উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/তিব্বত

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

তিব্বত

 হিমালয় পর্বতের উত্তরে তিব্বত দেশ—সেই যে দেশে আংটির মতন একটা হ্রদ আছে, ছেলেবেলা ভূগোলে পড়িয়াছিলাম যে, এই দেশের ছাগলের লোমে শাল হয়, আর সেখানে নাকি একটা মস্ত লামা থাকে।

 বাস্তবিক এই দেশটা আমাদের এত কাছে হইলেও আমরা ইহার সম্বন্ধে খুব কম খবর রাখি। ইহার প্রধান কারণ দুটিঃ ১) আমাদের এ দেশ হইতে তিব্বতে যাইতে হইলে হিমালয় পার হইয়া যাইতে হয়; ২) তিব্বতের লোকেরা বিদেশী লোককে সহজে তাহদের দেশে ঢুকিতে দেয় না।

 হিমালয় পর্বত পার হইয়া যাওয়া যে ভারী মুশকিলের কথা, এটা নিশ্চয়ই তোমরা অনেকটা বুঝিতে পার; কিন্তু ভাল করিয়া বুঝিতে পার কি না জানি না। হিমালয় পর্বত ভয়ানক উঁচু। তাহাকে ডিঙ্গাইতে হইলে লোকে অবশ্য তাহার অপেক্ষাকৃত নীচু স্থানটাই ডিঙ্গায়। কিন্তু এই পর্বতে ১৭০০০ (সতের হাজার) ফুটের চাইতে নীচু ডিঙ্গাইবার পথ নাই। সারা বছর সেখানে বরফ পড়িয়া থাকে। সেই বরফের উপর দিয়া পায় হঁটিয়া চলিবার সাধ্য নাই—এমনকি, ঘোড়াও তাহার উপর দিয়া সহজে যাইতে পারে না। চমরী গরুর পিঠে চড়িয়া এই সকল স্থান পার হইতে হয়। শীতের তো কথাই নাই, তাহা ছাড়া খাওয়া দাওয়ার অসুবিধাও খুব বেশি। তোমরা ডাল ভাত খাও, কিন্তু তিব্বতের পথে ডাল ভাত মিলে না। চিঁড়ে, ছাতু, চমরীর দুধ, এইসব খাইয়াই কাজ সারিতে হয়। গ্রীষ্মকালে বরফ কমে; তখন সকল স্থানে এত কষ্ট পাইতে হয় না;কিন্তু এরূপ সুবিধা দু’মাসের বেশি থাকে না। এসকল পথে ভল্লুকের ভয়ও আছে। তাহা ছাড়া শুধু বরফের দরুনই কত রকমের বিপদ হইতে পারে, তাহ শুনিলে আশ্চর্য হইবে। হাত পায়ের আঙ্গুল দুটা-একটা পচিয়া পড়া তো ধর্তব্যের ভিতরেই নহে। পথে চলিতে চলিতে বরফের ভিতর ডুবিলেই সর্বনাশ! এক এক স্থান এমন ভয়ানক যে, মাথার উপরে পর্বত প্রমাণ বরফ আলগোছে ঝুলিতেছে, সামান্য একটু ছুতা পাইলেই ঘাড়ে পড়িয়া মুহুর্তের মধ্যে তিব্বত যাইবার আশা মিটাইয়া দিবে। একটু অসতর্ক হইয়া পথ চলা, এমনকি, একটি গান ধরা, এরূপ সামান্য কারণ হইতে এইরূপে বরফ চাপা পড়িয়া দলসুদ্ধ লোক মারা যাইবার কথা শুনা গিয়াছে।

