কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

সপত্নীসম্ভাষে।

“Be at peace; it is your sister that addresses you.
Requite Lucretia's love.”

Lucretia.

কপালকুণ্ডলা গৃহ হইতে বহির্গতা হইয়া কাননাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। প্রথমে ভগ্ন গৃহ মধ্যে গেলেন। তথায় ব্রাহ্মণকে দেখিলেন। যদি দিনমান হইত তবে দেখিতে পাইতেন যে তাঁহার মুখকান্তি অত্যন্ত মলিন হইয়াছে। ব্রাহ্মণবেশী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন যে “এখানে কাপালিক আসিতে পারে, এখানে কোন কথা অবিধি। স্থানান্তরে আইস।” বন মধ্যে একটি অল্পায়ত স্থান ছিল তাহার চতুঃপার্শ্বে বৃক্ষরাজি; মধ্যে পরিষ্কার; তথা হইতে একটি পথ বাহির হইয়া গিয়াছে। ব্রাহ্মণবেশী কপলকুাণ্ডলাকে তথায় লইয়া গেলেন। উভয়ে উপবেশন করিলে ব্রাহ্মণবেশী কহিলেন,

 “প্রথমতঃ আত্মপরিচয় দিই। কত দূর আমার কথা বিশ্বাসযোগ্য তাহা আপনি বিবেচনা করিয়া লইতে পারিবা। যখন তুমি স্বামীর সঙ্গে হিজলী প্রদেশ হইতে আসিতেছিলে, তখন পথিমধ্যে রজনীযোগে এক যবনকন্যার সহিত সাক্ষাৎ হয়। তোমার কি তাহা মনে পড়ে?”

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “যিনি আমাকে অলঙ্কার দিয়াছিলেন?”

 ব্রাহ্মণবেশধারিণী কহিলেন “আমিই সেই।”

 কপালকুণ্ডলা অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। লুৎফ্-উন্নিসা তাঁহার বিস্ময় দেখিয়া কহিলেন, “আরও বিস্ময়ের বিষয় আছে—আমি তোমার সপত্নী।”

 কপালকুণ্ডলা চমৎকৃতা হইয়া কহিলেন, “সে কি?” লুৎফ্-উন্নিসা তখন আনুপূর্ব্বিক আত্মপরিচয় দিতে লাগিলেন। বিবাহ, জাতিভ্রংস, স্বামী কর্ত্তৃক ত্যাগ, ঢাকা, আগ্রা, জাঁহাগীর, মেহেরউন্নিসা, আগ্রা ত্যাগ, সপ্তগ্রামে বাস, নবকুমারের সহিত সাক্ষাৎ, নবকুমারের ব্যবহার, গত দিবস প্রদোষে ছদ্মবেশে কাননে আগমন, হোমকারীর সহিত সাক্ষাৎ, সকলই বলিলেন। এই সময় কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞাসা করিলেন,

 “তুমি কি অভিপ্রায়ে আমাদিগের বাটীতে ছদ্মবেশে আসিতে বাসনা করিয়াছিলে?”

 লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন “তোমার সহিত স্বামীর চিরবিচ্ছেদ জন্মাইবার অভিপ্রায়ে।”

কপালকুণ্ডলা চিন্তা করিতে লাগিলেন। কহিলেন, “তাহা কি প্রকারে সিদ্ধ করিতে?”

 লুৎফ্-উন্নিসা। “আপাততঃ তোমার সতীত্বের প্রতি স্বামীর সংশয় জন্মাইতাম। কিন্তু সে কথায় আর কাজ কি, সে পথ ত্যাগ করিয়াছি। এক্ষণে তুমি যদি আমার পরামর্শ মতে কাজ কর, তবে তোমা হইতেই আমার কামনা সিদ্ধ হইবে—অথচ তোমার মঙ্গলসাধন হইবে।”

 কপা। “হোমকারীর মুখে তুমি কাহার নাম শুনিয়াছিলে?”

