উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/ইতর প্রাণীর বুদ্ধি

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ইতর প্রাণীর বুদ্ধি

 শুনিয়াছি, ঘোড়ায় নাকি গনিতে শিখিয়াছে, কুকুর নাকি গান গাওয়ার কথা কয়। এসকল তো খুবই বুদ্ধির কাজ তাহাতে ভুল কি? কিন্তু আমি সেরকম বুদ্ধির কথা বলিতে যাইতেছি না। উপস্থিত ঘটনায় যে ইতর প্রাণীদিগকে ভাবিয়া চিন্তিয়া বুদ্ধি খাটাইতে দেখা যায়, তাহারই কথা কিছু বলিব।

 একটা বড় ঘরের ভিতরে কড়ির নিচে দিয়া কার্ণিশ গাঁথা আছে, একটা প্যাঁচা সেই কার্ণিশে বসিয়া আছে। দুটো কাক বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া ভাবিল, ‘বাঃ এখন তো এ ব্যাটাকে খোঁচাইবার বেশ সুবিধা।’ তাহারা দুজন ঘরের ভিতর আসিয়া প্যাঁচাটার দু পাশে বসিল। প্যাঁচাটা তাহাতে ব্যস্ত হইয়া যেই একটা কাকের দিকে চোখ রাঙাইয়া ফিরিয়াছে, অমনি আর একটা তাহার লেজ ধরিয়া দিয়াছে এক টান। তাহাতে বেচারা থতমত খাইয়া যেই সেটার দিকে ফিরিয়াছে, অমনি এ কাকটা আবার দিয়াছে এক টান। প্যাঁচা তো ভারি মুস্কিলে পড়িল। এর দিকে ফিরিলে ও মারে, ওর দিকে ফিরিলে এ মারে, এখন সে করে কি? তখন তাহার মাথায় এই বুদ্ধি জোগাইল যে ঘরের কোণে গিয়া বসিলে আর কেহ তার লেজ ধরিতে পারিবে না। অথচ কাহারও পানে না ফিরিয়াও দুজনকে চোখ রাঙানো যাইবে। সুতরাং সে ঘরের কোণে গিয়া বসিল। তখন কাকেরা দেখিল যে এ খেলায় আর মজা নাই, কাজেই তাহারা আর সেখানে সময় নষ্ট করিল না।

 একটা বাড়িতে কাঙ্গালীদিগকে খাইতে দেওয়া হয়। একটি ছোট জানালা আছে, সেইখানে একটি দড়ি ঝুলিতেছে। সেই দড়ি ধরিয়া টানিলে একটা ঘণ্টা বাজে,অমনি ভিতর হইতে কে যেন একসরা খাবার বাহির করিয়া দেয়। কাঙ্গালীরা দেখিতে পায় না কে খাবার দিল, যে দেয় সেও দেখিতে পায় না কে খাবার নিল এখন হইয়াছে কি, যত জন কাঙ্গালী আসে, রোজ দেখা যায় যে তাহার চেয়ে এক সরা খাবার বেশি দিতে হয়। ব্যাপারখানা কি দেখিবার জন্য পাহারা বসান হইল। তখন দেখা গেল যে কাঙ্গালীরা চলিয়া গেলে সেই বাড়ির একটা কুকুর আসিয়া ঘণ্টার দড়ি ধরিয়া টানে, আর খাবারের সরাটি বাহির হইলে তাহা মুখে করিয়া ছুট দেয়। তাহা দেখিয়া সকলে খুব হাসিল। এখন হইতে রোজ একসরা খাবার লইয়া যাইত, কেহ তাহাকে কিছু বলিত না।

 আমাদের ‘ভিকু’ বলিয়া একটা কুকুর ছিল। সে রাত্রে পাড়া বেড়াইসা আসিয়া বাড়ির দরজা বন্ধ দেখিলে ঠিক মানুষের মতো করিয়া দরজা নাড়িত। বাড়ির লোক ভাবিত কে যেন আসিয়াছে, তা তাহারা ব্যস্ত হইয়া দরজা খুলিয়া দিত, আর দেখিত ভিকু লেজ নাড়িতেছে।

