বিষয়বস্তুতে চলুন

উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/বাঘ আর শিয়ালের কথা

উইকিসংকলন থেকে

বাঘ আর শিয়ালের কথা

 পূর্বকালে পৌরাণিক নামে একরাজা তাঁহার প্রজাদিগের উপর অতিশয় অত্যাচার করাতে, মৃত্যুর পর তাঁহাকে শিয়াল হইয়া জন্মিতে হয়।

 সেই শিয়ালের পূর্ব জন্মের কথা সবই মনে ছিল। তাই সে দিন রাত কেবল এই বলিয়া দুঃখ করিত “হায়! আমি রাজা ছিলাম, আর নিজের কর্মদোষে শিয়াল হইলাম।”

 এই ভাবিয়া সে মাংস খাওয়া ছাড়িয়া দিয়া, কেবল ফল মূল খাইয়া দিন কাটাইতে লাগিল, আর, সর্বদা সত্য কথা বলাতে আর সকল জীবকে দয়া করাতে, অল্পদিনের ভিতরেই সে খুব ধার্মিক হইয়া উঠিল।

 সেই শিয়াল একটি শ্মশানে থাকিত। সেখানকার অন্য শিয়ালেরা তাহাকে আশ্চর্য হইয়া বলিল, “ভাই! তুমি শিয়াল হইয়া নিরামিষ খাও, ইহা বড়ই অন্যায় কথা। এত মাংস এখানে থাকিতে, তুমি এমন কষ্ট করিতেছ, তুমি কি বোকা?”

 এ কথায় সেই ধার্মিক শিয়াল বলিল, “ভাই! শিয়াল হইয়াছি বলিয়াই কি অধর্ম করিব? ফল খাইয়া যদি বাঁচিয়া থাকা যায়, তবে কেন মাংস খাইয়া পাপের ভাগী হই?”

 এই সময়ে এক বাঘ সেইখান দিয়া যাইতেছিল। শিয়ালের কথা শুনিয়া সে ভাবিল, ‘আহা, এই শিয়ালটি কি ধামিক! আমি ইহাকে আমার মন্ত্রী করিব।’

 এই ভাবিয়া সে শিয়ালকে বলিল, “আমি বুঝতে পারিতেছি তুমি অতি সৎলোক। তুমি আমার মন্ত্রী হও।”

 এ কথায় শিয়াল বলিল, “মহারাজ, আপনি যদি আমার কয়েকটি কথায় রাজি হন, তবে আমি আপনার মন্ত্রী হইতে প্রস্তুত আছি। আপনি কথায় অমত করিতে পারিবেন না। আপনি যখন আমার সহিত পরামর্শ করিবেন, তখন আর কেহ সেখানে উপস্থিত থাকিতে পারিবে না। আর, আপনার রাগ হইলেও আমাকে শাস্তি দিতে পারিবেন না।”

 বাঘ বলিল, “আচ্ছা, তাহাই হইবে। তুমি আমার সঙ্গে আইস।”

 এইরূপে সেই শিয়াল ত বাঘের মন্ত্রী হইল। তাহাকে মন্ত্রী করিবার কিছুদিন পরেই বাঘ বুঝিতে পারিল যে, এমন ভাল মন্ত্রী আর সে কখনো পায় নাই। সুতরাং সে তাহাকে খুবই আদর দেখাইতে লাগিল। শিয়ালও নিজের সুখ দুঃখের দিকে না চাহিয়া, প্রাণপণে তাহার কাজ করতে লাগিল।

 কিন্তু বাঘের যে পুরানো কর্মচারীরা ছিল, তাহারা এই নূতন মন্ত্রী আসাতে একটুও সন্তুষ্ট হইল না। তাহারা বড়ই দুষ্টলোক ছিল, দিনরাত কেবল বাঘকে ফাঁকি দিত। তাহারা দেখিল যে, নূতন মন্ত্রী আসাতে তাহাদের লাভের পথও একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তাই তাহারা সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিল যে, যেমন করিয়াই হউক, এই দুষ্ট মন্ত্রীটাকে তাড়াইতে হইবে।

 বাঘের খাওয়ার জন্য প্রতিদিন ভালো ভালো মাংস আসে, অন্য কাহারো সে মাংস খাইবার হুকুম নাই। বাঘের দুষ্ট চাকরেরা একদিন চুপি চুপি সেই মাংস চুরি করিয়া, শিয়ালের গর্তের নিকট লুকাইয়া রাখিল, শিয়াল ইহার কিছুই জানিতে পারিল না। বাঘ তখন ঘুমাইয়া আছে, ঘুম হইতে উঠিয়াই খাইবে। কিন্তু সেদিন সে ঘুম হইতে উঠিয়া দেখিল, তাহার খাইবার কিছুই নাই।

 তখন বাঘের কেমন রাগ হল, তাহা বুঝিতেই পার। সে রাগে গর্জন করিতে করিতে সকলকে বলিল, ‘কোন্ দুষ্ট আমার মাংস খাইল? শীঘ্র তাহাকে ধরিয়া আন।

 তখন সেই দুষ্ট চাকরেরা তাহাকে বলিল, মহারাজ, আপনার সেই মন্ত্রী মহাশয়ই এই কাজ করিয়াছেন। মহারাজ ভাবলেন, বুঝি তিনি বড়ই ধার্মিক, কিন্তু এই দেখুন, তাঁহার কেমন কাজ।

 এই বলিয়া শিয়ালের গর্তের কাছে লুকান সেই মাংস আনিয়া তাহারা বাঘকে দেখাইল। তখন বাঘ রাগে দুই চোখ ঘুরাইয়া বলিল, বাপুসকল! তোমরা শীঘ্র সেই দুষ্টকে বধ কর।

 দুষ্ট চাকরেরা তখনই গিয়া শিয়ালকে মারিয়া ফেলিত, কিন্তু বাঘের মা তাহা হইতে দিল না। সে বড়ই বুদ্ধিমতী বাঘিনী ছিল। তাই চাকরদের ছল বুঝিতে পারিয়া সে বাঘকে বলিল, বাঘ! ইহারা কেমন লোক, তাহা ত জানই! ইহাদের কথায় কি বিশ্বাস করিতে আছে? শিয়ালকে তুমি কত ভাল জিনিস দিতে চাও, সে তাহা নেয় না। সে কেন মাংস চুরি করিতে যাইবে? তুমি ভাল করিয়া ইহার বিচার কর।

 মায়ের কথায় বাঘ শান্ত হইল। তারপর একটু খবর লইয়াই সে বেশ বুঝিতে পারিল যে, শিয়ালের কোন দোষ নাই, সমস্তই সেই দুষ্ট চাকরদের চক্রান্ত।

 তখন আর শিয়ালের আদরের সীমা রহিল না। কিন্তু বুদ্ধিমান শিয়াল বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল যে, এমন মুনিবের চাকরি করা ধার্মিক লোকের কাজ নহে। সুতরাং সে বাঘকে বিনয় করিয়া বলিল, “মহারাজ! এমন অপমানের পর আর আপনার নিকট কি করিয়া থাকিব? আপনার মঙ্গল হউক। আমি চলিলাম।

 এই বলিয়া সে সেখান হইতে প্রস্থান করিল।