কজ্জলী/স্বয়ংবরা

উইকিসংকলন থেকে

চাটুজ্যেমশায় পাঁজি দেখিয়া বলিলেন—'বাত্রি ন-টা সাতান্ন মিনিট গতে অম্বুবাচী নিবৃত্তি। আগে এই বৃষ্টি থামবে না। এখন তো সবে সন্ধো।'

 বিনোদ উকিল বলিলেন— 'তাই তো, বাসায় ফেরা যায় কি ক'রে।'

 গৃহস্বামী বংশলোচনবাবু বলিলেন- ‘বৃষ্টি থামলে সে চিন্তা ক'রো। আপাতত এখানেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হোক। উদো, ব’লে আয তো বাড়ির ভেতব।'  চাটুজ্যে বলিলেন ‘মসুর ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ-ভাজা।

 বিনোদবাবু তাকিয়াটা টানিয়া লইয়া বলিলেন— তা তো হ’ল, কিন্তু ততক্ষণ সময় কাটে কিসে। চাটুজ্যে-মশায়, একটা গল্প বলুন।'

 চাটুজ্যে ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন— 'আর- বছর মুঙ্গেরে থাকতে আমি এক বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম।'

 বিনোদবাবু বাধা দিয়া বলিলেন – 'দোহাই চাটুজ্যে-মশায়, বাঘের গল্প আর নয়।'

 চাটুজ্যে একটু ক্ষুন্ন হইয়া বলিলেন—'তবে কিসের কথা বলব, ভূতের না সাপের?'

 —'এই বর্ষায় বাঘ ভূত সাপ সমস্ত অচল, একটি মোলায়েম দেখে প্রেমের গল্প বলুন।'

 –‘গল্প আমি বলি না। যা বলি, সমস্ত নিছক সত্য কথা।'

 ———'বেশতো একটি নিছক সত্য প্রেমের কথাই বলুন।

 নগেন বলিল—'তবেই হয়েছে, চাটুজ্যেমশায় প্রেমের কথা বলবেন! বয়স কত হ’ল চাটুজ্যেমশায়? আর কটা দাঁত বাকী আছে?'  —'প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস? ওরে গর্দভ, দাঁতে প্রেম হয় না, প্রেম হয় মনে।'

 নগেন বলিল- 'মন তো শুখিয়ে আমসি হয়ে গেছে। প্রেমের আপনি জানেন কি? সব ভুলে মেয়ে দিয়েছেন। প্রেমের কথা বলবে তরুণরা। কি বলিস উদো?'

 –‘তরুণ কি বে বাপু? সোজা বাংলায় বল্‌ চ্যাংড়া। তিন কুড়ি বয়েস হ’ল, কেদাব চাটুজ্যে প্রেমের কথা জানে না, জানে যত হ্যাংলা চ্যাংড়ার দল!'

 বিনোদবাবু বলিলেন -আঃ হা, কেন ব্রাহ্মণকে চটাও, শোনই না ব্যাপারটা।'

 চাটুজ্যে বলিলেন - ‘বর্ণের শ্রেষ্ঠ হলেন ব্রাহ্মণ। দর্শন বল, কাব্য বল, প্রেমতত্ত্ব বল, সমস্ত বেরিয়েছে ব্রাহ্মণের মাথা থেকে। আবার ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ হলেন চাটুজ্যে। যথা বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে।

 '-আব?’

 -‘আর এই ক্যাদার চাটুজ্যে। কেন বলব না? তোমাদের ভয় করব নাকি?'


 ‘যাক যাক, আপনি আরম্ভ করুন।'

 চাটুজ্যেমশায় আরম্ভ করিলেন ––‘আর বছরের ঘটনা। আমি এক অপরূপ সুন্দরী নারীর পাল্লায় পড়েছিলুম।  নগেন বলিল—–—'এই যে বলছিলেন বাঘিনীর পাল্লায়?

 বিনোদ বলিলেন –– ‘একই কথা।'

 চাটুজ্যে বলিলেন ‘ওরে মুখ্‌খু, বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম মুঙ্গেরে, আর এই নারীর ব্যাপার ঘটেছিল পঞ্জাব মেলে, টুণ্ডলার এদিকে। যাক, ঘটনাটা শোন।—


গেল বছর মাঘ মাসে চরণ ঘোষ বললে তার ছোট মেয়েটিকে টুণ্ডলায় রেখে আসতে, - জামাই সেখানেই কর্ম করে কিনা। সুবিধেই হ'ল, পবেব পয়সায় সেকেণ্ড ক্লাসে ভ্রমণ, আবার ফেরবার পথে একদিন কাশীবাসও হবে। মেয়েটাকে তো নির্বিবাদে পৌঁছিয়ে দিলুম। ফেরবার সময় টুণ্ডলা স্টেশনে দেখি গাড়িতে তিলার্ধ জায়গা নেই, আগ্রার ফেবত এক পাল মার্কিন ভবঘুরে সমস্ত ফাস্ট সেকেণ্ড ক্লাসের বেঞ্চি দখল ক’বে আছে। ভাগ্যিস জামাই রেলের ডাক্তার, তাই গার্ডকে ব’লে ক'য়ে আমায় একটা ফার্স্ট ক্লাসে ঠেলে তুলে দিলে। গাড়িও তখনই ছাড়ল।

