ঋষি রবীন্দ্রনাথ/২০

উইকিসংকলন থেকে

(২০)

 যেখান হইতে যাত্রা আরম্ভ হইয়াছিল, উপসংহারে আসিয়া সেখানেই যাত্রা শেষ করা যাইতেছে।—

 একটা প্রশ্ন তুলিয়াছিলাম যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, ইহা প্রমাণ করা চলে কিনা। ইহা প্রমাণ করা স্বভাবতই অসম্ভব, এই মূল সত্য স্বীকার করিয়া লইয়াই এই বিষয়ে একটা প্রচেষ্টা করা গিয়াছে।

 ব্রহ্মের অস্তিত্বই কেহ প্রমাণ করিতে পারে না। সাংখ্যশাস্ত্র তো পরিষ্কারই রায় দিয়াছেন যে, প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ। বস্তুতঃ কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণের উপর নির্ভর করে না, আমার জানা বা না-জানার উপর একটি ধূলিকণাও নির্ভর করে না, কারণ অস্তিত্ব মাত্রেই স্বতঃসিদ্ধ।

 ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না, ইহা একটা সমস্যা হইতে পারে। কিন্তু বুদ্ধির নিকট এই সমস্যাটি আছে বলিয়াই যে ‘ঈশ্বর-নাস্তি’ হইবেন, ইহা কুযুক্তি। ঈশ্বর আছেন, ইহা প্রমাণ করা যায় না; তবু, ঈশ্বর আছেন,—ইহা যাঁহারা সাক্ষাৎভাবে জানেন, তাঁহাদেরই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বলা হয়। এমন যে সাংখ্যশাস্ত্র, প্রমাণের অভাবে যেখানে ঈশ্বরকে অসিদ্ধ বলিয়া বাতিল করা হইয়ছে, সেখানেও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকৃত হইয়াছে।

 এই আত্মা সম্পর্কে প্রমাণের প্রয়োজন বা প্রশ্ন উঠে না, কারণ কেহই বলেন না যে, তিনি নিজে নাই। নিজের অস্তিত্ব অর্থাৎ আত্মা নাই, ইহা প্রমাণ করিতে হইলেও প্রারম্ভেই নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া লইতে হয়। দেখা যায় যে, আত্মার অস্তিত্ব এমনই একটি ব্যাপার, যাহা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না, বরং কোন কিছু প্রমাণের পূর্বে যাহার অস্তিত্ব স্বীকৃতিরই প্রথম অপেক্ষা করে। এক কথায় —আত্মা স্বতঃসিদ্ধ।

 আমি আছি, ইহা স্বতঃসিদ্ধ এবং এই আমিই আত্মা। এখন প্রশ্ন থাকে, এই ‘আমি’ বা আত্মা আসলে কি? এই আমি-র আসল রূপ অর্থাৎ স্বরূপ জানিতে গিয়াই যেখানে ঋষিগণ উপনীত হইয়াছেন— তিনিই ব্রহ্ম। এই স্তবঃসিদ্ধ আত্মারও তিনিই আশ্রয়।

 আত্মাই যদি স্বতঃসিদ্ধ হন, তাঁহার অস্তিত্বই যদি প্রমাণের কোন অপেক্ষা না রাখে, তবে সেই আত্মারই যিনি আশ্রয়, তাঁহার সম্পর্কে প্রমাণের প্রশ্ন উঠিতে পারে না এবং সে প্রমাণ-প্রচেষ্টারও কোন অর্থ হয় না। কাজেই, ব্রহ্ম আছেন, ইহা প্রমাণ করিতে না পারিলেও তিনি যে আছেন, ইহা মানিতে আমরা বাধ্য।

 তাঁহাকে প্রমাণ করিতে না পারিলেও তাঁহাকে জানিতে আমরা পারি। তাঁহাকে যাঁহারা জানিয়াছেন, তাঁহারাই ঋষি। রবীন্দ্রনাথও সেই ঋষি, ইহা প্রথমে মানিয়া লইয়াই পরে প্রমাণের প্রচেষ্টায় আমরা ব্রতী হইয়াছিলাম।

 প্রচেষ্টার প্রথম পাদেই দেখা গিয়াছে যে, ব্রহ্ম যে আছেন, ইহাই প্রমাণ করা যায় না। আর সেই ব্রহ্মকে কেহ জানিয়াছেন কি না, ইহা আমরা প্রমাণ করিব কি উপায়ে?

