বিষয়বস্তুতে চলুন

কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বিদায়

যেদিন রামহরির সহিত কথাবার্তা হইল, সেদিন রাত্রিতে মা, খেতুর গায়ে স্নেহের সহিত হাত রাখিয়া বলিলেন, —"খেতু! বাবা! তোমাকে একটি কথা বলি।”

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি মা?”

 মা উত্তর করিলেন,— “বাছা। তোমার রামহরি দাদার সহিত তোমাকে কলিকাতায় যাইতে হইবে।”

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “সে কোথায় মা?”

 মা বলিলেন,— “তোমার মনে পড়ে না? সেই যে, যেখানে গাড়ী-ঘোড়া আছে?”

 খেতু বলিলেন,— “সেইখানে? তুমি সঙ্গে যাবে তো মা?”

 মা উত্তর করিলেন,— “না বাছা! আমি যাইব না, আমি এইখানেই থাকিব।”

 খেতু বলিলেন,— “তবে মা! আমিও যাইব না!"

 মা বলিলেন,— “না গেলে বাছা চলিবে না। আমি মেয়েমানুষ, আমাকে যাইতে নাই। রামহরি দাদার সঙ্গে যাইবে, তাতে আর ভয় কি?”

 খেতু বলিলেন,— “ভয়! ভয় মা! আমি কিছুতে করি না। তবে তোমার জন্য আমার মন কেমন করিবে, তাই মা বলিতেছি যে, যাব না।”

 মা বলিলেন,— খেতু! সাধ করিয়া কি তোমাকে আমি কোথাও পাঠাই? কি করি, বাছা? না পাঠাইলে নয়, তাই পাঠাইতে চাই।”

 তুমি এখন বড় হইয়াছ, এইবার তোমাকে স্কুলে পড়িতে হইবে। না পড়িলে-শুনিলে মূর্খ হয়। মূর্খকে কেহ ভালবাসে না, কেহ আদর করে না। তুমি যদি স্কুলে যাও আর মন দিয়া লেখাপড়া কর, তাহা হইলে সকলেই তোমাকে ভালবাসিবে। আর খেতু! তোমার এই দুঃখিনী মার দুঃখ ঘুচিবে। এই দেখ, আমি আর সরু পৈতা কাটিতে পারি না, চক্ষে দেখিতে পাই না। আর কিছুদিন পরে হয়তো মোটা পৈতাও কাটিতে পারিব না। তখন বল, পয়সা কোথায় পাইব? লেখাপড়া শিখিয়া তুমি টাকা আনিতে পারিলে, আমাকে আর পৈতা কাটিতে হইবে না। আমি তখন সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকিব, পূজা-আচ্ছা করিব, আর ঠাকুরদের কাছে বলিব,— খেতু আমার বড় সুছেলে, খেতুকে তোমরা বাঁচাইয়া রাখ।”

 খেতু বলিলেন, — “মা। আমি যদি যাই, তুমি কাঁদিবে না?”

 মা উত্তর করিলেন,— “না বাছা, কাঁদিব না।

 খেতু বলিলেন, — “ঐ যে মা! কাঁদিতেছ?”

 মা উত্তর করিলেন,— “এখন কান্না পাইতেছে, ইহার পর আর কাঁদিব না। আর খেতু! সেখানে তোমাকে বারমাস থাকিতে হইবে না, ছুটি পাইলে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ী আসিবে। আমি পথপানে চাহিয়া থাকিব, আগে থাকিতে দত্তদের পুকুরধারে গিয়া বসিয়া থাকিব, সেইখান হইতে তোমাকে কোলে করিয়া আনিব। মন দিয়া লেখাপড়া করিলে, তুমি আবার আমাকে চিঠি লিখিতে শিখিবে। তুমি আমাকে কত চিঠি লিখিবে আমি সে চিঠিগুলি তুলিয়া রাখিব, কাহাকেও খুলিতে দিব না, কাহাকেও পড়িতে দিব না। তুমি যখন বাড়ীতে আসিবে, তখন সেই চিঠিগুলি খুলিয়া আমাকে পড়িয়া পড়িয়া শুনাইবে।”

 খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন, — “মা! সেখানে মালা পাওয়া যায়?”