 তখন সকাল সাতটা হবে, কিন্তু কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন, গাড়ির মধ্যে সমস্ত ঝাপসা। কিছুক্ষণ ধাঁধা লেগে চুপটি ক’রে দাঁড়িয়ে রইলুম, তার পর ক্রমে ক্রমে কামরাব ভেতরটা ফুটে উঠল।

 দেখেই চক্ষু স্থির। ওধাবের বেঞ্চিতে একটা অসুরের মতন আখাম্বা ঢ্যাঙা সায়েব চিতপাত হ’য়ে চোখ বুঁজে হাঁ করে শুয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি বলছে। দু-বেঞ্চির মাঝে মেঝের ওপর আর একটা বেঁটে মোটা সায়েব মুখ গুঁজে ঘুমুচ্ছে, তার মাথার কাছে একটা খালি বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে। এধারের বেঞ্চিতে কেউ নেই, কিন্তু তাতে দামী বিছানা পাতা, তার ওপর একটা অদ্ভূত পোশাক—বোধ হয় ভাল্লুকের চামড়াব, — আর নানা রকম জিনিসপত্র ছড়ানো রয়েছে। গাড়ি চলছে, পালাবার উপায় নেই। বেঞ্চির শেষদিকে একটা চেয়ারের মতন জায়গা ছিল, তাইতে বসে দুর্গানাম জপতে লাগলুম 1 কোনও গতিকে সময় কাটতে লাগল, সায়েব দুটো শুয়েই রইল, আমারও একটু একটু ক'রে মনে সাহস এল।

 হঠাৎ বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক অপরূপ মূর্তি। দূর থেকে বিস্তর মেমসায়েব দেখেছি, কিন্তু এমন সামনাসামনি দেখবার সুযোগ কখনও ঘটে নি। মুখখানি

চীনে করমচা, ঠোঁট দুটি পাকা লঙ্কা, মারবেলে কোঁদা


আজানুলম্বিত দুই বাহু। চোস্ত ঘাড়-ছাঁটা, কেবল কানের কাছে শণেব মতন দুগাছি চুল কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। পরনে একটি দেড়হাতী গামছা—


 বিনোদবাবু বললেন— ‘গামছা নয় চাটুজ্যেমশায়, ওকে বলে স্কার্ট।’

 ‘কাঠ-ফাঠ জানি নে বাবা। পষ্ট দেখলুম বাদি-পোতাব গামছা খাটো ক’বে পরা, তার নীচে নেমে এসেছে গোলাপী কলাগাছের মতন দুই পা, মোজা আছে কি নেই বুঝতে পাবলুম না। দেহযষ্টি কথাটা এতদিন ছাপার হরফেই পড়েছি, এখন স্বচক্ষে দেখলুম, —হাঁ, যষ্টি বটে, মাথা থেকে বুক-কোমর অবধি একদম চাঁচাছোলা, কোথাও একটু উঁচুনীচু টক্কব নেই। সঞ্চাবিণী পল্লবিনী লতেব নয, একবাবে জ্বলন্ত হাউইএব কাঠি। দেখে বড়ই ভক্তি হ'ল। কপালে হাত ঠেকিযে বললুম—সেলাম মেমসাহেব।

 ফিক ক'রে হাসলেন। পাকা লঙ্কার ফাঁক দিয়ে গুটিকতক কাঁচা ভুট্টাব দানা দেখা গেল। ঘাড় নেডে বললেন –ঘুৎ মর্নিং।

 মেম নৃত্যপবা অপ্সবাব মতন চঞ্চল ভঙ্গীতে এসে বেঞ্চে বসলেন, আমি কাঁচুমাচু হযে চেযাব ছেডে উঠে পডলুম। মেম বললেন – সিট ডাউন বাবু, ডবো সৎ।

 দেবীব এক হাতে ববাভয়, অপর হাতে সিগারেট। বুঝলুম প্রসন্ন হয়েছেন, আর আমায় মাবে কে। ইংবিজী ভাল জানি না, হিন্দী ইংরিজী মিশিয়ে নিবেদন করলুম—নিতান্ত স্থান না পেয়েই এই অনধিকার-প্রবেশ করেছি, অবশ্য গার্ডের হুকুম নিয়ে; মেমসায়েব যেন কসুব মাফ করেন। মেম আবাব অভয় দিলেন, আমিও ফের ব'সে পড়লুম।

 কিন্তু নিস্তার নেই। মেমসায়েব আমার পাশে ব'সে একটু দাঁত বাব ক’বে আমাকে একদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

 এই কেদার চাটুজোকে সাপে তাড়া করেছে, বাঘে পেছু নিয়েছে, ভূতে ভয় দেখিয়েছে, হনুমানে দাঁত খিঁচিয়েছে, পুলিসকোর্টের উকিল জেরা করেছে, কিন্তু এমন দুরবস্থা কখনও ঘটে নি। ষাট বছর বয়েস, রংটি উজ্জ্বল শ্যাম বলা চলে না, পাঁচ দিন ক্ষৌরি হয় নি, মুখ যেন কদম ফুল, কিন্তু এই সমস্ত বাধা ভেদ ক’বে লজ্জা এসে আমার আকর্ণ বেগনী ক'রে দিলে। থাকতে না পেরে বললুম মেম সাব, কেয়া দেখতা?

