কজ্জলী/জাবালি

উইকিসংকলন থেকে


রতের সঙ্গে বশিষ্ঠাদি যেসকল ঋষিগণ মহিষীগণ ও কুলপতিগণ চিত্রকূট পর্বতে গিয়াছিলেন তাঁহারা সকলে রামচন্দ্রকে অযোধ্যায় প্রত্যানয়নের জন্য নানাপ্রকার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সত্যসন্ধ রাম অটল রহিলেন। অবশেষে মহর্ষি জাবালি বলিলেন—

 [১]‘রাম, তুমি অতি সুবোধ, সামান্য লোকের ন্যায় তোমার বুদ্ধি যেন অনর্থদর্শিনী না হয়। জীব একাকী জন্মগ্রহণ করে এবং একাকীই বিনষ্ট হয়, অতএব মাতাপিতা বলিয়া যাহার স্নেহাসক্তি হইয়া থাকে সে উন্মত্ত। ... পিতার অনুরোধে রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া দুর্গম সংকটপূর্ণ অরণ্য আশ্রয় করা তোমার কর্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে তুমি সেই সুসমৃদ্ধ অযোধ্যায় প্রতিগমন কর। সেই একবেণীধরা নগরী তোমার প্রতীক্ষা কবিতেছেন। তুমি তথায় রাজভোগে কালক্ষেপ করিয়া দেবলোকে ইন্দ্রের ন্যায় পরম সুখে বিহার করিবে। দশরথ তোমার কেহ নহেন, তিনি অন্য, তুমিও অন্য।... বংস, তুমি স্ববুদ্ধিদোষে বৃথা নষ্ট হইতেছ। যাহারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। লোকে পিতৃদেবতার উদ্দেশে অষ্টকা শ্রাদ্ধ কবিয়া থাকে। দেখ, ইহাতে অন্ন অনর্থক নষ্ট করা হয়, কারণ, কে কোথায় শুনিয়াছে যে মৃতব্যক্তি আহার করিতে পারে? ... যেসমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা যজ্ঞ তপস্যা দান প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান্ মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেইসকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছে। অতএব রাম, পরলোকসাধন ধর্ম নামে কোন পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক। তুমি প্রত্যক্ষের অনুষ্ঠান এবং পরোক্ষের অননুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও। ভরত তোমাকে অনুরোধ করিতেছেন, তুমি সর্বসম্মত বুদ্ধির অনুসরণপূর্বক রাজ্যভার গ্রহণ কর।’

 জাবালির কথা শুনিয়া রামচন্দ্র ধর্মবুদ্ধি অবলম্বনপূর্বক কহিলেন—‘তপোধন, আপনি আমার হিতকামনায় যাহা কহিলেন তাহা বস্তুতঃ অকার্য, কিন্তু কর্তব্যবৎ প্রতীয়মান হইতেছে। আপনার বুদ্ধি বেদবিরোধিনী, আপনি ধর্মভ্রষ্ট নাস্তিক। আমার পিতা যে আপনাকে যাজকত্বে গ্রহণ করিয়াছিলেন আমি তাঁহার এই কার্যকে যথোচিত নিন্দা করি। বৌদ্ধ যেমন তস্করের ন্যায় দণ্ডার্হ, নাস্তিককেও তদ্রূপ দণ্ড করিতে হইবে। অতএব যাহাকে বেদবহিষ্কৃত বলিয়া পরিহার করা কর্তব্য, বিচক্ষণ ব্যক্তি সেই নাস্তিকের সঙ্গে সম্ভাষণও কবিবেন না।.....’

 জাবালি তখন বিনয়বচনে কহিলেন- ‘রাম, আমি নাস্তিক নহি, নাস্তিকের কথাও কহিতেছি না। আর পরলোক প্রভৃতি যে কিছুই নাই তাহাও নহে। আমি সময় বুঝিয়া নাস্তিক হই, আবার অবসরক্রমে আস্তিক হইয়া থাকি। যে কালে নাস্তিক হওয়া আবশ্যক সেই কাল উপস্থিত। এক্ষণে তোমাকে বন হইতে প্রতিনয়ন করিবার নিমিত্ত এইরূপ কহিলাম, এবং তোমাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্তই আবার তাহা প্রত্যাহার করিতেছি।’

 জাবালির কথা রামায়ণে এই পর্যন্ত আছে। যাহা নাই তাহা নিম্নে বর্ণিত হইল।


হর্ষি জাবালি ক্লান্তদেহে বিষণ্নচিত্তে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। সমস্ত পথ তাঁহাকে নীরবে অতিক্রম করিতে হইয়াছে, কারণ অন্যান্য ঋষিগণ তাঁহার সংস্রব প্রায় বর্জন করিয়াই চলিয়াছিলেন। খবট খল্লাট খালিত প্রভৃতি কয়েকজন ঋষি তাঁহাকে দূর হইতে নির্দেশ করিয়া বিদ্রূপ করিতেও ত্রুটি করেন নাই।

 অযোধ্যার বিপ্রগণ কেহই জাবালিকে শ্রদ্ধা করিতেন না। স্বয়ং রাজা দশরথ তাঁহার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলিয়া এ পর্যন্ত তাঁহাকে কোনও লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হয় নাই। কিন্তু এখন রামচন্দ্র কর্তৃক জাবালির প্রতিষ্ঠা নষ্ট হইয়াছে। সহযাত্রী বিপ্রগণের ব্যবহার দেখিয়া জাবালি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে তপ্ত তৈলমধ্যে মৎস্যের ন্যায় তাঁহার অযোধ্যায় বাস করা অসম্ভব হইবে।

 রামচন্দ্রের উপর জাবালির কিছুমাত্র ক্রোধ নাই, পরন্তু তিনি রামের ভবিষ্যতের জন্য কিঞ্চিৎ চিন্তান্বিত হইয়াছেন। ছোকরার বয়স মাত্র সাতাশ বৎসর, সাংসারিক অভিজ্ঞতা এখনও কিছুমাত্র জন্মে নাই। শাস্ত্রজীবী সভাপণ্ডিতগণ এবং মুনিপুংগব বিশ্বামিত্র— যিনি এককালে অনেক কীর্তি করিয়াছেন ইঁহারা যেরূপ ধর্মশিক্ষা দিয়াছেন, সরলস্বভাব রামচন্দ্র তাহাই চরম পুরুষার্থ বোধে গ্রহণ করিয়াছেন। বেচারাকে এর পর কষ্ট পাইতে হইবে। এইরূপ বিবিধ চিন্তা করিতে করিতে জাবালি অযোধ্যায় নিজ আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন।