 মা বলিলেন,— “মালা কি?”

 মা উত্তর করিলেন,— “হাঁ বাছা! মালা সেখানে অনেক পাওয়া যায়।”

 খেতু বলিলেন,— “আমি তোমার জন্য, মা! ভাল মালা কিনিয়া আনিব।”

 মা উত্তর করিলেন,— “তাই ভাল! আমার জন্য মালা আনিও।”

 মাতা-পুত্রে এইরূপ কথার পর, কলিকাতার বিষয় ভাবিতে ভাবিতে খেতু নিদ্রিত হইলেন। তাহার পরদিন সকালে উঠিয়া খেতু বলিলেন,— “মা, এই কয়দিন আমি পাঠশালায় যাইব না, খেলা করিতেও যাইব না, সমস্ত দিন তোমার কাছে থাকিব।”

 মা উত্তর করিলেন,— “আচ্ছা, তাই ভাল, তবে তোমার নিরঞ্জন কাকাকে একবার নমস্কার করিতে যাইও।”

 খেতু বলিলেন,— “তা যাব। আমি আর একটি কথা বলি। তোমার খাওয়া হইলে, এ কয়দিন আমি তোমার পাতে ভাত খাইব। পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, কেন তা জান মা? যাহা তোমার মুখে ভাল লাগে, নিজে না খাইয়া আমার জন্য রাখ। তাই আমি বলি, 'দুপুরবেলা, মা! আমার ক্ষুধা পায় না, আমার জন্য পাতে ভাত রাখিও না।' ক্ষুধা, কিন্তু মা! খুব পায়। লোকের গাছতলায় কত কুল, কত বেল পড়িয়া থাকে, স্বচ্ছন্দে কুড়াইয়া খাই। কিন্তু তোমার ক্ষুধা পাইলে তুমি তো মা, তা খাও না? তাই পাতে ভাত রাখিতে মানা করি, পাছে মা! তোমার পেট না ভরে।

 ব্রাহ্মণী খেতুকে কোলে লইলেন, মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে কঁদিতে লাগিলেন, আর বলিলেন,— “বাবা! এ দুঃখের কান্না নয়! তোমা হেন চাঁদ ছেলে যে গর্ভে ধরিয়াছে, তার আবার দুঃখ কিসের? তোমার সুধামাখা কথা শুনিলে ভয় হয়,—এ হতভাগিনীর কপালে তুমি কি বাঁচিবে?”

 সেইদিন আহারাদির পর, খেতুর ছেঁড়া-খোঁড়া কাপড়গুলি মা সেলাই করিতে বসিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “মা! আমি ছেঁড়ার দুই ধার এক করিয়া ধরি, তুমি ওদিক হইতে সেলাই কর, তাহা হইলে শীঘ্র শীঘ্র হইবে। আর মা! যখন সূচে সূতা না থাকিবে, তখন আমি পরাইয়া দিব, তুমি ছিদ্রটি দেখিতে পাও না, সূতা পরাইতে তোমার অনেক বিলম্ব হয়।”

 এইরূপে মাতা-পুত্রে কথা কহিতে কহিতে কাপড় সেলাই হইতে লাগিল। তাহার পর মা সেইগুলিকে ক্ষারে কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া লইলেন। খেতু কলিকাতায় যাইবেন, তাহার আয়োজন এইরূপে হইতে লাগিল।

 বৈকালবেলা খেতু নিরঞ্জনের বাটী যাইলেন। নিরঞ্জন ও নিরঞ্জনের স্ত্রীকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া, কলিকাতায় যাইবার কথা তাহাদিগকে বলিলেন। রামহরির নিকট নিরঞ্জন পূর্ব্বেই সমস্ত কথা শুনিয়াছিলেন।

