কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

আত্মমন্দিরে।

জনম অবধি হম রূপ নিহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোই মধুর বোল শ্রবণহি শুননু শ্রুতিপথে পরশ না গেল॥
কত মধু যামিনী রভসে গোয়াইনু না বুঝনু কৈছন না কেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুড়ন না গেল॥
যত যত রসিক জন রসে অনুগমন অনুভব কাহু না দেখ।
বিদ্যাপতি কহে প্রাণ জুড়াইতে লাখে না মিলল এক॥

লুতফ্-উন্নিসা আলয়ে আসিয়া প্রফুল্ল-বদনে পেষ্‌মন্‌কে ডাকিয়া বেশভূষা পরিত্যাগ করিলেন। সুবর্ণ মুক্তাদি খচিত বসন পরিত্যাগ করিয়া পেষ্‌মনকে কহিলেন যে “এই পোষাকটি তুমি লও।”

 শুনিয়া পেষ্‌মন্ কিছু বিস্ময়াপন্না হইলেন। পোষাকটি বহুমূল্যে সম্প্রতি মাত্র প্রস্তুত হইয়া ছিল। কহিলেন, “পোষাক আমায় কেন? আজিকার কি সম্বাদ?”

 লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন, “শুভ সম্বাদ বটে।”

 পে। “তা ত বুঝিতে পারিতেছি। মেহের-উন্নিসার ভয় কি ঘুচিয়াছে?”

 লু। “ঘুচিয়াছে। এক্ষণে সে বিষয়ের কোন চিন্তা নাই।” পেষ্‌মন্ অত্যন্ত আহ্লাদ প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “তবে এক্ষণে বেগমের দাসী হইলাম।”

 লু। “যদি তুমি বেগমের দাসী হইতে চাও, তবে আমি মেহের-উন্নিসাকে বলিয়া দিব।”

 পে। “সে কি? আপনি কহিতেছেন যে মেহের-উন্নিসা বাদশাহের বেগম হইবার কোন সম্ভাবনা নাই।

 লু। “আমি এমত কথা বলি নাই। আমি বলিয়াছি সে বিষয়ে আমার কোন চিন্তা নাই।”

 পে। “চিন্তা নাই কেন? আপনি আগ্রায় একমাত্র অধীশ্বরী না হইলে যে সকলই বৃথা হইল।”

 লু। “আগ্রার সহিত সম্পর্ক রাখিব না।”

 পে। “সে কি? আমি যে বুঝিতে পারিতেছি না, আজিকার শুভ সম্বাদ টা তবে কি বুঝাইয়াই বলুন।”

 লু। “শুভ সম্বাদ এই যে আমি এ জীবনের মত আগ্রা ত্যাগ করিয়া চলিলাম।”

 পে। “কোথায় যাইবেন?”

 লু। “বাঙ্গলায় গিয়া বাস করিব। পারি যদি কোন ভদ্র লোকের গৃহিণী হইব।”

 পে। “এরূপ ব্যঙ্গ নূতন বটে, কিন্তু শুনিলে প্রাণ শিহরিয়া উঠে।”

 লু। “ব্যঙ্গ করিতেছি না। আমি সত্য সত্যই আগ্রা ত্যাগ করিয়া চলিলাম। বাদশাহের নিকট বিদায় লইয়া আসিয়াছি।”

 পে। “এমন কুপ্রবৃত্তি আপনার কেন জন্মিল?”