গরের উপকণ্ঠে সরযূতীরে জাবালির পর্ণকুটীর। বেলা অবসান হইয়াছে। গোময়লিপ্ত পরিচ্ছন্ন অঙ্গনের এক পার্শ্বে পনসবৃক্ষতলে জাবালিপত্নী হিন্দ্রলিনী রাত্রের জন্য ভোজ্য প্রস্তুত করিতেছেন। নদীর পরপারবাসী নিষাদগণ যে মৃগমাংস পাঠাইয়াছিল তাহা শূলপক্ব হইয়াছে, এখন খানকয়েক মোটা মোটা পুরোডাশ সেঁকিলেই রন্ধন শেষ হয়। হিন্দ্রলিনী যবপিণ্ড থাসিতে থাসিতে নানাপ্রকার সাংসারিক ভাবনা ভাবিতে লাগিলেন। তাঁর এতখানি বয়স হইল, কিন্তু এ পর্যন্ত পুত্রমুখ দেখিলেন না। স্বামীর পুন্নাম নরকের ভয় নাই, পরলোকে পিণ্ডেরও ভাবনা নাই— ইহলোকে দু-বেলা নিয়মিত পিণ্ড পাইলেই তিনি সন্তুষ্ট। পোষ্যপুত্রেব কথা তুলিলে বলেন পুত্রের অভাব কি, যখন যাকে ইচ্ছা পুত্র মনে করিলেই হয়। কিবা কথার শ্রী! স্বামী যদি মানুষের মতন মানুষ হইতেন তাহা হইলে হিন্দ্রলিনীব অত খেদ থাকিত না। কিন্তু তিনি একটি সৃষ্টিবহির্ভূত লোক, কাহারও সহিত বনাইয়া চলিতে পারিলেন না। সাধে কি লোকে তাঁকে আড়ালে পাষণ্ড বলে! ত্রিসন্ধ্যা নাই, জপতপ নাই, অগ্নিহোত্র নাই, কেবল তর্ক করিয়া লোক চটাইতে পারেন। অমন যে রামচন্দ্র, ব্রাহ্মণ তাঁকেও চটাইয়াছেন। যতদিন দশবথ ছিলেন, অন্নবস্ত্রের অভাব হয় নাই। বৃদ্ধ রাজা স্ত্রৈণ ছিলেন বটে, কিন্তু নজরটা তাঁর উচ্চ ছিল। এখন কি হইবে ভবিতব্যতাই জানেন। ভরত তো নন্দিগ্রামে পাদুকাপূজা লইয়া বিব্রত। সচিব সুমন্ত্র এখন রাজকার্য দেখিতেছে; কিন্তু সে অত্যন্ত কৃপণ, ঘোড়ার বল্‌গা টানিয়া তার সকল বিষয়েই টানাটানি করা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। রাজবাটী হইতে যে সামান্য বৃত্তি পাওয়া যায় তাতে এই দুর্মূল্যের দিনে সংসার চলে না। হিন্দ্রলিনী তাঁর বাবার কাছে শুনিয়াছিলেন, সত্যযুগে এক কপর্দকে সাত কলস খাঁটী হৈয়ঙ্গবীন মিলিত, কিন্তু এই দগ্ধ ত্রেতাযুগৈ তিন কলস মাত্র পাওয়া যায়, তাও ভঁয়ষা। ঘৃতের জন্য জাবালির কিছু ঋণ হইয়াছে, কিন্তু শোধ করার ক্ষমতা নাই। নীবার ধান্য যা সঞ্চিত ছিল ফুরাইয়া আসিয়াছে, পরিধেয় জীর্ণ হইয়াছে, গৃহে অর্থাগম নাই, এদিকে জাবালি শত্রুসংখ্যা বাড়াইতেছেন। স্বামীর সংসর্গদোষে হিন্দ্রলিনীও অনাচারে অভ্যস্তা হইয়াছেন। অযোধ্যার নিষ্ঠাবতীগণ তাঁহাকে দেখিলে শূকরীর ন্যায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করে। হিন্দ্রলিনী আর সহ্য করিতে পারেন না, আজ তিনি আহারান্তে স্বামীকে কিছু কটুবাক্য শুনাইবেন।

 অঙ্গনের বাহিরে হুংকার করিয়া কে বলিল—‘হংহো জাবালে, হংহো!’ হিন্দ্রলিনী ত্রস্তা হইয়া দেখিলেন দশবার জন ক্ষুদ্রকায় ঋষি কুটীরদ্বারে দণ্ডায়মান। তাঁহাদের খর্ব বপু বিরল শ্মশ্রু ও স্ফীত উদর দেখিয়া হিন্দ্রলিনী বুঝিলেন তাঁহারা বালখিল্য মুনি।

 হিন্দ্রলিনী কহিলেন ‘হে মহাতপা মুনিগণ, আমার স্বামী সরযূতটে ধ্যানস্থ আছেন। তিনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবেন, আপনারা ততক্ষণ ঐ কুটীর-অলিন্দে আসন গ্রহণ করিয়া বিশ্রাম করুন।’

 বালখিল্যগণের অগ্রণী মহামুনি খর্বট কহিলেন ‘ভদ্রে, তোমার ঐ অলিন্দ ভূমি হইতে বিতস্তিত্রয় উচ্চ, আমরা নাগাল পাইব না। অতএব এই প্রাঙ্গণেই আসন পরিগ্রহ করিলাম, তুমি ব্যস্ত হইও না।’

 জাবালি তখন সরযূতীরে জম্বুবৃক্ষতলে আসীন হইয়া চিন্তা করিতেছিলেন এই অন্নজলাবলম্বী মানবশরীরে পঞ্চভূতের কিংবিধ সংস্থান হইলে সুবুদ্ধির উৎপত্তি হয় এবং কিরূপেই বা মূর্খতা জন্মে। অপরন্তু, লাঠ্যৌষধি দ্বারা দেহস্থ পঞ্চভূত প্রকম্পিত করিলে মূর্খতা অপগত হইয়া যে সুবুদ্ধির উদয় হয়, তাহা স্থায়ী কিনা। এই জটিল তত্ত্বের মীমাংসা কিছুতেই করিতে না পারিয়া অবশেষে জাবালি উঠিয়া পড়িলেন এবং আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন।

 জাবালি বালখিল্যগণকে কহিলেন — ‘অহো, আজ আমার কি সৌভাগ্য যে খর্বট খালিত প্রভৃতি মহামুনিগণ আমার এই আশ্রমে সমাগত! হে মুনিবৃন্দ, তোমাদের তো সর্বাঙ্গীণ কুশল? যাগযজ্ঞাদি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইতেছে তো? ঋষিভুক্ রাক্ষসগণ তোমাদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করে না তো? তোমাদের সেই কপিলা গাভীটির বাচ্চা হইয়াছে? রাজগুরু বশিষ্ঠ তোমাদের জন্য যথেষ্ট গব্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করিয়াছেন তো?’

