কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

কাননতলে।

——————Tender is the night,
And happy the Queen moon is on her throne
Olustered around by all her starry fays;
 But here there is no light.

Keats.

সপ্তগ্রামের এই ভাগ যে বনময় তাহা পূর্ব্বেই কতক কতক উল্লিখিত হইয়াছে। গ্রামের কিছু দূরে নিবিড় বন। কপালকুণ্ডলা একাকিনী এক সঙ্কীর্ণ বন্য পথে ঔষধির সন্ধানে চলিলেন। যামিনী মধুরা, একান্ত শব্দমাত্রবিহীনা। মাধবী যামিনীর আকাশে স্নিগ্ধরশ্মিময় চন্দ্র নীরবে শ্বেত মেঘ খণ্ড সকল উত্তীর্ণ হইতেছে: পৃথিবীতলে, বন্য বৃক্ষ লতা সকল তদ্রূপ নীরবে শীতল চন্দ্রকরে বিশ্রাম করিতেছে; নীরবে বৃক্ষপত্র সকল সে কিরণের প্রতিঘাত করিতেছে; নীরবে লতা গুল্ম মধ্যে শ্বেত কুসুমদল বিকশিত হইয়া রহিয়াছে। পশু পক্ষী নীরব। কেবল কোথাও কদাচিৎ মাত্র ভগ্নবিশ্রাম কোন পক্ষীর পক্ষস্পন্দনশব্দ; কোথাও কচিৎ শুষ্কপত্রপাতশব্দ; কোথাও তলস্থ শুষ্কপত্র মধ্যে উরগ জাতীয় জীবের ক্বচিৎ গতিজনিত শব্দ; ক্বচিৎ অতি দূরস্থ কুক্কুররব। এমত নহে যে একেবারে বায়ু বহিতেছিল না; মধু মাসের দেহস্নিগ্ধকর বায়ু; অতিমন্দ; একান্ত নিঃশব্দ বায়ু মাত্র; তাহাতে কেবল মাত্র বৃক্ষের সর্ব্বাগ্রভাগারূঢ় পত্রগুলিন হেলিতেছিল, কেবলমাত্র আভূমিপ্রণত শ্যামালতা দুলিতেছিল; কেবল মাত্র নীলাম্বরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ড গুলিন ধীরে ধীরে চলিতেছিল। কেবল মাত্র, তদ্রূপ বায়ু সংসর্গে সম্ভুক্ত পূর্ব্ব সুখের অস্পষ্ট স্মৃতি হৃদয়ে অল্প জাগরিত হইতেছিল।

 কপালকুণ্ডলার সেইরূপ পূর্ব্বস্মৃতি জাগরিত হইতেছিল; বালিয়াড়ীর শিখরে যে, সাগরবারিবিন্দুসংস্পৃষ্ট মলয়ানিল তাহার লম্বালকমণ্ডল মধ্যে ক্রীড়া করিত, তাহা মনে পড়িল; অমল নীলানন্ত গগণ প্রতি চাহিয়া দেখিলেন; সেই অমল নীলানন্ত গগণরূপী সমুদ্র মনে পড়িল। কপালকুণ্ডলা পূর্ব্বস্মৃতি সমালোচনায় অন্যমনা হইয়া চলিলেন।