 এই বিপদ বা সমস্যা উত্তীর্ণ হইবার জন্যই বিশেষ একটি পথ আমাদিগকে নির্বাচন করিতে হইয়াছে—সাধকের ব্যক্তিগত উপলব্ধির বিশ্লেষণ। এই উপলব্ধিকে একমাত্র উপনিষদের কষ্টিপাথরে ঘষিয়াই আমরা ইহার বিচার ও মূল্য নির্ধারণ করিয়াছি। সাধকের ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং শাস্ত্রবাক্য—এই পথই আমরা অনুসরণ করিয়াছি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে।

 রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উপলব্ধির উপর নির্ভর করিয়াই আমাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর দিবার চেষ্টা আমরা করিয়াছি। তাঁহার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ব্যতীত অপর কোন কিছুকে সাক্ষ্য হিসাবে বিচার ক্ষেত্রে আমরা উপস্থিত করি নাই, একমাত্র গীতাঞ্জলি ছাড়া।

 গীতাঞ্জলিকে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাধনার বিবরণ বলিয়া গ্রহণ করিতে আমরা বাধ্য হইয়াছি। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীকেও সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থিত করিবার অধিকার এবং সংযোগ দুই-ই আমাদের ছিল, তাহারও যুক্তি আমরা দেখাইয়াছি, যদিও কার্যকালে রবীন্দ্র-রচনাবলী বিচারক্ষেত্রে আনীত হয় নাই।

 রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি, ইহা প্রমাণ করিতে পারা গিয়াছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দিবার দায়িত্ব আমাাদের নহে। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, ইহাই আমরা ঘোষণা করিয়াছি এবং ঘোষণার সমর্থনে প্রমাণ ও যুক্তিও কিছু উপস্থাপিত করিয়াছি। আমাদের কর্তব্য এবং প্রচেষ্টা এই পর্যন্তই।

 ইহার পরেও যে প্রশ্ন, আলোচনা ইত্যাদি দেখা দিবে, আমাদের দিক দিয়া তাহা অবান্তর। অবশ্য, আমাদের প্রদত্ত প্রমাণ, যুক্তি ইত্যাদির স্বপক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ, যুক্তি ইত্যাদির অবকাশ নিশ্চয়ই রহিয়াছে, ইহা আমরা স্বীকার পাই। তবু তাহা আমাদের দিক দিয়া বাহুল্য, কারণ আমাদের প্রচেষ্টা ও কর্তব্যের যেখানে স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি, সেখানেই আসিয়া আমরা উপনীত হইয়াছি। অতঃপর শক্তিমান ও অধিকারী পুরুষগণ ইহার পরেও অগ্রসর হইবেন, ইহাই আমরা কামনা করি।

 রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ এই কথাটিই শুধু আমরা উপস্থিত করিয়াছি। মনীষী পুরুষগণ কথাটিকে তাঁহাদের বিচার ও আলোচনার বিষয়বস্তুররূপে গ্রহণ করিবেন, ইহাই ছিল আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই কথাটি যথাশক্তি এবং যথাসংক্ষেপে পেশ করিবার পর আমাদের কর্তব্য সমাপ্ত হইয়াছে বলিয়াই আমরা মনে করি।

 উপসংহারে বিশেষ একটি বিষয়ের আলোচনা করিতে আমরা বাধ্য হইতেছি। আলোচ্য বিষয়টি অবশ্য অপ্রাসঙ্গিক নহে, তবুও না তুলিলে কোন ক্ষতি ছিল না। তত্রাচ বিষয়টি যখন উত্থাপিত হইয়াছে, তখন তাহা প্রত্যাখ্যান করা সমীচীন হইবে না।

 আমাদের অলোচনা কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর অনেকেই প্রশ্ন করিয়া পাঠাইয়াছেন—রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগতজীবন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবন কি?

 বুঝিতে কষ্ট হয় না যে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, মুক্তপুরুষ, মহাপুরুষ, মহাযোগী ইত্যাদি বলিতে প্রশ্নকর্তাদের মনে যে ধারণা আছে, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন তাহার সঙ্গে খাপ খায় না, ইহাই তাঁহাদের অভিমত বা সিদ্ধান্ত।

 এই সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানিয়া লইলেও ‘রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ’ এই ঘোষণার কোন ইতরবিশেষ ঘটে না। ঘরের সব কয়টা বাতি সাদা আলো দেয় বলিয়াই যে লাল বাতিটাকে আলো বলা চলিবে না, প্রশ্নকর্তাদের মনোভাব যেন কতকটা এইরকম।

 ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রার কোন ধরা-বাঁধা ছক্ নাই। রাজর্ষি জনক, আর নগ্ন উন্মাদ-বৎ বিচরণশীল শুকদেবের জীবনযাত্রার মধ্যে তো কোন মিল নাই। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ এবং স্বয়ং ব্রহ্ম রামচন্দ্রের জীবনযাত্রায় কেহ সাদৃশ্য বা মিল খুঁজিয়া পাইবেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং মহর্ষি দুর্বাসা, এই উভয়ের জীবনধারার মধ্যে সাদৃশ্য বা সঙ্গতি অন্বেষণ করা বৃথা।

 উপনিষদের ঋষি বলিতে শান্ত সৌম্য এক জীবন-চিত্রই চোখে ভাসিয়া উঠে। তাহার বিপরীত জীবনযাপন কি ব্রহ্মজ্ঞের দেখা যায় না? একখানি উপনিষদের, যতদূর মনে পড়ে হয়তো জাবাল-উপনিষদের, এক ভাষ্যে এইরূপ উল্লেখই দেখিয়াছি,—“ভগবান দত্তাত্রেয় মদিরা এবং স্ত্রী সেবন করিতেন।” এইরূপ বহু দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যাইতে পারে এবং তাহাতে দেখা যাইবে যে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষদের জীবনযাত্রা বিভিন্ন এবং বিচিত্র, এমন কি বিপরীত।

 আধুনিক কালে আসিলেও এই একই ব্যাপার পরিদৃষ্ট হইবে। জ্ঞানাবতার শঙ্কর এবং প্রেমাবতার চৈতন্যদেব উভয়ের জীবনযাত্রা একই ধরণের, এমন কথা কেহ বলিবেন না। সিদ্ধযোগী এবং সিদ্ধতান্ত্রিক উভয়ের জীবনযাত্রা একেবারে বিপরীত। আবার, ব্রহ্মজ্ঞানী, ব্রহ্মভক্ত এবং ব্রহ্মজ্ঞ কর্মযোগী এই তিনের জীবনধারা পরস্পর হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্ররূপ।

 কাজেই, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা, কিংবা কাহারও নিজস্ব ধারণার সঙ্গে যদি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার কোন সাদৃশ নাই থাকে, তাহাতে ক্ষতি কি? আর তাহাতে আশ্চর্য হইবারই কি এমন আছে?

 শাস্ত্রে ব্রহ্মজ্ঞপুরুষের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে গুটিছয়েক প্রকৃতি বা রকমের উল্লেখ আছে, যথা—শান্ত, জড়, উন্মাদ, পিশাচ ইত্যাদি। অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞদের মধ্যে কেহ বা শান্ত, কেহবা একেবারে জড়বৎ, কেহ বা উম্মাদের ন্যায়, কেহ বা পিশাচবৎ জীবন যাপন করিয়া থাকেন। কাজেই বলা যাইতেছে যে, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা যে ধরণের বা প্রকৃতিরই হউক না কেন, তাহাতে তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের কোন ইতরবিশেষ ঘটে না।

 এতক্ষণ এই কথাটাই আমরা বলিতে চাহিয়াছি যে, আচরণ দেখিয়া ব্রহ্মজ্ঞ-পুরুষকে চেনা বা জানা কদাচ নৈব নৈবচ। সৎপুরুষ, সাধুপুরুষ, শক্তিমান-সাধক প্রভৃতিকে তাঁহাদের আচরণ হইতে ধরা যাইতে পারে, কিন্তু কোন ব্রহ্মজ্ঞই তাঁহার আচরণে ও ব্যবহারে কদাচ ধরা পড়েন না। কেন? উত্তরটা স্পষ্টতঃ না দিলেও একভাবে আভাসে এতক্ষণ দেওয়া হইয়াছে। এখন স্পষ্টভাবে উত্তরটা দেওয়া যাইতেছে।

 আচরণ, ব্যবহার ইত্যাদির সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞপুরুষের যথার্থ কোন যোগ নাই। ব্যক্তিই তাহার আচরণে ব্যক্ত হইয়া থাকে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ব্যক্তি নহেন। কারণ, ব্যক্তিত্বের নিঃশেষিত বিলোপ না ঘটিলে ব্রহ্মজ্ঞ হওয়া চলে না।