 মহামুনি খর্বট দর্দুরধ্বনিবৎ গম্ভীরনাদে কহিলেন ‘জাবালে, ক্ষান্ত হও। আপ্যায়নের জন্য আমরা আসি নাই। তুমি পাপপঙ্কে আকণ্ঠ নিমগ্ন হইয়া আছ, আমরা তোমাকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছি। প্রায়োপবেশন চান্দ্রায়ণাদি দ্বারা তোমার কিছু হইবে না। আমরা অথর্বোক্ত পদ্ধতিতে তোমাকে অগ্নিশুদ্ধ করিব, তাহাতে তুমি অন্তে পরমা গতি প্রাপ্ত হইবে। তূষানল প্রস্তুত, তুমি আমাদের অনুগমন কর।’

 জাবালি বলিলেন— ‘হে খর্বট, তোমাদিগকে কে পাঠাইয়াছেন? রাজপ্রতিভূ ভরত, না রাজগুরু বশিষ্ঠ? আমার উদ্ধারসাধনের জন্য তোমরাই বা অত ব্যগ্র কেন? আমি অতি নিরীহ বানপ্রস্থাবলম্বী প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, কখনও কাহারও অনিষ্ট করি নাই, তোমাদের প্রাপ্য দক্ষিণারও অংশভাক্ হই নাই। তোমরা আমার পরকালের জন্য ব্যস্ত না হইয়া নিজ নিজ ইহকালের জন্য যত্নবান্ হও।’

 তখন অতিকোপনস্বভাব খল্লাট ঋষি অশ্বধ্বনিবৎ কম্পিতকণ্ঠে কহিলেন— ‘রে তপোধন, তুমি অতি দুরাচার ধর্মভ্রষ্ট নাস্তিক। তোমার বাসহেতু এই অযোধ্যাপুরী অশুচি হইয়াছে, ধর্মাত্মা বিপ্রগণ অতিষ্ঠ হইয়াছেন। আমরা ভরত বা বশিষ্ঠ কাহারও আজ্ঞাবাহী নহি। ব্রাহ্মণ্যের রক্ষাহেতু আমরা প্রজাপতি ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট হইয়াছি। তুমি আর বাক্যব্যয় করিও না, প্রস্তুত হও।’

 জাবালি বলিলেন— ‘হে বালখিল্যগণ, আমি স্বেচ্ছায় যাইব না। তোমরা আমাকে ব্রহ্মতেজোবলে উত্তোলন কর।’

 জাবালির শালপ্রাংশু বিরাট বপু দেখিয়া বালখিল্যগণ কিয়ৎক্ষণ নিম্নকণ্ঠে জল্পনা করিলেন। অবশেষে গলিতদন্ত খালিত মুনি স্খলিত স্বরে কহিলেন— ‘হে জাবালে, যদি তুমি অগ্নিপ্রবেশ করিতে নিতান্তই ভীত হইয়া থাক তবে প্রায়শ্চিত্তের নিষ্ক্রয়স্বরূপ তিন শূর্প তিল ও শত নিষ্ক কাঞ্চন প্রদান কর। আমরা যথাবিহিত যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা তোমাকে পাপমুক্ত করিব।’

 জাবালি কহিলেন— ‘আমার এক কপর্দকও নাই, থাকিলেও দিতাম না।’

 তখন খবট খল্লাট খালিতাদি মুনিগণ সমস্বরে কহিলেন— ‘রে নরাধম, তবে আমরা অভিসম্পাত করিতেছি শ্রবণ কর। সাক্ষী চন্দ্র সূর্য তারা, সাক্ষী দেবগণ পিতৃগণ দিক্‌পালগণ বর্ষট্‌কারগণ—’

 জাবালি বলিলেন— ‘শৌণ্ডিকের সাক্ষী মদ্যপ, তস্করের সাক্ষী গ্রন্থিচ্ছেদক। হে বালখিল্যগণ, বৃথা দেবতাগণকে আহ্বান করিতেছ, তাঁহারা আসিবেন না। বরং তোমরা জুজুগণ ও কর্ণকর্তকগণকে স্মরণ কর।’

 হিন্দ্রলিনী বলিলেন- ‘হে আর্যপুত্র, তুমি কেন এই অল্পায়ু অপোগণ্ড অকালপক্ব কুষ্মাণ্ডগণের সঙ্গে বাক্‌বিতণ্ডা করিতেছ, উহাদিগকে খেদাইয়া দাও।’

 বালখিল্যগণ কহিলেন— ‘রে রে রে রে—’

 জাবালি তখন তাঁহার বিশাল ভুজদ্বয়ে বালখিল্যগণকে একে একে তুলিয়া ধরিয়া প্রাঙ্গণবেষ্টনীর পরপারে ঝুপ ঝুপ করিয়া নিক্ষেপ করিলেন।


বালখিল্যগণ প্রস্থান করিলে জাবালি বলিলেন— ‘প্রিয়ে, আমাদের আর অযোধ্যায় বাস করা চলিবে না, কখন কোন দিক হইতে উৎপাত আসিবে তাহার স্থিরতা নাই। অতএব কল্য প্রত্যুষেই আমরা এই আশ্রম ত্যাগ করিয়া দূরে কোনও নিরুপদ্রব স্থানে যাত্রা করিব।’

 পরদিন উষাকালে সস্ত্রীক জাবালি অযোধ্যা ত্যাগ করিলেন। কয়েকজন অনুগত নিষাদ তাঁহাদের সামান্য গৃহোপকরণ বহন করিয়া অগ্রে অগ্রে পথপ্রদর্শনপূর্বক চলিল। মাসাধিক কাল তাঁহারা নানা জনপদ গিরি নদী বনভূমি অতিক্রম করিয়া অবশেষে হিমালয়ের সানুদেশে শতদ্রুতীরে এক রমণীয় উপত্যকায় উপস্থিত হইলেন। জাবালি তথায় পুর্ণকুটীর রচনা করিয়া সুখে বাস করিতে লাগিলেন। পর্বতবাসী কিরাতগণ তাঁহার বিশাল দেহ, নিবিড় শ্মশ্রু ও মধুর সদয় ব্যবহার দেখিয়া মুগ্ধ হইল এবং নানাপ্রকার উপঢৌকন দ্বারা সংবর্ধনা করিল। জাবালি তথায় বিবিধ দুরূহ তত্ত্বসমূহের অনুসন্ধানে নিবিষ্ট রহিলেন এবং অবসরকালে শতদ্রু নদীতে মৎস্য ধরিয়া চিত্তবিনোদন করিতে লাগিলেন।