 ভিকু যে খালি এমনি করিয়া লেজ নাড়িত তাহা নহে। সে তাড়া খাইলে একটা ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিতে শিখিয়াছিল।

 সাধারণত সে অপরিচিত লোক দেখিলে বকিয়া তাড়াইয়া দিত। পাখি, ইন্দুর, বিড়াল পঞ্চাশ হাত দূর দিয়া গেলেও তাহাকে গালি না দিয়া ছড়িত না, কাছে আসিলে তো ধরিয়াই খাইত। কিন্তু আসলে সে বড় মহাশয় লোক ছিল। একবার আমাদের ছাতের উপর একটা পায়রাকে বাজ ধরিয়া তাহার চোখ কানা করিয়া দেয়। পায়রাটা অন্ধ হইয়া নিচে পড়িয়া গেল, আর পড়িল ঠিক ভিকুর সামনে। অন্য সময় হইলে ভিকু তাহাকে মারিয়া ফেলিত, কিন্তু সেই পায়রাটাকে সে তেমন কিছুই করিল না। সে খালি খানিক মনোযোগের সহিত তাহাকে দেখিল। তারপর যেই বুঝিল যে পায়রাটার কোনো বিপদ হইযাছে, অমনি সে তাহাকে পাহারা দিতে বসিল, আর সেখান হইতে উঠিল না। বিড়ালগুলি পায়রাটাকে খাইবার জন্য উঁকি ঝুঁকি মারিতেছিল—কিন্তু ভিকুর ভয়ে তাহার কাছে আসিতে পারে নাই। এমনি করিয়া দুদিন গেল। তাহার পরের দিন কোন কারণে ভিকুকে হাসপাতালে পাঠাইবার দরকার হয়। সেই দিন রাত্রেই বিড়ালেরা সুবিধা পাইয়া পায়রাটাকে খাইয়া ফেলিল।

 আলিপুরের বাগানে একটি ছোট বানরকে বিস্কুট দেওয়া হইতেছে। সেই বিস্কুটের সঙ্গে একটি মারবেলও তাহার হাতে দেওয়া গেল। মারবেলটি পাইয়াই সে মুখে পুরিয়া দিল, ভাবিল ওটাও বুঝি একরকমের বিস্কুট। বারকতক ওটাকে কামড়াইয়া যখন সে দেখিল যে সেটা ভারি শক্ত, দাঁতে ধরে না, তখন সে তাহাকে জলে ভিজাইয়া রাখিল। ভিজাইলে শক্ত জিনিস নরম হয় এ কথা সে জানিত, কিন্তু সকল জিনিসই যে নরম হয় না, এটুকু তখনো তাহার শিক্ষা হয় নাই।

 আর একটি বানরের গল্প এক ভদ্রলোকের মুখে শুনিয়াছিলাম, কতদূর সত্য বলিতে পারি না। বানরটি একটা হাসপাতালের কাছে থাকিত, লোকের অসুখ হইলে সেখানে যায় আর ডাক্তারবাবু তাহাদের হাত দেখিয়া ঔষধ দেন, ইহা সে দেখিত। তারপর একদিন তাহার নিজের অসুখ করিলে সেও গিয়া খুব গম্ভীর ভবে তাঁহাকে হাতখানি বাড়ইয়া দিল।

 একটা কুকুরের পা ভাঙ্গিয়া যায়, একজন ডাক্তার ঔষধ দিয়া তাহাকে ভালো করিয়া

দেন। তাহার কয়েকদিন পরে ডাক্তার দেখিলেন যে সেই কুকুরটা আর একটা খোঁড়া কুকুর আনিয়া তাঁহার কাছে উপস্থিত করিয়াছে।