 লু। “তোমারই নাম। তিনি তোমার মঙ্গল বা অমঙ্গল কামনায় হোম করেন, ইহা জানিবার জন্য প্রণাম করিয়া তাঁহার নিকট বসিলাম। যতক্ষণ না তাঁহার ক্রিয়া সম্পন্ন হইল ততক্ষণ তথায় বসিয়া রহিলাম। হোমান্তে তোমার নাম সংযুক্ত হোমের অভিপ্রায় ছলে জিজ্ঞাসা করিলাম। কিয়ৎক্ষণ তাঁহার সহিত কথোপকথন করিয়া জানিতে পারিলাম যে তোমার অমঙ্গলসাধনই হোমের প্রয়োজন। আমারও সেই প্রয়োজন। ইহাও তাঁহাকে জানাইলাম। তৎক্ষণাৎ পরস্পরের সহায়তা করিতে বাধ্য হইলাম। বিশেষ পরামর্শ জন্য তিনি আমাকে ভগ্ন গৃহ মধ্যে লইয়া গেলেন। তথায় আপন মনোগত ব্যক্ত করিলেন। তোমার মৃত্যুই তাঁহার অভীষ্ট। তাহাতে আমার কোন ইষ্ট নাই। আমি ইহ জন্মে কেবল পাপই করিয়াছি, কিন্তু পাপের পথে আমার এত দূর অধঃপাত হয় নাই যে, আমি নিরপরাধিনী বালিকার মৃত্যু সাধন করি। আমি তাহাতে সম্মতি দিলাম না। এই সময়ে তুমি তথায় উপস্থিত হইয়াছিলে। বোধ করি কিছু শুনিয়া থাকিবে।”

 কপা। “আমি ঐরূপ বিতর্কই শুনিয়াছিলাম।”

 লু। “সে ব্যক্তি আমাকে অবোধ অজ্ঞান বিবেচনা করিয়া কিছু উপদেশ দিতে চাহিল। শেষ টা কি দাঁড়ায় ইহা জানিয়া তোমায় উচিত সম্বাদ দিব বলিয়া তোমাকে বনমধ্যে অন্তরালে রাখিয়া গেলাম।”

 কপা। “তার পর আর ফিরিয়া আসিলে না কেন?”

 লু।” তিনি অনেক কথা বলিলেন, বাহুল্য বৃত্তান্ত শুনিতে শুনিতে বিলম্ব হইল। তুমি সে ব্যক্তিকে বিশেষ জান। কে সে অনুভব করিতে পারিতেছ?”

 কপা। “আমার পূর্ব্বপালক কাপালিক।”

 লু। “সেই বটে। কাপালিক প্রথমে তোমাকে সমুদ্র তীরে প্রাপ্তি, তথায় প্রতিপালন, নবকুমারের আগমন, তৎসহিত তোমার পলায়ন, এ সমুদায় পরিচয় দিলেন। তোমাদিগের পলায়নের পর যাহা যাহা হইয়াছিল, তাহাও বিবরিত করিলেন—সে সকল বৃত্তান্ত তুমি জান না। তাহা তোমার গোচরার্থ বিস্তারিত বলিতেছি।”

 এই বলিয়া লুৎফ্-উন্নিসা কাপালিকের শিখরচ্যুতি, হস্তভঙ্গ, স্বপ্ন, সকল বলিলেন। স্বপ্ন শুনিয়া কপালকুণ্ডলা চমকিয়া, শিহরিয়া উঠিলেন—চিত্তমধ্যে বিদ্যুচ্চঞ্চলা হইলেন। লুৎফ্-উন্নিসা বলিতে লাগিলেন,

 “কাপালিকের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ভবানীর আজ্ঞা প্রতিপালন। বাহুবলহীন, এই জন্য পরের সাহায্য তাহার নিতান্ত প্রয়োজন। আমাকে ব্রাহ্মণতনয় বিবেচনা করিয়া আমাকে সহায় করিবার প্রত্যাশায় সকল বৃত্তান্ত বলিল। আমি এ পর্য্যন্ত এ দুষ্কর্ম্মে স্বীকৃত হই নাই। এ দুর্বৃত্ত চিত্তের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু ভরসা করি যে কখনই স্বীকৃত হইব না। বরং এ সঙ্কল্পের প্রতিকূলাচরণ করিব এই অভিপ্রায়; সেই অভিপ্রায়েই আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। কিন্তু এ কার্য্য নিতান্ত অস্বার্থপর হইয়া করি নাই। তোমার প্রাণ দান দিতেছি। তুমিও আমার জন্য কিছু কর।”

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন, “কি করিব?”