দেবতাগণের খ্যাতি আছে—তাঁহারা অন্তর্যামী। কিন্তু বস্তুতঃ তাঁহাদিগকেও সাধারণ মনুষ্যের ন্যায় গুজবের উপর নির্ভর করিয়া কাজ করিতে হয় এবং তাহার


ফলে জগতে অনেক অবিচার ঘটিয়া থাকে। অচিরে দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট সমাচার আসিল যে মহাতেজা জাবালি মুনি শতদ্রুতীরে কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন আছেন,— তাঁহার অভিসন্ধি কি তাহা এখনও সম্যক্ অবধারিত হয় নাই, তবে সম্ভবতঃ তিনি ইন্দ্রত্ব বিষ্ণুত্ব কিংবা ঐরূপ কোনও একটা পরমপদ আয়ত্ত না করিয়া ছাড়িবেন না। দেবরাজ চিন্তিত হইয়া আজ্ঞা দিলেন— ‘উর্বশীকে ডাক।’


 মাতলি আসিয়া করজোড়ে নিবেদন করিলেন —‘হে দেবেন্দ্র, উর্বশী আর মর্তলোকে অবতীর্ণ হইতে চাহে না—’

 ইন্দ্র কহিলেন— ‘হুঁ, তার ভারি তেজ হইয়াছে।’

 দেবর্ষি নারদ কহিলেন— ‘মর্ত্যের কবিগণই স্তুতি করিয়া তাহার মস্তকটি ভক্ষণ করিয়াছেন। এখন কিছুকাল তাহাকে বিরাম দাও, দিনকতক অমরাবতীতে আবদ্ধ থাকিলে আপনিই সে মর্ত্যলোকে যাইবার জন্য আবদার ধরিবে। জাবালির জন্য অন্য কোনও অপ্সরা পাঠাও।’

 মাতলি বলিলেন— ‘মেনকা তার কন্যাকে দেখিতে গিয়াছে। তিলোত্তমাকে অশ্বিনীকুমারদ্বয় এখনও তিন মাস বাহির হইতে দিবেন না। অলম্বুষার পা মচকাইয়াছে, নাচিতে পারিবে না। অষ্টাবক্র মুনি দেবগণের উপর বিমুখ হইয়া বাঁকিয়া বসিয়াছেন, রম্ভা তাঁহাকে সিধা করিতে গিয়াছে। নাগদত্তা হেমা সোমা প্রভৃতি তিন শত অপ্সরাকে লঙ্কেশ্বর রাবণ অপহরণ করিয়াছেন। বাকী আছে কেবল মিশ্রকেশী ও ঘৃতাচী।’

 ইন্দ্র বিরক্ত হইয়া বলিলেন— ‘আমাকে না জানাইয়া কেন অপ্সরাগণকে যত্র তত্র পাঠানো হয়? মিশ্রকেশী ঘৃতাচীর বয়স হইয়াছে, তাহাদের দ্বারা কিছু হইবে না।’

 নারদ বলিলেন— ‘হে ইন্দ্র, সেজন্য চিন্তা করিও না। জাবালিও যুবা নহেন। একটু গৃহিণী-বাহিনী-জাতীরা অপ্সরাই তাঁহাকে ভালরকম বশ করিতে পারিবে।’

 ইন্দ্র বলিলেন— ‘মিশ্রকেশীর চুল পাকিয়াছে, সে থাক। ঘৃতাচীকে পাঠাইবার ব্যবস্থা কর। তাহাকে একপ্রস্থ সূক্ষ্ম চীনাংশুক ও যথোপযুক্ত অলংকারাদি দাও। বায়ু, তুমি মৃদুমন্দ বহিবে। শশধর, তুমি মন্দাকিনীতে স্নান করিয়া উজ্জ্বল হইয়া লও। কন্দর্প, তুমি সেই অভ্রের পোশাকটা পরিয়া যাইবে, আবার যাতে ভন্ম না হও। বসন্ত, তুমি সঙ্গে এক শত কোকিল লইবে।’

 নারদ বলিলেন— ‘আর এক শত বন্যকুকুট। ঋষি বড়ই মাংসাশী।’

 ইন্দ্র বলিলেন —‘আচ্ছা, তাহাও লইবে। আর দশ কুম্ভ ঘৃত, দশ স্থালী দধি, দশ দ্রোণী গুড় এবং অন্যান্য ভোজ্যসম্ভার। যেমন করিয়া হউক জাবালির ধ্যান ভঙ্গ করা চাই।’

 সমস্ত আয়োজন শেষ হইলে ঘৃতাচী জাবালিবিজয়ে যাত্রা করিলেন।


জাবালির তপোবনে তখন ঘোর বর্ষা। মেঘে পর্বতে একাকার হইয়া দিগন্তে নিবিড় প্রাচীর রচনা করিয়াছে। শতদ্রুর গৈরিকবর্ণ জলে পালে পালে মৎস্য বিচরণ করিতেছে। বনে ভেকবংশের চতুর্প্রহরব্যাপী মহোৎসব চলিতেছে।

 সন্ধ্যার প্রাক্‌কালে ঘৃতাচী অনুচরবর্গসহ জাবালির আশ্রমে পৌঁছিলেন। আক্রমণের উদ্‌যোগ করিতে তাঁহাদের কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না, কারণ বহুবার এইরূপ অভিযান করিয়া তাঁহারা পরিপক্ব হইয়াছেন। নিমেষের মধ্যে মেঘ দূরীভূত হইল, মলয়ানিল বহিতে লাগিল, শতদ্রুর স্রোত মন্দীভূত হইল, নির্মল আকাশে পূর্ণচন্দ্র উঠিল, পাদপসকল পুষ্পস্তবকে ভূষিত হইল, অলিকুল গুঞ্জরিতে লাগিল, ভেকগণ নীরব হইয়া পল্বলে লুকাইল।

