কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

প্রতিযোগিনী গৃহে।

শ্যামাদন্যো নহি নহি নহি প্রাণনাথোমমাস্তে।

<div style="text-align:right; padding-top: 0em; margin-right:ঊদ্ধবদূত; ">

এ সময়ে শের আফগান বঙ্গদেশের সুবাদারের অধীনে বর্দ্ধমানের কর্ম্মাধ্যক্ষ হইয়া অবস্থিতি করিতেছিলেন।

 মতি বিবি বর্দ্ধমানে আসিয়া শের আফগানের আলয়ে উপনীত হইলেন। শের আফগান সপরিবারে তাঁহাকে অত্যন্ত সমাদরে তথায় অবস্থিতি করাইলেন। যখন শের আফগান এবং তাঁহার স্ত্রী মেহের-উন্নিসা আগ্রায় অবস্থিতি করিতেন তখন মতি তাঁহাদিগের নিকট বিশেষ পরিচিতা ছিলেন। মেহের-উন্নিসার সহিত তাঁহার বিশেষ প্রণয় ছিল। পরে উভয়েই দিল্লীর সাম্রাজ্য লাভের জন্য প্রতিযোগিনী হইয়াছিলেন। এক্ষণে একত্র হওয়ায় মেহের-উন্নিসা মনে ভাবিতেছেন, “ভারতবর্ষের কর্ত্তৃত্ব কাহার অদৃষ্টে বিধাতা লিখিয়াছেন? বিধাতাই জানেন, আর সেলিম জানেন। আর কেহ যদি জানে ত সে এই লুৎফ্-উন্নিসা, দেখি, লুৎফ্-উন্নিসা কি কিছু প্রকাশ করিবে না?” মতি বিবিরও মেহের-উন্নিসার মন জানিবার চেষ্টা।

 মেহের-উন্নিসা তৎকালে ভারতবর্ষ মধ্যে প্রধানা রূপবর্তী এবং গুণবতী বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ তাদৃশ রমণী ভূমণ্ডলে অতি অল্পই জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। সৌন্দর্য্যে ইতিহাসকীর্ত্তিতা স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে তাঁহার প্রাধান্য ঐতিহাসিক মাত্রেই স্বীকার করিয়া থাকেন। কোন প্রকার বিদ্যায় তাৎকালিক পুৰুষদিগের মধ্যে বড় অনেকে তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন না। নৃত্য গীতে মেহের-উন্নিসা অদ্বিতীয়া; কবিতা রচনায় বা চিত্র লিখনেও তিনি সকলের মনোমুগ্ধ করিতেন। তাঁহার সরস কথা তাঁহার সৌন্দর্য্য অপেক্ষাও মোহময়ী ছিল। মতিও এসকল গুণে হীনা ছিলেন না। অদ্য এই দুই চমৎকারকারিণী পরস্পরের মন জানিতে উৎসুক হইলেন।

 মেহের-উন্নিসা খাস কামরায় বসিয়া তসবীর লিখিতেছিলেন, মতি মেহের-উন্নিসার পৃষ্ঠের উপর বসিয়া চিত্র লিখন দেখিতে ছিলেন, এবং তাম্বুল চর্ব্বণ করিতেছিলেন। মেহের-উন্নিসা জিজ্ঞাসা করিলেন, যে “চিত্র কেমন হইতেছে?” মতিবিবি উত্তর করিলেন “তোমার চিত্র যে রূপ হইয়া থাকে তাহাই হইতেছে। অন্য কেহ যে তোমার ন্যায় চিত্রনিপুণ নহে, ইহাই দুঃখের বিষয়।”

 মেহে। “তাই যদি সত্য হয় ত দুঃখের বিষয় কেন?”

 ম। “অন্যের তোমার মত চিত্রনৈপুণ্য থাকিলে তোমার এ মুখের আদর্শ রাখিতে পারিত।”

 মেহে। “কবরের মাটিতে মুখের আদর্শ থাকিবে,” মেহের-উন্নিসা এই কথা কিছু গাম্ভীর্য্যের সহিত কহিলেন।

 ম। “ভগিনি—আজ মনের স্ফূর্ত্তির এত অল্পতা কেন?”

 মেহে। “স্ফূর্ত্তির অল্পতা কই? তবে যে তুমি আমাকে কাল প্রাতে ত্যাগ করিয়া যাইবে তাহাই বা কি প্রকারে ভুলিব? আর দুই দিন থাকিয়া তুমি কেনই বা চরিতার্থ না করিবে?'

 ম।“সুখে কার অসাধ। সাধ্য হইলে আমি কেন যাইব? কিন্তু আমি পরের অধীন; কি প্রকারে থাকিব?”

 মেহে। আমার প্রতি তোমার ত ভালবাসা আর নাই, থাকিলে তুমি কোন মতে রহিয়া যাইতে। আসিয়াছ ত রহিতে পার না কেন?”

