উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/বাদশাহি সারকাস

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

বাদশাহি সারকাস

 রোমনগরের লোকেরা নানারকম জন্তু এবং মানুষের লড়াই দেখিতে বড় ভালবাসিত। এ সম্বন্ধে অনেক কথা তোমরা সময় সময় মুকুলে পড়িয়াছে। এক সময়ে আমাদের দেশেও যে ঐরূপ তামাসা হইত, তাহা হয়ত সকলের জানা নাই।

 আগে বিলাতে ‘ওরিএণ্টাল্‌ য়্যানুয়েল’ নামক একখানি বার্ষিক পত্রিকা বাহির হইত। ১৮৩৮ সালে উহার যে খণ্ড ছাপা হয়, তাহাতে এইরূপ তামাসার কিছু বর্ণনা আছে। এক সাহেব তাহা স্বচক্ষে দেখিয়া এইরূপ লিখিয়া গিয়াছেন:—

 একটা ছোট পুকুরে দুইটা কুমীর রাখা হইয়াছিল। ক্রমাগত দুমাস তাহাদের মুখ লোহার তার দিয়া বাধা ছিল;এই দু’মাস তাহারা কিছুই খাইতে পায় নাই। এরপর তাহাদিগকে ধরিয়া ডাঙ্গায় তুলিয়া তাহদের মুখের বাঁধন খুলিয়া দেওয়া হইল। বাঁধন খুলিয়া ছাড়িয়া দিতে তাহারা আবার জলের ভিতরে গিয়া ঢুকিল। দু’মাস একসঙ্গে এক পুকুরে থাকিয়া তাহদের মধ্যে কতকটা বন্ধুতা হইয়াছিল, সুতরাং তাহারা কোনরূপ ঝগড়া করিবার চেষ্টা করিল না। পুকুরটির জল বেশী গভীর ছিল না, সুতরাং তাহাদের চাল-চলন বেশ পরিষ্কার দেখা যাইতেছিল। তামাসার জায়গায় বিস্তর লোকের জনতা হইয়াছিল কিন্তু কুমীরেরা তাহা বড় গ্রাহ্য করল না। এমন কি, লম্বা বাঁশের খোঁচা দু-একটা না খাইলে, তাহদের বড় একটা নড়িবার চড়িবার মতলবও দেখা গেল না।

 এমন সময় একটা মরা ভেড়া আনিয়া ছোট কুমীরটার মুখের কাছে ফেলিয়া দেওয়া

হইল। ছোট কুমীরটা ভারি ব্যস্ত হইয়া যেই সেটাকে মুখে লইয়াছে, অমনি বড় কুমীরটা তীরের মতন ছুটিয়া তাহাতে ভাগ বসাইতে আসিল। এরপর কিছুকাল তাহারা জলের নীচে কাড়াকড়ি করিতে লাগিল। খানিক পরে একটাই ভাসিয়া উঠিল; তখন দেখা গেল, যে সে ভেড়ার কতকটা মুখে করিয়া লইয়া আসিয়াছে। সেটুকু খাওয়া হইলে সে আবার ডুব দিল, আর আবার নুতন করিয়া যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সেই যুদ্ধের চোটে ছোট পুকুরটি তোলপাড় হইয়া উঠিল, তাহার জল কাদায় ঘোলা আর রক্তে লাল হইয়া যাইতে লাগিল। দর্শকদের উৎসাহের কথা বুঝাই যায়। ভেড়া শেষ হইয়া গেলে, দুইটাতে পুকুরের দু জায়গায় ভাসিয়া উঠিল। তখন দেখা গেল, যে ছোট কুমীরটার গলায় ভয়ানক একটা গর্ত, আর বড় কুমীরটার সামনের পা একেবারে চৌচির। তাহাদের রক্তে জল লাল হইয়া যাইতেছে; কিন্তু বেশী কিছু কষ্ট যে তাহাদের হইতেছে, এইরূপ বোধ হইল না।