 মেম হু-হু ক’রে হেসে বললেন –– কুছ নেহি, নো অফেন্স। তুম কোন্ হ্যায় বাবু?

 আমার আত্মমর্যাদায় ঘা পড়ল। আমি কি সঙ না চিড়িয়াখানার জন্তু? বুক চিতিয়ে মাথা খাড়া ক'রে বললুম - আই কেদার চাটুজ্যে, নো জু-গার্ডেন।

 মেম আবার হু-হু ক'বে হেসে বললেন- বেঙ্গলী?

 আমি সগর্বে উত্তর দিলুম- ইয়েস সার, হাই কাস্ট বেঙ্গলী ব্রাহ্মিন। পাইতেটা টেনে বার ক'রে বললুম সী? আপ কোন হ্যায় ম্যাডাম?

 বিনোদবাবু বলিলেন- 'ছি চাটুজ্যেমশায়, মেমেব পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন! ওটা যে এটিকেটে বারণ।'

 ‘কেন করব না? মেম যখন আমার পরিচয় নিলে তখন আমিই বা ছাড়ব কেন। মেম মোটেই বাগ করলেন না, জানালেন তাঁর নাম জোন জিল্‌টাব, নিবাস আমেরিকা, এদেশে এর পূর্বেও ক-বাব এসেছিলেন, ইণ্ডিয়া বড় আশ্চর্য জায়গা।

 আমি সাহস পেযে সায়েব দুটোকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম এ রা করা?

 মেমটি বড়ই সবলা। বেঞ্চিব উপরের ঢ্যাঙা সায়েবের দিকে কড়ে আঙুল বাড়িয়ে বললেন দ্যাট চ্যাপি হচ্ছেন টিমথি টোপার, নিবাস কালিফোর্নিয়া, আমাকে বিবাহ করতে চান। ইনি দশ কোটির মালিক। আর যিনি গড়াগড়ি যাচ্ছেন, উনি হচ্ছেন ক্রিস্টফার কলম্বস ব্লটো, ইনিও আমাকে বিবাহ করতে চান, এঁরও দশ কোটি ডলার আছে।

 আমি গম্ভীরভাবে বললুম কলম্বস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন।

 মেম বললেন সে অন্য লোক। এঁরা আমেরিকায় থেকেও কিছু আবিষ্কার করতে পারেন নি। দেশটা একদম শুখিয়ে গেছে, মেথিলেটেড স্পিরিট ছাড়া কিছুই মেলে না। তাই এঁরা দেশত্যাগী হ'য়ে খাঁটী জিনিসের সন্ধানে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

 জিজ্ঞাসা করপুম - এঁরা বুঝি মস্ত স্পিরিচুয়ালিষ্ট?

 মেম বললেন—ভেরি।

 এমন সময় ঢ্যাঙা সায়েবটা চোখ মেলে কটমট ক'রে চেয়ে আমার দিকে ঘুষি তুলে বললে—ইউ-ইউ গেট আউট কুইক। বেঁটেটাও হঠাৎ হাত-পা ছুড়তে শুরু করলে।

 আমি আমার লাঠিটা বাগিয়ে ধ'রে ঠক ঠক ক'রে ঠুকতে লাগলুম। মেমসায়েব বিছানা থেকে তাঁর পালক-মোড়া চটিজুতো তুলে নিয়ে ঢ্যাঙার দুই গালে পিটিয়ে আদর ক'রে বললেন ইউ পগ্, ইউ পগ্। বেঁটেটাকে লাথি মেরে বললেন—ইউ পিগ, ইউ পিগ। দুটোই তখনই আবার হাঁ ক’বে ঘুমিয়ে পড়ল। মেম তাদের বুকেব ওপর এক-এক পাটি চটি রেখে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে এসে বললেম- ভয় নেই বাবু ৷

 ভরসাই বা কই? আরব্য উপন্যাসে পড়েছিলুম একটা দৈত্য এক রাজকন্যাকে সিন্দুকে পুরে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। দৈত্যটা ঘুমুলে রাজকন্যা তার বুকের ওপর একটা ঢিল রেখে দিয়ে যত রাজ্যের রাজপুত্তর জুটিয়ে আংটি, আদায় করতেন। ভাবলুম এইবার সেরেছে রে! এই মেমসায়েব দু-দুটো দৈত্যের ঘাড়ে চ'ড়ে বেড়াচ্ছে, এখনই নিরনব্বই আংটির মালা বার করবে।