 লু। “কুপ্রবৃত্তি নহে। অনেক দিন আগ্রায় বেড়াইলাম, কি ফল লাভ হইল? সুখের তৃষা বাল্যাবধি বড়ই প্রবল ছিল। সেই তৃষার পরিতৃপ্তি জন্য বঙ্গদেশ ছাড়িয়া এ পর্য্যন্ত আসিলাম। এ রত্ন কিনিবার জন্য কি ধন না দিলাম? কোন্ দুষ্কর্ম্ম না করিয়াছি? আর যে যে উদ্দেশে এতদূর করিলাম তাহার কোন্‌টাই বা হস্তগত হয় নাই? ঐশ্বর্য্য, সম্পদ, ধন, গৌরব, প্রতিষ্ঠা, সকলই ত পর্য্যাপ্ত পরিমাণে ভোগ করিলাম। যে ইন্দ্রিয়ের জন্য আর সকল ভোগই বিসর্জ্জন করিতে পারি, সে ইন্দ্রিয়ও অবাধে পরিতুষ্ট করিয়াছি। এত করিয়াও কি হইল? আজি এই খানে বসিয়া সকল দিন মনে মনে গণিয়া বলিতে পারি যে, এক দিনের তরেও সুখী হই নাই, এক মুহূর্ত্ত জন্যও কখন সুখভোগ করি নাই। কখন পরিতৃপ্ত হই নাই। কেবল তৃষা বাড়ে মাত্র। চেষ্টা করিলে আরও সম্পদ, আরও ঐশ্বর্য্য লাভ করিতে পারি, কিন্তু কি জন্যে? এ সকলে যদি সুখ থাকিত তবে এত দিন এক দিনের তরেও সুখী হইতাম। এই সুখাকাঙ্ক্ষা পার্ব্বতী নির্ঝরিণীর ন্যায়,—প্রথমে নির্ম্মল, ক্ষীণ ধারা বিজন প্রদেশ হইতে বাহির হয়, আপন গর্ব্ভে আপনি লুকাইয়া রহে, কেহ জানে না, আপনা আপনি কল কল করে, কেহ শুনে না। ক্রমে যত যায়, তত দেহ বাড়ে, তত পঙ্কিল হয়, শুধু তাহাই নয়; তখন আবার বায়ু বহে, তরঙ্গ হয়, মকর কুম্ভীরাদি বাস করে। আরও শরীর বাড়ে, জল আরও কর্দ্দমময় হয়, লবণময় হয়, অগণ্য সৈকতচর মরুভূমি নদীহৃদয়ে বিরাজ করে, বেগ মন্দীভূত হইয়া যায়, তখন সেই সকর্দ্দম নদী শরীর অনন্ত সাগরে কোথায় লুকায় কে বলিবে?”

 পে। “আমি ইহার ত কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। এ সবে তোমার সুখ হয় না কেন?”

 লু। “কেন হয় না তা এত দিনে বুঝিয়াছি। তিন বৎসর রাজপ্রাসাদের ছায়ায় বসিয়া যে সুখ না হইয়াছে, উড়িষ্যা হইতে প্রত্যাগমনের পথে এক রাত্রে সে সুখ হইয়াছে। ইহাতেই বুঝিয়াছি।”

 পে। “কি বুঝিয়াছ?”

 লু। “আমি এতকাল হিন্দুদিগের দেবমূর্ত্তির মত ছিলাম। বাহিরে সুবর্ণ রত্নাদিতে খচিত; ভিতরে পাষাণ। ইন্দ্রিয় সুখান্বেষণে আগুনের মধ্যে বেড়াইয়াছি, কখন আগুন স্পর্শ করি নাই। এখন একবার দেখি যদি পাষাণ মধ্যে খুজিয়া একটা রক্তশিরা ধমনী বিশিষ্ট অন্তঃকরণ পাই?”

 পে। “এওত কিছু বুঝিতে পারিলাম না।”

 লু। “এ হীরার অঙ্গুরী তোমায় কে দিয়াছে?”

 পে। “শাহবাজ খাঁ।”

 লু। “আর সেই পান্নার কণ্ঠী?

 পে। “আজিম খাঁ।”

 লু। “আর কে কে তোমার অলঙ্কার দিয়াছে?”

 পে। (হাসিয়া) “করীম খাঁ, কোকলতাষ, রাজা জীবন সিংহ, রাজা প্রতাপাদিত্য, মুসা খাঁ—কত লোক দিয়াছে কাহার নাম করিব। এখন যা পরিয়া আগ্রার পরিচারিকা মণ্ডলে প্রাধান্য স্বীকার করাই, সে স্বয়ং জাহাঙ্গীরের দান।”

 লু। “ইহার মধ্যে কাহাকে আমি ভাল বাসিতাম?”

 পে। (হাসিয়া) “সকলকেই।”

 লু। “এত গেল মুখের কথা। মনের কথা কি?”

 পে। (চুপি চুপি) “কাহাকেও না।”

 লু। “তবে পাষাণী নই ত কি?”

 পে। “তা এখন যদি ভাল বাসিতে ইচ্ছা হয়, তবে ভাল বাস না কেন?”

 লু। “মানস ত বটে। সেই জন্য আগ্রা ত্যাগ করিয়া যাইতেছি।”

 পে। “তারই বা প্রয়োজন কি? আগ্রায় কি মানুষ নাই, যে চুয়াড়ের দেশে যাইবে? এখন যিনি তোমাকে ভাল বাসেন তাঁহাকেই কেন ভাল বাস না? রূপে বল, ধনে বল, ঐশ্বর্য্যে বল, যাহাতে বল, দিল্লীর বাদশাহের বড় পৃথিবীতে কে আছে?”

 লু। “আকাশে চন্দ্র সূর্য্য থাকিতে জল অধোগামী কেন?

 পে। “কেন?”

 লু। “ললাটলিখন!”

 লুৎফ্-উন্নিসা সকল কথা খুলিয়া বলিলেন না। পাষাণ মধ্যে অগ্নি প্রবেশ করিয়াছিল। পাষাণ দ্রব হইতেছিল।