উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/সুন্দরবনের জানোয়ার

উইকিসংকলন থেকে

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

সুন্দরবনের জানোয়ার

 কয়েকটি সাহেব জাহাজে করিয়া সুন্দরবন দেখিতে গিয়াছে। জাহাজ-খানি রায়মঙ্গল নদীতে নঙ্গর করিয়াছে, সাহেবরা একটি ছোট্ট স্টীম বোটে করিয়া একটা খালে ঢুকিয়াছেন। প্রায় সমস্ত দিন নালায় নালায় ঘুরিয়া বিকাল বেলায় একটি ছোট নদীতে আসিয়া তাঁহাদের বোট থামিল।

 নদীর অপর পারে কয়েকটি শুয়োরছানা তাহাদের মায়ের সঙ্গে সঙ্গে মাটি খুঁড়িয়া বেড়াইতেছে। জলে অনেকগুলি কুমির নাক জাগাইয়া রহিয়াছে।

 হঠাৎ একটা বাঘ ঝোপের ভিতর হইতে লাফ দিয়া আসিয়া একটি শুয়োরছানাকে ধরিয়া লইয়া গেল, তাহাতে আর শুয়োরগুলি চ্যাঁচাইয়া আকাশ ফাটাইয়া দিতে লাগিল। তাহার পরের মুহূর্তেই তাহাদের বাপ বিশাল এক বরা বন হইতে আসিয়া বাঘের সামনে দাঁড়াইয়াছে। বাঘও তখন শুয়োরছানাটিকে রাখিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। খানিক দুজনেই দুজনের দিকে তাকাইয়া আছে, কেহ কিছু বলে না। তারপর বাঘ ঘন ঘন লেজ নাড়িতে নাড়িতে গর্জন করিয়া উঠিল, বরাও রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিয়া তাহার উত্তর দিল।

 বাঘের চেষ্টা সে তাহার পিছনে গিয়া তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িবে, কিন্তু বরা তা করিতে দিবে কেন? বাঘ যতই বরার পিছনের দিকে ঘুরিয়া যাইতে চাহে, বরা ততই তাহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়ায়। এমনি করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে যেই দুজনে কাছাকাছি হইয়াছে, অমনি বরা গুলির মতো ছুটিয়া বাঘকে মারিতে গেল। বাঘও তৎক্ষণাৎ পাশ কাটিয়া বরাকে ভয়ংকর এক চাপড় মারিল। সে চাপড় বরার পিঠে পড়িলে তাঁহার পিঠই ভাঙ্গিয়া যাইত, কিন্তু বরা তাহা কাঁধ পাতিয়া লওয়াতে তাহার কিছুই হইল না, কেন না তাহার সে জায়গা লোহার মতো মজবুত। এই গোলমালে বাঘ একটু অসতর্ক হইয়া পড়িয়াছিল, সেই হইল বরার সুযোগ। সে আর বাঘকে সামলাইতে না দিয়া, তৎক্ষণাৎ তাহার পেটে দাঁত বসাইয়া দিল। সেই যে দাঁত বসাইল, আর বাঘ কিছুতেই সে দাঁতকে ছাড়াইতে পারিল না। সে প্রাণপণে বরাকে আঁচড় কামড় দিতে লাগিল বটে, কিন্তু বরা তবুও তাহার সমস্ত শরীর চিরিয়া ফালিফালি করিয়া দিল। বাঘ মরিয়া গিয়াছে, তথাপি বরা তাহাকে ছাড়ে না। শেষে বরা চলিয়া গেল তখন দলে দলে কুমির আসিয়া সেই বাঘটাকে লইয়া টানাটানি করিতে লাগিল।

 বেলা শেষ হইয়া আসিল, সাহেবরাও তাড়াতাড়ি বোট ছাড়িয়া দিলেন। তাঁহার খানিক দূরে আসিয়াছেন এমন সময়ে অনেকগুলি শুয়োরছানা ছুটিয়া আসিয়া প্রাণপণে সাঁতারাইয়া নদী পার হইতে আরম্ভ করিল। অমনি দেখাগেল যে চারিদিক হইতে কুমিরেরা তাহাদিগকে খাইবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছে। তাহার পরের মুহুর্তেই একটি শুয়োরছানা চ্যাঁচাইয়া উঠিল, আর তাহাকে দেখা গেল না। আর একটা পিছনে ঠ্যাং ধরিয়া সাহেবের আরদালী তাহাকে বোটে তুলিয়া ফেলিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা কুমিরও জলের ভিতর হইতে মাথা ভাসাইয়া হাঁ করিয়া সেটাকে ধরিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু নাগাল পাইল না, লাভের মধ্যে সাহেবদের বন্দুকের গুলীতে তাহার নাক উড়িয়া গেল। শুয়োরটা ততক্ষণে বোটের তলায় শুইয়া বিষম চ্যাঁচামেচি জুড়িয়াছে। সেই শব্দে চারিদিক হইতে কুমির আসিয়া বোটে উঠে আর কি! শুয়োর যতই চ্যাঁচায় কুমিরগুলিও ততই ক্ষেপিয়া যায়। শেষে একটা একেবারে বোটের ধারে মাথা তুলিয়া দিয়া হাঁ করিয়া একজন খালাসীকে খাইতে আসিল। সাহেবরা সকলে মিলিয়া আর সব কুমিরের উপর গুলি চালাইতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতেও তাহার ভয় পাইবার নয়। যাহারা গুলি খাইয়াছে, তাহারা ছট্‌ফট্‌ করিতেছে, আর গুলি বোটের চারধারে অসিয়া দাঁত কট্‌মটাইতেছে। একটাতো আসিয়া এক কামড়ে একজনের বন্দুকই কাড়িয়া নিল, আর একটু হইলে সেই লোকটিকে অবধি লইয়া যাইত। বাস্তবিক সেদিন সাহেবদের একটু বেগতিকই হইয়াছিল, হঠাৎ বুদ্ধি না জোগাইলে কি হইত কে জানে? কোনোমতেই কুমিরগুলিকে তাড়াইতে না পারিয়া শেষে তাহারা অনেকটা কেরসিন তেল বোটের চারিদিকের জলে ঢালিয়া দিলেন। কুমির মহাশয়দের চোখ দুটি থাকে ঠিক জলের সমানে সমানে। কাজেই দেখিতে দেখিতে সেই কেরসিন তেল তাঁহাদের চোখে গিয়া ঢুকিল। এমন ওষুধ আর কখনো তাঁহারা চোখে মাখেন নাই, এমন চিড়বিড়ির মজাও বোধ হয় আর জীবনে কখনো পান নাই।

 শুয়োর খাওয়ার শখ তো তাঁহাদের মিটিলই, তখন তাড়াতাড়ি সেখান হইতে পলায়ন করিতে পারিলেই তাঁহারা বাঁচেন। ইহার পর আর সাহেবদের কোন বেগ পাইতে হয় নাই, তাঁহারা ভালোয় ভালোয় জাহাজে আসিয়া পৌঁছিলেন।

উপেন্দ্র—১০৮