কমলাকান্তের পত্র/মেকি
৩
মেকি
প্রসন্ন হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া বলিল—“দেখ গা, কে আমার মাথা খেতে একটা মেকি টাকা দিয়েছে—চল্চে না, কেউ নিচ্চে না, কি করি বল দেখি?”
আমি। রোখ শোধ হ’য়ে গেছে, প্রসন্ন; তুমি যেমন মেকি দুধ চালিয়েছ, সেও তেমনি মেকি টাকা দিয়েছে, মন্দ কি? আঘ্রাণের মূল্য আওয়াজ, গন্ধের মূল্য শব্দ—সে গল্প ত জান—তেমনি জোলো দুধের মূল্য মেকি টাকা, তা’ ত ঠিকই হইয়াছে। কিন্তু মেকি চল্চে না, এটা ত নূতন কথা শুনলাম—চল্তে চল্তে তোমার কাছ পর্য্যন্ত এসে কি তার দম ফুরিয়ে গেল—তা’ত হ’তেই পারে না।
প্রসন্ন অভিমান-ভরে বলিল—আমি জোলো দুধই তোমায় খাওয়াই কি না, নেমকহারামি কোরো না।
আমি বলিলাম—না প্রসন্ন খাঁটি যদি কিছু থাকে ত সে তোমার দুধ, আর আমার আফিম, আর সবই ঝুটা।
প্রসন্ন। নাও, তোমার বাজে কথা রাখ, এখন টাকাটার উপায় কি করি বল দেখি?
আমি। দেখ, আমরা তখন ছোট, আমাদের পাড়ায় এক বুড়ী ময়রাণি ছিল, সে যত অখাদ্য খাবার তৈরী করত, একদিন তা’কে বল্লাম, হ্যাঁগা তোমার এসব লক্ষ্মীছাড়া খাবার কেউ কেনে? সে বল্লে, ‘বাবু জন্মালে মৃত্যু আছেই, ও-গুলা লক্ষ্মীছাড়াই হ’ক আর লক্ষ্মীমন্তই হ’ক যখন জন্মেচে তখন মরবেই।’ তোমাকেও তাই বলি জন্মালে মৃত্যু আছেই; এ আজব দুনিয়া; যখন টাকাটি জন্মেছে, আর চলে’ চলে’ এতদূর এসেছে, তখন আরও অনেক দূর যাবেই।
তবে মেকিকে মেকি বলে’ সত্য সত্য জান্লে আর চলে না। মেকি বলে’ জেনেচ কি অচল। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মেকি বা মায়া বলে’ বুঝেছ কি আর বিশ্বপ্রপঞ্চ তোমার কাছে না থাকার সামিল; তুমি যে-মুহূর্ত্তে টাকাটাকে মেকি বলে’ সন্দেহ করেচ অমনি তোমার কাছে সেটা আর টাকা নয়, টাকার রূপ থাকলেও সেটা টাকা ছাড়া আর কিছু।
এখন কথা হচ্চে টাকাটি তোমার কাছ পর্য্যন্ত পৌঁছিল কি প্রকারে। হয় কেউ মেকি জানিতে পারেন নাই নচেৎ না-জানার ভান করিয়াছেন, আর সাচ্চা টাকার দলে মিশাইয়া অন্ধকারে চালাইয়া দিয়াছেন। এই রকম করিয়া তোমাকেও চালাইতে হইবে। এই রকম করিয়া কত বড় বড় মেকি চলিয়া গেল। গেলিলিও অঙ্ক পাতিয়া জানিলেন যে পৃথিবী স্থিরা নহেন। কিন্তু যতক্ষণ না তাহা না-জানার ভান করিলেন, ততক্ষণ তাঁর অন্ধতমসাচ্ছন্ন কারাগৃহ হইতে অব্যাহতি হইল না। পৃথিবী অচলা এই বিশ্বাসের ভান করিবামাত্র তিনিও আলোর মুখ দেখিলেন, আর চিরদিনের মেকি মতটাও চলিতে থাকিল।
তোমরা যে টিপ পর, কাজল পর, পাতা কাট, আল্তা পর, গহনা পর, রঙ্গীন শাড়ী পর—এটা কতখানি মেকি চালাইবার সরঞ্জাম তা ত বুঝিতে পার? আর এই সরল উপায়ে ত মেকি চলিয়াও যায়! পরচুলা ও বাঁধান দাঁত, corset 3 cosmetic, সে’ও ত চলে! কেন চলে? যে দেখে সে দেখিয়াও দেখে না, বা না-দেখার ভান করে—আর যে দেখায় সে সত্যকার দেখাটাকে ধূপছায়ার মধ্যে, আলো-আঁধারের মধ্যে যতটা পারে এড়াইবার চেষ্টা করে। এই আলো-আঁধারের মধ্যে কত টিকি, তিলক, বহির্বাস চলে’ যাচ্চে, কত public spirit, philanthropy চলে যাচ্চে, ঐ পথে মেকি টাকাটা ত চলিয়া আসিয়াছে এবং চলিয়া যাইবে, তুমি ভেব না।
প্রসন্ন। তা বলে’ কি লোকে ঘসে মেজে বাজিয়ে দেখে নেয় না বল্তে চাও?
আমি। সে দিকে, জীবনটা বড় ক্ষুদ্র যে প্রসন্ন, বাজিয়ে দেখতে দেখতে বাজি ভোর হ’য়ে যাবে, এ সুদীর্ঘ পথ আবার বাজিয়ে দেখতে দেখতে ফুরাবে না। আর বাজিয়ে দেখাও কি সোজা আর সুখের মনে কর? বাজিয়ে দেখতে দেখতে যে কত মেকিই ধরা পড়ে যাবে তা’র ইয়ত্তা আছে কি? সব ঝুটা হ্যায়—বলে’ শেষে মানুষ পাগল হ’য়ে যাবে যে!
