এখন যাঁদের দেখছি/কল্লোল-গোষ্ঠীর ত্রয়ী
কল্লোল-গোষ্ঠীর ত্রয়ী
কল্লোল-গোষ্ঠীর ত্রয়ী বলতে বোঝায় এই তিনজনের নাম— শ্রীঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শ্রীবুদ্ধদেব বসু, ও শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্র। এঁরা তিনজনেই কবি, ঔপন্যাসিক ও গল্প-লেখক। তিনজনেই কিছু কিছু, অন্যান্য শ্রেণীর রচনাতেও হাত দিয়েছেন।
এঁরা তিনজন এবং কল্লোল-গোষ্ঠীভুক্ত আরো কয়েকজন শক্তিশালী লেখক আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তথাকথিত অশ্লীলতার অপরাধে নিষ্ঠুরভাবে আক্রান্ত ও ধিক্কৃত হন। সেই সময়ে—অর্থাৎ প্রায় দুই যুগ আগে—আমি এঁদের পক্ষসমর্থন ক’রে লিখেছিলুমঃ “তবে কি এই অশ্লীলতাই স্বাভাবিক? আমাদের তো বিশ্বাস তাই। এ বিশ্বাস ভুল হ’তেও পারে। এবং অশ্লীলতার যে একটা সীমারেখা আছে, তাও আমরা না মেনে পারব না। কিন্তু একেবারে একেলে সাহিত্য সেই সীমারেখাকে অতিক্রম করেছে কি না, এখন সেইটেই হচ্ছে বিবেচ্য। * * * “What is Art” লেখবার পরেও টলস্টয়ের মতন লোক যে-দুর্বলতা পরিহার করতে পারেন নি, তার কবল থেকে আত্মরক্ষা করা যে সহজ নয়, সে কথা বলা বাহুল্য। এ দুর্বলতা আছে এবং থাকবেও। স্বাভাবিকতার উচ্ছেদ অসম্ভব। কেবল এই চেষ্টাই করা ভালো, যেন সে কুৎসতি না হয়, যেন সে শিষ্টতার সীমানা না ছাড়ায়, যেন সে রূপের সেবা না ভুলে যায়। রূপকে আমরা ব্যাপক অর্থে ধরছি। * * * আমরা অস্কার ওয়াইল্ডের এই বিখ্যাত উক্তি উড়িয়ে দিতে পারি না— লেখার দোষে শ্লীলও অশ্লীল হয়ে দাঁড়ায় এবং লেখার গুণ তার উল্টোটাকেই প্রকাশ করে। যে কোন কুৎসিত বিষয় সুন্দর রূচিকর ক’রে দেখানো যেতে পারে” প্রভৃতি।
একটা বড় মজার ব্যাপার এই যে, যুগে যুগে অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ লেখকেরই বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অশ্লীলতার অপরাধ। অনেক সময়ে আবার দেখা গিয়েছে, অভিযোক্তাকেই হ’তে হয়েছে একই অপরাধে অভিযুক্ত। রবীন্দ্রনাথের রচনাকে অশ্লীল বলে প্রতিপন্ন করবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তারপর রবীন্দ্র-ভক্তরা দেখিয়ে দিলেন অশ্লীলতায় তিনিও বড় কম যান না। দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর অনেক পরে শিশিরকুমার যখন তাঁর “পাষাণী” নাটক মঞ্চস্থ করেন, তখন রুচিবাগীশরা এত জোরে চ্যাঁচাতে সুরু ক’রে দেন যে, রীতিমত অভিনীত হয়েও পালাটি ভালো ক’রে জমতে পারে নি।
স্বর্গীয় ঔপন্যাসিক যতীন্দ্রমোহন সিংহ অশ্লীলতার উপরে হাড়ে হাড়ে চটা ছিলেন। অশ্লীল লেখা দেখলেই কলম উঁচিয়ে তেড়ে আসতেন। অবশেষে বুড়ো বয়সে নিজেই ফেঁদে বসলেন এমন এক অশ্লীল গল্প যে, চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল ধিক্কারধ্বনিতে।
কল্লোল-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোক্তা ছিলেন “শনিবারের চিঠি”র দল। অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব ও জীবনানন্দ দাশ প্রভৃতির অশ্লীলতার প্রমাণ “শনিবারের চিঠি”তে বিতরিত হ’ত ভূরি পরিমাণে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও অতিশয় স্পষ্টভাবেই দেখা যেতে লাগল, “শনিবারের চিঠি”তে প্রকাশিত গল্পে ও কবিতাতেও অশ্লীলতার কিছুমাত্র অপ্রতুলতা নেই। সূতরাং সবাই যখন ভূত, মিছামিছি রামনাম নিয়ে টানাটানি কেন?