 অন্য মনে যাইতে যাইতে কোথায় কি উদ্দেশে যাইতেছিলেন, কপালকুণ্ডলা তাহা ভাবিলেন না। যে পথে যাইতেছিলেন, তাহা ক্রমে অগম্য হইয়া আসিল; বন নিবিড়তর হইল; শিরোপরে ব্রক্ষশাখাবিন্যাসে চন্দ্রলোক প্রায় একেবারে ৰুদ্ধ হইয়া আসিল, ক্রমে আর পথ দেখা যায় না। পথের অলক্ষ্যতায় প্রথমে কপালকুণ্ডলা চিন্তামগ্নতা হইতে উত্থিত হইলেন। ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন এই নিবিড় বনমধ্যে আলো জ্বলিতেছে। লুৎফ্-উন্নিসাও পূর্ব্বে এই আলো দেখিয়াছিলেন। কপালকুণ্ডলা পূর্ব্বাভ্যাসফলে এ সকল সময়ে ভয়হীনা, অথচ কৌতূহলময়ী। ধীরে ধীরে সেই দীপজ্যোতিরভিমুখে গেলেন। দেখিলেন, যথায় আলো জ্বলিতেছে তথার কেহ নাই। কিন্তু তাহার অনতিদূরে বননিবিড়তা হেতু দূর হইতে অদৃশ্য একটি ভগ্ন গৃহ আছে। গৃহটি ইষ্টকনির্মিত, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য; তাহাতে একটি মাত্র ঘর। সেই ঘর হইতে মনুষ্যকথোপকথন নির্গত হইতেছিল, কপালকুণ্ডলা নিঃশব্দ পদক্ষেপে গৃহ সন্নিধানে গেলেন। গৃহের নিকটবর্ত্তী হইবামাত্র বোধ হইল দুই জন মনুষ্য সাবধানে কথোপকথন করিতেছে। প্রথমে কথোপকথন কিছুই বুঝিতে পারিলেন না; পরে ক্রমে চেষ্টাজনিত কর্ণের তীক্ষ্ণতা জন্মিলে নিম্নলিখিত মত কথা শুনিত পাইলেন।

 এক জন কহিতেছে, “আমার অভীষ্ট মৃত্যু, ইহাতে তোমার অভিমত না হয়, আমি তোমার সাহায্য করিব না; তুমিও আমার সহায়তা করিও না।”

 অপর ব্যক্তি কহিল, “আমিও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী নহি; কিন্তু যাবজ্জীবন জন্য ইহার নির্ব্বাসন হয়, তাহাতে আমি সম্মত আছি। কিন্তু হত্যার কোন উদ্যোগ আমা হইতে হইবে না; বরং তাহার প্রতিকূলাচরণ করিব।”

 প্রথমালাপকারী কহিল, “তুমি অতি অবোধ, অজ্ঞান। তোমায় কিছু জ্ঞান দান করিতেছি। মনঃসংযোগ করিয়া শ্রবণ কর। অতি গূঢ় বৃত্তান্ত বলিব; চতুর্দ্দিক্ এক বার দেখিয়া আইস, যেন মনুষ্যশ্বাস শুনিতে পাইতেছি।”

 বাস্তবিক কপালকুণ্ডলা কথোপকথন উত্তমরূপে শুনিবার জন্য কক্ষ্যাপ্রাচীরের অতি নিকটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এবং তাঁহার আগ্রহাতিশয় এবং শঙ্কার কারণে ঘন ঘন গুরু শ্বাস বহিতেছিল।

 সমভিব্যাহারীর কথায় গৃহমধ্যস্থ এক ব্যক্তি বাহিরে আসিলেন, এবং আসিয়াই কপালকুণ্ডলাকে দেখিতে পাইলেন। কপালকুণ্ডলাও পরিষ্কার চন্দ্রালোকে আগন্তুক পুরুষের অবয়ব সুস্পষ্ট করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া ভীতা হইবেন, কি প্রফুল্লিতা হইবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। দেখিলেন, আগন্তুক ব্রাহ্মণবেশী সামান্য ধূতি পরিধান; গাত্র উত্তরীয়ে উত্তমরূপে আচ্ছাদিত। ব্রাহ্মণকুমার, অতি কোমলবয়স্ক; মুখমণ্ডলে বয়শ্চিহ্ণ কিছুমাত্র নাই। মুখ খানি পরম সুন্দর, সুন্দরী রমণীমুখের ন্যায় সুন্দর, কিন্তু রমণীর দুর্ল্লভ তেজোগর্ব্ববিশিষ্ট। তাঁহার কেশ গুলিন সচরাচর পুরুষদিগের কেশের ন্যায় ক্ষৌর-কার্য্যাবশেষাত্মক মাত্র নহে, স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় অচ্ছিন্নাবস্থায় উত্তরীয় প্রচ্ছন্ন করিয়া পৃষ্ঠদেশে, অংসে, বাহুদেশে, কদাচিৎ বক্ষে সংসর্পিত হইয়া পড়িয়াছে। ললাট প্রশস্ত, ঈষৎ স্ফীত, মধ্যস্থলে এক মাত্র শিরাপ্রকাশশোভিত। চক্ষু দুটি বিদ্যুত্তেজঃপরিপূর্ণ। কোষশূন্য এক দীর্ঘ তরবারি হস্তে ছিল। কিন্তু এ রূপরাশি মধ্যে এক ভীষণ ভাব ব্যক্ত হইতেছিল। হেমকান্ত বর্ণে যেন কোন করাল কামনার ছায়া পড়িয়াছিল। অন্তস্তল পর্য্যন্ত অন্বেষণক্ষম কটাক্ষ দেখিয়া কপালকুণ্ডলার ভীতিসঞ্চার হইল।

