে যান, ততই তাহার আরো সাহস বাড়িয়া যায়। শেষে অবোধের যে দশা সচরাচর হয়, তাঁহারও তাহাই হইল, তাঁহার আর অস্ত্র নাই। তখন অর্জুন তাহাকে বলিলেন, “তুমি ছেলেমানুষ হইয়া বেশ যুদ্ধ করিয়াছ, এখন ঘরে যাও! আমি তোমাকে বধ করিব না।” তাহাতে মেঘসন্ধি করজোড়ে কহিলেন, “মহাশয়! আমি পরাজিত হইয়াছি। এখন অনুমতি করুন, কি করিব।” অর্জুন বলিলেন, “চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ দেখিতে যাইবে।” এই বলিয়া তিনি সেখান হইতে চলিয়া আসিলেন।

 গান্ধার দেশে শকুনির পুত্রও প্রথমে ভারি তেজ দেখাইয়াছিলেন। অর্জুন কৃপাপূর্বক, তাঁহার মাথা না কাটিয়া, পাগড়িটি উড়াইয়া দিলে, তাহার চৈতন্য হইল।

 এইরূপে এক বৎসরকাল ঘোড়াটিকে দেশে দেশে ভ্রমণ করাইয়া তাহাকে হস্তিনায় ফিরাইয়া আনিলে, সেই ঘোড়ার মাংস দিয়া যজ্ঞ সম্পন্ন হইল। সেরূপ যজ্ঞ আর তাহার পরে কখনো হয় নাই। এমন কোনো আত্মীয়-স্বজন, এমন কোনো রাজারাজড়া এমন কোনো মুনি-ঋষি বা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন না, যিনি সেই যজ্ঞে না আসিয়াছিলেন।  আর ভোজনের বিষয় কি বলিব? অন্নের পর্বত, ধৃত-দধির নদী, আর মিঠাই-মোণ্ডা কি পরিমাণ, তাহা বলিতে পারি না। হাজার হাজার লোক মণি, কুণ্ডল, আর সুবর্ণ মাল্যে সুসজ্জিত হইয়া সেই-সকল সুমধুর খাদ্য পরিবেশন করিয়াছিল। এক-একলক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন শেষ হইলে, এক-একবার দুন্দুভি বাজিত। এইরূপে যজ্ঞের কয়েকদিনের মধ্যে কত শত বার যে দুন্দুভি বাজিয়াছিল, তাহার সংখ্যা নাই।

 এইরূপ সমারোহে সেই মহাযজ্ঞ শেষ হইল। এই যজ্ঞে একটি অদ্ভুত ঘটনা হয়। যজ্ঞ শেষে সকলেই যুধিষ্ঠিরের অতিশয় সুখ্যাতি করিতেছেন, এমন সময় একটি আশ্চর্য নকুল আসিয়া তথায় উপস্থিত হইল। উহার চক্ষু দুটি নীল; মাথা আর শরীরের এক পাশ সোনার। নেউল আসিয়া ঠিক মানুষের মতো বলিতে লাগিল, “হে রাজামহাশয়গণ! উঞ্ছবৃত্তি নামক ব্রাহ্মণ যে ছাতু দান করিয়াছিলেন, সে কাজ আপনাদের যজ্ঞের চেয়ে অনেক বড়!”

 এ কথায় সকলে আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এমন কি দেখিয়াছ বা শুনিয়াছ যে, এই যজ্ঞকে তাহা অপেক্ষা কম মনে করিলে?”

 তাহাতে নেউল বলিল, “আপনারা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করুন। উঞ্ছবৃত্তি নামক এক ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁহার স্ত্রী, এক পুত্র ও পুত্রবধু ছিল। ক্ষেত্রের শস্য কাটিয়া নিলে যাহা পড়িয়া থাকে, উঞ্ছবৃওি এবং তাঁহার পরিবার সেই শস্যমাত্র আহার করিতেন; এইরূপে তাঁহাদের দিন যাইত।

 “তারপর দেশে দুর্ভিক্ষ আসিল, ক্ষেত্রে শস্য নষ্ট হইল, ব্রাহ্মণের কষ্টও বৃদ্ধি পাইল। তখন কোনোদিন অতি কষ্টে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ আহার জুটিত, কোনোদিন একেবারেই জুটিত না।

 “এই সময়ে একবার সারাদিন ঘুরিয়া, শেষবেলায় ব্রাহ্মণ কিঞ্চিৎ যব পাইলেন। তাহাতে তাহার পরিবারের লোকেরা আহ্লাদিত হইয়া, সেই যবের ছাতু প্রস্তুত করিল। তারপর সকলে স্নান, আহ্নিক অন্তে সেই ছাতু আহারের আয়োজন করিলেন।

 “এমন সময় সেখানে এক অতিথি ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় কাতর হইয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ সেই অতিথিকে আদরের সহিত তাঁহার নিজের ছাতুর ভাগ আহার করিতে দিলেন, কিন্তু অতিথির তাহাতে তৃপ্তি হইল না।

 “তাহা দেখিয়া ব্রাহ্মণী তাঁহার নিজের ভাগ অতিথিকে দিলেন, কিন্তু তাহাতেও তাহার তৃপ্তি হইল না।

 “তাহা দেখিয়া ব্রাহ্মণের পুত্র তাঁহার নিজের ভাগ অতিথিকে দিলেন, কিন্তু তথাপি তাঁহার তৃপ্তি হইল না।

 “তখন ব্রাহ্মণের পুত্রবধূ তাঁহার নিজের ভাগ আনিয়া অতিথিকে দিলেন।

 “ইহাতে সেই অতিথি পরম পরিতুষ্ট হইয়া বলিলেন, “হে ধার্মিক! ঐ দেখ স্বর্গ হইতে পুষ্পবৃষ্টি হইতেছে দেবতারা তোমার স্তব করিতেছে। এখন তুমি পরম সুখে সপরিবারে স্বর্গে চলিয়া যাও।”

 সেই অতিথি ছিলেন, স্বয়ং ধর্ম। তাঁহার কথায় ব্রাহ্মণ স্ত্রী, পুত্র এবং পুত্রবধূ সহ তখনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। তারপর আমি গর্ত হইতে উঠিয়া, সেই অতিথির পাতের উপর গড়াগড়ি দিতে লাগিলাম। তাহাতেই এই দেখুন! আমার অর্ধেক শরীর স্বর্ণময় হইয়া গিয়াছে।  সেই অবধি আমি, আমার অবশিষ্ট শরীরটুকু স্বর্ণময় করিবার আশায় যজ্ঞস্থান দেখিলেই তাহাতে গড়াগড়ি দিয়া থাকি। আজ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের কথা শুনিয়া, অনেক আশায় এখানে আসিয়া গড়াগড়ি দিলাম কিন্তু আমার শরীর সোনার হইল না! তাই বলিতেছি যে, সেই গরিব ব্রাহ্মণ যে অতিথিকে ছাতু খাওয়াইয়াছিল, তাহা ইহার চেয়ে বড় কাজ৷”

 এই বলিয়া সেই নেউল তথা হইতে প্রস্থান করিল।