 জাবালি শতদ্রুতীরে ছিপহস্তে নিবিষ্টমনে মাছ ধরিতেছিলেন। আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তিনি বিচলিত হইয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। সহসা ঋতুরাজ বসন্তের খোঁচা খাইয়া নিদ্রাতুর কোকিলকুল আকুল চিৎকার করিয়া উঠিল। জাবালি চমকিত হইয়া পিছন ফিবিয়া দেখিলেন, এক অপূর্ব রূপলাবণ্যবর্তী দিব্যাঙ্গনা কটিতটে বামকর, চিবুকে দক্ষিণকর নিবদ্ধ করিয়া নৃত্য করিতেছে।

 ধীমান্ জাবালি সমস্ত ব্যাপারটি চট করিয়া হৃদয়ংগম করিলেন। ঈষৎ হাস্যে বলিলেন— ‘অয়ি বরাঙ্গনে, তুমি কে, কি নিমিত্তই বা এই দুর্গম জনশূন্য উপত্যকায় আসিয়াছ? তুমি নৃত্য সংবরণ কর। এই সৈকতভূমি অতিশয় পিচ্ছিল ও উপলবিষম। যদি আছাড় খাও তবে তোমার ঐ কোমল অস্থি আস্ত থাকিবে না।’

 অপাঙ্গে বিলোল কটাক্ষ স্ফুরিত করিয়া ঘৃতাচী কহিলেন— ‘হে ঋষিশ্রেষ্ঠ, আমি ঘৃতাচী স্বর্গাঙ্গনা। তোমাকে দেখিয়া বিমোহিত হইয়াছি, তুমি প্রসন্ন হও। এই সমস্ত দ্রব্যসম্ভার তোমারই। এই ঘৃতকুম্ভ দধিস্থালী গুড়দ্রোণী— সকলই তোমার। আমিও তোমার। আমার যা কিছু আছে- নাঃ থাক।’ —এই পর্যন্ত বলিয়া লজ্জাবতী ঘৃতাচী ঘাড় নীচু করিলেন।

 জাবালি বলিলেন— ‘অয়ি কল্যাণি, আমি দীনহীন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। গৃহিণীও বর্তমানা। তোমার তুষ্টি বিধান করা আমার সাধ্যের অতীত। অতএব তুমি ইন্দ্রালয়ে ফিরিয়া যাও। অথবা যদি তোমার নিতান্তই মুনিঋষির প্রতি ঝোঁক হইয়া থাকে তবে অযোধ্যায় গমন কর। তথায় খর্বট খল্লাট খালিতাদি মুনিগণ আছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁকে ইচ্ছা এবং যতগুলিকে ইচ্ছা তুমি হেলায় তর্জনীহেলনে নাচাইতে পারিবে। আর যদি তোমার অধিকতর উচ্চাভিলাষ থাকে তবে ভার্গব


দুর্বাসা কৌশিক প্রভৃতি অনলসংকাশ উগ্রতেজা মহর্ষিগণকে জব্দ করিয়া যশস্বিনী হও। আমাকে ক্ষমা দাও।’


 ঘৃতাচী কহিলেন ‘হে জাবালে, তুমি নিতান্তই নীরস। তোমার ঐ বিপুল দেহ কি বিধাতা শুষ্ক কাষ্ঠে নির্মাণ করিয়াছেন? তুমি দীনহীন তাতে ক্ষতি কি, আমি তোমাকে কুবেরের ঐশ্বর্য আনিয়া দিব। ব্রাহ্মণীকে বাবাণসী প্রেরণ কর। তিনি নিশ্চয়ই লোলাঙ্গী বিগতযৌবনা। আর আমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত কর,— চিরযৌবনা, নিটোলা, নিখুঁতা। উর্বশী মেনকা পর্যন্ত আমাকে দেখিয়া ঈর্ষায় ছটফট করে।

 জাবালি সহাস্যে কহিলেন— ‘হে সুন্দরি, কিছু মনে করিও না। তুমিও নিতান্ত খুকীটি নহ। তোমার মুখের লোধ্ররেণু ভেদ করিয়া কিসের রেখা দেখা যাইতেছে? তোমার চোখের কোলে ও কিসের অন্ধকার? তোমার দন্তপঙ্‌ক্তিতে ও কিসের ফাঁক?’

 ঘৃতাচী সরোষে কহিলেন— “হে মূর্খ, তুমি নিশ্চয়ই রাত্র্যন্ধ, তাই অমন কথা বলিতেছ। পথশ্রমের ক্লান্তিহেতু আমার লাবণ্য এখন সম্যক্ স্ফুর্তি পাইতেছে না। আগে সকাল হোক, আমি দুধের সর মাখিয়া চান করি, তখন দেখিও, মুণ্ড ঘুরিয়া যাইবে’—এই বলিয়া ঘৃতাচী আবার নৃত্য শুরু করিলেন।

 অদূরবর্তী দেবদারুবৃক্ষের অন্তরালে থাকিয়া জাবালিপত্নী সমস্ত দেখিতেছিলেন। ঘৃতাচীর দ্বিতীয়বার নৃত্যারম্ভে তিনি আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না, সম্মার্জনীহস্তে ছুটিয়া আসিয়া ঘৃতাচীর পৃষ্ঠে ঘা-কতক বসাইয়া দিলেন।

 তখন কন্দর্প বসন্ত শশধর মলয়ানিল সকলেই মহাভয়ে ব্যাকুল হইয়া বেগে পলায়ন করিলেন। আকাশ আবার জলদজালে আচ্ছন্ন হইল, দিঙ্‌মণ্ডল তিমিরাবৃত হইল, কোকিলকুল ঢুলিতে লাগিল, মধুকরনিকর উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া পরস্পরকে দংশন করিতে লাগিল, শতদ্রু স্ফীত হইল, ভেককুল মহা উল্লাসে বিকট কোলাহল করিয়া উঠিল।

 জাবালি পত্নীকে কহিলেন— ‘প্রিয়ে, স্থিরা ভব। ইনি স্বর্গাঙ্গনা ঘৃতাচী, ইন্দ্রের আদেশে এখানে আসিয়াছেন— ইঁহার অপরাধ নাই।’

 হিন্দ্রলিনী কহিলেন— ‘হলা দগ্ধাননে নির্লজ্জে ঘেঁচী, তোর আস্পর্ধা কম নয় যে আমার স্বামীকে বোকা পাইয়া ভুলাইতে আসিয়াছিস! আর, ভো অজ্জউত্ত, তোমারই বা কি প্রকার আক্কেল যে এই উৎকপালী বিড়ালাক্ষী মায়াবিনীর সহিত বিজনে বিশ্রম্ভালাপ করিতেছিলে!’