 উভয়ে উভয়ের প্রতি ক্ষণ কাল চাহিয়া রহিলেন। প্রথমে কপালকুণ্ডলা নয়নপল্লব নিক্ষিপ্ত করিলেন। কপালকুণ্ডলা নয়নপল্লব নিক্ষিপ্ত করাতে আগন্তুক তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”

 যদি এক বৎসর পূর্ব্বে হিজলীর কিয়াবনে কপালকুণ্ডলার প্রতি এ প্রশ্ন হইত, তবে তিনি তৎক্ষণেই সঙ্গত উত্তর দিতেন। কিন্তু এখন কপালকুণ্ডলা কতক দূর গৃহরমণীর স্বভাবসম্পন্না হইয়াছিলেন, সুতরাং সহসা উত্তর করিতে পারিলেন না। ব্রাহ্মণবেশী কপালকুণ্ডলাকে নিরুত্তরা দেখিয়া গাম্ভীর্য্যের সহিত কহিলেন, “কপালকুণ্ডলা! তুমি রাত্রে এ নিবিড় বন মধ্যে কি জন্য আসিয়াছ?”

 অজ্ঞাত রাত্রিচর পুরুষের মুখে আপন নাম শুনিয়া কপালকুণ্ডলা অবাক হইলেন, কিছু ভীতও হইলেন। সুতরাং সহসা কোন উত্তর তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইল না।

 ব্রাহ্মণবেশী পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন “তুমি আমাদিগের কথা বার্তা শুনিয়াছ?”

 সহসা কপালকুণ্ডলা বাক্‌শক্তি পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন। তিনি উত্তর না দিয়া কহিলেন “আমিও তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি। এ কানন মধ্যে তোমরা দুই জনে এ নিশীথে কি কুপরামর্শ করিতেছিলে?”

 ব্রাহ্মণ কিছু কাল নিরুত্তরে চিন্তামগ্ন হইয়া রহিলেন। যেন কোন নূতন ইষ্টসিদ্ধির উপায় তাঁহার চিত্ত মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল। তিনি কপালকুণ্ডলার হস্তধারণ করিলেন এবং হস্ত ধরিয়া ভগ্ন গৃহ হইতে কিছু দূরে লইয়া যাইতে লাগিলেন। কপালকুণ্ডলা অতি ক্রোধে হস্ত মুক্ত করিয়া লইলেন। ব্রাহ্মণবেশী অতি মৃদুম্বরে কপালকুণ্ডলার কাণের কাছে কহিলেন,

 “চিন্তা কি? আমি পুরুষ নহি।”

 কপালকুণ্ডলা আরও চমৎকৃতা হইলেন। এ কথায় তাঁহার কতক বিশ্বাস হইল, সম্পূর্ণ বিশ্বাসও হইল না। তিনি ব্রাহ্মণবেশধারিণীর সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। ভগ্ন গৃহ হইতে অদৃশ্য স্থানে গিয়া ব্রাহ্মণবেশী কপালকুণ্ডলাকে কর্ণে কর্ণে কহিলেন, “আমরা যে কুপরামর্শ করিতেছিলাম তাহা শুনিবে? সে তোমারই সম্বন্ধে।”

 কপালকুণ্ডলার ভয় এবং আগ্রহ অতিশয় বাড়িল। কহিলেন, “শুনিব।”

 ছদ্মবেশিনী কহিলেন, “তবে যত ক্ষণ না প্রত্যাগমন করি তত ক্ষণ এই স্থানে প্রতীক্ষা কর।”

