বিষয়বস্তুতে চলুন

কথা (১৯৩৮)/হোরিখেলা

উইকিসংকলন থেকে

হােরিখেলা

(রাজস্থান)

পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী,—
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।

পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।

ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আম্র বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুনপুরে দলে দলে আজি
পাঠান সেনা হোরি খেলতে এল

কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মূলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরি-খেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।

পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
ডাহিন-হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচ্‌কারী,

বামহস্তে গুলাব ভরা ঝারী
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।

আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে—
কেসর তবে কহে কাছে আসি’,—
বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি’—
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি।—
শুনে রাজার শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্ট হাসি’।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি’।

শুরু হোলো হোরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব-বরন ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে,
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।

চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।—
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি।
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক’রে কাঁকন বাজছে না।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।

পাঠান কহে—রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা।
বাহু যুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।
পাঠান ভাবে দেহে কিংবা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।

তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুগুলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,

দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।

কেসর কহে—তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।—
রানী কহে—আমারো সেই দশা।—
একশো সখি হাসিয়া বিবশা,—
পাঠানপতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠানপতির চক্ষু হোলো কানা।

বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝনঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু তলে তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।

বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কেরে
বাহির হোলো নারী-সজ্জা ছেড়ে,
একশত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্ন সম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।

যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন রাতে কুঞ্জ বিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হোলো সারা।
যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।

৯ই কার্ত্তিক, ১৩০৬



'কুগুলেতে' নয় হবে 'কুন্ডলেতে'