 এরপর আর একটা ভেড়া আনিয়া জলে ফেলা হইল; সুতরাং যুদ্ধও আবার আরম্ভ হইল। এবারে যুদ্ধ বেশীক্ষণ থাকিল না; কারণ ভেড়াটা এত পচা ছিল যে সহজেই ছিঁড়িয়া গেল। সেদিনকার তামাসা এই পর্যন্ত। পরদিন বাঘে কুমীরে লড়াই। বাঘটা একটা প্রকাণ্ড চিতা বাঘ। সেই আগের দিনের দুটা কুমীরের সঙ্গে তার লড়াই হইবে। ছোট কুমীরটাকে দেখিয়াই বোধ হইল, যে আগের দিনের সেই গলার আঘাতে সে বড়ই কাবু হইয়াছে—যুদ্ধের মেজাজ তাহার একেবারেই নাই।

 বাঘটাও যেন কুমীর দেখিয়া একটু ভয় পাইয়াছে। সে সহজে খাঁচার বাহিরে আসিতে চায় না। —তাহাকে খোঁচাইয়া বাহির করিবার দরকার হইল। বাহিরে আসিয়া সে একবার কুমীরের কাছে যায়—আর এক একবার ওৎ পাতিবার যোগাড় করে—আবার ভয় পাইয়া থামে। বাঘটা বেশী কাছে আসিলে কুমীর গুলা একটু একটু লেজ নাড়ে। এমন সময় কতকগুলি পট্‌কায় আগুন ধরাইয়া বাঘের পিছনে ফেলিয়া দেওয়া হইল।

 পট্‌কার শব্দে বাঘটা চম্‌কাইয়া আর চটিয়া এক লাফে গিয়া ছোট কুমীরটার উপরে পড়িল। সে বেচারা আগে হইতেই কাবু হইয়া আছে, সুতরাং তাহার গলার দাঁত বসাইয়া তাহাকে মারিতে বাঘের কিছুই মুশকিল হইল না।

 তিন দিন যাবৎ বাঘটা কিছু খাইতে পায় নাই; ক্ষুধায় সে আগেই গরম হইয়াছিল। এর উপরে এখন রক্তের লোভ পাইয়া সে আরো খেপিয়াছে; আবার একটা কুমীরকে এত সহজে মারিয়া তাহার ভয়ও ভাঙ্গিয়াছে। সুতরাং সে ইহার পরেই লাফাইয়া বড় কুমীরটার ঘাড়ে পড়িতে গেল। কিন্তু বড় কুমীরটা ভয়ানক তাড়াতাড়ি মাথা সরাইয়া নেওয়াতে, বাঘ ত তাহার ঘাড়ে পড়িতেই পাইল না, বরং বাঘ সাম্‌লাইয়া উঠিবার আগেই কুমীর তাহার মাথাটি কামড়াইয়া ধরিল। ইহার পর এক পালোয়ান বল্লম দিয়া কুমীরটাকে মারিয়া ফেলিল।

 আর একবার একটা বড় বাঘ আর একটা মহিষে যুদ্ধ হইয়াছিল। মহিষটা প্রকাণ্ড আর ভয়ানক রাগী। মুহূর্তের মধ্যে সে বাঘ মহাশয়কে তাড়াইয়া কোণঠাসা করিল। বাঘ তখন আর কি করে, লাফাইয়া মহিষের ঘাড়ে পড়া ভিন্ন তাহার অন্য উপায় নাই। সে মহিষের ঘাড়ে পড়িয়া আঁচড় কামড়ে তাহাকে ক্ষত বিক্ষত করিয়া ফেলিল, কিন্তু মহিষের তাহাতে গ্রাহ্য নাই। সে এমনি জোরে এক ঘা ঝাড়া দিল যে, বাঘ আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়িয়া অজ্ঞান হইয়া গেল;আর মহিষ শিঙের গুঁতায় তাহার নাড়িভূঁড়ি বাহির করিয়া দিল। যতক্ষণ বাঘের প্রাণ ছিল ততক্ষণ মহিষ তাহাকে গুঁতাইয়াছিল আর মাড়াইয়াছিল। তারপর পাগলের মত ছুটতে লাগিল। তাহার গা দিয়া দর দর করিয়া রক্ত পড়িতেছে, মুখ দিয়া ফেনা ঝরিতেছে, চোখ দিয়া যেন আগুন বাহির হইতেছে! মাঝেমাঝে দাঁড়াইয়া, পায়ে মাটি খোঁড়ে আর ভয়ানক গর্জন করে।