 ব্রহ্মজ্ঞের যে-ব্যক্তিত্ব তাহা নৈর্ব্যক্তিক ব্যক্তিত্ব। ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে বাহির হইতে চিনিবার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় না, অন্ততঃ তাঁহার আচরণে পাওয়া যায় না। খুব সজাগ ও সতর্ক থাকিলে একটি মাত্র লক্ষণ ধরা দিয়া থাকে, তাহা হইল এই—ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের ‘অহং’ পরিদৃষ্ট হয় না, না আচরণে না কথাবার্তায়।

 আর একটি কথা আছে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়, পাপপুণ্য ইত্যাদির দ্বারা অস্পৃষ্ট। তাঁহাদের নিকট ন্যায় ও অন্যায়, ভালোমন্দ, ইত্যাদি সমস্তই সমান অথবা এক। কিন্তু আচরণে তাঁহারা কখনো ক্ষেত্র-ধর্ম লঙ্ঘন করেন না দেখা যায়।

 আচার্য শঙ্কর তাঁহার শারীরকভাষ্যে একস্থানে এইরূপ অভিমতই প্রকাশ করিয়াছেন যে, ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্বান (ব্রহ্মবিদ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) এবং অবিদ্বানে কোন পার্থক্য নাই। অর্থাৎ, সর্ব বন্ধনমুক্ত হইয়াও ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তির আচরণ, ব্যবহার আর দশজন লোকেরই মত, ইহাই হইল আচার্য শংকরের সিদ্ধান্ত।

 আচরণ দেখিয়া ব্রহ্মজ্ঞ বাছাই বা সনাক্ত করা হাস্যকর বালসুলভ চিন্তা বা চেষ্টা মাত্র। আচরণ দেখিয়া যদি ব্রহ্মকে ধরা যাইত, তবে ঢেউ ধরিয়া সমুদ্রকে পারে টানিয়া আনা যাইত। অগণিত গ্রহ-উপগ্রহের প্রচন্ড ঘূর্ণি বা আবর্তনে যেমন আকাশের বুকে কোন দাগ কাটে না বা রাখে না, সংসার বা তাহার ব্যবহারও তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ-চরিত্রে কোন দাগ কাটে না। অগণিত গ্রহ-উপগ্রহকে বুকে স্থান দিয়াও যেমন আকাশ স্থির, স্বতন্ত্র ও পৃথক, বহু ও বিচিত্র আচরণকে আশ্রয় দিয়াও ব্রহ্মজ্ঞের জীবন মুক্ত, অস্পষ্ট ও পৃথক। কারণ, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেহে থাকিয়াও বিদেহী। দেহের আচরণ দ্বারা বিদেহীকে কখনও কেহ ধরিতে পারে না, যদি না তাঁহারা কৃপা করিয়া ধরা দেন।

 রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সম্ভাব্য সর্বরকম অভিযোগ মানিয়া লইয়াই আমরা এতক্ষণ আলোচনা করিয়াছি এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, রবীন্দ্রনাথের আচরণ যদি ধর্ম ও নীতি-বিরদ্ধে বলিয়া কেহ দেখাইতেও পারেন, তথাপি ‘রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ’ এই সত্যের কোন ইতরবিশেষ ঘটিবে না।

 রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলে না, এই অর্থহীন প্রশ্নটিকে স্বীকার করিয়াই এতক্ষণ আলোচনা করা গিয়াছে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের মধ্যেও শ্রেণীভেদ আছে এবং ‘ব্রহ্মবিদ্ বরিষ্ঠ’ বলিয়া উল্লেখ ও প্রয়োগ উপনিষদেই রহিয়াছে।

 কাজেই, প্রশ্নটিকে ঠিকমত আকার দিলে আলোচনার একটা অবকাশ থাকে। আচরণ দেখিয়া ব্রহ্মজ্ঞ চিনিবার চেষ্টা ছাড়িয়া দিয়া প্রশ্ন হওয়া উচিত—ব্রহ্মজ্ঞদের জীবনযাত্রা বা আচরণে এমন পার্থক্য কেন?

 রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন যতটা প্রযোজ্য হইতে পারে, আলোচনার ক্ষেত্রের পরিধি সেই অবধি সীমাবদ্ধ রাখিয়া একটু অগ্রসর হওয়া যাইতেছে।

 ধরিয়া লওয়া যাইতেছে যে, রবীন্দ্রনাথকেও সাধারণ মানুষের ন্যায় আসক্ত হইতে, আচ্ছন্ন হইতে এবং বিচলিত হইতে দেখা গিয়াছে। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের আচরণে জ্ঞান, বৈরাগ্য ও শান্তির বিলক্ষণ অভাব প্রায়শ বা কখনো কখনো দেখা গিয়াছে, ইহা সত্য বলিয়াই আমরা ধরিয়া লইতেছি।

 ইহা মানিয়া লইলে তারপরও কি বলা চলে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি? আমাদের উত্তর, হ্যাঁ, ইহা মানিয়া লইলেও দ্বিধাহীন অকুণ্ঠভাবেই বলা চলে— রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি। কেন চলে, সেই আলোচনাই সংক্ষেপে শেষ করিয়া ‘ঋষি রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের উপর যবনিকাপাত করা যাইতেছে।


 ‘ব্রহ্মসূত্রে’ ব্রহ্মবিদ্যার ফল সম্বন্ধে ভগবান বেদব্যাস প্রথমে একটি সূত্রে বলিয়াছেন, “ঐহিকমপ্রস্তুতে প্রতিবন্ধে, তদ্দর্শর্নাৎ”—প্রতিবন্ধ না থাকিলে এই জন্মেই বিদ্যা (ব্রহ্মজ্ঞান) লাভ করা যায়, প্রতিবন্ধ থাকিলে পরজন্মে প্রতিবন্ধ দূর হইলে লাভ হয়।

 ইহার পরের সূত্রটিতে ব্রহ্মবিদ্যাপ্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, “মুক্তি ফলানিয়ম-স্তদবস্থাবধৃতে স্তদবস্থাবধৃতেঃ”—তদ্রূপ মুক্তিরূপ ফল যে এই জন্মান্তেই লাভ হইবে, তাহারও নিয়ম নাই।

 উপনিষদে বলা হইয়াছে যে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেহান্তে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করেন এবং তাঁহার আর পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ পুনর্জন্ম ঘটে না। কিন্তু এই সূত্রটিতে বলা হইয়াছে যে, ব্রহ্মজ্ঞের প্রাপ্য মুক্তিফল সম্পর্কেও এমন কোন নিয়ম নাই যে, দেহান্তেই তাহা তিনি প্রাপ্ত হইবেন।

 ব্রহ্মজ্ঞ হইয়াও কেন দেহান্তে মুক্তিলাভ হইবে না, এ আলোচনা বিচার্য ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। দেখা গেল যে, ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিও মুক্তিফল হইতে বঞ্চিত থাকেন, অবশ্য বিশেষ কারণে। বিশেষ কারণটি হইল কর্মবন্ধন।

 ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরও যদি কর্মবন্ধন থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বদ্ধপুরুষের আচরণ যদি কেহ পরিদর্শন করিয়া থাকেনই, তবে কি তাহা আদৌ আশ্চর্যের বিষয় কিছু? ভগবান বেদব্যাসের ব্রহ্মসূত্র তথা উপনিষদ হইতেই জানা যায় যে, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরও কর্মক্ষয় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হয় বিদেহ মুক্তির পূর্বে। সেই কর্ম ভালোও হইতে পারে, মন্দও হইতে পারে, কিম্বা শুভাশুভ মিশ্রিতও হইতে পারে।

 এই কারণেই আমরা দ্বিধাহীন কণ্ঠে এবং অকুণ্ঠ চিত্তে ঘোষণা করিয়াছি—আচরণ দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞকে জানা যায় না, আচরণে ব্রহ্মজ্ঞানের কোন হানি ঘটে না। তাই তাঁহার আচরণের তথাকথিত ভালোমন্দ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি।

 ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের অবস্থা সম্বন্ধে বেদান্তের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ ‘পঞ্চদশী’তে যে বিশদ আলোচনা করা হইয়াছে, কৌতূহলী পাঠক এবং জিজ্ঞাসুগণ তাহা পাঠ করিয়া দেখিতে পারেন। প্রসিদ্ধ বেদভাষ্যকার সায়নাচার্যের ভ্রাতা মাধবাচার্য বা বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর ‘পঞ্চদশী’র রচয়িতা। বিদ্যারণ্যমুনিকে শঙ্করাচার্যের অবতার বা দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য বলিয়া অদ্বৈতী-বেদান্তিগণ পূজা করিয়া থাকেন। ‘পঞ্চদশী’কারও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের জীবনযাত্রা, আচরণ ইত্যাদি সম্বন্ধেই বহু প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া তাহার উত্তর দিয়াছেন।

