বিষয়বস্তুতে চলুন

কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

বিকার

গদাধরের মুখে সকল কথা শুনিয়া, জনার্দ্দন চৌধুরী তখন তনু রায় প্রভৃতি গ্রামের ভদ্রলোকদিগকে ডাকিতে পাঠাইলেন।

 সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলে, জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “আজি আমি ঘোর সর্ব্বনাশের কথা শুনিলাম। জাতি-কুল, ধর্ম্ম-কর্ম্ম, সব লোপ হইতে বসিল। পিতা-পিতামহদিগকে যে এক গণ্ডুষ জল দিব, তাহারও উপায় রহিল না। ঘোর কলি উপস্থিত।”

 সকল জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি হইয়াছে, মহাশয়?”

 জনাৰ্দন চৌধুরী উত্তর করিলেন,—“শিবচন্দ্রের পুত্র ঐ যে খেতা, কলিকাতায় রামহরির বাসায় থাকিয়া ইংরেজী পড়ে, সে বরফ খায়। বরফ সাহেবেরা প্রস্তুত করেন, সাহেবের জল। শিরোমণি মহাশয় বিধান দিয়াছেন যে, বরফ খাইলে সাহেবত্ব প্রাপ্ত হয়। সাহেবত্ব-প্রাপ্ত লোকের সহিত সংস্রব রাখিলে সেও সাহেব হইয়া যায়। তাই, এই খেতার সহিত সংস্রব রাখিয়া সকলেই আমরা সাহেব হইতে বসিয়াছি।”

 এই কথা শুনিয়া দেশশুদ্ধ লোক একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। সর্ব্বনাশ! বরফ খায়? যাঃ। এইবার ধর্ম্ম-কর্ম্ম সব গেল।

 সর্ব্বের চেয়ে ভাবনা হইল ষাঁড়েশ্বরের। ডাক ছাড়িয়া তিনি কাঁদেন নাই সত্য, কিন্তু তাঁহার ধর্ম্মগত প্রাণে বড়ই আঘাত লাগিয়াছিল। কত যে তিনি “হায়, হায়!” করিলেন, তাহার কথা আর কি বলিব!

 যাহা হউক, সর্ব্ববাদিসম্মত হইয়া খেতুকে 'একঘোরে' করা স্থির হইল।

 নিরঞ্জন কেবল ঐ কথায় সায় দিলেন না। নিরঞ্জন বলিলেন,— “আমি থাকিতে খেতুকে কেহ 'একঘোরে' করিতে পরিবে না। না হয় দু’ঘোরে হইয়া থাকিব।”

 নিরঞ্জন আরও বলিলেন,— “চৌধুরী মহাশয়! আজি প্রাতঃকাল হইতে যাহা দেখিলাম, যাহা শুনিলাম, তাহাতে বুঝিতেছি যে, ঘোর কলি উপস্থিত। নিদারুণ নরহত্যা ব্রহ্মহত্যার কথা শুনিলাম। চৌধুরী মহাশয়! আপনি প্রাচীন, বিজ্ঞ, লক্ষ্মীর বরপুত্র; বিধাতা আপনার প্রতি সুপ্রসন্ন। এ কুচক্র আপনাকে শোভা পায় না; লোককে জাতিচ্যুত করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নাই, পতিতকে উদ্ধার করাই মানুষের কার্য্য। বিষ্ণু ভগবান পতিতাকে উদ্ধার করেন বলিয়াই তাঁহার নাম 'পতিতপাবন’ হইয়াছে। পৃথিবীতে সজ্জনকুল সেই পতিতপাবনের প্রতিরূপ। এই ষাঁড়েশ্বরের মত সুরাপানে আর অভক্ষ্য-ভক্ষণে যাহারা উন্মত্ত, এই তনু রায়ের মত যাহাদিগের অপত্য-বিক্রয়-জনিত শুষ্ক গ্রহণে মানস কলুষিত, এই গোবৰ্দ্ধনের মত যাহারা ব্রহ্মহত্যামহাপাতকে পতিত, সেই গলিত নরককীটেরা ধর্ম্মের মর্ম্ম কি জানিবে?”

 এই বলিয়া নিরঞ্জন সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 নিরঞ্জন চলিয়া যাইলে, গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি বলিলেন,— “ষাঁড়েশ্বর বাবাজীকে ইনি গালি দিলেন, ষাঁড়েশ্বর বাবাজী বীরপুরুষ। ষাঁড়েশ্বর বাবাজীকে অপমান করিয়া এ-গ্রামে আবার কে বাস করিতে পারে?”