 ম। “আমি ত সকল কথাই বলিয়াছি। আমার সহোদর মোগল সৈন্যে মন্‌সব্‌দার—তিনি উড়িষ্যার পাঠানদিগের সহিত যুদ্ধে আহত হইয়া শঙ্কটাপন্ন হইয়া ছিলেন। আমি তাঁহারই বিপৎ সম্বাদ পাইয়া বেগমের অনুমতি লইয়া তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছিলাম। উড়িষ্যায় অনেক বিলম্ব করিয়াছি, এক্ষণে আর বিলম্ব করা উচিত নহে। তোমার সহিত অনেক দিন দেখা হয় নাই, এই জন্য দুই দিন রহিয়া গেলাম।”

 মেহে। “বেগমের নিকট কোন্ দিন পৌছিবার বিষয় স্বীকার করিয়া আসিয়াছ?”

 মতি বুঝিলেন, মেহের-উন্নিসা ব্যঙ্গ করিতেছেন। মার্জ্জিত অথচ মর্ম্মভেদী ব্যঙ্গে মেহের-উন্নিসা যে রূপনিপুণ, মতি সে রূপ নহেন। কিন্তু অপ্রতিভ হইবার লোকও নহেন। তিনি উত্তর করিলেন,

 “দিন নিশ্চিত করিয়া তিন মাসের পথ যাতায়াত করা কি সম্ভবে? কিন্তু অনেক কাল বিলম্ব করিয়াছি; আর বিলম্বে অসন্তোষের কারণ জন্মাইতে পারে।”

 মেহের-উন্নিসা নিজ ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া কহিলেন, “কাহার অসন্তোষের আশঙ্কা করিতেছ? যুবরাজের না তাঁহার মহিষীর?”

 মতি কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়। কহিলেন “এ লজ্জাহীনাকে কেন লজ্জা দিতে চাও? উভয়েরই অসন্তোষ হইতে পারে।”

 মে। “কিন্তু জিজ্ঞাসা করি,—তুমি স্বয়ং বেগম নাম ধারণ করিতেছ না কেন? শুনিয়াছিলাম কুমার সেলিম তোমাকে বিবাহ করিয়া খাস বেগম করিবেন। তাহার কত দূর?”

 ম। “আমি ত সহজেই পরাধীনা। যে কিছু স্বাধীনতা আছে, তাহা কেন নষ্ট করিব। বেগমের সহচারিণী বলিয়া অনায়াসে উড়িষ্যায় আসিতে পারিলাম; সেলিমের বেগম হইলে কি উড়িষ্যায় আসিতে পারিতাম?”

 মে। “যে দিল্লীশ্বরের প্রধানা মহিষী হইবে তাহার উড়িষ্যায় আসিবার প্রয়োজন?”

 ম। “সেলিমের প্রধান। মহিষী হইব, এমত স্পর্দ্ধা কখন করি না।—এ হিন্দুস্থান দেশে কেবল মেহের-উন্নিসাই দিল্লীশ্বরের প্রাণেশ্বরী হইবার উপযুক্ত।”

 মেহের-উন্নিসা মুখ নত করিলেন। ক্ষণেক নিরুত্তর থাকিয়া কহিলেন—“ভগিনি—আমি এমত মনে করি না। যে তুমি আমাকে পীড়া দিবার জন্য এ কথা বলিলে, কি আমার মন জানিবার জন্য বলিলে। কিন্তু তোমার নিকট আমার এই ভিক্ষা, আমি যে শের আফগানের বনিতা, আমি যে কায়মনোবাক্যে শের আফগানের দাসী—তাহা তুমি বিস্মৃত হইয়া কথা কহিও না।”

 লজ্জাহীনা মতি এ তিরস্কারে অপ্রতিভ হইলেন না। বরং আরও সুযোগ পাইলেন, কহিলেন, “তুমি যে পতিগতপ্রাণা তাহা আমি বিলক্ষণ জানি। সেই জন্যই ছলক্রমে একথা তোমার সমুখে পাড়িতে সাহস করিয়াছি। সেলিম যে এ পর্যন্ত তোমার সৌন্দর্য্যের মোহ ভুলিতে পারেন নাই, এই কথা বলা আমার উদ্দেশ্য। সাবধান থাকিও।”

 মে। এখন বুঝিলাম। কিন্তু কিসের আশঙ্কা?” মতি কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করিয়া কহিলেন “বৈধব্যের আশঙ্কা।”

 এই কথা বলিয়া মতি মেহের-উন্নিসার মুখপানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি করিয়া রহিলেন, কিন্তু ভয় বা আহ্লাদের কোন চিহ্ন তথায় দেখিতে পাইলেন না। মেহের-উন্নিসা সদর্পে কহিলেন,

 “বৈধব্যের আশঙ্কা! শের আফগান আত্মরক্ষার অক্ষম নহে। বিশেষ আকবর বাদশাহের রাজ্যমধ্যে তাঁহার পুত্ত্রও বিনা দোষে পরপ্রাণ নষ্ট করিয়া নিস্তার পাইবেন না।”

 ম। “সত্য কথা, কিন্তু সম্প্রতিকার আগ্রার সম্বাদ এই যে, আকবর শাহ গত হইয়াছেন। সেলিম সিংহাসনারূঢ় হইয়াছেন। দিল্লীশ্বরের দমন করিবে?”

