কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/আবার

উইকিসংকলন থেকে

আবার

তুমি কেন আইলে হেথায়
এ আমার সাধের আবাসে?
এ আলয়ে যে নিবাসী থাকে,
এ আলয়ে যে অতিথি আসে,
সবাই আমার বন্ধু, সবাই আমার সাথী,
সবারেই আমি ভালবাসি,
তারাও আমারে ভালবাসে,
তুমি তবে কেন এলে হেথা
এ আমার সাধের আবাসে?

এ তামার প্রেমের আলয়,
এ মোর স্নেহের নিকেতন,
বেছে বেছে কুসুম তুলিয়া
রচিয়াছি কোমল আসন।

কেহ হেথা নাইক নিষ্ঠুর,
কিছু হেথা নাইক কঠিন,
কবিতা আমার প্রণয়িনী
এইখানে আসে প্রতিদিন।



বায়ু হেথা দেয় আনি কোমল পরশখানি
যখনি সে পায় অবকাশ,
প্রভাত যখনি ফুটে, আলোক সে জেগে উঠে,
অমনি সে আসে মোর পাশ;
দুই বাহু প্রসারিয়া, আমারে বুকেতে নিয়া
কত শত বারতা শুধায়,
সখী মোর প্রভাতের বায়।
আকাশেতে তুলে আঁখি বাতায়নে বসে থাকি
নিশি যবে পোহায় পোহায়;
উষার আলোকে হারা সখী মোর শুকতারা
পূরবের স্বর্ণ বাতায়নে
নীরবে চাহিয়া রহে, নীরব নয়নে কহে
“ভালো হল দেখা তোমা সনে।”


ধীরে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস
প্রতিদিন আসে মোর পাশ।
অতি ধীরে আলিঙ্গন করে,
কথা কহে সকরুণ স্বরে,
কানে কানে বলে “হায় হায়!”
কোমল কপোল দিয়া কপোল চুম্বন করি
অশ্রুবিন্দু সুধীরে শুখায়।



সবাই আমার মন বুঝে,
সবাই আমার দুঃখ জানে,
সবাই করুণ আঁখি মেলি
চেয়ে থাকে এই মুখপানে!
যে কেহ আমার ঘরে আসে
সবাই আমারে ভালবাসে,
তবে কেন তুমি এলে হেথা,
এ আমার সাধের আবাসে!


ফের’ ফের’—ও নয়ান রসহীন ও বয়ান
আনিও না এ মোর আলয়ে
আমরা সখারা মিলি আছি হেথা নিরিবিলি
আপনার মনোদুঃখ লয়ে।
এমনই হয়েছে শান্ত মন,
ঘুচেছে দুঃখের কঠোরতা;
ভালো লাগে বিহঙ্গের গান,
ভালো লাগে তটিনীর কথা।
ভালো লাগে কাননে দেখিতে
বসন্তের কুসুমের মেলা,
ভালো লাগে সারাদিন বসে
দেখিতে মেঘের ছেলেখেলা।



এইরূপে সায়াহ্নের কোলে
রচেছি গোধূলি-নিকেতন,
দিবসের অবসান-কালে
পশে হেথা রবির কিরণ।
আসে হেথা অতি দূর হতে
পার্থীদের বিরামের তান,
মিয়মাণ সন্ধ্যা-বাতাসের
থেকে থেকে মরণের গান।
পরিশ্রান্ত অবশ পরাণে
বসিয়া রয়েছি এইখানে।
যাও মোরে যাও ছেড়ে, নিও না—নিও না কেড়ে,
নিও না, নিও না মন মোর;
সখাদের কাছ হতে ছিনিয়া নিও না মোরে,
ছিঁড়ে না এ প্রণয়ের ডোর।
আবার হারাই যদি এই গিরি, এই নদী,
মেঘ বায়ু কানন নির্ঝর,
আবার স্বপন ছুটে একেবারে যায় টুটে
এ আমার গোধূলির ঘর,
আবার আশ্রয়হারা, ঘুরে ঘুরে হই সারা
ঝটিকার মেঘখণ্ড সম,
দুঃখের বিদ্যুৎ-ফণা ভীষণ ভুজঙ্গ এক
পোষণ করিয়া বক্ষে মম,—

তাহা হলে এ জনমে, নিরাশ্রয় এ জীবনে
ভাঙা ঘর আর গড়িবে না,
ভাঙা হৃদি আর জুড়িবে না।
কাল সবে গড়েছি আলয়,
কাল সবে জুড়েছি হৃদয়,
আজি তা’ দিও না যেন ভেঙে
রাখ তুমি রাখ এ বিনয়!