 যা ভয় করছিলুম ঠিক তাই। আমার হাতে একটা রুপো আর তামার তারে জড়ানো পলা-বসানো আংটি ছিল। মেম হঠাৎ সেটাকে দেখে বললে- - হাউ লভ্‌লি! দেখি বাবু কি রকম আংটি।

 আমি ভয়ে ভয়ে হাতটি এগিয়ে দিলুম, যেন আঙুল হাড়া অস্তর করাচ্ছি। মেম ফস করে আংটিটি খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে পরিয়ে বললেন বিউচিফুঃ!

 হরে রাম! এ যে আমার ত্রিসন্ধ্যা জপ করার আংটি,—হায় হায়, এই ম্লেচ্ছ মাগী সেটাকে অপবিত্র ক'রে দিলে! আমার চোখ ছলছল ক'রে উঠল, কিন্তু কৌতুহলও খুব হ’ল। বললুম – মেমসায়েব, আপ্‌কা আর কয়ঠো আংটি হ্যায়? নাইণ্টিনাইন?

 মেম বেঞ্চির তলা থেকে একটি তোরঙ্গ টেনে এনে তা থেকে একটি অদ্ভুত বাক্স খুলে আমাকে দেখালেন। চোখ ঝলসে গেল। দেরাজের পর দেরাজ, কোনওটায় গলার হার, কোনওটায় ক্লানের দুল, কোনওটায় আর কিছু। একটা আংটির ট্রে—তাতে কুড়ি পঁচিশটা হবে- আমার সামনে ধ’রে বললেন —যেটা খুশি নাও বাবু!

 আমি বললুম—সে কি কথা। আমার আংটির দাম মোটে ন-সিকে। আমি ওটা আপনাকে প্রেজেণ্ট কবলুম, সাবধানে রাখবেন, ভেরি হোলি আংটি।

 মেম কললেন— ইউ ওল্ড ডিয়ার! কিন্তু তোমার উপহার যদি আমি নিই, আমার উপহারও তোমার ফেরত দেওয়া উচিত নয়। এই ব’লে একটা চুনির আংটি আামার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। বললুম - থ্যাংক ইউ মেমসায়েব, আমি আপনার গোলাম, ফরগেট মি নট। মনে মনে বললুম -ভয় নেই ব্রাহ্মণী, এ আংটি তোমার জন্যেই রইল।


ট্রেন এটাওআয় এসে পৌঁছল। কেলনারের খানসামা চা রুটি মাখন নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে -টি হুজুর? মেম ট্রে রাখলেন। তার পর আমার লাঠিটা নিয়ে ঢ্যাঙা আর বেঁটেকে একটু গুতো দিয়ে বললেন—গেট আপ টিমি, গেট আপ ব্লটো। তারা বুনো শুয়োরের মতন ঘোঁত ঘোঁত ক’রে কি বললে শুনতে পেলুম না। আন্দাজে বুঝলুম এখনও তাদের ওঠবার অবস্থা হয় নি। মেম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন - চ্যাটার্জি, তুমি খাবে? আপত্তি নেই তো?

 মহা ফাঁপরে পড়া গেল। ম্লেচ্ছ নাবীব স্বহস্তে মিশ্রিত, কিন্তু ভুরভূরে খোশবায়, শীতটাও খুব পড়েছে। শাস্ত্রে চা খেতে বারণ কোথাও নেই। তা ছাড়া রেলগাড়ির মতন বৃহৎ কাষ্ঠে ব’সে শীত নিবারণের জন্যে ঔষধার্থে যদি চা পান করা যায় তবে নিশ্চয়ই দোষ নাস্তি। বললুম - ম্যাডাম লক্ষ্মী, তুমি যখন নিজ হাতে চা দিচ্ছ, তখন কেন খাব না। তবে রুটিটা থাক।

 চায়ে মনের কপাট খুলে যায়, খেতে খেতে অনেক বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অশ্বত্থাম। যেমন দুধের অভাবে পিটুলি-গোলা খেয়ে আহ্লাদে নৃত্য করতেন, নিরীহ বাঙালী তেমনি চায়েতেই মদেব নেশা জমায়। বঙ্কিম চাটুজ্যে তারিফ ক'রে চা খেতে শেখেন নি, সর্দি-টর্দি হ'লে আদা-নুন দিয়ে খেতেন,— তাতেই দেখতে পেরেছেন—বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। আজকাল চায়ের কল্যাণে বাংলা দেশে ভাবের বন্যা এসেছে, ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম। সেকালের কবিদের বিস্তরা য়নাক্কা ছিল,—উপবন রে, চাঁদ রে, মলয় রে, কোকিল রে, তবে পঞ্চশর ছুটবে। এখন কোনও ছঞ্ঝাট নেই,— ৷ই শুধু দুটো হাতল-ভাঙা বাটি, একটু ছেঁড়া অয়েল থ, একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল, দু-ধারে দুই তরুণ- তরুণী, আর মধ্যিখানে ধূমায়মান কেতলি। ভাগ্যিস বয়েসটা ষাট, তাই বেঁচে গিয়েছিলুম।

 মেমকে জিজ্ঞাসা করলুম- আচ্ছা মেমসায়েব, এই য দুই হুজুব গড়াগড়ি যাচ্ছেন, এঁরা দুজনেই তো আপনার প্রাণিপ্রার্থী। আপনি কোন্ ভাগ্যবান্‌টিকে বরণ করবেন?

