বিষয়বস্তুতে চলুন

কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/দ্বিতীয় খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

সুন্দরী সন্দর্শনে।

——————“ধর দেবি মোহন মুরতি।
দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বর বপু আনি
নানা আভরণ!”

মেঘনাদবধ।

নবকুমার গৃহস্বামিনীকে ডাকিয়া অন্য প্রদীপ আনিতে বলিলেন। অন্য প্রদীপ আনিবার পূর্ব্বে একটী দীর্ঘ নিঃশ্বাস শব্দ শুনিতে পাইলেন। প্রদীপ আনিবার ক্ষণেক পরে ভৃত্যবেশী এক জন মুসলমান আসিয়া উপস্থিত হইল। বিদেশিনী তাহাকে দেখিয়া কহিলেন,

 “সে কি, তোমারদিগের এত বিলম্ব হুইল কেন? আর সকল কোথা?”

 ভৃত্য কহিল, “দাসেরা সকল মাতোয়ারা হইয়াছিল, তাহাদিগের গুছাইয়া আনিতে আমরা পালকীর পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। পরে ভগ্ন শিবিকা দেখিয়া এবং আপনাকে না দেখিয়া আমরা একেবারে অজ্ঞান হইয়াছিলাম। কেহ কেহ সেই স্থানে আছে; কেহ কেহ অন্যান্য দিকে আপনার সন্ধানে গিয়াছে, আমি এ দিকে সন্ধানে আসিয়াছি।”

 মতি কহিলেন, “তাহাদিগের লইয়া আইস।”

 নফর সেলাম করিয়া চলিয়া গেল; বিদেশিনী কিয়ৎকাল করলগ্নকপোলা হইয়া বসিয়া রহিলেন।

 নবকুমার বিদায় চাহিলেন। তখন মতি স্বপ্নোত্থিতার ন্যায় গাত্রোত্থান করিয়া, পূর্ব্ববৎ ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথায় অবস্থিতি করিবেন?”

 নব। “ইহারই পরের ঘরে।”

 মতি। “আপনার সে ঘরের কাছে এক খানি পালকী দেখিলাম, আপনার কি কেহ সঙ্গী আছেন?”

 “আমার স্ত্রী সঙ্গে।”

 মতি বিবি আবার ব্যঙ্গের অবকাশ পাইলেন। কহিলেন, “তিনিই কি অদ্বিতীয় রূপসী?”

 নব। “দেখিলে বুঝিতে পারিবেন?”

 মতি। “দেখা কি পাওয়া যায়?”

 নব। (চিন্তা করিয়া) “ক্ষতি কি?”

 মতি। “তবে একটু অনুগ্রহ কৰুন। অদ্বিতীয় রূপসীকে দেখিতে বড় কৌতুক হইতেছে। আগ্রা গিয়া বলিতে চাহি। কিন্তু এখনই নহে—আপনি এখন যান। ক্ষণেক পরে আমি আপনাকে সম্বাদ করিব।”

 নবকুমার চলিয়া গেলেন। ক্ষণেক পরে অনেক লোক জন দাস দাসী ও বাহক সিন্ধুকাদি লইয়া উপস্থিত হইল। এক খানি শিবিকাও আসিল; তাহাতে এক জন দাসী। পরে নবকুমারের নিকট সম্বাদ আসিল “বিবি স্মরণ করিয়াছেন।”

 নবকুমার মতি বিবির নিকট পুনরাগমন করিলেন। দেখিলেন, এবার আবার রূপান্তর। মতিবিধি, পূর্ব্ব পরিচ্ছদ ত্যাগ করিয়া সুবর্ণমুক্তাদিশোভিত কাৰুকার্য্যযুক্ত বেশ ভূষা ধারণ করিয়াছেন;—নিরলঙ্কার দেহ অলঙ্কারে খচিত করিয়াছেন। যেখানে যাহা ধরে—কুন্তলে, কবরীতে, কপালে, নয়নপার্শ্বে, কর্ণে, কণ্ঠে, হৃদয়ে, বাহুযুগে, সর্ব্বত্রে সুবর্ণ মধ্য হইতে হীরকাদি রত্ন ঝলসিতেছে। নবকুমারের চক্ষু অস্থির হইল। অধিকাংশ স্ত্রীলোক বহুস্বর্ণখচিত হইলে প্রায় কিছু শ্রীহীনা হয়;—অনেকেই সজ্জিতা পুত্তলিকার দশা প্রাপ্ত হয়েন; —কিন্তু মতি বিবিতে সে শ্রীহীনতা বা দশা দৃষ্ট হইবার সম্ভাবনা ছিল না। প্রভূতনক্ষত্রমালাভূষিত আকাশের ন্যায়—মধুরায়ত শরীর সহিত অলঙ্কার বাহুল্য সুসঙ্গত বোধ হইল বরং তাহাতে আরও সৌন্দর্য্যপ্রভা বর্দ্ধিত হইল। মতি বিবি নবকুমারকে কহিলেন, “মহাশয়, চলুন, আপনার পত্নীর নিকট পরিচিত হইয়া আসি।”