 লু। “আমারও প্রাণদান দাও—স্বামী ত্যাগ কর।”

 কপালকুণ্ডলা অনেক ক্ষণ কথা কহিলেন না। অনেক ক্ষণের পর কহিলেন, “স্বামী ত্যাগ করিয়া কোথায় যাইব?”

 লু। “বিদেশে—বহু দূরে—তোমাকে অট্টালিকা দিব—ধন দিব—দাস দাসী দিব, রাণীর ন্যায় থাকিবে।”

 কপালকুণ্ডলা আবার চিন্তা করিতে লাগিলেন। পৃথিবীর সর্ব্বত্র মানসলোচনে দেখিলেন—কোথাও কাহাকে দেখিতে পাইলেন না; অন্তঃকরণ মধ্যে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন—তথায় ত নবকুমারকে দেখিতে পাইলেন না, তবে কেন লুৎফ-উন্নিসার সুখের পথ রোধ করিবেন? লুৎফ-উন্নিসাকে কহিলেন,

 “তুমি যে আমার উপকার করিয়াছ কি না তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি না। অট্টালিকা, ধন সম্পত্তি, দাস দাসীরও প্রয়োজন নাই। আমি তোমার সুখের পথ কেন রোধ করিব? তোমার মানস সিদ্ধ হউক—কালি হইতে বিঘ্নকারিণীর কোন সম্বাদ পাইবে না। আমি বনচর ছিলাম আবার বনচর হইব?”

 লুৎফ-উন্নিসা চমৎকৃতা হইলেন, এরূপ আশু স্বীকারের কোন প্রত্যাশা করেন নাই। মোহিত হইয়া কহিলেন, “ভগিনি—তুমি চিরায়ুষ্মতী হও! আমার জীবন দান করিলে। কিন্তু আমি তোমাকে অনাথিনী হইয়া যাইতে দিব না। কল্য প্রাতে তোমার নিকট আমার এক জন বিশ্বাসযোগ্যা চতুরা দাসী পাঠাইব। তাহার সঙ্গে যাইও। বৰ্দ্ধমানে কোন অতি প্রধানা স্ত্রীলোক আমার সুহৃৎ।—তিনি তোমার সকল প্রয়োজন সিদ্ধ করিবেন।”

 লুৎফ-উন্নিসা এবং কপালকুণ্ডলা এরূপে মনঃসংযোগ করিয়া কথাবার্ত্তা কহিতেছিলেন, যে সম্মুখ বিঘ্ন কিছুই দেখিতে পারেন নাই। যে বন্য পথ তাঁহাদিগের আশ্রয়স্থান হইতে বাহির হইয়াছিল, সে পথপ্রান্তে দাঁড়াইয়া কাপালিক ও নবকুমার তাঁহাদিগের প্রতি যে করাল দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন, তাহা কিছুই দেখিতে পারেন নাই।

 নবকুমার ও কাপালিক ইঁহাদিগের প্রতি দৃষ্টি করিয়াছিলেন মাত্র, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তত দূর হইতে তাহাদিগের কথোপকথনের মধ্য কিছুই তদুভয়ের শ্রুতিগোচর হইল না। মনুষ্যের চক্ষুঃ কর্ণ যদি সমদূরগামী হইত, তবে মনুষ্যের দুঃখস্রোত শমিত কি বর্দ্ধিত হইত তাহা কে বলিবে? লোকে বলিয়া থাকে সংসাররচনা অপূর্ব্ব কৌশলময়।