কি শ্লীল, কি অশ্লীল, কে বলতে পারে? এর আগে আমার একটি গল্পের দুর্দশার কথা বলেছি। “কল্লোল” সম্পাদক সেটিকে শ্লীল ব’লে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গল্পটিকে চালান করা হয় “ভারতবর্ষ” কার্যালয়ে। সেখান থেকে সেটি ফেরত আসে অশ্লীলতার অভিযোগ বহন ক’রে। ধাঁধায় পড়লুম, নিজেই বুঝতে পারলুম না আমি কি শ্শীল কি অল্লীল? কাশীধাম থেকে এল “উত্তরা”র জন্যে লেখার তাগিদ। গল্পটিকে প্রেরণ করলুম সেইখানেই। সে শ্লীল কি অশ্লীল তা নিয়ে “উত্তরা” মাথা ঘামালে না, তাকে ছাপিয়ে দিলে বিনাবাক্যব্যয়ে। “উত্তরা”য় প্রকাশিত আমার একটি কবিতার দুটি লাইনের জন্যে গালিগালাজে বাজার সরগরম হয়ে উঠেছিল—ঐ অশ্লীলতার অপরাধেই। কিন্তু আমার সেই একাধারে শ্লীল ও অশ্লীল (!) গল্পের জন্যে কোন চায়ের পেয়ালাতেই ওঠেনি উত্তাল তরঙ্গ।
একই গল্প যখন হ’তে পারে কারুর মতে শ্লীল এবং কারুর মতে অশ্লীল, তখন বিচারের মানদণ্ড কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে বাচনিক বিচারে সুরাহা হওয়া অসম্ভব। যে রচনা সুরচিত এবং যা মনকে নোংরা করে না, নিন্দা ক’রেও তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। মুক্ত চক্ষু ধূলোর মধ্যে কুড়িয়ে পায় রোদের সোনা। অন্ধ ধূলো হাতড়ালে ছুঁয়ে ফেলে সারমেয়—বিষ্ঠা। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশ্লীল মনই আবিষ্কার করে অশ্লীলতাকে। পরমহংসদেবের একটি বাণীর মর্মার্থ হচ্ছে শকুনি পক্ষবিস্তার ক’রে উড়ে বেড়ায় নির্মলনীল আকাশে, কিন্তু তার নজর প’ড়ে থাকে নীচে ভাগাড়ের দিকেই।
রসিক হন মরালের মত। জলভাগ ত্যাগ করতে পারেন অনায়াসেই।
অশ্লীলতাকে অন্বেষণ করবার জন্যে কোনদিনই আমি অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র ও বুদ্ধদেবের রচনাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করি নি, বঞ্চিত হই নি তাই উপভোগের আনন্দ থেকে। তাঁদের উপন্যাস পড়েছি, ছোটগল্প পড়েছি, কবিতা পড়েছি। মুগ্ধ করেছে আমাকে অনেক রচনাই। আবার কোন কোন রচনার বিষয়বস্তু হয়তো আমার মনের মত হয় নি। কিন্তু এই ভালো লাগা আর না লাগার মধ্যে একটা যে সত্য সর্বদাই উপরে ছাপিয়ে উঠেছে তা হচ্ছে এইঃ তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে উচ্চশ্রেণীর লিপি-কুশলতা। তাঁদের ভাষা ও শব্দবিন্যাস হচ্ছে বিষয়বস্তু-নিরপেক্ষ। তাঁদের কোন গল্পের আখ্যানবস্তু বা কোন কবিতা ভালো না লাগলেও তাঁদের ভাষা ও রচনাভঙ্গির দিকে পাঠকরা বিশেষভাবে আকৃষ্ট না হয়ে পারবেন না।
“ভারতী”, “কল্লোল” ও “শনিবারের চিঠি” প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এক এক দল শক্তিধর সাহিত্যিক পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। “ভারতী” গোষ্ঠীর ভিতর থেকে আমরা পেয়েছি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী, কিরণধন চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্র– নারায়ণ বাগচী, মোহিতলাল মজুমদার ও হেমেন্দ্রলাল রায়—যাঁরা আজ স্বর্গে। এবং সেই সঙ্গে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও নরেন্দ্র দেব প্রভৃতি জীবিত লেখকদের। শরৎচন্দ্রেরও প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল “ভারতী"তেই। তারপরে “ভারতী”তে তাঁর একাধিক রচনা প্রকাশিত হ’লেও তিনি নিয়মিত লেখক-শ্রেণীভুক্ত ছিলেন না বটে, কিন্তু ঐখানেই ছিল তাঁর নিজস্ব আসর। হামেসাই উঠতেন বসতেন, আলাপ-আলোচনা করতেন আমাদের সঙ্গে। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই আমাদের ঘরের লোক।