 এই কথা মতিবিধি পূর্ব্ববৎ ব্যঙ্গানুরাগের সহিত কহিলেন, কিন্তু নবকুমার শুনিলেন তাহার কণ্ঠের স্বর কিছু বিকৃত। নবকুমার মতিবিবিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিলেন। যে দাসী শিবিকারোহণে আসিয়াছিল, সেও সঙ্গে চলিল। ইহার নাম পেষ্‌মন্।

 কপালকুণ্ডলা দোকান ঘরের আর্দ্র মৃত্তিকায় একাকিনী বসিয়াছিলেন। একটী ক্ষীণালোক প্রদীপ জ্বলিতেছে মাত্র—অবদ্ধনিবিড়কেশরাশি পশ্চাদ্ভাগ অন্ধকার করিয়া রহিয়াছিল। মতিবিবি প্রথম যখন তাঁহাকে দেখিলেন, তখন অধরপার্শ্বে ও নয়নপ্রান্তে ঈষৎ হাসি ব্যক্ত হইল। ভাল করিয়া দেখিবার জন্য প্রদীপটী তুলিয়া কপালকুণ্ডলার মুখের নিকট আনিলেন। তখন সে হাসি হাসি ভাব দূর হইল;—মতির মুখ গম্ভীর হইল;—অনিমিক্ লোচনে দেখিতে লাগিলেন। কেহ কোন কথা কহেন না;—মতি মুগ্ধা, কপালকুণ্ডলা কিছু বিস্মিতা।

 ক্ষণেক পরে মতি আপন অঙ্গ হইতে অলঙ্কাররাশি মোচন করিতে লাগিলেন। নবকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিতেছ?” মতি কহিলেন, “দেখুন না।” মতি আত্মশরীর হইতে অলঙ্কাররাশি মুক্ত করিয়া একে একে কপালকুণ্ডলাকে পরাইতে লাগিলেন। কপালকুণ্ডলা কিছু বলিলেন না। নবকুমার কহিতে লাগিলেন, “ও কি হইতেছে?” মতি তাঁহার কোন উত্তর করিলেন না।

 অলঙ্কারসমাবেশ সমাপ্ত হইলে, মতি নবকুমারকে কহিলেন, “আপনি সত্যই বলিয়াছিলেন। এ ফুল রাজোদ্যানেও ফুটে না। পরিতাপ এই যে রাজধানীতে এ রূপরাশি দেখাইতে পারিলাম না। এ সকল অলঙ্কার এই অঙ্গেরই উপযুক্ত—এই জন্য পরাইলাম। আপনিও কখন কখন পরাইয়া মুখরা বিদেশিনীকে মনে করিবেন।”

 নবকুমার চমৎকৃত হইয়া কহিলেন, “সে কি? এ যে বহুমূল্য অলঙ্কার। আমি এ সব লইব কেন?”

 মতি কহিলেন “ঈশ্বরপ্রসাদাৎ আমার আর আছে। আমি নিরাভরণা হইব না। ইহাকে পরাইয়া আমার যদি সুখবোধ হয়, আপনি কেন ব্যাঘাত করেন?”

 মতিবিবি ইহা কহিয়া দাসীসঙ্গে চলিয়া গেলেন। বিরলে আসিলে পেষমন্ মতিবিবিকে জিজ্ঞাসা করিল,

 “বিবি, এ ব্যক্তি কে?”

 যবনবালা উত্তর করিলেন, “মেরা খসম!”