বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/চালনি বলেন ছুঁচ ভাই তুমি কেন ছেদা

উইকিসংকলন থেকে

চালনি বলেন ছুঁচ ভাই তুমি কেন ছেঁদা

 কেনারাম সম্মুখের লোকটিকে দেখাইতেন। তাঁর নিজের পিঠের দিকে একবার দেখিলে হইত। নিজের দোষগুলিকে সকলেই পিছনে ফেলিয়া দিতে চায়। আমি চেঁচাইয়া বলিলাম, “লোকনাথ বড় রাগী, আমি তাহাকে ভালোবাসি না,” বল দেখি ভাই, আমার সম্বন্ধে তুমি কিরূপ মনে করিতেছ? অন্যের ছেঁড়া মোজা দেখিয়া বিরক্ত হওয়ার আগে, নিজের জুতার ভিতর চাহিয়া দেখা ভালো। আমি যতক্ষণ বসিয়া থাকিব, ততক্ষণ তুমি হাঁটিতেছনা বলিয়া আমার বিরক্ত হওয়ার অধিকার কি? আর যদি এমন হয় যে আমি হাঁটিতেছি, তাহাতেই বা কি হইল।

  অন্যের তিলটিকে তাল করিবার পূর্বে নিজের তালটি ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেওয়া ভালো। গম্ভীরভাবে বক্তৃতা করিলে কি হয়, পরক্ষণেই যদি বক্তা নিজের অসারত্ব হাতে কলমে বুঝাইয়া দেন, তবে লাভ কি হইল? লাভ হইল যে, অন্য কেহ ঐ বিষয় নিয়া আমাকে কিছু বলিলে, আমি তাহাকে বলিব, “আরো একজন একবার বলিয়াছিলেন৷” আমার দোষ দেখিয়া তোমার কষ্ট বোধ হইয়াছে? ভালো। কিন্তু কষ্ট পাইয়া যদি তুমি আসিয়া মুরুবিব লোকের মতন আমাকে বকিতে থাক, তবে হয়তো লাভের মধ্যে এই হবে যে, তোমাতে আমাতে যে ভালোবাসাটুকু ছিল তাহা আর থাকিবে না। ক্লাশে একটি নূতন ছেলে আসিল—বেচারাকে যেন খেলার সামগ্রী পাইলে; অত বোকা বুঝি আর কেহ কখনো দেখে নাই। কিন্তু মনে পড়ে কি? তোমাকে যখন ধরিয়া বাঁধিয়া ইস্কুলে মাস্টারমহাশয়ের কাছে দিয়া যাওয়া হইয়াছিল, তখন তুমিও একটি জানোয়ারের মতন ছিলে কি না? অন্যের ত্রুটি নিয়া হাসিতামাশা করা যাহাদের অভ্যাস, তাহদের অনেকেরই দেখা যায় মেজাজটি বড় উগ্র—কথা সয় না। ইহারা যদি অন্যের উপর ঢিল ছুঁড়িবার সময় নিজের গায়ে মারিয়া একবার পরীক্ষা করিয়া দেখেন, তাহা হইলে বড় ভালো হয়। না হয় প্রতিপক্ষের পাটকেলটির সময় যেন মুখ বিকৃত না করেন। বাস্তবিক ওরূপ লোকের ঐ ঔষধ—আমি বলিলাম ‘খক্’ তুমি বলিলে ‘থুঃ’। বেশ সমানে সমানে গেল। এরূপ বারকয়েক হইলেই দেখিবে আমার রোগ সারিয়াছে, আমি ভালোমানুষ হইয়াছি৷

  ভালো ঠাট্টা কয়জন করিতে পারে? কথা শুনিয়া হাসিলাম; উপকারও হইল; এরূপ কথা কয়জন বলিতে পারে? প্রায়ই তো দেখি, তুমি বলিলে, আমি হাসিলাম, আর যদু চটিল৷ আমাদের দেশের একজন প্রতিভাশালী লোক বলিয়াছেন—‘কবির আমোদ, কিন্তু বিপিনের ক্লেশ, লোষ্ট্রক্ষেপী বালকের সুখে যথা ভেক৷’ তুমি তো এক কথা বলিয়া মজা করিলে; আমি বেচারা যে তাহাতে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিলাম। ঠাট্টা মাঝে মাঝে ভালো লাগে, কিন্তু বিদ্র‍ূপকে বড় ভয় করি। যিনি স্বভাবত কাহারো মনে ক্লেশ না দিয়া নির্দোষ কথা বলিয়া সকলকে আমোদ দেন, তিনি বড় ভালো লোক। আর যাহাদের দোষ সংশোধন করিবার ক্ষমতা নাই, কেবল বিদ্র‍ূপ করিবার জন্য অন্যের সমালোচনা করিয়া থাকে, তাহাদের সম্বন্ধে ছেলেবেলায় পড়িয়াছি, ‘খলেরা কেবল পরের দোষই অন্বেষণ করে—’৷