আর ঘসে মেজে নেবারই যদি চেষ্টা করা যায় যেমন বিবেকের কষ্টি-পাথরে গিল্টি ধরা পড় পড় হয়েছে, অননি চারিদিক থেকে হাঁ হাঁ করে’ বলে’ উঠবে—ওটা অপৌরুষেয় বেদবাক্য, ওটা mystery, ওটা লীলা, ওখানে ও কষ্টি-পাথর চল্বে না; ওখানে হৃদয় দিয়ে দেখতে হবে, অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হবে। অথবা—ওটা expediency বা practical politics, ওখানে অত idealistic হ’লে চলবে না। তুমি সেখানে কোন্টা মানবে; দশজন ভক্তের রোষকষায়িত রক্ত চক্ষুগুলি মান্বে, না তোমার বুদ্ধিকে মান্বে? তুমি, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে সুখের চেয়ে স্বস্তিকে, বোঝার চেয়ে অন্ধকারকেই বরণ করে’ নিয়ে চির অন্ধকারের প্রতীক্ষায় বসে’ থাকবে!
প্রসন্ন। তবে উপায় কি স্পষ্ট করে’ বল না, আমি তোমার ও-সব কথা বুঝতে পারি না।
প্রসন্নর মত ধীর শ্রোতা পাইলে অনেকেই বক্তা হইতে পারিতেন এ কথা আমি মুক্ত কণ্ঠে বলিতে পারি! বুঝিতে পারে না অথচ স্থির হইয়া শুনিয়া যায় এমন শ্রোতা কি মিলে? খুব ভক্তি অথবা খুব ভয়, অথবা দুই’এর সমবায় হইলে, তবে না বুঝিলেও লোক স্থির থাকিতে পারে; এখানে ভয়ও ছিল না ভক্তিও ছিল না, কেন না প্রসন্ন ভয় করিবার মেয়ে নয়,—আর আমার মত নীরস আফিংখোরকে ভক্তি করিবে কে?
প্রসন্ন। ওগো একটা উপার বল, আমার ষোল ষোল আনা পয়সা জলে যাচ্চে? বেটারা দুধ খেয়েচে না...... খেয়েচে।
আমি। হাঁ তাই না হয় খেয়েচে। কিন্তু প্রায় বিনামূল্যে, তা’তে তাদের তত বেশী লোকসান হয় নি যত তোমার হয়েচে। তুমি যদি টাকাটী চালাতে চাও ত চিরন্তন প্রথা অনুসারে, চক্ষু বুজিয়া গোটাকতক ভাল টাকার সঙ্গে মেকিটাকে চালাইয়া দাও, সৎসঙ্গে কাশীবাস, দশটার সঙ্গে চলিয়া যাইবেই। আর যদিই বা ধরা পড়, ‘অবাক করেচে মা’ বলিয়া আকাশ থেকে পড়িও, একটু আর্ত্তনাদ করিও, এবং বারান্তরে অন্যত্র চেষ্টা করিও—নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।
প্রসন্ন। আমার ভয় করে, কে কি বল্বে, কি মনে করবে!
আমি। তা হলে হবে না, বেপরোয়া হ’য়ে কাজ করতে হবে—বুক ফুলিয়ে চল্তে হবে; এটাও একটা মেকি চালাবার প্রকৃষ্ট উপায়। শ্রীকৃষ্ণ বাম হস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলির উপর অবলীলাক্রমে গিরিগোবর্দ্ধন ধারণ করিয়া গোকুলবাসী গোপগোপীগণকে ইন্দ্রদেবের বর্ষণবন্যা হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন, একথা বেপরওয়া হ’য়ে যদি বেদব্যাস না বলিয়া, একটু কুণ্ঠিত হইরা বলিতেন, যে শ্রীকৃষ্ণের হাতের কব্জিতে পরদিন একটু চুনে-হলুদ দিতে হইয়াছিল, তাহা হইলে তা’তে তাঁর বলবত্তার কিছুই কমি হইত না বটে, কিন্তু তাহার ফলে সমস্ত ব্যাপারটাই পূর্ণ লীলা না হইয়া বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব মধ্যে পড়িয়া যাইত; বেদব্যাসের অসমসাহসিকতার ফলে উহা তর্কের অতীত হইয়া রহিয়াছে। অতএব ভয় পাইলে সব মাটি হইয়া যাইবে।
আর আগে যে সঙ্গ বা সঙ্ঘের কথা বলেছি—অমন মেকি চালাবার উপায় আর দুটি নেই। বুদ্ধদেবের আমল হ’তে আরম্ভ করে’ আজ পর্য্যন্ত কত সঙ্ঘ গেছে এসেছে, অমন মেকি চালাবার আড্ডা আর কোথাও হবে না। সাচ্চা লোক কেউ-না-কেউ সব সঙ্ঘেই ছিলেন, কিন্তু সেটা সঙ্ঘের গুণে নহে, সঙ্ঘ ছিল তাঁহাদের গুণে, একটার গুণে দশটা মেকি চলে' যেত ও যাচ্চে, আর দশটা ভাল টাকার সঙ্গে তোমার একটা মেকি চলবে না?
প্রসন্নর মন উঠল না, সে বোকা গয়লার মেয়ে বলে’ উঠল— অত-শতয় কাজ নেই, আমার পয়সা ত জলেই গেছে, আমি টাকাটা পুকুরের জলে ফেলে দেব, আপদ নিশ্চিন্দি!