 নবকুমার দেখিলেন কপালকুণ্ডলা আলুলায়িতকুন্তলা; যখন কপালকুণ্ডলা তাঁহার হয় নাই তখনই সে কুন্তল বাঁধিত না। আবার দেখিলেন যে সেই কুন্তলরাশি আসিয়া ব্রাহ্মণকুমারের পৃষ্ঠদেশে পড়িয়া তাঁহার অংসসম্বিলম্বী কেশদামের সহিত মিশিয়াছে। কপালকুণ্ডলার কেশরাশি ঈদৃশ আয়তনশালী এবং লঘু স্বরে কথোপকথনের প্রয়োজনে উভয়ে এরূপ সন্নিকটবর্তী হইয়া বসিয়াছিলেন, যে লুৎফ-উন্নিসার পৃষ্ঠ পর্য্যন্ত কপালকুণ্ডলার কেশের সম্প্রসারণ কেহই দেখিতে পায়েন নাই। দেখিয়া, নবকুমার ধীরে ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।

 কাপালিক ইহা দেখিয়া নিজ কটিবিলম্বী এক নারিকেলপাত্র বিমুক্ত করিয়া কহিলেন, “বৎস! বল হারাইতেছ, এই মহৌষধ পান কর; ইহা ভবানীর প্রসাদ। পান করিয়া বল পাইবে।”

 কাপালিক পাত্র নবকুমারের মুখের নিকট ধরিল। তিনি অন্যমনে পান করিয়া দারুণ তৃষা নিবারণ করিলেন। নবকুমার জানিতেন না যে এই সুস্বাদ পেয় কাপালিকের স্বহস্তপ্রস্তুত প্রচণ্ড তেজস্বিনী সুরা। পান করিবামাত্র কিছু সবল হইলেন।

 এ দিকে লুৎফ-উন্নিসা পূর্ব্ববৎ মৃদু স্বরে কপালকুণ্ডলাকে কহিতে লাগিলেন,

 “ভগিনি! তুমি যে কার্য্য করিলে তাহার প্রতিশোধ করিবার আমার ক্ষমতা নাই, তবু যদি আমি চিরদিন তোমার মনে থাকি সেও আমার সুখ। যে অলঙ্কার গুলিন দিয়াছিলাম, তাহা শুনিয়াছি তুমি দরিদ্রকে বিতরণ করিয়াছ। এক্ষণে নিকটে কিছুই নাই, কল্যকার অন্য প্রয়োজন ভাবিয়া কেশ মধ্যে একটী অঙ্গুরীয় আনিয়াছিলাম, জগদীশ্বরের কৃপায় সে পাপপ্রয়োজনসিদ্ধির আবশ্যক হইল না। এই অঙ্গুরীয়টী তুমি রাখ। ইহার পরে অঙ্গুরীয় দেখিয়া যবনী ভগিনীকে মনে করিও। আজি যদি স্বামী জিজ্ঞাসা করেন, অঙ্গুরীয় কোথায় পাইলে, কহিও, লুৎফ-উন্নিসা দিয়াছে।” ইহা কহিয়া লুৎফ-উন্নিসা আপন অঙ্গুলি হইতে বহু ধনে ক্রীত এক অঙ্গুরীয় উন্মোচিত করিয়া কপালকুণ্ডলার হস্তে দিলেন। নবকুমার তাহাও দেখিতে পাইলেন; কাপালিক তাঁহাকে ধরিয়াছিলেন, আবার তাঁহাকে কম্পমান দেখিয়া পুনরপি মদিরা সেবন করাইলেন। মদিরা নবকুমারের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়া তাঁহার প্রকৃতি সংহার করিতে লাগিল; স্নেহের অঙ্কুর পর্যন্ত উন্মূলিত করিতে লাগিল।

 কপালকুণ্ডলা লুৎফ্-উন্নিসার নিকট বিদায় হইয়া গৃহাভিমুখে চলিলেন। তখন নবকুমার ও কাপালিক লুৎফ্-উন্নিসার অদৃশ্য পথে কপালকুগুলার অনুসরণ করিতে লাগিলেন।