 এত কষ্ট করিয়া তিব্বতে যাইতে হয়, সেখানকার লোকেরা আবার তাহাদের দেশে ঢুকিতে দিতে চায় না। সাধু সন্ন্যাসী ভিন্ন অন্য লোক এ দেশ হইতে তিববতে খুব অল্পই গিয়াছেন। যাঁহারা গিয়াছেন, তাঁহাদেরও অধিকাংশই অতি কষ্টে অল্প দিন মাত্র সেখানে থাকিয়া শেষটা—অনেক সময় প্রাণের ভয়ে—চলিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছেন। এইজন্যই তিববত দেশের এত কম খবর এ দেশে আসে। যাহা আসে, তাহারও কতটা খাঁটি তাহার নিশ্চয় নাই৷

 তিববত দেশটা খুব উঁচু। আমাদের এ দেশের চাইতে মোটের উপরে দু মাইল উঁচু হইবে। অবশ্য ইহার চাইতে কম উঁচু স্থানও আছে, তেমনি আবার তিন মাইল উঁচু স্থানও আছে। পাহাড়ে দেশ; কাঁকরে মাটি। বৃষ্টি বাদ্‌লা বড় একটা নাই। শীতকালে অসম্ভব শীত, আবার গ্রীষ্মকালে কয়েকটা দিন ভয়ানক গরম। হাওয়া যারপরনাই শুকনো। সেদেশে জিনিস পচিতে পায় না। মাংস শুকাইয়া এমন হইবে যে, টিপিলে গুঁড়া হইয়া যায়; কিন্তু তাহাতে গন্ধ হওয়া বা পচা ধরা—তাহা কখনই হইবে না৷

 তিববতের অনেক স্থানই অনুর্বর, তাহাতে গাছপালা বেশি জন্মে না। কিন্তু অনেক উর্বরা মাঠও আছে, তাহাতে খুব ঘাস হয়, আর অনেক জীব জন্তু তাহাতে বাস করে। চমরী, ঘোড়া, গাধা আর ভেড়াই ইহাদের মধ্যে প্রধান৷

 এ দেশের প্রধান শস্য যব, রুটি, ছাতু ইত্যাদি প্রধান খাদ্য। মাখন খুব পুরাতন হইলেই বেশি পছন্দ হয়। ছাগলের চামডার থলিতে মাখন রাখিয়া দেওয়া হয়। সে মাখন যত পুরাতন হয়, ততই তার দাম বাড়ে, এক পুরুষের লোকেরা মাখন রাখে, হয়ত তার পরের, এমনকি, তারও পরের পুরুষের লোকেরা তাহা ব্যবহার করবে। খুব উঁচু দরের মাখন ৪০/৫০ বৎসরেরও হয়। এত ভাল মাখন অবশ্য সর্বদাই খাইতে পাওয়া যায় না। বিবাহাদি বড় বড় উৎসব ভিন্ন তাহার থলি খোলা হয় না৷

 তিববতীরা চা খুব কম খায়। তবে ঘৃতের ন্যায়, চা-টাও একটু নূতন ধরনের। তাহাতে নুন থাকে, আর খানিকটা মাখনও থাকে। এই চা প্রস্তুত করিবার সময় তাহা খুব ঘাঁটিতে হয়৷

 তিববতের লোকেরা ভাল চা-ও প্রস্তুত করিতে জানে। এক সাহেব তিব্বতের প্রধান সেনার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন; সেখানে তাঁহাকে চা খাইতে দিয়াছিল। তিনি বলিয়াছেন যে, সে চা খাইতে খুব ভাল। তাঁহার সবটাই খাইবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শেষ না হইতেই পিয়ালা লইয়া গেল। তিববতে মানুষ মরিলে তাহাকে কুকুর দিয়া খাওয়ায়। গরীব লোক মরিলে তাহাকে সাধারণ কুকুরেই খায়; কিন্তু বড় লোকদের জন্য মঠ মন্দিরেতে ভাল কুকুর রাখা হয়। কেহ মরিলেই তখনি কিন্তু তাহাকে কুকুর দিয়া খাওয়ায় না। মড়াটা পাছে উঠিয়া ঘরের লোকের উপর উৎপাত করে, সেই ভয়ে, মরিবার পরেই তাহাকে বেশ করিয়া বাধিয়া, দেওয়ালে হেলান দিয়া দাঁড় করাইয়া কয়েক দিন রাখিয়া দেয়৷

 তিববতীরা বেঁটে ও বলিষ্ঠ। দেখিতে কতকটা চীনেদের মতন। ইহাদের স্বভাব বড় নোংরা। বৎসরে একদিন স্নান করে। কাপড় পরিয়া সেটা ছিড়িয়া টুকরা টুকরা না হইলে, আর তাহা ছাড়ে না। ইহারা বেশ পরিশ্রমী। পুরুষদের চাইতে স্ত্রীলোকেরা বেশী পরিশ্রম করে। পশমের সুতা পাকান, আর তাহা দ্বারা নানারকম জিনিস প্রস্তুত করা পুরুষদের একটা প্রধান কাজ৷

 ইহারা মহিষের চামড়ার ভিতরে হাওয়া পুড়িয়া তাহ নদীতে ভাসাইয়া দেয়। নদী পার হইতে হইলে ইহাই তাহদের খেয়া। এ খেয়াতে দাঁড়, লগী বা হালের প্রয়োজন হয় না। তুমি চামড়ার উপরে উঠিয়া যেমন করিয়া পার বসিয়া থাকিবে; আর খেয়ানী দুপায় জল কাটিয়া সাতরাইবার কায়দায় তোমাকে ও-পারে লইয়া যাইবে৷

 স্কুলে যাতায়াতের প্রধান উপায় চমরী এবং ঘোড়া। চমরীগুলির স্বভাবটা বড় বুনো; কখন কি করিয়া বসে, তাহার ঠিক নাই। নাকে দড়ি না লাগাইলে তাহাকে চালানই ভার। তাহার পিঠে বসিয়া তুমি কিছুতেই নিশ্চিন্ত হইতে পার না। তোমাকে গুঁতাইবার অবসর পাইলে সে তো তাহা সন্তোষের সহিত করিবেই। আর কিছু না পারিলে অন্ততঃ তোমাকে লইয়া একটা বেখাপ্পা ছুট দিবে। পাহাড়ে উঠিবার সময় ইহারা ভারি হুঁশিয়ার; কিন্তু তাহা খালি তাহার নিজের সম্বন্ধেই—তোমার সম্বন্ধে নহে। খাদের পাশে নিয়া তোমাকে ঝাড়িয়া ফেলিবার সুযোগ পাইলে, সে অম্লানবদনে তাহা করিবে৷

 তিববতীরা পাহাড়ে উঠিতে হইলে অনেক সময় এক নুতন কায়দায় ঘোড়া চড়ে। অর্থাৎ ঘোড়ায় না চড়িয়া, তাহার লেজ ধরিয়া ঝুলিতে থাকে; ঘোড়া তাহাকে টানিয়া লইয়া যায়৷

 তিববতীদের ভূত-পেত্নীর ভয়টা বড়ই বেশী। তোমাদের মধ্যে যাহারা দার্জিলিং গিয়াছ, তাহারা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ, ভূটিয়ারা কেমন নেকড়ের নিশান টাঙ্গায়। ঐ নেকড়ের নিশান ভূত তাড়াইবার ঔষধ! ভূত তাড়াইবার মন্ত্র তাহাতে লেখা আছে। ঘরে দরজায়, পথে ঘাটে, সকল স্থানেই ঐ সকল নিশান দেখিতে পাইবে৷

 ভূটিয়ারা তিববতের ধর্ম পালন করে। তিববতের ধর্মটা মোটামুটি বৌদ্ধ ধর্মই বটে; কিন্তু সেই বৌদ্ধ ধর্মের ভিতরে তিববতীরা তাহদের দেশের ভূত-পেত্নীগুলির জন্য অনেকখানি জায়গা করিয়া লইয়াছে। তাহদের “লামারা” এই সকল ভূত তাড়াইবার মন্ত্র লিখিয়া সাধারণ লোকের নিকট বিক্রয় করে। “লামা” বলিতে, সেই যার ছাগলের মতন গা, আর উটের মতন মুখ, যার লোমে গেঞ্জি তৈয়ার হয়—সেই জন্তুটাকে মনে করিও না। এই সকল লামা তিববতীদের প্রধান পুরোহিত এবং শাসনকর্তা। তিববতীয়েরা একেবারে স্বাধীন নহে, কোন কোন বিষয়ে চীনেদের অধীন। চীনেরা ইহাদের নিকট হইতে কর নেয়৷

