উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জ্বালাতন

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

জ্বালাতন

 পোকার জ্বালায় অস্থির হলাম—আর ব্যাঙের জ্বালায়। মাস দুই আগে ব্যাঙগুলো, মাছির মতো ছোট্ট-ছোট্ট ছিল, তখন তাদের দেখলে ভারি মায়া হত। ঠিক বুড়ো ব্যাঙদের মতোই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে হাওয়া খেতে বেরুত, ধরতে গেলেও তেমন ব্যস্ত হত না, হাতের তেলোয় তুলে বসিয়ে দিলেও ভয় পেত না। এখন সেগুলো বড় হয়েছে এখন সিঁড়ি বেয়ে ঘরে উঠতে পারে। ঘর যেন আমাদের নয়, যেন তাদেরই ঘর। ভারি গম্ভীর হয়ে তারা তার ভেতরে বেড়িয়ে বেড়াবে, আমাদের গ্রাহ্যও করবে না। তাড়াতে গেলে ব্যস্ত হয়ে গলিঘুচির ভেতরে ঢুকতে যাবে, কিন্তু বাইরে যাবার নামও করবে না। এদের মারবার সাধ্য নাই, মুখখানি দেখলেই দয়া হয়। যেন বেচারারা কিছু জানে না, কারও মন্দ ভাবে না।

 মাঝে মাঝে ওরা ঘরের কোণে এসে দু পাশের দেয়ালে পা ঠেকিয়ে বেয়ে উঠবার বিষম চেষ্টা করে। তখন তাদের দেখলে বড়ই হাসি পায়। আর, যখন ছুটতে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে হাত-পা ছোঁড়ে, তখনোও মজা কম হয় না। কাজেই তাদের আর মারা যায় কি করে? ওদের জব্দ করার এক উপায় হচ্ছে খালি কাগজ দিয়ে ধরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। তখন তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে, খানিক কি যেন ভাবে, তারপর আবার লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে, যেন কিছুই হয়নি।

 পোকার কথা আর কি বলব? আগে এদের বড় দেখতে পাই নি, বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে। এদের জ্বালায় রাত্রে আলো জ্বালিয়ে খাবার জো নাই, লাফিয়ে এসে ভাতে পড়তে চায়। এত রকমের পোকাও হয়! গঙ্গা ফড়িং, পিঁপড়ে, সাপের মাসি, গাঁধি, রাউটি, কত নাম করব? দশটার মধ্যে একটারও নাম জানি না হয়তো। চেহারাই-বা কতরকমের, রঙই-বা কতরকমের, গন্ধই-বা কতরকমের, রীতিনীতিই-বা কতরকমের, তার উপর আবার কামড়ের জ্বালাও আছে। গাঁধির আবার কামড়াতেও হয় না, তোমায় শুধু ফুঁকেই ফোস্কা ধরিয়ে দিতে পারে। মাঝে মাঝে এক-একটা ফড়িং আসে, সে এমনি গোঁয়ার যে, লাফিয়ে

এসে ঘাড়ে বসে, গোদা পায়ের লাথি লাগিয়ে চলে যাবে।

 একদিন একটা ফড়িং এসেছিল, সেটা দেখতে এমনি অদ্ভুত যে কি বলব। চুপ করে বসে থাকলে কখনো তাকে দেখে বলতে পারবে না যে সে খানিকটা গাছের ছাল নয়, সে একটা ফড়িং। হাত-পাগুলো গাছের ডালের মতো, পাখাগুলো গাছের ছালের মতো, রঙটি অবিকল শুকনো গাছের মতো।

 জানোয়ারের মধ্যে যেমন ব্যাঙ, পোকার মধ্যে তেমনি গুবরে পোকা। ওগুলোর কাণ্ড দেখে আমার বড্ড হাসি পায়। বোঁ—ওঁ—ওঁ!! করে এসে ঘরে ঢুকবে— ঢুকেই অমনি দেয়ালে ঢুঁ খেয়ে চিৎ হয়ে মেঝেয় পড়ে প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়তে থাকবে। তখন তাড়াতাড়ি বাটি চাপা দিলেই, বেটারা জব্দ হয়। জব্দ হয় বটে, কিন্তু সে কথা মানার দস্তুর তাদের নাই। চাপা দিবার খানিক পরেই দেখবে, সে তোমার বাটি ঠেলে নিয়ে চলেছে। সারারাত যদি অমনিভাবে বাটি চাপা দিয়ে রাখ, তবে সারা রাতই শুনবে খালি বাটি ঠেলার খন্‌খন্‌ শব্দ।

 একদিন একটা গুবরে পোকা এসেছিল, সেটা প্রায় দু ইঞ্চি লম্বা। দেখতে কালো, তার উপরে এই বড়-বড় সাদা ফুট্‌কি। মাথায় দুটো দাঁড়া, সে কি ভয়ানক! তাকে বাটি চাপা দিতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। তোমার হাতে বাটি দেখলেই সে তোমার মতলব এঁচে নেবে, তারপর কি ছুটই দেবে! ছুটে গিয়ে কপাটের আড়ালে ঢুকে, সেখান থেকে উঁকি মেরে তোমাকে দেখতে থাকবে। এগুলোর কামড়ে নাকি বিষ আছে, তার ঘা শিগ্‌গির শুকোয় না।