 জাবালি তখন সমস্ত ব্যাপার বিবৃত করিয়া অতি কষ্টে পত্নীকে প্রসন্না করিলেন এবং রোরুদ্যমানা ঘৃতাচীকে বলিলেন— ‘বৎসে, তুমি শান্ত হও। হিন্দ্রলিনী তোমার পৃষ্ঠে কিঞ্চিৎ ইঙ্গুদীতৈল মর্দন করিয়া দিলেই ব্যথার উপশম হইবে। তুমি আজ রাত্রে আমার কুটীরেই বিশ্রাম কর। কল্য অমরাবতীতে ফিরিয়া গিয়া দেবরাজ ইন্দ্রকে আমার প্রীতিসম্ভাষণ এবং ঘৃত-দধি-গুড়াদির জন্য বহু ধন্যবাদ জানাইও।’

 ঘৃতাচী কহিলেন— ‘তিনি আমার মুখদর্শন করিবেন না। হা, এমন দুর্দশা আমার কখনও হয় নাই।’

 জাবালি বলিলেন— ‘তোমার কোনও ভয় নাই। তুমি দেবেন্দ্রকে জানাইও যে ইন্দ্রত্বের উপর আমার কিছুমাত্র লোভ নাই, তিনি স্বচ্ছন্দে স্বর্গরাজ্য ভোগ করিতে থাকুন।’


ঘৃতাচীর পরাভব শুনিয়া দেবরাজ ইন্দ্র নারদকে কহিলেন— ‘হে দেবর্ষে, এখন কি করা যায়? জাবালি ইন্দ্রত্ব চাহেন না জানিয়াও আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছি না। জনরব শুনিতেছি যে ঐ দুর্দান্ত ঋষি সমস্ত দেবতাকেই উড়াইয়া দিতে চায়।’

 নারদ কহিলেন— ‘পুরন্দর, তুমি চিন্তিত হইও না। আমি যথোচিত ব্যবস্থা করিতেছি।’

নৈমিষারণ্যে সনকাদি ঋষিগণের সকাশে দেবর্ষি নারদ আসিয়া জিজ্ঞাসিলেন— ‘হে মুনিগণ, শাস্ত্রে উক্ত আছে, সত্যযুগে পুণ্য চতুষ্পাদ, পাপ নাস্তি। কিন্তু এই ত্রেতাযুগে পুণ্য ত্রিপাদ মাত্র এবং একপাদ পাপও দেখা গিয়াছে। ইহার হেতু কি তোমরা তাহা চিন্তা করিয়া দেখিয়াছ কি?’

 মুনিগণ বলিলেন ‘আশ্চর্য, উহা আমরা কেহই ভাবিয়া দেখি নাই।’

 নারদ বলিলেন ‘তবে তোমাদের যাগযজ্ঞ জপতপ সমস্তই বৃথা।’ ইহা কহিয়া তিনি তাঁহার কাষ্ঠবাহনে আরোহণপূর্বক ব্রহ্মার নিকট অপর এক ষড়যন্ত্র করিতে প্রস্থান করিলেন।

 মুনিগণ নারদীয় প্রশ্নের মীমাংসা করিতে না পারিয়া এক মহতী সভা আহ্বান করিলেন। জন্তু, প্লক্ষ, শাল্মলী প্লবাদি সপ্তদীপ হইতে বিবিধ শাস্ত্রজ্ঞ বিপ্রগণ নৈমিষারণ্যে সমবেত হইলেন। মহর্ষি জাবালিও আমন্ত্রিত হইয়া আসিলেন।

 অনন্তর সকলে আসন গ্রহণ করিলে সভাপতি দক্ষ প্রজাপতি কহিলেন ‘ভো পণ্ডিতবর্গ, সত্যযুগে পুণ্য চতুষ্পাদ ছিল, এখন তাহা ত্রিপাদ হইয়াছে। কেন এমন হইল এবং ইহার প্রতিকার কি, যদি তোমরা কেহ অবগত থাক তবে প্রকাশ করিয়া বল।’

 তখন জ্বলন্ত পাবকতুল্য তেজস্বী জামদগ্ন্য মুনি কহিলেন— ‘হে প্রজাপতে, এই পাপাত্মা জাবালিই সমস্ত অনিষ্টের মূল। উহার সংস্পর্শে বসুন্ধরা ভারগ্রস্তা হইয়াছেন।’

 সভাস্থ পণ্ডিতমণ্ডলী বলিলেন— ‘ঠিক, ঠিক, আমরা তাহা অনেকদিন হইতেই জানি।’

 জামদগ্ন্য কহিলেন— ‘এই জাবালি ভ্রষ্টাচার উন্মার্গগামী নাস্তিক। ইহার শাস্ত্র নাই, মার্গ নাই। রামচন্দ্রকে এই পাষণ্ডই সত্যধর্মচ্যুত করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। বালখিল্যগণকে এই দুরাত্মাই নির্যাতিত করিয়াছে। দেবরাজ পুরন্দরকেও এই পাপিষ্ঠ হাস্যাস্পদ করিয়াছে। ইহাকে বধ না করিলে পুণ্যের নষ্টপাদ উদ্ধার হইবে না।’

 পণ্ডিতগণ কহিলেন ‘আমরাও ঠিক তাহাই ভাবিতেছিলাম।’

 দক্ষ প্রজাপতি কহিলেন— ‘হে জাবালে, সত্য করিয়া কহ তুমি নাস্তিক কিনা। তোমার মার্গ কি, শাস্ত্রই বা কি।’

 জাবালি বলিলেন— ‘হে সুধীবৃন্দ, আমি নাস্তিক কি আস্তিক তাহা আমি নিজেই জানি না। দেবতাগণকে আমি নিষ্কৃতি দিয়াছি, আমার তুচ্ছ অভাব-অভিযোগ জানাইয়া তাঁহাদিগকে বিব্রত করি না। বিধাতা যে সামান্য বুদ্ধি দিয়াছেন তাহারই বলে কোনও প্রকারে কাজ চালাইয়া লই। আমার মার্গ যত্র তত্র, আমার শাস্ত্র অনিত্য, পৌরুষেয়, পরিবর্তনসহ।’

 দক্ষ কহিলেন — ‘তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিলাম না।’

 জাবালি বলিলেন— ‘হে ছাগমুণ্ড দক্ষ, তুমি বুঝিবার বৃথা চেষ্টা করিও না। আমি এখন চলিলাম। বিপ্রগণ, তোমাদের জয় হউক।’