 খেতু যে একঘোরে হইয়াছেন, —নিয়মিতরূপে লোককে সেইটি দেখাইবার নিমিত্ত, স্ত্রীর মাসিক শ্রাদ্ধ উপলক্ষে জনার্দ্দন চৌধুরী সপ্তগ্রাম সমাজ নিমন্ত্রণ করিলেন। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল যে, কুসুমবাটী নিবাসী শিবচন্দ্রের পুত্র, ক্ষেত্র, “বরফ” খাইয়া কৃস্তান হইয়াছে।

 সেইদিন রাত্রিতে ষাঁড়েশ্বর চারি বোতল মহুয়ার মদ আনিলেন। তারীফ শেখের বাড়ী হইতে চুপি-চুপি মুরগী রাঁধাইয়া আনিলেন। পাঁচ ইয়ার জুটিয়া পরমসুখে পান-ভোজন হইল। একবার কেবল এই সুখে ব্যাঘাত হইবার উপক্রম হইয়াছিল। খাইতে খাইতে ষাঁড়েশ্বরের মনে উদয় হইল যে, তারীফ শেখ হয়তো মুরগীর সহিত বরফ মিশ্রিত করিয়াছে। তাই তিনি হাত তুলিয়া লইলেন, আর বলিলেন, —“আমার খাওয়া হইল না। বরফ-মিশ্রিত মুরগী খাইয়া শেষে কি জাতিটি হারাইব?” সকলে অনেক বুঝাইলেন যে, মুরগী বরফ দিয়া রান্না হয় নাই। তবে তিনি পুনরায় আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। পান-ভোজনের পর নিরঞ্জনের বাটিতে সকলে গিয়া ঢিল ও গোহাড় ফেলিতে লাগিলেন। এইরূপ ক্রমাগত প্রতি রাত্রিতে নিরঞ্জনের বাটীতে ঢিল ও গোহাড় পড়িতে লাগিল। আর সহ্য করিতে না পারিয়া, নিরঞ্জন ও তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে পৈতৃক বাস্তৃভূমি পরিত্যাগ করিয়া অন্য গ্রামে চলিয়া গেলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কাকা মহাশয়! আপনি চলুন। আমিও এ-গ্রাম হইতে শীঘ্র উঠিয়া যাইব।”

 খেতুর মার নিকট যে ঝি ছিল, সে ঝিটি ছাড়িয়া গেল। সে বলিল,— “মঠাকুরাণি! আমি আর তোমার কাছে কি করিয়া থাকি? পাঁচজনে তাহা হইলে আমার হাতে জল খাইবে না।”

 আরও নানা বিষয়ে খেতুর মা উৎপীড়িত হইলেন। খেতুর মা ঘাটে স্নান করিতে যাইলে, পাড়ার স্ত্রীলোকেরা দূরে দূরে থাকেন; পাছে খেতুর মা তাঁহাদিগকে ছুইয়া ফেলেন।

 যে কমল ভট্টাচার্য্যের কথা গদাধর ঘোষ বলিয়াছিল, সেই কমলের বিধবা স্ত্রী মুখ ফুটিয়া খেতুর মাকে বলিলেন, —"বাছা! নিজে সাবধান হইতে জানিলে কেহ আর কিছু বলে না! বসিতে জানিলে উঠেত হয় না। তোমার ছেলে বরফ খাইয়াছে, তোমাদের এখন জাতিটি গিয়াছে। তা বলিয়া আমাদের সকলের জাতিটি মার কেন? আমাদের ধর্ম্ম-কর্ম্ম নাশ কর কেন? তা তোমার বাছা দেখিতেছি, এ ঘাটটি না হইলে আর চলে না। সেদিন মেটে কলসটি যেই কাঁকে করিয়া উঠিয়াছি, আর তোমার গায়ের জলের ছিটা আমার গায়ে লাগিল, তিন পয়সার কলসীটি আমাকে ফেলিয়া দিতে হইল। আমাকে পুনরায় স্নান করিতে হইল। আমরা তোমার বাছা, কি করিয়াছি? যে তুমি আমাদের সঙ্গে এত লাগিয়াছ?”

 খেতুর মা কোন উত্তর দিলেন না। কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “মা! কাঁদিও না। এখানে আর আমরা অধিক দিন থাকিব না। এ-গ্রাম হইতে আমরা উঠিয়া যাইব।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “বাছা! অভাগীরা যাহা কিছু বলে, তাহাতে আর দুঃখ করি না। কিন্তু তোমার মুখপানে চাহিয়া রাত্রি-দিন আমার মনের ভিতর আগুন জ্বলিতেছে। তোমার আহার নাই, নিদ্রা নাই; একদণ্ড তুমি সুস্থির নও! শরীর তোমার শীর্ণ, মুখ তোমার মলিন। খেতু! আমার মুখপানে চাহিয়া একটু সুস্থির হও, বাছা!”