“কল্লোল” গোষ্ঠীর ভিতর থেকে দেখা দিয়েছেন দীনেশরঞ্জন দাশ, গোকুলচন্দ্র নাগ,— এঁরা এখন স্বর্গীয়। তারপর আছেন হেমচন্দ্র বাগচী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, প্রবোধকুমার সান্যাল, অজিতকুমার দত্ত, ভূপতি চৌধুরী ও জসীমউদ্দীন প্রভৃতি।
একটি বিশেষ আদর্শ সামনে রেখে, একই ভাবের অনুপ্রেরণায় এমনি দলবদ্ধ হয়ে সাহিত্য-সাধনার মধ্যে কেবল যে একটা সমষ্টিগত শক্তির উপলব্ধি থাকে তা নয়; উপরন্তু সেই সঙ্গে পাওয়া যায় পরম আনন্দ ও বিপুল উৎসাহ। ভিন্ন ভিন্ন পথ, লক্ষ্য কিন্তু এক।
কিন্তু আজকের দিনের তরুণ লেখকরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সাহিত্যসাধনা করতে চান না বা করতে পারেন না। “কল্লোল” লুপ্ত হবার পর কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে দেখি ভ্রাতৃভাবের পরিবর্তে ছাড়া ছাড়া ভাব। বোঝা যায় ना তাঁদের লক্ষ্য ও আদর্শ। সাহিত্যক্ষেত্রে গোষ্ঠীই সৃষ্টি করতে পারে নব নব পদ্ধতি বা “স্কুল”। ফরাসী সাহিত্যে এটা বার বার দেখা গিয়েছে, এবং বাংলা দেশেও “বঙ্গদর্শন”, “সবুজপত্র”, “ভারতী” ও “কল্লোল” প্রভৃতি পত্রিকা বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল ব’লেই যুগে যুগে বাংলা সাহিত্যে এসেছে নূতন নূতন ধারা ও ভঙ্গি।
অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ঠিক কোন্খানে, আমার মনে পড়ছে না। তবে হয় “কল্লোল”, নয় “মৌচাক” কার্যালয়ে। স্মরণ হচ্ছে, “কল্লোল” প্রকাশিত হবার আগেই “ভারতী”র পৃষ্ঠায় যেন তাঁর একটি রচনা পাঠ করেছি।
তারপর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে নানা জায়গায়। এবং আমি তাঁকে অন্যতম অন্তরঙ্গ ব’লেই গ্রহণ করেছি। একহারা দেহ, রংটি কালো হ’লেও মুখে-চোখে আছে বুদ্ধির প্রাখর্য। শান্ত স্বভাব, সংলাপ শিষ্ট ও মিষ্ট। কথার ঝড় বহিয়ে দেন না, বাক্যব্যয় করেন বেশ সংযত ভাবেই।
“কল্লোল যুগ” পাঠ করলে বোঝা যায়, “শনিবারের চিঠি”র ধারাবাহিক আক্রমণ তাঁর মনকে তিক্ত ক’রে তুলেছিল। সেই সময়ে “কল্লোল” এর দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছি ব’লেই হোক বা অন্য যে কোন কারণে আমিও “শনিবারের চিঠি”র দ্বারা বার বার আক্রান্ত হ’তে লাগলুম। কিন্তু আমি মার খেয়ে মার স’য়ে থাকবার মানুষ নই। একই খেলা দুই পক্ষই খেলতে পারে, এটা দেখিয়ে দেবার জন্যে “নাচঘরে” খুললুম একটি বিশেষ বিভাগ। তারপর কিছুকাল ধ’রে চলতে লাগল দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল বাক্যযুদ্ধ—গদ্যে এবং পদ্যে। আমার লেখা কোন কোন ব্যঙ্গ-কবিতা নজরুল ইসলাম এবং আরো কেউ কেউ মুখস্থ ক’রে ফেলেছিলেন। অচিন্ত্যকুমারও উৎসাহিত হয়ে একদিন “নাচঘর” কার্যালয়ে এসে ছদ্মনামে লেখা একটি ব্যঙ্গ-কবিতা দিয়ে গেলেন আমার হাতে। এই বিভাগে তিনি এবং অন্য কোন কোন লেখক করেছিলেন আরো কিছু কিছু সাহায্য। ফাঁপরে পড়তে হ’ল “শনিবারের চিঠি”কে। সে হচ্ছে মাসিক, আর “নাচঘর” ছিল সাপ্তাহিক, কাজেই মাসে একবার আক্রান্ত হ’লে প্রতিআক্রমণ করবার সুযোগ পায় মাসে চারবার। “শনিবারের চিঠি” মুখবন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই “নাচঘরে”র এই বিশেষ বিভাগটি তুলে দেওয়া হয়। তারপর “শনিবারের চিঠি”র সম্পাদকের সঙ্গে স্থাপিত হয়েছে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমি তাঁর “দাদা”।
অচিন্ত্যকুমার কেবল প্রভূত শব্দসম্পদের অধিকারী নন, শব্দ প্রয়োগও করেন নিপুণ শিল্পীর মত। “কল্লোলে”র দলের মধ্যে ভাষা নিয়ে তিনিই বোধ করি সবচেয়ে মাথা ঘামান বা খাটান। একেবারে চাঁচাছোলা, ওজন করা, তীক্ষ্নধার ভাষা, যেখানে যা মানায় খুঁজে পাওয়া যায় তাকেই। অতি-মার্জনার ও শব্দালঙ্কারের এই প্রাধান্য হয়তো সহজ সরলতার অনুকূল নয়, কিন্তু পাঠকদের চিত্তকে সমৃদ্ধ ক’রে তোলে রীতিমত।