 একটা বাঘের কথা পড়িয়াছিলাম, সে মানুষ খাইতে বড় ভালোবাসিত। সে গোরু খাইত না, কিন্তু গোরুর দড়ি ধরিয়া টানিয়া তাহাকে বনের কাছে নিয়া আটকাইয়া রাখিত। তারপর সেই গোরু খুঁজিতে খুঁজিতে মানুষ গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলে আর তাহাকে ধরিয়া খাইতে বেশি মুস্কিল হইত না।

 স্যাণ্ডার্সন নামে এক সাহেব লিখিয়াছেন যে একবার তাঁহাদের ছাউনি হইতে ক্রমাগত চাউল চুরি হইতে আরম্ভ হয়। চাকরেরা চাউলের বস্তা মাথায় দিয়া ঘুমাইয়া থাকে, তাহাদের মাথার নিচ হইতে কে সেই চাউল চুরি করিয়া লইয়া যায়, তাহারা তাহা টের পায় না। শেষটা চোর ধরিবার জন্য সাহেব নিজেই রাত জাগিয়া পাহারা দিতে লাগিলেন। তখন দেখিলেন যে তাহাদের সর্যূ নামে একটা হাতি ছিল, সেইটা অনেক রাত্রে আসিয়াছে। একজন লোক চাউলের বস্তা মাথায় রাখিয়া ঘুমাইতেছে সর্যূ আসিয়া প্রথমে শুঁড় দিয়া ভারি যত্বের সহিত তাহার মাথাটি আলগোছা ধরিল। তারপর চাউলের বস্তাটি আস্তে আস্তে সরাইয়া নিজের একখানি পা লোকটির মাথার নিচে রাখিয়া দিল। লোকটি ইহার কিছুই টের পায় নাই, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছে, আর সেই অবসরে সর্যূ চাউল শেষ করিয়া বস্তাটি পুঁটুলি পাকাইয়া আবার তাহার মাথার নিচে রাখিয়া দিয়াছে সাহেব এতক্ষণ তামাশা দেখিতেছিলেন, হাতির বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট হইয়া আর তাহার খাওয়ার বাধা দেন নাই। খাওয়া শেষ হইলে তিনি ডাকিলেন সর্যূ! আমনি সর্যূ সেখান হইতে দে ছুট!

 বিলাতে এক সাহেবের প্রকাণ্ড এক বানর ছিল, সে তাঁহার খোকাটিকে বড় ভালোবাসিত। একদিন সাহেবের বাড়িতে আগুন লাগিল। সকলেই সেই আগুন নিবাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। এদিকে খোকা যে উপরে রহিয়াছে আর সিঁড়িতে আগুন ধরিয়া গিয়াছে কাহারও সে হুঁস নাই। খোকার কথা মনে হইলে সকলে কপাল চাপড়াইতে লাগিল—হায় হায়! এখন উপায় কি হইবে, আর তো উপরে যাইবার সাধ্য নাই। এমন সময় দেখা গেল, বানরটা খোকাকে লইয়া জানালা দিয়া বাহির হইতেছে। তারপর সে খোকাকে সুদ্ধ ধীরে ধীরে নিচে নামিয়া আসল, বিপদও কাটিয়া গেল! তখন হইতে সেই বানরের কি রকম আদর হইয়াছিল, তাহা বুঝিতেই পার।

 শিয়ালের বুদ্ধির কথা আর কি বলিব, তোমরা সকলেই তাহা জান, অনেক সময় বেগতিক দেখিলে শিয়াল মুখ সিঁটকাইয়া মরিয়া থাকে। মরা শিয়াল মনে করিয়া কেহ তাহাকে কিছু বলে না। তারপর মুস্কিল চলিয়া গেলে সে আস্তে আস্তে উঠিয়া ঘরে যায়।

 কুকুরের ছানা হইলে দুটা শিয়াল মিলিয়া দু-দিক হইতে তাহাকে ভ্যাঙচাইতে আসে। কুকুরটা তাহাতে ভারি চটিয়া যেই একটাকে তাড়া করে, অমনি অপরটা ছানা লইয়া ছুট দেয়।