 মেম বললেন- সে একটি সমস্যা। আমি এখনও মনস্থির করিতে পারিনি। কখনও মনে হয় টিমিই উপযুক্ত পাত্র, বেশ লম্বা সুপুরুষ, আমাকে ভালও বাসে খুব কিন্তু মদ খেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আর ঐ ব্লটো, যদিও বেঁটে মোটা, আর একটু বয়স হয়েছে, কিন্তু আমার অত্যন্ত বাধ্য আর বড় নরম মন। একটু মদ খেলেই কেঁদে ফেলে। বড় মুশকিলে পড়েছি, দুজনেই নাছোড়বান্দা। যা হ’ক এখনও ক-ঘণ্টা সময়

পাওয়া যাবে, হাওড়া পৌছবার আগেই স্থিব ক'রে ফেলব। আচ্ছা চাটার্জি, তুমিই বল না- -এদের মধ্যে কাকে বিয়ে করা উচিত।

 বললুম —মেমসায়েব, আপনি এদের স্বভাবচরিত্র যে- প্রকার বর্ণনা কবিলেন তাতে বোধ হয় দুটিই অতি সুপাত্র। তবে কি না এঁরা যেরকম বেহুঁশ হয়ে আছেন-

 মেম বললেন ও কিছু নয়। একটু পরেই দুজনে চাঙ্গা হ'য়ে উঠবে।

 আমি বললুম – আপনার নিজের যদি কোনওটির ওপর বেশী ঝোঁক না থাকে, তবে আপনার বাপ-মার ওপর স্থির করাব ভাব দিন না?

 মেম বললেন— আমার বাপ-মা নেই, নিজেই নিজের অভিভাবক। দেখ চ্যাটার্জি, তোমার ওপরেই ভার দিলুম। তুমি বেশ ক’বে দুটোকে ঠাউরে দেখ। মোগলসরাইএ নেমে যাবার আগেই তোমার মত আমাকে জানাবে। ভেবেছিলুম একটা টাকা ছুড়ে চিত-উবুড় দেখে মনস্থির করব, কিন্তু তুমি যখন রয়েছ তখন আর দরকার নেই।

 ব্যবস্থা মন্দ নয়। আত্মীয়-বন্ধুদের জন্যে এ পর্যন্ত বিস্তর বর-কনে ঠিক ক'রে দিয়েছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত পাত্র দেখার ভার কখনও পাই নি। দুজনেই ক্রোবপতি, দুটোই পাঁড়মাতাল। একটা লম্বায় বড়, আব একটা ওজনে পুষিয়ে নিয়েছে। বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় এ যাবৎ যা পেয়েছি তা শুধু ঘোঁত ঘোঁত। চুলোয় যাক, মেমের যখন আপত্তি নেই তখন যেটার হয় নাম বলব। আর যদি বুঝি যে মেম আমার কথা রাখবে, তবে বলব- মা লক্ষ্মী, মাথা যখন আগেই মুড়িয়েছ তখন বাকী কাজটুকুও সেবে ফেল। এই দু-ব্যাটা ভাবী স্বামীকে ঝেঁটিযে নবকস্থ কব।


ল্প করতে করতে বেলা প্রায় সাড়ে নটা হয়ে এল। এর পবেই একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি থামবে, সেই অবসবে সায়েব-মেমরা হাজবি খেতে খানা-কামরায় যাবে। এতক্ষণ ঠাওর হয় নি, এখন দেখতে পেলুম চা খেয়ে মেমেব ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝলুম রংটি কাঁচা। মেম একটি সোনার কৌটো খুললেন, তা থেকে বেরুল একটি ছোট আরশি, একটি লাল বাতি, একটি পাউডারের পুঁটুলি। লালবাতি ঠোঁটে ঘ’সে নাকে একটু পাউডাব লাগিয়ে মুখখানি মেরামত ক’বে নিলেন।

 গাড়ি থামল। মেম বললেন —চ্যাটার্জি, আমি ব্রেকফাস্ট খেতে চললুম। টিমি আর ব্লটো রহিল, এদের দিকে একটু নজর রেখো, যেন জেগে উঠে মারামারি না করে। যদি সামলাতে না পার তবে শেকল টেনো।