তারপর তিনি হলেন সরকারী চাকরে। সচল পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আর আমি প’ড়ে রইলুম কলকাতার একটেরে, গঙ্গার ধারে। দু’জনের মুখ-দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে তিনি যে আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন, সে খবর পাইনি। আচম্বিতে তাঁর অতি-আধুনিক রচনা “পরম পুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ” পাঠ করে সবিস্ময়ে উপলব্ধি করতে পারলুম সেই সত্য। শিল্পীর তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি পরমহংসদেবের অনুপম জীবনচিত্র।
স্বর্গীয় মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (“শ্রীম”) ছিলেন পরমহংসদেবের শিষ্য এবং সমসাময়িক। ঠাকুরকে তিনি যেমনটি দেখেছিলেন ঠিক সেই ভাবেই দেখিয়েছেন তাঁর অতুলনীয় গ্রন্থ “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে”। সে হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা। সাদাসিধে, নিরলঙ্কার, চলতি ভাষার ভিতর দিয়ে জলজিয়ন্ত ভাবে দেখা যায় একটি বালকের মত সহজ সরল, ভাবে ভোলা, কিন্তু দিব্যজ্ঞানী ও অনন্যসাধারণ মহামানবকে। কিন্তু তিনি যে নিজে একজন উঁচুদরের সাহিত্যশিল্পী, অচিন্ত্যকুমার একথা ভুলতে পারেন নি। ঠাকুরকে তিনি সাজাতে চেয়েছেন সমুজ্জল ভাষার ঐশ্বর্য দিয়ে। দুইখানি জীবনচিত্রের মধ্যে এই হচ্ছে পার্থক্য।
এইবারেই দুই-একটি ব্যক্তিগত কথা বলি। অচিন্ত্যকুমারের সখ্য আমার কাছে সত্য সত্যই প্রীতিপ্রদ। মানুষটিকে ভালো লাগে। একদিন দুপুরে সহধর্মিণী ও দুই কন্যাকে নিয়ে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট দিয়ে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ দেখতে পেলুম গুরুদাস লাইব্রেরীর ভিতরে ব’সে আছেন অচিন্ত্যকুমার। তৎক্ষণাৎ গাড়ী থেকে নেমে প’ড়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করলুম। এবং তাঁর কোন আপত্তি আমলে না এনে সোজা গিয়ে উঠলুম চৌরঙ্গীর চাঙ্গুয়া রেস্তোরাঁয়। তারপর সপরিবারে ও বন্ধু সমভিব্যাহারে বহুক্ষণ ধ’রে চলল গল্পগুজব এবং পানাহার।
আর একদিনের কথা। আমার বাড়ীর ত্রিতলের অলিন্দই হচ্ছে আমার লেখবার, পড়বার, বসবার ও গল্প করবার জায়গা। হাতে যখন কাজ থাকে না, প্রবহমানা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপ ক’রে ব’সে থাকি। স্রোতম্বিনীর চলোর্মিমালার সঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে অনেক দূরে চলে যায় নয়ন এবং মন।
এক বৈকালে সহধর্মিণী ও পুত্রকন্যাদের সঙ্গে সেইখানে ব’সে আছি, হঠাৎ গঙ্গাতীরে দেখতে পেলুম দুটি তরুণীকে। একটি মেয়ের ক্রীড়াচঞ্চল সপ্রতিভ ভাবভঙ্গি আমাকে করলে আকৃষ্ট। সাধারণতঃ বাঙালীর মেয়েরা নিজেদের নারীত্ব সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন হয়ে কতকটা আড়ষ্টভাবেই পথের উপরে দেখা দেন। এ মেয়েটি সে রকম নন, জীবনের আনন্দে যেন উচ্ছ্বসিত।
ভালো লাগল। ছোট ছেলেকে বললুম, “মেয়েটিকে বাড়ীতে ডেকে আনো তো!”
স্ত্রী বললেন, “অচেনা বাড়ীতে ওরা আসবেন কেন?”
আমি বললুম, “গৃহিণী, ও’রা হচ্ছেন নতুন বাংলার মেয়ে। রজ্জু দেখে ওরা সাপ ব’লে ভয় পান না। সাপ দেখলেও আত্মরক্ষা করবার শক্তি আছে ওঁদের।”
সত্য হ’ল আমার অনুমান। আমার বাড়ীতে তাঁরা অসঙ্কোচে চ’লে এলেন। সদর দরজার কাছে এসে একজন বললেন, “শুনেছি এইখানে কোথায় হেমেন রায়ের বাড়ী আছে।”
ছেলে বললে, “আপনারা তো সেই বাড়ীতেই এসেছেন।”
তারপর মেয়েটির পরিচয় পেলুম। একজন হচ্ছেন অচিন্ত্যকুমারের পত্নী। আর আর একজন তাঁর শ্যালিকা, অবিবাহিতা ও কলেজের ছাত্রী।
তারপর অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে দেখা হ’তে বললুম, “অচিন্ত্য, সেদিন তোমার স্ত্রী হরণ করেছিলুম!”