 এই বলিয়া ছদ্মবেশিনী ভগ্ন গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন; কপালকুণ্ডলা কিয়ৎক্ষণ তথায় বসিয়া রহিলেন। কিন্তু যাহা দেখিয়া ও শুনিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার অতি উৎকট ভয় জন্মিয়াছিল। এক্ষণে একাকিনী অন্ধকার বনমধ্যে বসিয়া আরও ভয় বাড়িতে লাগিল। বিশেষ এই ছদ্মবেশী তাঁহাকে কি অভিপ্রায়ে তথায় বসাইয়া রাখিয়া গেল, তাহা কে বলিতে পারে? হয় ত সুযোগ পাইয়া আপনার মন্দ অভিপ্রায় সিদ্ধ করিবার জন্যই বসাইয়া রাখিয়া গিয়াছে। এইরূপ আলোচনা করিয়া কপালকুণ্ডলা ভীতিবিহ্বল হইলেন। এ দিকে ব্রাহ্মণবেশীর প্রত্যাগমনে অনেক বিলম্ব হইতে লাগিল। কপালকুণ্ডলা আর বসিতে পারিলেন না। উঠিয়া দ্রুত পাদবিক্ষেপে গৃহাভিমুখে চলিলেন।

 তখন আকাশমণ্ডল ঘনঘটায় মসীময় হইয়া আসিতে লাগিল; কাননতলে যে সামান্য আলো ছিল, তাহাও অন্তর্হিত হইতে লাগিল। কপালকুণ্ডলা আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিতে পারিলেন না। শীঘ্রপদে কাননাভ্যন্তর হইতে বাহিরে আসিতে লাগিলেন। আসিবার সময়ে যেন পশ্চাদ্ভাগে অপর ব্যক্তির পদক্ষেপধ্বনি শুনিতে পাইলেন। কিন্তু মুখ ফিরাইয়া অন্ধকারে কিছু দেখিতে পাইলেন না। কপালকুণ্ডলা মনে করিলেন ব্রাহ্মণবেশী তাঁহার পশ্চাৎ আসিতেছেন। বনত্যাগ করিয়া পূর্ব্ববর্ণিত ক্ষুদ্র বনপথে আসিয়া বাহির হইলেন। তথায় তাদৃশ অন্ধকার নহে; দৃষ্টিপথে মনুষ্য থাকিলে দেখা যায়। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। কপালকুণ্ডলা মনে করিলেন তাঁহার চিত্তভ্রান্তি জন্মিয়াছে। অতএব দ্রুতপদে চলিলেন। কিন্তু আবার স্পষ্ট মনুষ্যগতিশব্দ শুনিতে পাইলেন। আকাশ নীল কাদম্বিনীতে ভীষণতর হইল। কপালকুণ্ডলা আরও দ্রুত চলিলেন। গৃহ অনতিদূরে, কিন্তু গৃহপ্রাপ্তি হইতে না হইতেই প্রচণ্ড ঝটিকা বৃষ্টি ভীষণ রবে প্রঘোষিত হইল। কপালকুণ্ডলা দৌড়াইলেন। পশ্চাতে যে আসিতেছিল, সেও যেন দৌড়াইল, এমত শব্দ বোধ হইল। গৃহ দৃষ্টিপথবর্ত্তী হইবার পূর্ব্বেই প্রচণ্ড ঝটিকা বৃষ্টি কপালকুণ্ডলার মস্তকের উপর দিয়া প্রধাবিত হইল। ঘন ঘন গম্ভীর মেঘশব্দ, এবং অশনিসম্পাত শব্দ হইতে লাগিল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল। মূষল ধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। কপালকুণ্ডলা কোন ক্রমে আত্মরক্ষা করিয়া গৃহে আসিলেন। প্রাঙ্গনভূমি পার হইয়া প্রকোষ্ঠ মধ্যে উঠিলেন। দ্বার তাঁহার জন্য খোলা ছিল। দ্বার ৰুদ্ধ করিবার জন্য প্রাঙ্গনের দিকে সম্মুখ ফিরিলেন। বোধ হইল যেন প্রাঙ্গনভূমিতে এক দীর্ঘাকার পুৰুষ দাঁড়াইয়া আছে। এই সময়ে এক বার বিদ্যুৎ চমকিল। একবার বিদ্যুতেই তাহাকে চিনিতে পারিলেন! সে সাগরতীরপ্রবাসী সেই কাপালিক!