 খেতু বলিলেন,— “মা! আর সাত দিন! আজ মাসের হইল ১৭ তারিখ। ২৪শে তারিখে কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে। সেইদিন আশাটি আমার সমূলে নির্মূল হইবে। সেইদিন আমরা জন্মের মত এ-দেশ হইতে চলিয়া যাইব।”

 খেতুর মা বলিলেন,— “দাসেদের মেয়ের কাছে শুনিলাম যে, কঙ্কাবতীকে আর চেনা যায় না। সে রূপ নাই, সে রং নাই, সে হাসি নাই। আহা! তবুও বাছা মা'র দুঃখে কাতর! আপনার সকল দুঃখ ভুলিয়া, বাছা-আমার মা'র দুঃখে দুঃখী। কঙ্কাবতীর মা রাত্রি-দিন কাঁদিতেছেন, আর কঙ্কাবতী মাকে বুঝাইতেছেন।”  “শুনিলাম, সেদিন কঙ্কাবতী মাকে বলিয়াছেন যে, 'মা। তুমি কাঁদিও না! আমার এই কয়খানা হাড় বেচিয়া বাবা যদি টাকা পান, তাতে দুঃখ কি মা? এরূপ কত হাড় শ্মশানঘাটে পড়িয়া থাকে, তাহার জন্য কেহ একটি পয়সাও দেয় না। আমার এই হাড় ক'খানার যদি অত মূল্য হয়, বাপ-ভাই সেই টাকা পাইয়া যদি সুখী হন, তার জন্য আর আমরা দুঃখ কেন করি মা? তবে মা! আমি বড় দুর্ব্বলল হইয়াছি, শরীরে আমার সুখ নাই। পাছে এই কয়দিনের মধ্যে আমি মরিয়া যাই, সেই ভয় হয়। টাকা না পাইতে পাইতে মরিয়া গেলে, বাবা আমার উপর বড় রাগ করিবেন। আমি তো ছাই হইয়া যাইব, কিন্তু আমাকে তিনি যখনি মনে করিবেন, আর তখনি কত গালি দিবেন।”

 খেতুর মা পুনরায় বলিলেন, — “খেতু কঙ্কাবতীর কথা যা আমি শুনি, তো তোমাকে বলি না, পাছে তুমি অধৈর্য্য হইয়া পড়! কঙ্কাবতীর যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, কঙ্কাবতী আর অধিক দিন বাঁচিবে না।”

 খেতু বলিলেন,— “মা। আমি তনু রায়কে বলিলাম যে, রায় মহাশয়! আপনাকে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিতে হইবে না, একটি সুপাত্রের সহিত দিন। রামহরি দাদা ও আমি ধনাঢ্য সুপাত্রের অনুসন্ধান করিয়া দিব। কিন্তু মা! তনু রায় আমার কথা শুনিলেন না, অনেক গালি দিয়া আমাকে তাড়াইয়া দিলেন। আমাদের কি মা? আমরা অন্য গ্রামে গিয়া বাস করিব। কিন্তু কঙ্কাবতী যে এখানে চিরদুঃখিনী হইয়া রহিল। সেই মা দুঃখ! আমি কাপুরুষ, যে তাহার কোন উপায় করিতে পারিলাম না, সেই মা দুঃখ। আর মা, যদি কঙ্কাবতীর বিষয়ে কোন কথা শুনিতে পাও, তো আমাকে বলিও। আমার নিকট কোনও কথা গোপন করিও না। আহা! সীতাকে এ সময়ে কলিকাতায় কেন পাঠাইয়া দিলাম। সীতা যদি এখানে থাকিত, তাহা হইলে প্রতিদিনের সঠিক সংবাদ পাইতাম।”

 খেতুর মা, তার পরদিন খেতুকে বলিলেন,— “আজি শুনিলাম, কঙ্কাবতীর বড় জ্বর হইয়াছে। আহা! ভাবিয়া ভাবিয়া জ্বর হইবে, সে আর বিচিত্র কথা কি? বাছার এখন প্রাণরক্ষা হইলে হয়। জনার্দ্দন চৌধুরী কবিরাজ পাঠাইয়াছেন, আর বলিয়া দিয়াছেন যে, যেমন করিয়া হউক, চারিদিনের মধ্যে কঙ্কাবতীকে ভাল করিতে হইবে।”

 খেতু বলিলেন, — “তাই তো মা! এখন কঙ্কাবতীর প্রাণটা রক্ষা হইলে হয়। মা! কঙ্কাবতীর বিড়াল আসিলে এ কয়দিন তাহাকে ভাল করিয়া দুধ-মাছ খাইতে দিবে। হাঁ মা! আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর বিড়াল কি আমাদের বাড়ীতে আর আসিবে? না, বড় মানুষের বাড়ীতে গিয়া আমাদিগকে ভুলিয়া যাইবে?”

 খেতুর মা কোনও উত্তর দিলেন না, আঁচলে চক্ষু মুছিতে লাগিলেন। এইরূপে দিন দিন কঙ্কাবতীর পীড়া বাড়িতে লাগিল, কিছুই কমিল না। সাত দিন হইল। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল।

 সেদিন কঙ্কাবতীর গায়ের বড় জ্বালা, কঙ্কাবতীর বড় পিপাসা, কঙ্কাবতী একেবারে শয্যাধরা। কঙ্কাবতীর সমূহ রোগ। কঙ্কাবতীর ঘোর বিকার। কঙ্কাবতীর জ্ঞান নাই, সংজ্ঞা নাই। লোক চিনিতে পারেন না, কঙ্কাবতী এখন যান। তখন যান!