খুব খানিকটা হেসে নিয়ে অচিন্ত্যকুমার বললেন, “শুনেছি হেমেনদা।”
প্রেমেন্দ্রের ভাষা আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করে। তা প্রসাদগুণে মনোরম। তা শব্দগত নয়, ভাবগত। তার মধ্যে শব্দ-সম্পদের গন্ধ নেই, চেষ্টার লক্ষণ নেই, কিন্তু স্বয়মাগত শব্দ ব্যবহার ক’রে যথাযথ ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। লেখকের মনের কথা স্বাভাবিক ভাবেই পরিণত হয় পাঠকের মনের কথায়। নিজস্ব স্টাইল দেখাবার অছিলায় জোরে জোরে শব্দ-ঝুমঝুমি বাজিয়ে ও বহুতর মুদ্রাদোষের সাহায্য নিয়ে অনেকেই দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চান, কিন্তু প্রেমেন্দ্রের স্টাইল হচ্ছে স্বভাবসঙ্গত ও অকৃত্রিম। তাকে চালাতে হয় না, সে আপনি চলে। তাঁর ভাষা দেখলে বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ মনে পড়ে— সরলতাই ভাষার শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার।
ফরাসী সাহিত্যাচার্য ফ্লবেয়ার বলেছিলেন: “ সাদা কথায় সাদাকে ফোটানোই হচ্ছে উচ্চতর শক্তির কাজ।” সমালোচকরা ইংরেজী বাইবেলের ভাষার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তা কত সহজ, কত সরল! আধুনিক যুগের আর এক ফরাসী সাহিত্যাচার্য আনাতোল ফ্রাঁশও ছিলেন একান্তভাবেই জটিলতার বিরোধী। কোনদিন তিনি কুয়াসার ধার দিয়েও যাননি, সাদা কথায় গেয়ে গিয়েছেন আলোকের গান। আবার তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে ফরাসী কবি স্টিফেন ম্যালার্মিকে বলতে শুনি, “এ কবিতাটিকে আবার নতুন ক’রে লিখতে হবে। সবাই কবিতাটিকে পাঠ ক’রে সহজেই বুঝতে পারছে।” ম্যালার্মি’র পরে এলেন পল ভ্যালারি, লোকে তাঁকে বলে, “নীরবতার বাণী” এবং তিনি বলেন— আমার নীরবতা সম্পূর্ণ নির্বাক হ’লেই আমি হতুম মহত্তর। তিনি অভিযোগ করলেন— আনাতোল ফ্রাঁশের রচনা বড় সরল! বঙ্কিমচন্দ্র ও ফ্রাঁশের সেকেলে মত একালে বোধ করি চলবে না। আধুনিকরা হয়তো বলবেন—ভাষার শ্রেষ্ঠ ত্রুটি হচ্ছে, সরলতা। সে যাইই হোক, প্রেমেন্দ্র একেলে লেখক হয়েও যে বঙ্গদেশীয় ম্যালার্মি ও ভ্যালারিদের দলভুক্ত হননি, এইটেই হচ্ছে আনন্দের কথা। বুঝতে পারব না ব’লে লেখা পড়ব? এ মত যুক্তিহীন। এবং এই আজব মতের দোহাই দিলে সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত যাঁরা অতুলনীয় ব’লে স্বীকৃত হয়েছেন, আসর ছেড়ে স’রে পড়তে হবে তাঁদের প্রত্যেককেই। আপন আপন আত্মীয়সভার কবি হচ্ছেন ম্যালার্মি ও ভ্যালারি। সেক্সপিয়রের নিজের আত্মীয়দের কেউ চেনে না, কিন্তু সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দারা হচ্ছে তাঁর আত্মীয়। বার্নার্ড শ’য়ের জীবনব্যাপী প্রোপাগাণ্ডার পরেও বিশ্বের বাসিন্দারা সেক্সপীয়রকে বয়কট করেনি। জানি ওয়াকারের ভাষায়: Born 1564, still going strong!”