 মেহের-উন্নিসা আর কিছু শুনিলেন না। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া কাঁপিতে লাগিল। আবার মুখ নত করিলেন—লোচনযুগলে অশ্রুধারা বহিতে লাগিল। মতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাঁদ কেন?”

 মেহের-উন্নিসা নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন “সেলিম ভারতবর্ষের সিংহাসনে, আমি কোথায়?”

 মতির মনস্কাম সিদ্ধ হইল। তিনি কহিলেন, “তুমি কি আজও যুবরাজকে একেবারে বিস্মৃত হইতে পার নাই?”

 মেহের-উন্নিসা গদ গদ স্বরে কহিলেন “কাহাকে বিস্মৃত হইব? আত্মজীবন বিস্মৃত হইব, তথাপি যুবরাজকে বিস্মৃত হইতে পারিব না। কিন্তু শুন ভগিনি—অকস্মাৎ মনের কবাট খুলিল; তুমি এ কথা শুনিলে; কিন্তু আমার শপথ, একথা যেন কর্ণান্তরে না যায়।”

 মতি কহিল, “ভাল তাহাই হইবে। কিন্তু যখন সেলিম শুনিবেন যে আমি বর্দ্ধমানে আসিয়াছিলাম, তখন তিনি অবশ্য জিজ্ঞাসা করিবেন যে মেহের-উন্নিসা আমার কথা কি বলিল? তখন আমি কি উত্তর করিব?”

 মেহের-উন্নিসা কিছু ক্ষণ ভাবিয়া কহিলেন “এই কহিও যে মেহের-উন্নিসা হৃদয়মধ্যে তাঁহার ধ্যান করিবে। প্রয়োজন হইলে তাঁহার জন্য আত্মপ্রাণ পর্যন্ত সমর্পণ করিবে। কিন্তু কখন আপন কুলমান সমর্পণ করিবে না। দাসীর স্বামী জীবিত থাকিতে সে কখন দিল্লীশ্বরকে মুখ দেখাইবে না। আর যদি দিল্লীশ্বর কর্ত্তৃক তাহার স্বামীর প্রাণান্ত হয়, তবে স্বামিহন্তার সহিত ইহজন্মে তাহার মিলন হইবেক না।”

 এই কহিয়া মেহের-উন্নিসা সে স্থান হইতে উঠিয়া গেলেন। মতিবিবি চমৎকৃতা হইয়া রহিলেন। কিন্তু মতি বিবিরই জয় হইল। মেহের-উন্নিসার চিত্তের ভাব মতিবিবি জানিলেন; মতিবিবির আশা ভরসা মেহের-উন্নিসা কিছুই জানিতে পারিলেন না। যিনি পরে আত্মবুদ্ধিপ্রভাবে দিল্লীশ্বরেরও ঈশ্বরী হইয়াছিলেন, তিনিও মতির নিকট পরাজিতা হইলেন! ইহার কারণ মেহের-উন্নিসা প্রণয়শালিনী; মতিবিধি এ স্থলে কেবলমাত্র স্বার্থপরায়ণা।

 মনুষ্য হৃদয়ের বিচিত্র গতি মতি বিবি বিলক্ষণ বুঝিতেন। মেহের-উন্নিসার কথা আলোচনা করিয়া তিনি যাহা সিদ্ধান্ত করিলেন, কালে তাহাই যথার্থীভূত হইল। তিনি বুঝিলেন যে মেহের-উন্নিসা জাঁহাগীরের যথার্থ অনুরাগিণী; অতএব নারীদর্পে এখন যাহাই বলুন, পথমুক্ত হইলে মনের গতি রোধ করিতে পারিবেন না। বাদশাহের মনস্কামনা অবশ্য সিদ্ধ করিবেন।

 এ সিদ্ধান্তে মতির আশা ভরসা সকলই নির্মূল হইল। কিন্তু তাহাতে কি মতি নিতান্তই দুঃখিত হইলেন? তাহা নহে। বরং ঈষৎ সুখানুভবও হইল। কেন যে এমন অসম্ভব চিত্ত প্রসাদ জন্মিল তাহা মতি প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না। তিনি আগ্রার পথে যাত্রা করিলেন। পথে কয়েক দিন গেল। সেই কয়েক দিনে আপন চিত্তভাব বুঝিলেন।