 তখন সভায় ভীষণ কোলাহল উত্থিত হইল এবং ধর্মপ্রাণ বিপ্রগণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। কয়েকজন জাবালিকে ধরিয়া ফেলিলেন। জামদগ্ন্য তাঁহার তীক্ষ্ণ কুঠার উদ্যত করিয়া কহিলেন— ‘আমি একবিংশতিবার ক্ষত্রিয়কুল নিঃশেষ করিয়াছি, এইবার এই নাস্তিককে সাবাড় করিব।’

 স্থিরপ্রজ্ঞ দক্ষ প্রজাপতি কহিলেন— ‘হাঁ হাঁ কর কি, ব্রাহ্মণের দেহে অস্ত্রাঘাত! ছি ছি, মনু কি মনে করিবেন! বরং উহাকে হলাহল প্রয়োগে বধ কর।’

 দেবর্ষি নারদ এতক্ষণ অলক্ষ্যে বসিয়াছিলেন। এখন আত্মপ্রকাশ করিয়া কহিলেন— ‘আমার কাছে বিশুদ্ধ চৈনিক হলাহল আছে। তাহা সর্ষপপ্রমাণ সেবনে দিব্যজ্ঞান লাভ হয়, দুই সর্ষপে বুদ্ধিভ্রংশ, চতুর্মাত্রায় নরকভোগ, এবং অষ্টমাত্রায় মোক্ষলাভ হয়। জাবালিকে চতুর্মাত্রা সেবন করাও; সাবধান, যেন অধিক না হয়।’

 মহাচীন হইতে আনীত কৃষ্ণবর্ণ হলাহল জলে গুলিয়া জাবালিকে জোর করিয়া খাওয়ানো হইল। তাহার পর তাঁহাকে গভীর অরণ্যে নিক্ষেপ করিয়া ত্রিলোকদর্শী পণ্ডিতগণ কহিলেন ‘পাষণ্ড এতক্ষণে কুম্ভীপাকে পৌঁছিয়াছে।’


চৈনিক হলাহল জাবালির মস্তিষ্কে ক্রমশঃ প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিল।

 জাবালি যজ্ঞের নিমন্ত্রণে বহুবার সোমরস পান করিয়াছেন; প্রথম যৌবনে বয়স্থ্য ক্ষত্রিয়কুমারগণের পাল্লায় পড়িয়া গৌড়ী মাধ্বী পৈষ্টী প্রভৃতি আসবও চাখিয়া দেখিয়াছেন; ছেলেবেলায় মামার বাড়িতে একযার ভৃগুমামার সঙ্গে চুরি করিয়া ফেনিল তালরসও খাইয়াছিলেন, কিন্তু এমন প্রচণ্ড নেশা পূর্বে তাঁহার কখনও হয় নাই। জাবালির সকল অঙ্গ নিশ্চল হইয়া আসিল, তালু শুষ্ক হইল, চক্ষু ঊর্ধ্বে উঠিল, বাহজ্ঞান লোপ পাইল।

 সহসা জাবালি অনুভব করিলেন— তিনি রক্তচন্দনে চর্চিত হইয়া রক্তমাল্যধারণপূর্বক গর্দভযোজিত রথে দক্ষিণাভিমুখে দ্রুতবেগে নীয়মান হইতেছেন। রক্তবসনা পিঙ্গলবর্ণা কামিনী তাহাকে দেখিয়া হাসিতেছে এবং বিকৃতবদনা রাক্ষসী তাঁহার রথ আকর্ষণ করিতেছে। ক্রমে বৈতরণী পার হইয়া তিনি যমপুরীর দ্বারে উপনীত হইলেন। তথায় যমকিংকরগণ তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া ধর্মরাজের সকাশে লইয়া গেল।

 যম কহিলেন ‘জাবালে, স্বাগতোসি, আমি বহুদিন তোমার প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। তোমার পারলৌকিক ব্যবস্থা আমি যথোচিত করিয়া রাখিয়াছি, এখন আমার অনুগমন কর। দূরে ঐ যে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গবাক্ষহীন অগ্ন্যুদ্‌গারী সৌধমালা দেখিতেছ, উহাই বৌরব; ইতরপ্রকৃতি পাপিগণ তথায় বাস করে। আর সম্মুখে এই যে গগনচুম্বী তাম্রচূড় রক্তবর্ণ অলিন্দপরিবেষ্টিত আয়তন, ইহাই কুম্ভীপাক: সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণ এখানে অবস্থান করেন। তোমার স্থান এখানেই নির্দিষ্ট হইয়াছে, ভিতরে চল।


 অনন্তর ধর্মরাজ যম জাবালিকে কুম্ভীপাকের গর্ভমণ্ডপে লইয়া গেলেন। এই মণ্ডপ বহুযোজনবিস্তৃত, উচ্চচ্ছাদ, বাষ্পসমাকুল, গম্ভীর আরাবে বিধূনিত। উভয় পার্শ্বে জ্বলন্ত চুল্লীর উপর শ্রেণীবদ্ধ অতিকায় কুম্ভসকল সজ্জিত আছে, তাহা হইতে নিরন্তর শ্বেতবর্ণ বাষ্প ও আর্তনাদ উত্থিত হইতেছে। নীলবর্ণ যমকিংকরগণ ইন্ধননিক্ষেপের জন্য মধ্যে মধ্যে চুল্লীদ্বার খুলিতেছে, জ্বলন্ত অনলচ্ছটায় তাহাদের মুখ উল্কাপিণ্ডের ন্যায় উদ্ভাসিত হইতেছে।

 কৃতান্ত কহিলেন— ‘হে মহর্ষে, এই যে রজতনির্মিত কিংকিণীজালমণ্ডিত সুবৃহৎ কুম্ভ দেখিতেছে, ইহাতে নহুষ যযাতি দুষ্মন্ত প্রভৃতি মহাযশা মহীপালগণ পরিপক্ক হইতেছেন। ইঁহারা প্রায় সকলেই সংশোধিত হইয়া গিয়াছেন, কেবল যযাতির কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। আর এক প্রহরের মধ্যে সকলেই বিগতপাপ হইয়া অমরাবতীতে গমন করিবেন। ঐ যে বৈদূর্যখচিত হিরণ্ময় কুম্ভ দেখিতেছ, উহার তপ্ত তৈলে ইন্দ্রাদি দেবগণ মধ্যে মধ্যে অবগাহন করিয়া থাকেন। গৌতমের অভিশাপের পরে সহস্রাক্ষ পুরন্দরকে বহুকাল এই কুম্ভমধ্যে বাস করিতে হইয়াছিল। নিরবচ্ছিন্ন অগ্নিপ্রয়োগে ইহার তলদেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে। এই যে রুদ্রাক্ষমালাবেষ্টিত গৈরিকবর্ণ প্রকাণ্ড কুম্ভ দেখিতেছ, ইহার অভ্যন্তরে ভাগব দুর্বাসা কৌশিক প্রভৃতি উগ্রতপা মহর্ষিগণ সিদ্ধ হইতেছেন।’