 এক্ষণে খেতুকে আশীর্ব্বাদ করিয়া, নানারূপ উপদেশ দিয়া নিরঞ্জন বলিলেন,— “খেতু! সর্ব্বদা সত্যকথা বলিবে, মিথ্যা কখনও বলিও না। নীচতা ও নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করবে। জীবে দয়া করিবে। যথাসাধ্য পরোপকার করবে। ইহাই সনাতন ধর্ম্ম। সুখ-দুঃখের সকল কথা তোমার রামহরি দাদাকে বলিবে, কোনও কথা তাহার নিকট গোপন করিবে না। অনেক বালকের সহিত তোমাকে পড়তে হইবে, তাহার মধ্যে কেহ দুষ্ট, কেহ শিষ্ট হইবে। অন্যায় করিয়া কাহাকেও মারিও না, দু্র্ব্বলকে মারিও না, পাঁচজনে পড়িয়া একজনকে মারিও না, দুর্ব্বলকে কেহ মারিতে আসিলে তাহার পক্ষ হইও। দুর্ব্বলের পক্ষ হইয়া যদি মার খাইতে হয় সেও ভাল। প্রতিদিন রাত্রিতে শুইবার সময় মনে করিয়া দেখিবে যে, সেদিন কি সুকার্য্য, কি কুকার্য্য করিয়াছ। যদি কোনও প্রকার কুকার্য্য করিয়া থাক, তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিবে যে, আর এমন কাজ কখনও করিব না।”

 এইরূপ খেতু, নিরঞ্জন কাকার নিকট হইতে বিদায়গ্রহণ করিলেন। মঙ্গলবার রাত্রিতে মাতা-পুত্রের নিদ্রা হইল না। দুইজনে কেবল কথা কহিতে লাগিলেন, কথা আর ফুরায় না।

 কতবার মা বলিলেন,— “খেতু! ঘুমাও, না ঘুমাইলে অসুখ করিবে।”

 খেতু বলিলেন,— “না মা! আজ রাত্রিতে ঘুম হইবে না। আর মা কাল রাত্রিতে তো আর তোমার সঙ্গে কথা কহিতে পাব না? কাল কতদূর চলিয়া যাব। সে কথা যখন মা! মনে করি, তখন আমার কান্না পায়।”

 মা বলিলেন,— পূজার ছুটির আর অধিক দিন নাই, দেখিতে দেখিতে এ কয়মাস কাটিয়া যাইবে। তখন তুমি আবার বাড়ী আসিবে।

 প্রাতঃকালে রামহরি আসিলেন। খেতুর মা, খেতুর কপালে দধির ফোটা করিয়া দিলেন, চাদরের খুঁটে বিল্বপত্র বঁধিয়া দিলেন। নীরবে নিঃশব্দে রামহরির হাতের উপর খেতুর হাতটি দিলেন। চক্ষু ফুটিয়া জল আসিতেছিল, অনেক কষ্টে তাহা নিবারণ করিলেন।

 অবশেষে ধীরে ধীরে কেবল এই কথাটি বলিলেন,— “দুঃখিনীর ধন তোমাকে দিলাম।”

 রামহরি বলিলেন,— “খেতু! মাকে প্রণাম কর।” খেতু প্রণাম করিলেন, রামহরি নিজেও প্রণাম করিয়া দুইজনে বিদায় হইলেন।

 যতক্ষণ দেখা যাইল, ততক্ষণ খেতুর মা অনিমিষ-নয়নে সেই পথপানে চাহিয়া রহিলেন। খেতুও মাঝে মাঝে পশ্চাৎদিকে চাহিয়া মাকে দেখিতে লাগিলেন। যখন আর দেখা গেল না, তখন খেতুর মা পথের ধুলায় শুইয়া পড়িলেন। ধূলায় লুষ্ঠিত হইয়া অবিরল ধারায় চক্ষের জলে সেই ধূলা ভিজাইতে লাগিলেন।