 তাঁহার সিদ্ধান্তের সামান্য কিছু, উদ্ধৃত করা যাইতেছে, তাহাতে আমাদের অভিমতের পূর্ণ সমর্থনই পাঠক দেখিতে পাইবেন।

 (১) “যেমন দাইটি ভাষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি যথাক্রমে দুইটি ভাষাই ব্যবহার করেন, সেইরূপে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি বিষয়ানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ উভয়ই উপলব্ধি করিয়া থাকেন।”

 (২) “যেমন গঙ্গায় অর্ধমগ্ন পুরুষের যুগপৎ শীতোষ্ণ জ্ঞান হয়, সেইরূপ বিবেকীর স্বরূপানন্দ ও সাংসারিক সুখদুঃখ যুগপৎ অনুভূত হয়।”

 (৩) “যতদিন দেহ থাকে, ততদিন তত্ত্বজ্ঞের অবিদ্যা-বাসনাও থাকে, এই জন্য কখনো কখনো তত্ত্বজ্ঞও স্বপ্নে সাধারণ লোকের ন্যায় সুখ দুঃখ অনভব করেন।”

 (৪) “ভোগ ব্যতিরেকে প্রারব্ধ ক্ষয় হইবার নহে। বামদেবের ইহা ক্ষয় হইতে এক জন্ম লাগিয়াছিল। বস্তুতঃ শেষ প্রারব্ধ ক্ষয় হইতে কত জন্ম লাগিবে তাহার নিয়ম নই।” ব্রহ্মসূত্রে ভগবান বেদব্যাসের সিদ্ধান্তেরই ইহা প্রতিধ্বনি যে, ব্রহ্মজ্ঞানের ফলপ্রাপ্তি যে এই দেহান্তেই ঘটিবে, তাহার কোন নিয়ম নাই।

 (৫) “প্রারব্ধের বশে তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরও কদাচিৎ অনাচারে প্রবৃত্তি হইতে পারে; কারণ প্রারব্ধ কর্মকে কাহারও এড়াইবার ক্ষমতা নাই।”

 (৬) “যাঁহার পূর্ণমাত্রায় তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়, কিন্তু বৈরাগ্য ও উপরতি প্রতিবন্ধ হয়, তাঁহার মুক্তিলাভ হয় সন্দেহ নাই; তবে দুস্প্রারব্ধবশে জীবদ্দশায় দুঃখ ভোগ হইতে নিষ্কৃতি হয় না, অর্থাৎ জীবন্মুক্তি সুখ ঘটে না।”

 বেদান্তের দ্বিতীয় শঙ্করের সিদ্ধান্তসমূহ যে আমাদের পূর্বোক্ত অভিমতসমূহের পূর্ণ সমর্থন করিতেছে, ইহা আর খুলিয়া বলার দরকার করে না। কাজেই আচরণ হইতে ব্রহ্মজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে ধরা যাইবে না এবং কোন আচরণেই তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের ইতর বিশেষ সাধিত হয় না, ইহাই সিদ্ধান্ত।

 জাগ্রত অবস্থায় ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের চরিত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হইয়া থাকে, শাস্ত্র বলেন। তাহা হইল—জ্ঞান, বৈরাগ্য ও উপরতি অর্থাৎ শান্তি। প্রারব্ধের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে বৈরাগ্য কিম্বা উপরতির তারতম্য পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞের কখনো আত্মবিস্মৃতি ঘটে না। অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান তাঁহার অব্যাহত ও স্থায়ী হইয়াই থাকে।

 কাজেই রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যদি কেহ যথার্থই বৈরাগ্য বা উপরতির কম বেশী অভাব দেখিয়া থাকেন বা দেখাইতে পারেন, তাহা হইলেও ব্রহ্মজ্ঞানের তাহাতে কোন হ্রাস বৃদ্ধি হয় না। তখনো রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, তখনো রবীন্দ্রনাথ ঋষি।

 পঞ্চাশ পার হইলে ‘বনং প্রজেৎ’ বিধান আছে। আর বন বলিতে ভারতের তপোবনকেই বুঝাইয়া থাকে। এযুগের ভারতের তপোবনের ঋষি বলিয়া যাঁহাকে জানিয়াছি এবং মানিয়াছি, পঞ্চাশ পার হইয়া বনে গমনের পরিবর্তে তাঁহারই পায়ে প্রণাম জানাইতেছি। ‘ঋষি রবীন্দ্রনাথ’ আমার সেই পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ, অর্থাৎ আমার ঋষি-প্রণাম।