 তারপর একটি ছোট গণ্ডার আনা হইল। সে তামাসার জায়গায় এক পাশে দাঁড়াইয়া আড় চোখে মহিষকে দেখিতে লাগিল, কিন্তু কিছুমাত্র ব্যস্ত হইল না। মহিষটা মাঝখানে দাঁড়াইয়া ছিল। সে সেখান হইতে শিং নীচু করিয়া গণ্ডারের দিকে ছুটিল। মহিষ কাছে আসিবামাত্র গণ্ডার পাশ কাটিয়া তাহাকে এড়াইয়া গেল, আর তাহার নিজের খড়গ দিয়া মহিষকে গুঁতাইয়া দিল। গুতা মহিষের গায় ভাল করিয়া লাগিল নাখালি একটা লম্বা আঁচড় পড়িল। এতক্ষণে গণ্ডারটা রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিতেছে, তাহার চোখদুটি যেন জ্বলিতেছে! মহিষ এতক্ষণে আবার ফিরিয়া আসিয়া গণ্ডারের কাধে এক গুঁতা লাগাইল, কিন্তু গণ্ডারের চামড়া এমন শক্ত, যে সে গুঁতায় তাহার বিশেষ কিছুই হইল না। গুঁতা খাইয়াই গণ্ডার তৎক্ষণাৎ মহিষের পাজরার ভিতরে তাহার খড়গ ঢুকাইয়া দিল, তারপর তাহাকে খড়েগ তুলিয়া খানিক দূরে ছুঁড়িয়া ফেলিল। মহিষও মাটিতে পড়িয়া তখনই মারা গেল।

 শেষে একটা প্রকাণ্ড ভালুক আর তিনটা বুনো কুকুরের যুদ্ধ। বেশ গভীর অথচ মুখ লম্ব চওড়া একটা গর্তের মতন স্থানের মাঝখানে একটা থাম পোঁতা আছে। ভালুকটা সেই থামের আগায় চড়িতে ভারি ব্যস্ত। এমন সময় কুকুরগুলিকে ভিতরে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। ভালুককে থামের উপরে দেখিয়াই কুকুরগুলি ভয়ানক ঘেউ ঘেউ আরম্ভ করিল। শেষে অনেক কষ্টে গর্তের এককোণে গিয়া কুকুরগুলিকে সামনে করিয়া বসিয়া, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। একটা কুকুর তাহার গলা কামড়াইয়া ধরিল। সে দুহাতে চাপিয়া কুকুরটাকে মারিয়া ফেলিল। কুকুর মরিল, কিন্তু কামড় ছাড়িল না। ততক্ষণে আর দুটা কুকুর আসিয়া তাহাকে কামড়াইয়া ধরিল। প্রথম কুকুরটা কখন মরিয়া গিয়াছে; কিন্তু ভালুক সেই যে কামড়াইয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতেছে। বেচারা নাকাল হইয়া শেষটা আবার চ্যাঁচাইতে লাগিল।

 শেষে আর উপায় না দেখিয়া ভালুক মাথা গুঁজিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া রহিল। কুকুরগুলি তাহার পিঠে কামড়াইয়া বিশেষ কিছু করিতে পারিল না—সেখানকার চামড়াও মজবুত আর লোমগুলিও লম্বা লম্বা সুতরাং কামড়াইবার সুবিধা হয় না। যাহা হউক যতক্ষণ তাহাদের কিছুমাত্র দম ছিল, ততক্ষণ তাহারা ভালুককে ছাড়ে নাই। শেষে যখন একেবারেই হাঁপাইয়া পড়িল, তখন তাহাদিগকে লইয়া যাওয়া হইল। ভালুকও “বড্ড বেঁচে গিয়াছি” মনে করিয়া মরা কুকুরটাকে ফেলিয়া দিয়া, আবার তাহার থামে চড়িতে ব্যস্ত হইল।