কাব্যগ্রন্থ (তৃতীয় খণ্ড)/সোনার তরী/বর্ষা যাপন

উইকিসংকলন থেকে

বর্ষা যাপন

রাজধানী কলিকাতা; তেতলার ছাতে
কাঠের কুঠরি এক ধারে
আলাে আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে
বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।
মেঝেতে বিছানা পাতা, দুয়ারে রাখিয়া মাথা,
বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি,
সৌধ-ছাদ শত শত ঢাকিয়া রহস্য কত
আকাশেরে করিছে ভ্রুকুটি।
নিকটে জানালা গায় এক কোণে আলিশায়।
একটুকু সবুজের খেলা,
শিশু অশথের গাছ আপন ছায়ার নাচ
সারাদিন দেখিছে একেলা।
দিগন্তের চারিপাশে আষাঢ় নামিয়া আসে
বর্ষা আসে হইয়া ঘােরালাে,
সমস্ত আকাশযােড়া গরজে ইন্দ্রের ঘােড়া
চিমিকে বিদ্যুতের আলাে।
চারিদিকে অবিরল ঝরঝর বৃষ্টিজল
এই ছােট প্রান্ত ঘরটিরে
দেয় নির্বাসিত করি’— দশদিক অপহরি—
সমুদয় বিশ্বের বাহিরে।

বসে’ বসে’ সঙ্গীহীন ভালো লাগে কিছুদিন
পড়িবারে মেঘদূত-কথা;—
—বাহিরে দিবস রাতি বায়ু করে মাতামাতি
বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা;—
বহু পূর্ব্ব আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন ভারতের
নগ নদী নগরী বাহিয়া
কত শ্রুতিমধু নাম কত দেশ কত গ্রাম
দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া;
ভালাে করে’ দোঁহে চিনি, বিরহী ও বিরহিণী
জগতের দু’পারে দু’জন,
প্রাণে প্রাণে পড়ে টান, মাঝে মহা ব্যবধান,
মনে মনে কল্পনা সৃজন;
যক্ষবধূ গৃহকোণে ফুল নিয়ে দিন গণে
দেখে শুনে ফিরে আসি চলি।
বর্ষা আসে ঘন রােলে, যত্নে টেনে লই কোলে
গােবিন্দদাসের পদাবলী।
সুর করে’ বারবার পড়ি বর্ষা অভিসার;—
অন্ধকার যমুনার তীর,—
নিশীথে নবীনা রাধা নাহি মানে কোনাে বাধা,
খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটীর;
অনুক্ষণ দর দর বারি ঝরে ঝর ঝর
তাহে অতি দূরতর বন,—

ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার, সঙ্গে কেহ নাহি আর
শুধু এক কিশাের মদন।
আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ
রচি “ভরা বাদরের” সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা, গীতগােবিন্দের গাথা
গাহি “মেঘে অম্বর মেদুর।”
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে—
শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায়।
“রজনী সাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন”
সেই গান মনে পড়ে যায়।
“পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে”
মন সুখে নিদ্রায় মগন,
সেই ছবি জাগে মনে পুরাতন বৃন্দাবনে
রাধিকার নির্জন স্বপন।
মৃদু মৃদু বহে শাস, অধরে লাগিছে হাস
কেঁপে উঠে মুদিত পলক,
বাহুতে মাথাটি থুয়ে, একাকিনী আছে শুয়ে,
গৃহকোণে স্লান দীপালােক।
গিরিশিরে মেঘ ডাকে, বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে
দাদুরী ডাকিছে সারারাতি,
হেন কালে কি না ঘটে! এ সময়ে আসে বটে
একা ঘরে স্বপনের সাথী!

মরি মরি স্বপ্নশেষে পুলকিত রসাবেশে
যখন সে জাগিল একাকী,
দেখিল বিজন ঘরে দীপ নিবুনিবু করে
প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি;—
বাড়িছে বৃষ্টির বেগ, থেকে থেকে ডাকে মেঘ,
ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া,
সেই ঘনঘােরা নিশি স্বপ্নে জাগরণে মিশি’
না জানি কেমন করে হিয়া!—

লয়ে’ পুঁথি দু’চারিটি নেড়ে চেড়ে ইটি সিটি
এই মত কাটে দিনরাত।
তার পরে টানি লই বিদেশী কাব্যের বই
উলটি পালটি দেখি পাত;—
কোথারে বর্ষার ছায়া, অন্ধকার মেঘমায়া,
ঝর ঝর ধ্বনি অহরহ!
কোথায় সে কর্ম্মহীন একান্তে আপনে লীন
জীবনের নিগূঢ় বিরহ!
বর্ষার সমান সুরে অন্তর বাহির পূরে’
সঙ্গীতের মুষল ধারায়
পরাণের বহুদূর কূলে কূলে ভরপূর,—
বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়?

তখন সে পুঁথি ফেলি, দুয়ারে আসন মেলি
বসি গিয়ে আপনার মনে,
কিছু করিবার নাই চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই
দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে।
মাথাটি করিয়া নীচু বসে’ বসে’ রচি কিছু
বহু যত্নে সারাদিন ধরে’,—
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনােমত
গল্প লিখি একেকটি করে’।
ছােট প্রাণ, ছােট ব্যথা ছােট ঘােট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল;
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি র’বে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধূলা
কত ভাব, কত ভয় ভুল
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝর ঝর বরষার মত—

ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তা’র শুনি অবিরত।
সেই সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারিদিকে করি’ স্তুপাকার
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতি-বৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণ নিশার।

১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯।