বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/একটি অন্ধ সীলের কথা

উইকিসংকলন থেকে

একটি অন্ধ সীলের[] কথা

 সে প্রায় চল্লিশ বছরের কথা। ব্লু উপসাগরে একটি সীলের ছানা ধরা পড়ে। সমুদ্রের ধারেই একটি ভদ্রলোক থাকিতেন, তিনি তাকে তাঁর রান্নাঘরে পুষিতে লাগিলেন। সে খুব বাড়িতে লাগিল; চাকরদের সঙ্গে তাহার খুব ভাব, বাড়ির এবং লোকের প্রতি বেশ মমতা। স্বভাবটি অতি মৃদু, কারুর কিছু ক্ষতি করে না, ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে, আর কর্তার ডাক শুনলেই কাছে হাজির হয়। তার প্রভুভক্তির কথা বলিতে হইলে বুড়ো বলিতেন যেমন কুকুরটি; আর আমোদ তামাশার কথা বলিতে হইলে বলিতেন ‘যেমন বিড়ালছানাটি।’

 সীলটি রোজ মাছ ধরিতে যাইত, আর নিজের জোগাড় হইলে পর প্রায়ই কর্তার জন্য দু-একটি মাছ আনিত। গ্রীষ্মের সময় রৌদ্রে বসিয়া থাকিত আর শীতের সময় ঘরের আগুনের এক পাশে একটা জায়গা পাইলে বড় খুশি হইত। আর কুম পাইলে তুন্দুরটার[] ভিতর যাইয়া বাসা লইত।

 বারো বছর এইরূপে সীলটিকে পোয়া হইল। এরপর একবার কর্তার ‘গোয়ালে’ একপ্রকার রোগ দেখা দিল। কতকগুলি পশু মরিয়া গেল; অন্যান্য পশুদের রোগ ধরিল। অন্যলোকের গোর স্থান পরিবর্তনে ভালো হয়; কিন্তু কর্তার গোরুর তাহা হইল না। কতা একটি স্ত্রী-ওঝার। নিকট পরামর্শ লইলেন। সে বলিল ‘ওগো! তুমি ওটা কি ধরে এনেছে, তাতেই তোমার গোরু মরে যায়। ওটাকে তাড়িয়ে দাও নৈলে আমার ওষুধেও ধরবে না, রোগও সারবে না’ সুতরাং সীলটিকে একটি নৌকায় তুলিয়া অনেক দূরে গিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইল, সেখানে তার যা খুশি তাই করুক। নৌকা ফিরিয়া আসিল; বাড়ির সকলে ঘুমাইল। সকালে একটি চাকরানী আসিয়া কাকে খবর দিল ‘সীল তুন্দুরের ভিতরে শুয়ে আছে।’ বাড়ির মায়ায় বেচারা রাত্রি করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। একটি জানালা খোলা পাইয়া ঘরে ঢুকিয়া তাহার জায়গা দখল করিয়া বসিয়াছে।

 পরদিন আর একটি গোরুর ব্যারাম হইল। সীলটাকে আর রাখা হইল না। অনেক দূর হইতে জেলে-নৌকা মাছ লইয়া আসিয়াছিল, তাহার মাঝি দু-তিন দিনের পথ লইয়া গিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে স্বীকার পাইল। তাহাই করা হইল। একদিন একরাত্রি গেল। পরদিন সন্ধ্যার সময় চাকর আগুন উস্কিয়া দিতেছিল, এমন সময় দরজার কাছে খট্‌মট্‌ শব্দ হইল। চাকর মনে করিল কুকুরটা বুঝি; অমনি দরজা খুলিয়া দিল—আর থপথপ করিয়া সীলটা ঘরে আসিল। অনেক পথ হাঁটিয়া ক্লান্ত হইয়া বাড়ি আসিয়াছে তাই একপ্রকার অব্যক্ত শব্দ করিয়া মনের সন্তোষ জানাইল, তারপর হাত-পা ছড়াইয়া আগুনের কাছে সুখে নিদ্রা গেল।

 এই অমঙ্গলের খবর কর্তার কানে গেল। কর্তা বিপদ ভাবিয়া ‘জান’কে জাগাইয়া পরামর্শ চাহিলেন। জান বলিল, ‘সীল মারলে অশুভ হয়, তবে’ চোখ দুটো খুঁড়ে ফের সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসো।” কর্তার বুদ্ধি চড়ায় ঠেকিয়াছে, কর্তা তাহাতেই রাজি। নিষ্ঠুরেরা সেই নির্দোষ বেচারার চক্ষু দুটি নষ্ট করিয়া ফেলিল। পরদিন সকালে বেচারা যাতনায় ছটফট করিতেছে এরূপ অবস্থায় তাহাকে সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া হইল।

 এক সপ্তাহ কাল গেল। কর্তার অমঙ্গল যেন জো পাইল। গোরু ক্রমাগত মরিতে লাগিল। শেষটা ওঝা আসিয়া বলিলেন, “ওগো আমি আর পারি নে। তোমায় বড় ভূতে পেয়েছে আমার আর সাধ্যি নেই।”

 আটদিনের দিন ভয়ানক তুফান হইল। মাঝে মাঝে বিরামের সময় দরজার নিকট কান্নার শব্দের মতো শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। সকালে দরজা খোলা হইল। সিঁড়ির উপর সীলটি মরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে।


  1. প্রাণীবৃত্তান্তে সীলের বাঙ্গালা মকর লেখা হইয়াছে, আমাদের বড় ভালো না লাগাতে, আমরা সীলই রাখিলাম।
  2. রুটি প্রস্তুত করিবার বড় উনুনকে তন্দুর’ বলে।