 জাবালি কৌতূহলপরবশ হইয়া বলিলেন— ‘হে ধর্মরাজ, কুম্ভের ভিতরে কি হইতেছে দয়া করিয়া আমাকে দেখাও।’

 ধর্মরাজের আজ্ঞা পাইয়া জনৈক যমকিংকর কুম্ভের আবরণী উন্মুক্ত করিল। যম তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ দারুময় দর্বী নিমজ্জিত করিয়া সন্তর্পণে উত্তোলিত করিলেন। সিক্তজটাজূট ধুমায়িতকলেবর কয়েকজন ঋষি দর্বীতে সংলগ্ন হইয়া উঠিলেন এবং যজ্ঞোপবীত ছিঁড়িয়া অভিসম্পাত আরম্ভ করিলেন ‘রে নারকী যমরাজ, যদি আমাদের কিঞ্চিদপি তপঃপ্রভাব থাকে—’

 দর্বী উল্টাইয়া কুম্ভের ঢাকনি ঝটিতি বন্ধ করিয়া যম কহিলেন— ‘হে ‘জাবালে, এই কোপনস্বভাব ঋষিগণের কাঠিন্য দূর হইতে এখনও বহু বিলম্ব আছে। উঁহাবা আরও অষ্টাহকাল পরিসিদ্ধ হইতে থাকুন।’

 এমন সময় কয়েকজন যমদূতের সহিত খর্বট খল্লাট খালিত বিষণ্নবদনে কুম্ভীপাকের গর্ভগৃহে প্রবেশ করিলেন।

 জাবালি কহিলেন— ‘হে ভ্রাতৃগণ, তোমরা এখানে কেন, ব্রহ্মলোকে কি স্থানাভাব ঘটিয়াছে?’

 খর্বট উত্তর দিলেন— ‘জাবালে, তুমি বিরক্ত করিও না, আমরা এখানে তদারক করিতে আসিয়াছি।’


 যমরাজের ইঙ্গিতে কিংকরগণ বালখিল্যত্রয়কে একত্র বাঁধিয়া উত্তপ্ত পঞ্চগব্যপূর্ণ এক ক্ষুদ্রকায় কুম্ভে নিক্ষেপ করিল। কুম্ভ হইতে তীব্র চিৎকার উঠিল এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্বতান্তের বাপান্তকর বাক্যসমূহ নির্গত হইতে লাগিল। ধর্মরাজ কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান করিয়া সরিয়া আসিয়া বলিলেন ‘হে মহর্ষে, এই নরকের অনুষ্ঠানসকল অতিশয় অপ্রীতিকর, কেবল বিপন্না ধরিত্রীর রক্ষাহেতুই আমাকে সম্পন্ন করিতে হয়। যাহা হউক, আমি আর তোমার মূল্যবান্ সময় নষ্ট করিব না, এখন তোমার প্রতি আমার যাহা কর্তব্য তাহাই পালন করিব। দেখ, যে পাপ মনের গোচর তাহা আমি সহজেই দূর করিতে পারি। কিন্তু যাহা মনের অগোচর, তাহা জন্মজন্মান্তরেও সংক্রমিত হয়, এবং তাহা শোধন করিতে হইলে কুম্ভীপাকে বার বার নিষ্কাশন আবশ্যক। তোমার যাহা কিছু দুষ্কৃত আছে তাহা তুমি জানিয়া শুনিয়াই দৌর্বল্যবশাৎ করিয়া ফেলিয়াছ, কদাপি আত্মপ্রবঞ্চনা কর নাই। সুতরাং আমি তোমাকে সহজেই পাপমুক্ত করিতে পারিব, অধিক যন্ত্রণা দিব না।

 এই বলিয়া কৃতান্ত জাবালিকে সুবৃহৎ লৌহসংদংশে বেষ্টিত করিয়া একটি তপ্ত তৈলপূর্ণ কুম্ভে নিক্ষেপ করিলেন। ছ্যাঁক করিয়া শব্দ হইল।


হস্র বিহগকাকলিতে বনভূমি সহসা ঝংকৃত হইয়া উঠিল। প্রাচীদিক্ নবারুণকিরণে আরক্ত হইয়াছে। জাবালি চৈতন্য লাভ করিয়া সাধ্বী হিন্দ্রলিনীর অঙ্ক হইতে ধীরে ধীরে মস্তক উত্তোলন করিয়া দেখিলেন— সম্মুখে লোকপিতামহ ব্রহ্মা প্রসন্নবদনে মৃদুমধুর হাস্য করিতেছেন।

 ব্রহ্মা বলিলেন— ‘বৎস, আমি প্রীত হইয়াছি। তুমি ইচ্ছানুযায়ী বর প্রার্থনা কর।’

 জাবালি বলিলেন— ‘হে চতুরানন, ঢের হইয়াছে। আর বরে কাজ নাই। আপনি সরিয়া পড়ুন, আর ভেংচাইবেন না।’

 ব্রহ্মা তাঁহার ভুর্জপত্ররচিত ছদ্মমুখ মোচন করিয়া কহিলেন— ‘জাবালে, অভিমান সংবরণ কর। তুমি বর না চাহিলেও আমি ছাড়িব কেন? আমিও প্রার্থী। হে স্বাবলম্বী মুক্তমতি যশোবিমুখ তপস্বী, তুমি আর দুর্গম অরণ্যে আত্মগোপন করিও না, লোকসমাজে তোমার মন্ত্র প্রচার কর। তোমার যে ভ্রান্তি আছে তাহা অপনীত হউক, অপরের ভ্রান্তিও তুমি অপনয়ন কর। তোমাকে কেহ বিনষ্ট করিবে না, অপরেও যেন তোমার দ্বারা বিনষ্ট না হয়। হে মহাত্মন্, তুমি অমরত্ব লাভ করিয়া যুগে যুগে লোকে লোকে মানবমনকে সংস্কারের নাগপাশ হইতে মুক্ত করিতে থাক।

 জাবালি বলিলেন— ‘তথাস্তু।’

  1. বাল্মীকি রামায়ণ। অযোধ্যাকাণ্ড। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য কৃত অনুবাদ।