কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/চিত্রা/প্রেমের অভিষেক

উইকিসংকলন থেকে

প্রেমের অভিষেক

তুমি মােরে করেছ সম্রাট। তুমি মােরে
পরায়েছ গৌরব-মুকুট। পুষ্পডোরে
সাজায়েছ কণ্ঠ মোর; তব রাজটীকা
দীপিছে ললাটমাঝে মহিমার শিখা
আমার সকল দৈন্য লাজ,
আমার ক্ষুদ্রতা যত, ঢাকিয়াছ আজ
তব রাজ-আস্তরণে। হৃদিশয্যাতল
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ, কোমল শীতল,
তারি মাঝে বসায়েছ; সমস্ত জগৎ
বাহিরে দাড়ায়ে আছে, নাহি পায় পথ
সে অন্তর-অন্তঃপুরে। নিভৃত সভায়
আমারে চৌদিকে ঘিরি’ সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি’; অমরবীণায়
উঠিয়াছে কি ঝঙ্কার। নিত্য শুনা যায়
দূর দূরান্তর হতে দেশবিদেশের
ভাষা, যুগযুগান্তের কথা, দিবসের
নিশীথের গান, মিলনের বিরহের

গাথা, তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের
উৎকণ্ঠিত তান।—
প্রেমের অমরাবতী,
প্রদোষ-আলোকে যেথা দময়ন্তী সতী
বিচরে নলের সনে দীর্ঘনিশ্বসিত
অরণ্যের বিষাদ-মর্মরে; বিকশিত
পুষ্পবীথিতলে, শকুন্তলা আছে বসি’
কর-পদ্মতল-লীন ম্লান মুখশশী
ধ্যানরতা; পুরুরবা ফিরে অহরহ
বনে বনে, গীতস্বরে দুঃসহ বিরহ
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে; মহারণ্যে যেথা,
বীণা হস্তে ল’য়ে তপস্বিনী মহাশ্বেতা
মহেশ-মন্দিরতলে বমি’ একাকিনী
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিণী
সান্ত্বনা-সিঞ্চিত; গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপােল
চুম্বিছে ফাল্গুনী; ভিখারী শিবের কোল
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্বতীরে
অনন্ত ব্যগ্রতাপাশে; সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রু-মন্দাকিনী, মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানচ্ছবি করে

করুণায়; বাঁশরীর ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করিছে সন্ধান
হৃদয়সাথীরে;—হাত ধরে’ মােরে তুমি
ল’য়ে গেছ সৌন্দয্যের সে নন্দনভূমি
অমৃত-আলয়ে! সেথা আমি জ্যোতিষ্মন
অক্ষয় যৌবনময় দেবতাসমান,
সেথা মাের লাবণ্যের নাহি পরিসমা,
সেথা মােরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা
নিখিল প্রণয়।; সেথা মাের সভাস
রবিচন্দ্রতারা, পার’ নব পরিচ্ছদ
শুনায় অমারে তারা নব নব গান
নব অর্থভরা; চির-হৃদ্মান
সর্ব চরাচর! হেথা আমি কেহ নহি,
সহস্রের মাঝে একজন,—সদা বহি
সংসারের ক্ষুদ্র ভার,—কত অনু গ্রহ
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ;
সেই শতসহত্রের পরিচয়হান
প্রবাহ হইতে, এই তুচ্ছ কর্ম্মাধীন
মােরে তুমি লয়েছ তুলিয়া, নাহি জানি
কি কারণে! অয়ি মহীয়সী মহারাণী
তুমি মােরে করিয়াছ মহীয়ান আজি।
এই যে আমারে ঠেলি’ চলে জনরাজি

না তাকায়ে মাের মুখে, তাহারা কি জানে
নিশিদিন তােমার সােহাগসুধাপানে
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর? তাহারা কি
পায় দেখিবারে—নিত্য মোরে আছে ঢাকি
মন তব অভিনব লাবণ্য-বসনে?
তব স্পর্শ তব প্রেম রেখেছি যতনে,
তব সুধাকণ্ঠৰণী, তােমার চুম্বন
তােমার তাঁখির দৃষ্টি, সব দেহমন
পূর্ণ করি’; রেখেছে যেমন সুধাকর
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগযুগান্তর
আপনারে বাপাত্র করি; বিধাতার
পুণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার
সবিতা যেমন সযতনে, কমলার
চরণকিরণে যথ। পরিয়াছে হার
সুনির্ম্মল গগনের অনন্ত ললাট।
হে মহিমাময়ী মোরে করেছ সম্রাট।

১৪ই মাঘ, ১৩০০।