কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/দুদিন

উইকিসংকলন থেকে


দুদিন


আরম্ভিছে শীতকাল, পড়িছে নীহার-জাল,
শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন;
মৃতপ্রায় পৃথিবীর মুখের উপরে
বিষাদে প্রকৃতি মাতা শুভ্র বাষ্পজালে গাঁথা
কুজ্ঝটি-বসনখানি দেছেন টানিয়া;
পশ্চিমে গিয়েছে রবি, স্তব্ধ সন্ধ্যাবেলা,
বিদেশে আইনু শ্রান্ত পথিক একেলা!

রহিনু দুদিন,
এখনো রয়েছে শীত বিহঙ্গ গাহে না গীত
এখনো ঝরিছে পাতা, পড়িছে তুহিন।
বসন্তের প্রাণ-ভরা চুম্বন-পরশে
সর্ব্ব অঙ্গ শিহরিয়া পুলকে আকুল হিয়া
মৃত-শয্যা হতে ধরা জাগেনি হরষে।
এক দিন দুই দিন ফুরাইল শেষে,
আবার উঠিতে হল, চলিনু বিদেশে।
এই যে ফিরানু মুখ, চলিনু পূরবে,
আর কিরে এ জীবনে ফিরে আসা হবে?



কত মুখ দেখিয়াছি দেখিব না আর!
ঘটনা ঘটিবে কত, বরষ বরষ শত
জীবনের পর দিয়া হয়ে যাবে পার;
হয়ত বা একদিন অতি দূরদেশে,
আসিয়াছে সন্ধ্যা হয়ে, বাতাস যেতেছে বয়ে
একেলা নদীর ধারে রহিয়াছি বসে,
হুহু করে উঠিবেক সহসা এ হিয়া,
সহসা এ মেঘাচ্ছন্ন স্মৃতি উজলিয়া
একটি অস্ফুট রেখা সহসা দিবেরে দেখা
একটি মুখের ছবি উঠিবে জাগিয়া,
একটি গানের ছত্র পড়িবেক মনে
দুয়েকটি সুর তার উদিবে স্মরণে,
অবশেষে একেবারে সহসা সবলে
বিস্মৃতির বাঁধগুলি ভাঙিয়া চুর্ণিয়া ফেলি
সে দিনের কথাগুলি বন্যার মতন
একেবারে বিপ্লাবিয়া ফেলিবে এ মন।


পাষাণ মানব-মনে সহিবে সকলি;
ভুলিব, যতই যাবে বর্ষ বর্ষ চলি—
কিন্তু আহা, দুদিনের তরে হেথা এনু,
একটি কোমল প্রাণ ভেঙে রেখে গেনু

তার সেই মুখখানি——কঁদো-কাঁদো মুখ,
এলানো কুন্তল-জালে ছাইয়াছে বুক,
বাষ্পময় আঁখি দুটি  অনিমিখ আছে ফুটি
আমারি মুখের পানে; অঞ্চল লুটিছে,——
থেকে থেকে উচ্ছ্বসিয়া কাঁদিয়া উঠিছে,——
সুকুমার কুসুমটি—জীবন আমার——
বুক চিরে হৃদয়ের হৃদয় মাঝার
শত বর্ষ রাখি যদি দিবস রজনী
মেটে না মেটে না তবু তিয়াষ আমার;——
শত ফুল-দলে গড়া সেই মুখ তার,
স্বপনেতে প্রতি নিশি  হৃদয়ে উদিবে আসি,
এলানো আকুল কেশে, আকুল নয়নে।
সেই মুখ সঙ্গী মোর হইবে বিজনে——
নিশীথের অন্ধকার আকাশের পটে
নক্ষত্র গ্রহের মাঝে উঠিবেক ফুটে
ধীরে ধীরে রেখা রেখা সেই মুখ তার,
নিঃশব্দে মুখের পানে চাহিয়া আমার।
চমকি উঠিব জাগি শুনি ঘুম-ঘোরে,
“যাবে তবে? যাবে?” সেই ভাঙা ভাঙা স্বরে।

ফুরালো দুদিন—
শরতে যে শাখা হয়েছিল পত্রহীন

এ দুদিনে সে শাখা উঠেনি মুকুলিয়া।
অচল শিখর’পরি  যে তুষার ছিল পড়ি
এ দুদিনে কণা তার যায়নি গলিয়া,
কিন্তু এ দুদিন মাঝে একটি পরাণে
কি বিপ্লব বাধিয়াছে কেহ নাহি জানে।
ক্ষুদ্র এ দুদিন তার শত বাহু দিয়া
চিরটি জীবন মোর রহিবে বেষ্টিয়া।
দুদিনের পদচিহ্ন চিরদিন তরে
অঙ্কিত রহিবে শত বরষের শিরে!