 আহা, কি সোজা কাজই দিয়ে গেলেন! প্রায় আধ ঘণ্টা পরে কানপুরে গাড়ি থামবে, তখন মেম আবার এই কামরায় ফিরে আসবেন। ততক্ষণ মরি আর কি! লাঠিটা বাগিয়ে নিয়ে ফের দুর্গানাম জপ করতে লাগলুম।

 ঢ্যাঙা সায়েবটা উঠে বসেছে। হাই তুললে, চোখ, রগড়ালে, আঙুল মটকালে। আমার দিকে একবার কটমট ক’রে চাইলে, কিন্তু কিছু বললে না। টলতে টলতে বাথরুমে গেল।

 তখন বেঁটেটা তড়াং ক’রে উঠে কোলা ব্যাঙের মতন থপ ক’রে আমার পাশে এসে বসল। আমি ভয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই সে আমার হাতটা নেড়ে দিয়ে বললে— গুড মর্নিং সার, আমি হচ্ছি ক্রিস্টফার কলম্বস ব্লটো।

 আমি সাহস পেয়ে বললুম—সেলাম হুজুর।

 —আমার দশ কোটি ডলার আছে। প্রতি মিনিটে আমার আয়—


 — হুজুর দুনিয়ার মালিক তা আমি জানি।

 ব্লটো আমার বুকে একটা আঙুল ঠেকিয়ে বললে— লুক হিয়ার বাবু, আমি তোমাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দেবো।

 — কেন হুজুর?

 — মিস জিল‍্টারকে তোমার রাজী করাতেই হবে। আমি তোমাদের সমস্ত কথা শুনেছি। তোমারই ওপর সমস্ত ভার, তুমিই কন্যাকর্তা। ঐ টিমথি টোপার—ও অতি পাজী লোক, ওর সমস্ত সম্পত্তি আমার কাছে বাঁধা আছে। ও একটা পাঁড়মাতাল, পপার, ওর সঙ্গে বিয়ে হ’লে মিস জিল‍্টার মনের দুঃখে মারা যাবেন।

 এই ব’লে ব্লটো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একটা বোতলে একটু তলানি পড়ে ছিল, সেটুকু খেয়ে ফেলে বললে—বাবু, তুমি জন্মান্তর মান?

 —মানি বইকি।

 —আমি আর জন্মে ছিলাম একটি তৃষিত চাতক পক্ষী, আর এই মেম ছিল একটি রূপসী পানকৌড়ি। আমরা ছুটিতে—

 এমন সময় বাথরুমের দরজা ন’ড়ে উঠল। ব্লটো তাড়াতাড়ি আমাকে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারা ক’রেই ফের নিজের জায়গায় শুয়ে নাক ডাকাতে লাগল।

 ঢ্যাঙা সায়েব—মেম যাকে টিমি বলে—ফিরে এসে নিজের বেঞ্চে গ্যাঁট হয়ে বসল। তখন ব্লটো জেগে ওঠার ভান ক’রে হাই তুললে, চোখ রগড়ালে, আমার দিকে একবার করুণ নয়নে চেয়ে বাথরুমে ঢুকল।

 এবার টিমির পালা। ব্লটো স’রে যেতেই সে কাছে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলে। আমি আগে থাকতেই বললুম— গুড মর্নিং সার।

 টিমি আমার হাতটায় ভীষণ মোচড় দিলে।

 বললুম—উঃ!

 টিমি বললে —তোমার হাড় গুঁড়ো ক'রে দেব।

 ভয়ে ভয়ে বললুম—ইয়েস সার।

 — তোমায় থেঁতলে জেলি বানাব।

 — ইয়েস সার।

 — মিস জোন জিল‍্টারকে আমি বিয়ে করবই। আমি সমস্ত শুনেছি। যদি আমার হয়ে তাকে না বল তবে তোমাকে বাঁচতে হবে না।

 — ইয়েস সার।

 — আমার অগাধ সম্পত্তি। পাঁচটা হোটেল, দশটা জাহাজ কোম্পানি, পঁচিশটা শুঁটকী শুওরের কারখানা। ব্লটের কি আছে? একটা মদের চোরা ভাঁটি, তাও আমার টাকায়। ব্লটো একটা হতভাগা মাতাল বেঁটে বজ্জাত—

 ব্লটো বোধ হয় আড়ি পেতে সমস্ত শুনছিল। হঠাৎ কামরায় ছুটে ফিরে এসে ঘুষি তুলে বললে—কে হতভাগা, কে মাতাল, কে বেঁটে বজ্জাত?