রচনার ঐ প্রসাদগুণের জন্যেই প্রেমেন্দ্র অতি অনায়াসে বড়দের আড্ডা ছেড়ে ছোটদের আসরে এসে নিজের জন্যে জায়গা ক’রে নিতে পারেন। বাজারে গুজব শুনি, ছোটদের জন্যে লেখা কেতাবের চাহিদা নাকি যথেষ্ট। তাই হয়তো কৌতূহলী হয়ে অনেকেই ছোটদের খেলাঘরে এসে মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি মারেন। ফল হয় না সন্তোষজনক। শরৎচন্দ্রের একখানি এই শ্রেণীর বই আছে—আমি তার নামকরণ করেছিলুম, “ছেলেবেলার গল্প”। শরৎচন্দ্রের অন্যান্য রচনার তুলনায় এ বইখানির কাটতি আশাপ্রদ নয়। যে গল্পের রচনারীতি সাবালকদের উপযোগী, তা পরিবর্তিত না করলে নাবালকদের মনে সাড়া দেয় না। আবার এক একজন এমন লেখক আছেন, যাঁরা সাবালকদের নিয়ে কারবার করবার সময়েও স্বতঃস্ফূর্ত, সহজ ও স্বাভাবিক সরলতাটুকু ঢেকে রাখবার চেষ্টা করেন না। তাই তাঁদের সে লেখা নাবালকরাও উপভোগ করতে পারে। প্রেমেন্দ্র হচ্ছেন এই শ্রেণীর লেখক। ছোটদের জন্যে লেখবার সময়ে তিনি নিজের রচনারীতি বিশেষ পরিবর্তিত না ক’রেই দৃষ্টি রাখেন কেবল তাদের উপযোগী বিষয়বস্তুর দিকে। তাঁর ঝরঝরে প্রাঞ্জল ভাষা ছোট-বড় উভয়েরই পক্ষে উপভোগ্য।
পটুয়াটোলা লেনে “কল্লোল” কার্যালয়ে প্রেমেন্দ্রের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। ছোটখাটো শ্যামবর্ণ মানুষটি, সাজগোজের ভড়ং নেই, প্রফুল্ল মুখ। তারপর এখানে-ওখানে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হ’তে লাগল; পরিচয়ও ক্রমেই নিবিড় হ’য়ে উঠতে লাগল। আমি তাঁকে হয়তো তেমন আকৃষ্ট করতে পারিনি, কিন্তু তিনি আকৃষ্ট করেছিলেন আমাকে। “কল্লোলে”র মাধ্যমে যে কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম, তাঁদের মধ্যে প্রেমেন্দ্রের সঙ্গেই বেশীবার সংযোগ স্থাপনের সুযোগ পেয়েছি।
একদিন তিনি আমার বাড়ীতে পাঠগৃহের ভিতরে এসে বসলেন। সে ঘরের তিনদিকে ছিল কেতাবের আলমারি। প্রেমেন্দ্র চুপ ক’রে তাকিয়ে তাকিয়ে বইগুলো দেখতে লাগলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, “হেমেনদা, আপনার সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল।”
আমি বললুম, “বদলে গেল? কেন?”
কেতাবের আলমারির দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ ক’রে তিনি বললেন, “এই সব দেখে।”
আগে আমার সম্বন্ধে তাঁর কি ধারণা ছিল, সে কথা আমি আর জিজ্ঞাসা করলুম না, তিনিও খুলে কিছু বললেন না।
তাঁকে ভালোবেসেছিলুম সত্য সত্যই। রাজপথে, প্রকাশকের পুস্তকালয়ে, ফুটবল খেলার মাঠে, যেখানেই তাঁকে দেখেছি, আমার বাড়ীতে ধ’রে এনেছি। একবার কয়েক দিন তাঁর দেখা নেই, অথচ তাঁকে কাছে পাবার জন্যে মন ব্যস্ত হ’য়ে উঠল। কোথায় বাগবাজারের গঙ্গার ধার, আর কোথায় কালীঘাটের আদিগঙ্গার ধার। ট্যাক্সি ডেকে সেই দীর্ঘ পথ অতিক্রম ক’রে একেবারে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলুম। তিনি বেরিয়ে আসতেই তাঁকে গ্রেপ্তার ক’রে টেনে আনলুম নিজের বাড়ীতে। তখন তিনি নিজেও প্রায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। একদিন এলেন যুগলে—অর্থাৎ নব-বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে। নিজেও যেমন ছোট্ট মানুষ, সহধর্মিণীরূপেও বেছে নিয়েছেন তেমনি একটি ছোট্ট তরুণীকে। বলা যায় মানিকজোড়।
ভেবেছিলুম প্রেমেন্দ্রকে পেলুম স্থায়ী বন্ধুরূপে, কিন্তু হঠাৎ সিনেমা এসে বাদ সাধলে। আজ কয়েক বৎসর যাবৎ তিনি অদৃশ্য হয়ে আছেন। সিনেমার যে প্রতিবেশ আমার কাছে অসহনীয়, তার মধ্যেই দিব্য বাহাল তবিয়তে তিনি করছেন জীবনযাপন। তিনি কেবল আমাকেই ভোলেননি, প্রায় ভুলে গিয়েছেন সাহিত্যকেও। আগে তাঁর লেখনী প্রসব করত রচনার পর রচনা। এখন ন-মাসে ছ-মাসে তাঁর কলম থেকে ঝ’রে পড়ে দু-এক ফোঁটা কালি—তাও রীতিমত জোর তাগিদের পর। শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়েরও ঐ দশা।
