কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/উপহার

উইকিসংকলন থেকে
উপহার

অয়ি সন্ধ্যে, 
অনন্ত আকাশতলে বসি একাকিনী,
কেশ এলাইয়া,
নত করি স্নেহমাখা মোহময় মুখ
মাথা হেলাইয়া,
মৃদু মৃদু ও কি কথা কহিস্ আপন মনে
মৃত্যু মৃত্যু গান গেয়ে গেয়ে,
ধরণীর মুখ-পানে চেয়ে?

প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজো তোর ওই কথা
নারিনু বুঝিতে।
প্রতিদিন শুনিয়াছি, আজো তোর ওই গান
নারিনু শিখিতে।



চোখে শুধু লাগে ঘুমঘোর,
প্রাণ শুধু ভাবে হয় ভোর।
হৃদয়ের অতি দূর—দূর—দূরান্তরে
মিলাইয়া কণ্ঠস্বর তোর কণ্ঠস্বরে
কে জানেরে কোথাকার উদাসী প্রবাসী যেন
তোর সাথে তোরি গান করে।

অয়ি সন্ধ্যা, তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী
তারি যেন আপনার ভাই
প্রাণের প্রবাসে মোর দিশ। হারাইয়া
কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সদাই।
যখনি শুনে সে তোর স্বর
শোনে যেন স্বদেশের গান,
সহসা সুদূর হতে অমনি সে দেয় সাড়া,
অমনি সে খুলে দেয় প্রাণ।
চারিদিকে চেয়ে দেখে—আকুল ব্যাকুল হয়ে
খুঁজিয়ে বেড়ায় যেন তোরে।
ডাকে যেন তোর নাম ধরে।
যেন তোর কত শত পুরানো সাধের স্মৃতি
জাগিয়া উঠেরে ওই গানে।
ওই তারকার মাঝে যেন তার গৃহ ছিল,
হাসিত কাঁদিত ওইখানে।



বিজন গভীর রাতে ওই তারকার মাঝে
বসিয়া গাহিত যেন গান,
ওইখান হতে যেন কোন্ সুদুরের পথে
চাহিত সে মেলিয়া নয়ান!
সেই সব পড়ে বুঝি মনে,
অশ্রুবারি ঝরে দু-নয়নে।


যেন পূর্ব্ব জনমের প্রথম প্রেয়সী তার
ওইখানে ফেলে আসিয়াছে;
প্রাণ বুঝি তাহাদের কাছে
আর বার ফিরে যেতে চায়—
পথ তবু খুঁজিয়া না পায়।
কত না পুরানো কথা, কত না হারানো গান
কত না প্রাণের দীর্ঘশ্বাস,
সরমের আধ হাসি সোহাগের আধ বাণী
প্রণয়ের আধ মৃদু ভাষ,
সন্ধ্যা, তোর ওই অন্ধকারে
হারাইয়া গেছে একেবারে!
পূর্ণ করি অন্ধকার তোর
তারা সবে ভাসিয়া বেড়ায়,
যুগান্তের প্রশান্ত হৃদয়ে
ভাঙাচোরা জগতের প্রায়।

যবে এই নদীতীরে বসি তোর পদতলে,
তা'রা সবে দলে দলে আসে,
প্রাণেরে ঘেরিয়া চারি পাশে;
হয়ত একটি কথা, একটি আধেক বাণী
চারিদিক হতে বারেবার
শ্রবণেতে পশে অনিবার।
হয়ত একটি হাসি ,একটি আধেক হাসি
সমুখেতে ভাসিয়া বেড়ায়,
কভু ফোটে, কভুবা মিলায়।
হয়ত একটি ছায়া, একটি মুখের ছায়া
আমার মুখের পানে চায়,
চাহিয়া নীরবে চলে যায়।

অয়ি সন্ধ্যা, স্নেহময়ী, তোর স্বপ্নময় কোলে
তাই আমি আসি নিতি নিতি,
স্নেহের আঁচল দিয়ে প্রাণ মোর দিস্ ঢেকে,
এনে দিস্ অতীতের স্মৃতি।

আজি আসিয়াছি সন্ধ্যা,—বসি তোর অন্ধকারে
মুদিয়া নয়ান,
সাধ গেছে গাহিবারে—মৃদুস্বরে শুনাবারে
দু-চারিটি গান।



সে গান না শোনে কেহ যদি,
যদি তার হারাইয়া যায়,
সন্ধ্যা, তুই সযতনে গোপনে বিজনে অতি
ঢেকে দিস আঁধারের ছায়।
যেথায় পুরানো গান যেথায় হারানো হাসি,
যেথা আছে বিস্মৃত স্বপন,
সেইখানে সযতনে রেখে দিস্ গানগুলি
রচে দিস্ সমাধি-শয়ন।

জানি সন্ধ্যা, জানি তোর স্নেহ,
গোপনে ঢাকিবি তার দেহ,
বসিয়া সমাধিপরে, নিষ্ঠুর কৌতুকভরে
দেখিস হাসে না যেন কেহ।
ধীরে শুধু ঝরিবে শিশির,
মৃত্যু শ্বাস ফেলিবে সমীর।
মরণ কপোলে হাত দিয়ে
একা সেথা রহিবে বসিয়া,
মাঝে মাঝে দুয়েকটি তারা
সেথা আসি পড়িবে খসিয়া।