 রাত্রে এই-সব, আর দিনের বেলায় মাছি আর বোলতা। মাছির কথা আর কি বলব? সে তো সকলেই জানে। এরাই নাকি গায়ে হাতে করে ভয়ানক ভয়ানক বেয়ারামের বীজ এনে আমাদের গায়ে আর খাবারের ভিতর রেখে যায়। তবেই ভাব, এরা আমাদের কিরকম শক্র। দুপুরবেলায় একটু ঘুমুতে গেলে এরা এসে নাকে মুখে সুড়সুড়ি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলে। ক্ষুদে মাছিগুলো আবার এর চেয়েও দুষ্টু। আমি লিখছি আর ওরা পিন্‌ পিন্‌ পিন্‌ করে এসে খালি আমার নাকের আর চোখের ভিতর ঢুকতে চেষ্টা করছে। চোখে চশমা আছে, তাতেও ওদের গ্রাহ্য নেই, চশমার পাশ দিয়ে একেবারে চোখের ভিতরে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন তাকে মারবারও জো নেই, তা হলে চশমা ভেঙ্গে যাবে। সেদিন ঠিক এমনি করে চোখের ভিতর থেকে ক্ষুদে মাছি তাড়াতে গিয়ে এক বাবুর থাপ্পড় লেগে তাঁর চশমা উড়ে গিয়েছিল।

 পিঁপড়েগুলোও কম নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে এক্ষুনি একটা এসে আমাকে, উঃ, কি কামড়ই দিল। এক-এক সময় আট-দশটা মিলে একসঙ্গে কামড়াতে আসে।

 এদের সকলের চেয়ে অবশ্যি বোলতাকেই আমার বেশি ভয় করে। আজ অন্যদিনের চেয়ে এদের একটু কম আনাগোনা দেখছি; তবে এরই মধ্যে দু তিনজন এসে আমার খবর নিয়ে গেছে। চার বছর আগে একটা বোলতা আমাকে কামড়িয়েছিল, এখনো তার দাগটি আমার হাতে আছে। ছেলেবেলায় এদের কত কামড়ই খেয়েছি। তখন থেকেই এই পোকাগুলোকে আমি ভারি ভয় করি। একবার একটার তাড়া খেয়ে এমনি ছুট দিয়েছিলাম যে সিকি মাইল আমার পিছু পিছু তাড়িয়ে সেটা আমাকে ধরতে পারে নি। আমাদের বাড়ির কর্ত্রীকে যে বোলতায় কামড়িয়েছিল, তার কথা এখনো তিনি মাঝে মাঝে দুঃখের সহিত বলেন।

 কাজেই বোলতা ঘরে এলেই আমরা একটু ব্যস্ত হই; কখন কাকে কামড়ায়, তার ঠিক কি? এর ওষুধ হচ্ছে পাখা হাতে নিয়ে বসা, আর বোলতা খানকা বেশি কাছে এলে তাকে ঠাঁই করে মারা। তখন সে মাটিতে পড়ে ফড়্‌ফড়্‌ করে ঘুরতে থাকে, বেশি লাগলে অজ্ঞান হয়ে যায়, কিন্তু সহজে মরে না। খানিক বাদেই দেখবে, সে উঠে বসেছে; আর খানিক বাদে উড়তে থাকবে। তখনো হয়তো তার মাথা ঘোরা একেবারে সারবে না; হয়তো সে মাতালের মতো টলতে টলতে উড়বে, আর দেয়ালে টক্কর খেতে খেতে ভাববে ‘বড্ড সামলে গেছি!’ যাহোক, আর-একটু পরেই সে বেরিয়ে চলে যাবে।

 যদি বোলতা মরে যায়, তবে অমনি পিঁপড়েরা এসে তাকে নিয়ে যাবার আয়োজন করবে। একটা বোলতাকে নিয়ে যেতে কটা পিঁপড়ে লাগে আমি তার হিসাব করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দেখলাম যে কাজটি বড়ই কঠিন। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটি পিঁপড়ে একটা বোলতাকে ধরেছে, কিন্তু তাদের সকলে একদিকপানে টানছে না। একদল যেদিকে টানছে, আরেকদল টানছে ঠিক তার উল্টো দিকে। তার মধ্যে আবার দশ-বারোজন বোলতাটার উপরে উঠে খালি পাইচারি করছে। তারা টানছে তো না-ই, লাভের মধ্যে অনর্থক বোঝা বাড়াচ্ছে। আমি জানতাম যে, পিঁপড়েরা ভারি বুদ্ধিমান জীব; এখন দেখছি, তারা মাঝে মাঝে নিতান্ত বোকার মতো কাজও করে। কাজেই আমার আর হিসাব করা হল না; শুধু এইটুকু বুঝলাম যে বুঝে শুনে টানলে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটার চেয়ে ঢের কম পিঁপড়েতে একটা বোলতাকে সমান জমির উপরে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

 অনেক সময় বোলতাটা মরবার আগে পিঁপড়েগুলো এসে তাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তখন বোলতা তাদের এক-এক জনকে এমনি লাথি মারে যে, তাতেই তাদের দুতিনশ হাত (পিঁপড়ের হাতে) দূরে গিয়ে ছিটকিয়ে পড়তে হয়।

 আমি যে বোলতাগুলোর কথা বলছি, তারা দেখতে ভারি সুন্দর। গায়ের রঙটা, তোমরা যাকে চকোলেট রঙ বল, তেমনি। কপাল আর দুটি শুঁড়ের গোড়া দুটি খানিক হলদে, খানিক চকোলেট। দুপাশে দুটি বড়-বড় চোখ, তার প্রত্যেকটি হাজার-হাজার চোখ দিয়ে তয়ের হয়েছে। তাছাড়া মাথার উপরে আরো তিনটি ছোট-ছোট চোখ আছে।