ওঁদের সাহিত্যজীবনের প্রথম দিকটা অর্থাভাবে প্রীতিকর হয়নি। শ্রীঅচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন: “সর্বক্ষণ যদি দারিদ্র্যের সঙ্গেই যুঝতে হয়, তবে সর্বানন্দ সাহিত্য সৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? কোথায় বা সংগঠনের সাফল্য? শৈলজা খোলার বস্তিতে থেকেছে, পানের দোকান দিয়েছিল ভবানীপরে। প্রেমেন্দ্র ঔষধের বিজ্ঞাপন লিখেছে, খবরের কাগজের অফিসে প্রুফ দেখেছে।”
কিন্তু তবু তখন তাঁরা সাহিত্যধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। অমর ফরাসী লেখক গতিয়েরকেও জীবিকানির্বাহের জন্যে অমনি সব উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করতে হ’ত, কিন্তু তিনি সাহিত্যকে ত্যাগ করতে পারেননি। ইংলণ্ডের কবি ও শিল্পী বেক সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন নিরতিশয় দারিদ্র্যজ্বালা ভোগ করতে করতে, কিন্তু তবু কি তিনি নিজের আর্টকে ভুলে থাকতে পেরেছেন? চিত্রকর রেমব্রাণ্ড যখন সর্বহারা বাজারে যখন তাঁর চাহিদা নেই এবং দেশের লোক যখন তাঁকে ভুলে গিয়েছে, তখনও তিনি এঁকে গিয়েছেন ছবির পর ছবি। আমাদের দেশের কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস এক হাতে করতেন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ, আর এক হাতে করতেন কবিতা আর কবিতা রচনা।
সাহিত্যের জন্যে অর্থ আসতে পারে— কারুর কারুর যে আসছে, স্বচক্ষেই তো সেটা দেখছি। কিন্তু অর্থের জন্যে সাহিত্য নয়, সাহিত্য নয় অর্থের জন্যে। বরং অর্থ ক্ষুণ্ন করে আর্ট ও সাহিত্যকে। প্রমাণ প্রেমেন্দ্র ও শৈলজানন্দ। অর্থের জন্যে তাঁরা হয়েছেন সিনেমাওয়ালা। আশা করি, সুগম হয়েছে তাঁদের অর্থাগমের পথ। আশা করি, ওদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন এখন তাঁরা। তবু সিনেমার কাজের ফাঁকে তাঁরা যে সাহিত্যসেবার জন্যে খানিকটা সময় ব্যয় করতে পারেন না, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। মনে হচ্ছে প্রেমেন্দ্রই কোথায় যেন এই মর্মে বলেছিলেন-আর্টের জন্যে আমি প্রিয়াকে ছাড়তে পারি, কিন্তু প্রিয়ার জন্যে ছাড়তে পারি না আমার আর্টকে। স্বধর্ম ত্যাগ না করলে এতদিনে তাঁর সাহিত্যসাধনার একটা মহান পরিণতি দেখবার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তাত্থেকে আমরা বঞ্চিত। প্রেমেনের জন্যে আমি দুঃখিত।
"শনিবারের চিঠি”র সম্পাদক “কল্লোল” গোষ্ঠীভুক্ত লেখকদের পক্ষে পরমবন্ধুর কাজ করেছেন। “কল্লোলে”র মত ছোট ছোট আরো অনেক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলা দেশে। তবে জনসাধারণের দৃষ্টি তাদের দিকে ভালো ক’রে আকৃষ্ট হবার আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে তাদের পরমায়ু। কিন্তু “শনিবারের চিঠি” হয়েছিল “কল্লোলের” লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মত। “চিঠি”র সম্পাদকই হয়েছিলেন “কল্লোলের” প্রচারকর্তা। তার অশ্লীলতার অভিযোগ শুনে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে “কল্লোলে”র সঙ্গে পরিচিত হন। তারপর তথাকথিত অশ্লীলতার জন্যে কারুর মন অশুচি হয়েছিল কি না সে কথা আমি বলতে পারব না, তবে এটকু অনায়াসেই অনুমান করা যায় যে, একদল অজানিত ও শক্তিধর লেখকের অভাবিত আবির্ভাব দেখে সকলেই বিস্মিত না হয়ে পারেননি। কারুর কারুর কাছে তাঁদের রচনার স্থলবিশেষ হয়তো স্বাস্থ্যকর ব’লে মনে হয়নি, কিন্তু সমগ্রভাবে তাঁদের রচনা যে বলিষ্ঠ, গরিষ্ঠ ও বিশিষ্ট, এ সম্বন্ধে মতদ্বৈধ ছিল না নিশ্চয়ই; তাঁরা কাঁচা হাতে বেলেখেলা খেললে অশ্লীলতার খোরাক জুগিয়েও কিছুতেই টেকসই হ’তে পারতেন না। কিন্তু তাঁরা কচি হাতেও খেলতে পেরেছিলেন পাকা খেলা। লোকে তাই তাঁদের ভুললে না, চিনে রাখলে।