 সকলেরই বিশ্বাস যে গান আর গালাগাল হিন্দীতেই ভাল রকম জমে। হিন্দী গালাগালের প্রসাদগুণ খুব বেশী তা স্বীকার করি। কিন্তু যদি নিছক আওয়াজ আর দাপট চাও তবে বিলিতী গাল শুনো—বিশেষ ক’রে মার্কিনী গাল। এক-একটি লব্‌জ যেন তোপ, কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশে। ইংরিজী আমি ভাল জানি না, সব গালাগালের অর্থ বুঝতে পারি নি, কিন্তু তাতে রসগ্রহণের কিছুমাত্র বাধা হয় নি।

 দেখলুম এক বিষয়ে সায়েবরা আমাদের চেয়ে দুর্বল—তারা বাগ যুদ্ধ বেশীক্ষণ চালাতে পারে না। দু-মিনিট যেতে না যেতেই হাতাহাতি আরম্ভ হ’ল। আমি হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগলুম, গাড়ি কখন কানপুরে এসে থামল, তা টের পাই নি।

 হনহন ক’রে মেমসায়েব এসে পড়ল। এই গজকচ্ছপের লড়াই থামানো কি তার কাজ? বললে—


টিমি ডিয়ার, ডোন্ট্‌—ব্লটো ডারলিং, ডোন্ট্‌—প্লিজ প্লিজ ডোন্ট্‌। কিছুই ফল হ’ল না। আমি বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটলুম।

 ফার্স্ট সেকেণ্ড ক্লাস সমস্ত খালি। ডাইনিং কাবে সকলে তখনও খানা খাচ্ছে। কাকে বলি? ওই যে—একটা সাদা ফ্লানেলের পেণ্টুলুন-পরা সায়েব প্লাটফর্মে পাইচারি ক’রে শিস দিচ্ছে। হস্তদন্ত হয়ে তাকে বললুম—কাম্ সার, লেডির মহা বিপদ। সায়েব হুশ ক’রে একটি জোরে শিস দিয়ে আমার সঙ্গে ছুটল।

 মেম তখন আমার লাঠিটা নিয়ে অপক্ষপাতে দুব্যাটাকেই পিটছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, সমানে ঝুটোপটি করছে। আগন্তুক সায়েবটি মেমকে জিজ্ঞাসা করলে— হেলো জোন, ব্যাপার কি? মেম তাড়াতাড়ি ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন। সাহেব টিমি আর ব্লটোকে থামাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু তারা তাকেই মারতে এল। নতুন সায়েবের তখন হাত ছুটল।

 বাপ, কি ঘুষির বহর! টিমি ঠিকরে গিয়ে দরজায় মাথা ঠুকে প’ড়ে চতুর্দশ ভুবন অন্ধকার দেখতে লাগল। ব্লটো কোঁক ক’রে বেঞ্চের তলায চিতপাত হয়ে পড়ল। বিলকুল ঠাণ্ডা।


কটু জিরিয়ে নিয়ে মেম আমার সঙ্গে নতুন সায়েবটির পরিচয় করিয়ে দিলেন—ইনি বিখ্যাত মিস্টার বিল বাউণ্ডার, খুব ভাল ঘুষি লড়তে পারেন। আর ইনি মিস্টার চ্যাটার্জি, ভেরি ডিয়ার ওল্ড ফ্রেণ্ড।

 সায়েব আমার মুখখানা দেখে বললে—সাম্ বিয়ার্ড!

 মেম বললেন—থাকুক দাড়ি। ইনি অতি জ্ঞানী লোক।

 সায়েব আমার হাতটা খুব ক’রে নেড়ে দিয়ে বললে হা-ডু-ডু! বেশ শীত পড়েছে নয়?

 ধাঁ ক’রে আমার মাথায় একটা মতলব এল। মেমসায়েবকে চুপি চুপি বললুম—দেখুন মিস জোন, অত গোলমালে কাজ কি? টিমি আর ব্লটো দুজনেই তো কাবু হয়ে পড়েছে। আমি বলি কি—আপনি এই বিল সায়েবকে বিয়ে করুন। খাসা লোক।

 মেম বললেন রাইটো। আমার একথা এতক্ষণ মনেই পড়ে নি। আই সে বিল, আমায় বিয়ে করবে?

 বিল বললে রাদার। কে বলে আমি করব না?

 বাধামাধব! সায়েব জাতটা ভারী বেহায়া। বিলকে বাধা দিয়ে বললুম—রোসো সায়েব, এক্ষুনি ও সব কেন। আমি হচ্ছি ব্রাইড-মাস্টার— কন্যাকর্তা। তোমার কুলশীল আগে জেনে নি, তার পর আমি মত দেব।

 বিল বললে— আমার ঠাকুরদা ছিলেন মুচি। আমার বাপও ছেলেবেলায় জুতো সেলাই করতেন।

 আমি বললুম—তাতে কুলমর্যাদা কমে না। তোমার আয় কত?