 দলাই লামার নীচে আরো অনেক লামা আছেন, তাহারা পদ অনুসারে অল্প বেশী সম্মান লাভ করেন। একজন লামার ছবি দেওয়া যাইতেছে, তাহা দেখিয়া তাহার পরিচ্ছদাদির বিষয় অনেকটা বুঝিতে পরিবে। ছবিতে লামা পূজায় নিযুক্ত আছেন। এক হাতে ঘণ্টা আর এক হাতে বজ্র। সামনে একটি ডমরু পড়িয়া আছে। ডমরু একটি খুব ছোট ঢাক। আকৃতি কতকটা মোড়ার ন্যায়। আমাদের বাজিকরেরা অনেক সময় ইহা বাজায়। এই সকল জিনিস লামারা ভূত তাড়াইবার জন্যে ব্যবহার করেন৷

 লামার ডানদিকে একটা ঘটির মুখে ঝুমঝুমির ন্যায় যে জিনিস দেখিতেছ, তাহ তাঁহার “যপ-চক্র”। এইযপ-চক্র অতি অদ্ভুত জিনিস। ইহার ভিতরে ইহাদের সর্বপ্রধান মন্ত্র অনেকবার লেখা আছে। হাতলে ধরিয়া পাক দিয়া চক্র ঘুরাইতে হয়। চক্র এক পাক ঘুরিয়া আসিলে ঐ মন্ত্র হয়ত দশ হাজার বার (যতবার তাহা লেখা আছে) যপ করিবার ফল হইবে। চক্র আবার ঘুরাইবার উল্টা সোজা আছে। উল্টা ঘুরাইলে ফলও উল্টা হইবে। এ চক্রটি নিতান্তই ছোট। এমন চক্রও আছে, যে তাহা ঘুরাইতে দুজন বলিষ্ঠ লোকের দরকার। তাহার ভিতরে অনেক কাগজ ধরে, সুতরাং মন্ত্রও অনেকবার লেখা যায়, আর তাহাতে ফলও সেই পরিমাণে বেশী হয়। বড় বড় মঠে ১০ হাত ২০ হাত উচু প্রকাণ্ড যপ-চক্র খাটান থাকে। পয়সা

থাকিলে একজনকে নিযুক্ত করিয়া যতক্ষণ ইচ্ছা সেই চক্র ঘুরাইতে পার; আর এইরূপে বিনা মেহনতে অনেক ফল পাইতে পার। অনেক যপ-চক্র হাওয়ার অথবা জলের জোরে চলে, তাহাকে যে একবার চালাইয়া দেয়, তাহার ঢের ফললাভ হয়। এক লামা এইরূপ চক্র চালাইয়া দিয়া, নিশ্চিন্ত মনে বাড়ী চলিয়াছেন, এমন সময় আর এক লামা আসিয়া চক্র থামাইয়া পুনরায় নিজের জন্যে তাহাকে চালাইয়া দিলেন। প্রথম লামা তাহা দেখিতে পাইয়া ভয়ানক রাগিয়া গেলেন; সুতরাং দুজনে বিবাদ আরম্ভ হইল। এমন সময় আর একজন বৃদ্ধ লামা আসিয়া, তাহদের বিবাদের কারণ জানিয়া বলিলেন, “বাপু সকল, তোমাদের বিবাদ করিয়া দরকার নাই; আমি তোমাদের জন্য চক্র ঘুরাইতেছি, তোমরা ঘরে যাও৷”