এই দলেরই অন্যতম উজ্জল নক্ষত্র হচ্ছেন বুদ্ধদেব। কাঁচা বয়সে হয়তো তিনি বয়সোচিত দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলেন অল্প-বিস্তর। কারণ “কল্লোলে” প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্প “রজনী হ’ল উতলা” (নামটি খাসা) সম্বন্ধে নিজেই তিনি মত প্রকাশ করেছেন—গল্পটি কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয়। ঐটিই তাঁর রচিত প্রথম গল্প কি না, সে খবর আমি রাখি না। তবে প্রথম গল্প না হ’লেও ওটি তাঁর প্রথম বয়সেরই রচনা। সে হিসাবে গল্পটির রচনানৈপণ্য বিশেষভাবে প্রশংসনীয়।
বুদ্ধদেবের নিজের মুখে থেকেই জানতে পারি, এগারো বৎসর বয়সেই তিনি তিনচারখানা খাতা কবিতায় কবিতায় ভরিয়ে ফেলেছেন এবং তখন তাঁকে আকৃষ্ট করত আমারই কোন কোন কবিতা। সে আজ প্রায় তিন যুগ আগেকার কথা। তিনি বলেনঃ “যখন যে লেখা ভালো লাগতো, তক্ষণি তার অনুকরণে কিছু লিখে ফেলতে না পারলে আমি টিকতেই পারতুম না। মৌচাকের দ্বিতীয় সংখ্যায় গ্রীষ্ম-বিষয়ক একটি কবিতা বেরুলো—খুব সম্ভব হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা, আমি চটপট তার একটি নকল খাড়া ক’রে মৌচাকে পাঠিয়ে দিলুম এবং চটপট সেটি ফেরৎ এলো।”
কিন্তু আজ তাঁর নকল ক’রে লেখবার এবং লেখা ফেরৎ আসবার দিন আর নেই। পত্রিকা সম্পাদকদের কাছে তাঁর রচনা এখন মহার্ঘ্য। কেবল বাংলাতে নয়, ইংরেজীতেও তাঁর লেখার হাত রীতিমত পরিপক্ক। তিনি কেবল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখেন না, বেশ লেখেন প্রবন্ধও। একসময়ে নাটক রচনাতেও হাত দিয়েছিলেন, তারপর ও-বিভাগ থেকে হাত গুটিয়ে ব’সে আছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নূতন এবং আধুনিক যুগের উপযোগী। গত যুগের সাহিত্য সম্বন্ধে তিনি তেমন শ্রদ্ধাবান নন। কিন্তু গত যুগের কোন কোন সাহিত্যিকের মতন এমন মস্ত মস্ত গ্রন্থ রচনা করতে পারেন যে দেখলে চক্ষু বিস্ফারিত হয়—তাদের মধ্যে ‘কোয়ালিটি’ ও ‘কোয়াণ্টিটি’ দুইই পাওয়া যায়, সাধারণতঃ যা দুর্লভ।
“কল্লোল” কার্যালয়ে প্রেমেনের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের সময়ে প্রথম দেখি বুদ্ধদেবকে। তাঁর লেখা পড়লে মনে জাগে, একটি একরোখা মানুষের মূর্তি, মুখে যাঁর ‘কুছ পরোয়া নেহি’ গোছের অদম্য ভাব। কিন্তু চেহারাটি শান্তশিষ্ট নিরীহ ধরণের, দশজনের ভিতর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। তাঁর লেখায় যে ব্যক্তিত্ব পাই, তাঁর চেহারায় তা নেই। হাসতে হাসতে এবং কথা কইতে কইতে সিগারেটের পর সিগারেট পুড়িয়ে ছাই করেন।
ভারি সিগারেটের ভক্ত। অস্কার ওয়াইল্ডের মত তাঁর কাছেও সিগারেট বোধ করি “নিখুঁত আনন্দ”। ঐখানে তাঁর সঙ্গে আমার মিল আছে। সিগারেটের অভাব হ’লে চোখে আমি অন্ধকার দেখি। অচিন্ত্যের সঙ্গে বুদ্ধদেব একদিন আমার বাড়ীতে পদার্পণ করেছিলেন।
অচিন্ত্য বললেন, “হেমেনদার বাড়ীতে যেখানেই বসি, সেইখানেই দেখি খালি ছাইদান আর ছাইদান।”
বুদ্ধদেব গম্ভীরভাবে বললেন, “প্রত্যেক ভদ্রলোকের বাড়ীতেই তা থাকা উচিত।”
জাত-সাহিত্যিক এই বুদ্ধদেব। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অটল নিষ্ঠা। এসেছে সৌভাগ্য, এসেছে দুর্ভাগ্য, কিন্তু টাকার প্রভাবে বা অভাবে কোন দিনই বিসর্জন দেননি সাহিত্যধর্ম। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।