 বিল একটু হিসেব ক’রে বললে— মিনিটে দশ হাজার, ঘণ্টায় ছ লাখ। কিন্তু চিন্তা করবেন না, আমার মাসী মারা গেলে আয় আর একটু বাড়বে। তাঁর পঁচিশটা বড় বড় পুকুর আছে, নোনা জলে ভরতি, তাতে তিমি মাছ কিলবিল করছে।

 বললুম—থাক, আর বলতে হবে না, আমি মত দিলুম। এগিয়ে এস, আমি আশীবাদ করব, রিয়াল হিন্দু স্টাইল।

 কিন্তু ধান-দুব্বো কই? জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললুম— এই কুলী, জলদি থোড়া ঘাস ছিঁড়কে লাও, পয়সা মিলেগা।

 ইংরেজী আশীর্বাদ তো জানি না। বললুম— যদি আপত্তি না থাকে তবে বাংলাতেই বলি।

 —নিশ্চয়, নিশ্চয়।

 সাহেরের মাথায় এক মুঠো ঘাস দিয়ে বললুম—বেঁচে থাক। ধন তো যথেষ্ট আছে, পুত্রও হবে, লক্ষ্মী এই সঁপে দিলুম। কিন্তু খবরদার ব্যাটা, বেশী মদ-টদ খেয়ো না, তা হ’লে ব্রহ্মশাপ লাগবে। সাহেব আর একবার আমার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়া ছিঁড়ে দিলে।

 মেমকে বললুম—মা লক্ষ্মী, তোমার ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হ’ক। বীরপ্রসবিনী হয়ে কাজ নেই মা—আশীর্বাদটা আমাদের অবলাদের জন্যই তোলা থাক। তুমি আর গরিব কালা-আদমীদের দুঃখের নিমিত্ত হয়ো না, গুটিকতক শান্তশিষ্ট কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ঘরকন্না কর।

 মেম হঠাৎ তার মুখখানা উঁচু ক’রে আমার সেই পাঁচ দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর

 বিনোদবাবু বলিলেন ‘আ ছি ছি ছি।’

 চাটুজ্যেমশায় বলিলেন- ‘হু, দেবীচৌধুরানীতে ঐ বকম লিখেছ বটে।’

 ‘আচ্ছা চাট্টজ্যেমশায়, পাকা লঙ্কার আস্বাদটা কি রকম লাগল?’

 ‘তাতে ঝাল নেই। আরে, ঐ হ’ল ওদের রেওয়াজ, ঐ রকম ক’রেই ভক্তিশ্রদ্ধা জানায়, তাতে লজ্জা পাবার কি আছে।’

 চাটুজ্যেমশায় বলিতে লাগিলেন —‘তারপর দেখি ঢ্যাঙা আর বেঁটে মুখ চুন ক’রে নেমে যাচ্ছে, জন-দুই কুলী তাদের মালপত্র নামাচ্ছে।

 গাড়ি ছাড়ল। বিল আর জোন হাত ধরাধরি


ক'রে নাচ শুরু করে দিলে। আমি ফ্যাল ফ্যাল ক'রে চেয়ে দেখতে লাগলুম।


 জোন বললে— চ্যাটার্জি, এই আনন্দের দিনে তুমি অমন গ্লাম্ হয়ে বসে থেকো না। আমাদের নাচে যোগ দাও।

 বললুম — মাদার লক্ষ্মী, আমার কোমরে বাত। নাচতে কবিরাজের বারণ আছে।

 তবে তুমি গান গাও, আমারই নাচি।

 কি আর করা যায়, পড়েছি যবনের হাতে। একটা রামপ্রসাদী ধরলুম।

 সমস্ত পথটা এই রকম চলল, অবশেষে মোগলসরাই এল। মেম বললে কলকাতায় গিয়েই তাদের বিয়ে হবে, আমি যেন তিন দিন পরে গ্রাণ্ড হোটেলে অতি অবশ্য তাদের সঙ্গে দেখা করি। বিস্তর শেকহ্যাণ্ড, বিস্তর অনুরোধ, তারপর নেমে কাশীর গাড়ি ধরলুম।...... পরদিন আবার কলকাত। যাত্রা।’


বিনোদবাবু বলিলেন ‘আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, গিন্নী সব কথা শুনেছেন?’

 ‘কেন শুনবেন না। সতীলক্ষ্মী, তায় পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে। তোমাদের নবীনাদের মতন অবুঝ নন যে অভিমানে চৌচির হবেন। আমি বাড়ি ফিরে এসেই তাঁকে সমস্ত বলেছি।’

 চাটুজ্যেগিন্নী শুনে কি বললেন?

 ‘তক্ষুনি একটা উড়ে নাপিত ডেকে বললেন—দে তো রে, বুড়োর মুখখানা আচ্ছা ক’রে চেঁচে, ম্লেচ্ছ মাগী উচ্ছিষ্টি ক’রে দিয়েছে! তারপর সেই চুনির আংটিটা কেড়ে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে নিজের আঙুলে পরলেন।’

 ‘বউভাতের ভোজটা কি রকম খেলেন?’

 ‘সে দুঃখের কথা আর না-ই শুনলে। গ্রাণ্ড হোটেলে গিয়ে জানলুম ওরা কেউ নেই। একটা খানসামা বললে —বিয়ের পরদিনই বেটী পালিয়েছে। সায়েব তাকে খুঁজতে গেছে।’